ভূমিকা: ইসলামী বিশ্ব সম্প্রতি হারিয়েছে এক উজ্জ্বল আলেম, নির্ভরযোগ্য ইমাম এবং হাদীসশাস্ত্রের এক জীবন্ত মানদণ্ড—আল্লামা শায়খ রাবী বিন হাদী আল‑মাদখালী রাহিমাহুল্লাহ। তিনি ছিলেন সঊদী আরবের একজন প্রাজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদ, বিশিষ্ট গবেষক ও যুগের অন্যতম মুজাদ্দিদ। হাদীছশাস্ত্রে তাঁর অবদান তাঁকে এই শতাব্দীর খ্যাতনামা মুহাদ্দিছদের কাতারে স্থান দিয়েছে। মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ করে বিশুদ্ধ আক্বীদা ও সালাফী মানহাজের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি ১৪৪৭ হিজরীর ১৪ মুহাররম (৯ জুলাই ২০২৫) তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে ইলমী অঙ্গন এক অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন: শায়খ রাবী রাহিমাহুল্লাহজন্মগ্রহণ করেন সঊদী আরবের জাযান প্রদেশের আল-জারাদিয়া গ্রামে, ১৩৫১ হিজরীতে (১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন নিজ এলাকার আলেমদের কাছে। কুরআন, তাজবীদ ও প্রাথমিক ইসলামী জ্ঞান অর্জনের পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান মদীনায়।
শিক্ষাজীবন ও বৈশিষ্ট্য: স্নাতক: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীআহ বিভাগ থেকে ১৯৬৪ সালে ‘মুমতাজ’ গ্রেডে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মাস্টার্স ও ডক্টরেট: মক্কার কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে মাস্টার্স ও ১৯৮০ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মাস্টার্স থিসিস— ইমাম মুসলিম ও ইমাম দারাকুতনী-এর তুলনামূলক হাদীছ বিশ্লেষণ। ডক্টরেট গবেষণা— النكت على كتاب ابن الصلاح —হাদীছশাস্ত্রের মূলগ্রন্থগুলোর এক যুগান্তকারী সমালোচনা।
শিক্ষাগুরুগণ: তাঁর সৌভাগ্য ছিল এমন সব মহান আলেমদের সাহচর্য পাওয়ার, যাঁরা আজকের ইসলামী জ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন— শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ, শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালেহ আল-উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ—তাঁদের কাছ থেকে তিনি শুধু ইলম নয়, পেয়েছেন দাওয়াহর প্রকৃত আদব ও মানহাজ।
শিক্ষকতা ও দাওয়াতী ভূমিকা: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ বিভাগে অধ্যাপনা করেন দীর্ঘ সময়। একই সঙ্গে উচ্চতর গবেষণা বিভাগেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছাত্ররা আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাওয়াহ, ফতওয়া ও হাদীছ শিক্ষার ময়দানে কাজ করছেন।
তিনি ছিলেন এমন একজন চিন্তানায়ক যিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত এবং সালাফী মানহাজের ব্যাখ্যা ও রক্ষায় অসামান্য অবদান রেখেছেন।
রচনাসমূহ: তাঁর লেখাগুলো স্পষ্ট, দলীলভিত্তিক ও হক্ব-বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণে অগ্রগণ্য। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো—الحد الفاصل بين الحق والباطل (সত্য ও মিথ্যার সীমা নির্ধারণকারী), منهج الأنبياء في الدعوة إلى الله (নবীদের দাওয়াহর পদ্ধতি),النكت على كتاب ابن الصلاح (ইবনে ছালাহের রচনার বিশ্লেষণ),مدارك النظر (রাজনীতির ইলমী ও মানহাজী দৃষ্টিভঙ্গি),الانتصار لأهل الحديث (আহলুল হাদীছদের পক্ষে দলীলসমৃদ্ধ জবাব)।
সালাফী আন্দোলনে অবদান: শায়খ রাবী ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি এই যুগে সালাফী মানহাজের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাকারী হিসেবে বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল বাতিলের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ, আক্বীদা ও মানহাজের প্রশ্নে ছিল আপসহীন অবস্থান।
তিনি ছিলেন সালাফিী ভাবধারার অন্যতম রক্ষাকর্তা, জারহ ও তা‘দীলের যুগপরিচিত নাম এবং বর্তমান শতকের ইমামদের অন্যতম।
সম্মান ও স্বীকৃতি: শায়খ ইবনে বায, শায়খ উছায়মীন, শায়খ আলবানী প্রমুখ তাঁর ইলম, বোধশক্তি ও মানহাজিক স্থিরতার প্রশংসা করেছেন।
বিশ্বজুড়ে তার ছাত্ররা তাঁর আদর্শ ও গবেষণাকে অনুসরণ করে দাওয়াতী অঙ্গনে কাজ করে যাচ্ছেন।
মৃত্যু ও জানাযা: ৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেন। ১০ জুলাই (১৫ মুহাররম) সকালে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয় মদীনার মসজিদে নববীতে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন অসংখ্য আলেম, ছাত্র, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক অতিথিবৃন্দ। তাঁকে জান্নাতুল বাক্বী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
স্মৃতিচারণ: শায়খ নিজেই একবার আবেগভরে বলেছিলেন, ‘যখন শায়খ ফাওজান এবং শায়খ লুহাইদান মারা যাবেন, তখন দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। আমি চাই তাদের আগেই যেন মারা যাই…’। তাঁর এ বাণী এখন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তিনি আজ আর নেই। তবে তাঁর রেখে যাওয়া দাওয়াত, গবেষণা ও চিন্তাধারা যুগ যুগ ধরে উম্মাহর জন্য মশাল হয়ে থাকবে, ইনশা-আল্লাহ।
উপসংহার: আল্লামা শায়খ রাবী বিন হাদী আল‑মাদখালী রাহিমাহুল্লাহছিলেন এমন এক ইমাম, যাঁর ইলম, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও মানহাজিক স্থিরতা যুগস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি যেমন বাতিলের বিরুদ্ধে কলম ধরতে দ্বিধা করেননি, তেমনি হক্বের পথে অবিচল থেকেছেন আমৃত্যু। তাঁর মৃত্যু শুধু সালাফী অঙ্গন নয়, পুরো ইসলামী জগতের জন্য এক বেদনাবিধুর অধ্যায়।
আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন এবং তাঁর রেখে যাওয়া ইলমকে কবুল করুন- আমীন!
ড. যায়নুল আবেদীন বিন নুমান মাদানী
লিসান্স, হাদীছ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।