[৯যুলহিজ্জাহ, ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ১৫ জুন, ২০২৪। আরাফার মাঠে অবস্থিত ‘মসজিদে নামিরা’য় আরাফার খুৎবা প্রদান করেন শায়খ ড. মাহের বিন হামাদ আল-মুআয়ক্বিলী হাফিযাহুল্লাহ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই, যিনি প্রজ্ঞাময় ও সকল বিষয়ে ওয়াকিফহাল। তিনি মহাজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান। ‘তিনি দিনকে রাতের পর্দা দিয়ে ঢেকে দেন, তারা একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে এবং সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি তাঁরই আজ্ঞাবহ। জেনে রেখো, সৃষ্টি তাঁর, হুকুমও (চলবে) তাঁর, বরকতময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৫৪)। ‘তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদাত করো। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর তত্ত্বাবধায়ক’ (আল-আনআম, ৬/১০২)। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির জন্য রহমতস্বরূপ এবং তাদের অবস্থার সংশোধনের লক্ষ্যে পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন। ‘এই কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৯)।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত সত্যিকারার্থে কারো ইবাদত করা সমীচীন নয়। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো, তিনি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেছেন মানবজাতিকে কল্যাণের পথে আহ্বান জানানোর জন্য, যার কারণে তাদের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমার রহমত সব বিষয়ে পরিব্যাপ্ত আর তা আমি তাদের জন্য লিখে দিব যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে, যাকাত দিবে আর যারা আমার নিদর্শনাবলিতে বিশ্বাসী হবে। যারা সেই নিরক্ষর রাসূলের অনুসরণ করে চলে যার কথা তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীল কিতাবে লিখিত পায়, যে মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয় ও অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করে আর সে তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ বৈধ করে এবং অপবিত্র ও খারাপ বস্তুকে তাদের প্রতি অবৈধ করে আর তাদের উপর চাপানো বোঝা ও বন্ধন হতে তাদেরকে মুক্ত করে। সুতরাং তাঁর প্রতি যারা ঈমান রাখে, তাকে সম্মান করে এবং সাহায্য করে ও সহানুভূতি প্রকাশ করে আর সেই আলোকের অনুসরণ করে চলে যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, তারাই (ইহকালে ও পরকালে) সাফল্য লাভ করবে। বলো, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সকলের জন্য সেই আল্লাহর রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি, যিনি আকাশ ও ভূ-মণ্ডলের সার্বভৌম একচ্ছত্র মালিক, তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তিনিই জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান। সুতরাং আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর সেই বার্তাবাহক নিরক্ষর নবীর প্রতি ঈমান আন। যে আল্লাহ ও তাঁর কালামে বিশ্বাস স্থাপন করে, তোমরা তাঁরই অনুসরণ করো। আশা করা যায়, তোমরা সরল সঠিক পথের সন্ধান পাবে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৫৬-১৫৮)। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবীগণ ও সকল অনুসারীদের প্রতি দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন।
অতঃপর, হে মানুষ সকল! ‘হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো এবং ভয় করো সেই দিনের যখন পিতা সন্তানের কোনো উপকারে আসবে না এবং সন্তানও কোনো উপকারে আসবে না তার পিতার। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সেই প্রবঞ্চক যেন তোমাদেরকে কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে’ (লুক্বমান, ৩১/৩৩)। কেননা যে ব্যক্তি তাক্বওয়ার অধিকারী হয় সে দুনিয়া ও আখেরাতের উত্তম পরিণাম ও নিশ্চিত বিজয় লাভ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মুত্তাক্বীদের উদ্ধার করবেন তাদের সাফল্যসহ; তাদেরকে অমঙ্গল স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখও পাবে না’ (আয-যুমার, ৩৯/৬১)। ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক্ব দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই’ (আত-তালাক, ৬৫/২-৩)। ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন’ (আত-তালাক, ৬৫/৪)। ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার গুনাহসমূহ মোচন করে দেন এবং তার প্রতিদানকে মহান করে দেন’ (আত-তালাক, ৬৫/৫)।
আর আল্লাহভীতির অপরিহার্য বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে, বান্দা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করবে, অন্য কারো ইবাদত করবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বিধান একমাত্র আল্লাহরই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া আর কারো ইবাদত করো না। এটিই সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না’ (ইউসুফ, ১২/৪০)।
হে মানুষ সকল! ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদাত করো, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাক্বী (পরহেযগার) হতে পার’ (আল-বাক্বারা, ২/২১)।
আর এটাই হলো তাওহীদের সাক্ষ্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তথা ‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই’-এই কথার মর্মার্থ। যা দ্বীন ইসলামের নিদর্শন ও সাফল্যের চাবিকাঠি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু’ (আল-বাক্বারা, ২/১৬৩)। ‘তিনিই তোমাদেরকে মায়ের পেটে যেভাবে ইচ্ছা আকৃতি দেন, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি মহাশক্তিমান ও প্রজ্ঞাশীল’ (আলে ইমরান, ৩/৬)।
তাওহীদের সাক্ষ্যের সাথে রিসালাতের সাক্ষ্যও অন্তর্ভুক্ত হয়। কারণ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নয়, কিন্তু (সে) আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাতা’ (আল-আহযাব, ৩৩/৪০)।
এই দুটি বিষয়ের সাক্ষ্য ইসলামের রুকনসমূহের মধ্যে প্রথম রুকন। ইসলামের রুকনসমূহের মধ্যে আরো রয়েছে, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ক্বায়েম করা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতি যে কিতাব অহী করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত করো এবং ছালাত ক্বায়েম করো। নিশ্চয় ছালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা করো’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)।
ইসলামের আরেকটি রুকন হলো, যাকাত আদায় করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে নবী!) তুমি তাদের ধনসম্পদ হতে ছাদাক্বা গ্রহণ করো, যা দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করে দিবে আর তাদের জন্য দু‘আ করো। নিঃসন্দেহে তোমার দু‘আ হচ্ছে তাদের জন্য শান্তির কারণ আর আল্লাহ খুব শোনেন, খুব জানেন’ (আত-তওবা, ৯/১০৩)।
ইসলামের রুকনসমূহের মধ্যে রয়েছে, রামাযান মাসে ছিয়াম রাখা। আল্লাহ বলেন, ‘রামাযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে ছিয়াম পালন করে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৫)।
ইসলামের আরেকটি রুকন হলো, সামর্থ্য থাকলে পবিত্র বায়তুল্লাহতে হজ্জ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে। যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাযির হতে পারে’ (আল-হজ্জ, ২২/২৭)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ইসলাম হচ্ছে— তুমি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো ইলাহ (মা‘বূদ) নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, ছালাত ক্বায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রামাযানের ছিয়াম পালন করবে এবং যদি পথ অতিক্রম করার সামর্থ্য থাকে তাহলে বায়তুল্লাহর হজ্জ করবে’। তিনি আরো বললেন, ‘ঈমান হলো এই যে তুমি আল্লাহ, তার ফেরেশতাকুল, তার কিতাবসমূহ, তার প্রেরিত নবীগণ ও শেষদিনের উপর ঈমান রাখবে এবং তুমি তাক্বদীর ও এর ভালোমন্দের প্রতিও ঈমান রাখবে’। তিনি আরো বললেন, ‘ইহসান হলো এই যে, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তাকে দেখছ, যদি তাকে না দেখ, তাহলে তিনি তোমাকে দেখছেন বলে অনুভব করবে’।[1]
হে মুমিনগণ! এই হলো আল্লাহর দ্বীন ও শরীআহ, যা তিনি সৃষ্টিকুলের জন্য নির্বাচন করেছেন এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে রহমতের চাদরে ঢেকে দিয়েছেন। ফলে এটি তাদের জন্য নানাবিধ কল্যাণ, উপকার বয়ে নিয়ে এসেছে এবং বিভিন্ন অকল্যাণ ও অনিষ্টকর বিষয় প্রতিরোধ করেছে। এজন্যই আরাফার দিবসে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর এই আয়াত নাযিল হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিলাম’ (আল-মায়েদা, ৫/৩)। আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি’ (আল-আম্বিয়া, ২১/১০৭)।
এই পরিষ্কার অবস্থান থেকে বরকতময় ইসলামী শরীআহ কল্যাণ অর্জন ও তা বৃদ্ধি করা এবং অকল্যাণ দূরীকরণ ও তা হ্রাসকরণের মূলনীতি প্রবর্তন করেছে। পাশাপাশি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, অকল্যাণ প্রতিহত করা কল্যাণ নিয়ে আসার চেয়েও অগ্রগামী। একইভাবে ছোট কল্যাণ ছেড়ে দিয়ে হলেও বড় কল্যাণ অর্জন করা এবং বড় ক্ষতি রোধ করার নিমিত্তে ছোট ক্ষতি মেনে নেওয়ার মূলনীতি নিয়ে এসেছে ইসলাম। একসাথে একাধিক বিষয়ের সম্মুখীন হলে সবচেয়ে বড় কল্যাণ ও সবচেয়ে ছোট ক্ষতিটি গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এভাবে ইসলামী শরীআহ গুরুত্বারোপ করেছে যে, একটি ক্ষতি দূর করতে গিয়ে আরেকটি ক্ষতি করা যাবে না। যেমন হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন যে, ক্ষতি করাও যাবে না, ক্ষতি সহ্যও করা যাবে না।[2]
সুতরাং যথাসম্ভব ক্ষতি রোধ করতে হবে। এই প্রসঙ্গে ইসলামী শরীআহ এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেছে যা জীবনকে সমৃদ্ধ করবে এবং যার দ্বারা জীবনের উন্নতি ঘটবে। আমাদের শরীআহ অন্যের ক্ষতি করা থেকে অথবা কারো প্রতি কষ্ট পৌঁছানো থেকে নিষেধ করেছে। পাশাপাশি আদেশ দিয়েছে ন্যায়-নীতি, উত্তম চরিত্র, পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, সত্য কথা বলা এবং অধিকার সংরক্ষণের সাথে সাথে হক্বদারের নিকট আমনত পৌঁছে দেওয়া, আমানত আদায় করা, চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং শাসকের কথা শুনা ও তাদের আনুগত্য করা ইত্যাদি বিষয়ের। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালঙ্ঘন করতে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো যখন পরস্পর অঙ্গীকার করো এবং তোমরা শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না; তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন’ (আন-নাহল, ১৬/৯০-৯১)। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হক্বদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে কতই না সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (আন-নিসা, ৪/৫৮)।
মহাপ্রজ্ঞাবান বিধানদাতা রব্বুল আলামীন পাঁচটি মৌলিক বিষয় সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। সকল শরীআতেই এ বিষয়গুলোকে সংরক্ষণের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা হলো— ১. দ্বীন পালন করা, ২. জীবন রক্ষা করা, ৩. বিবেক-বুদ্ধিকে হেফাযত করা, ৪. সম্পদ সংরক্ষণ করা এবং ৫. সম্মানের অধিকার সংরক্ষণ করা। বরং ইসলামী শরীআহ এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছে। আর এজন্যই এ বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হওয়াকে জান্নাতে প্রবেশ ও দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমসমূহের মাঝে বিশেষভাবে গণ্য করা হয় এবং সুখ-শান্তি, উন্নতি ও দুনিয়াতে সভ্যতার উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গুণ অনুপস্থিত থাকলে জীবন বিঘ্নিত হয় এবং এতে ত্রুটি করলে তা আখেরাতে শাস্তির কারণ হবে। এই কারণেই বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের রক্ত ও তোমাদের সস্পদ তোমাদের জন্য হারাম (মর্যাদাপূর্ণ) যেমন তা হারাম (মর্যাদাপূর্ণ) তোমাদের এ দিনে, তোমাদের এ মাসে এবং তোমাদের এ শহরে’।[3]
সুতরাং দ্বীন ইসলামের অনুসরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর ইবাদত ছাড়া মানুষের অন্য কোনো উপায় নেই। আর কেবল এ লক্ষ্যেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘বলুন, আমার রব নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের। আর তোমরা প্রত্যেক সিজদা বা ইবাদতে তোমাদের লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহকেই নির্ধারণ করো এবং তাঁরই আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁকেই ডাক। তিনি যেভাবে তোমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন তোমরা সেভাবে ফিরে আসবে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/২৯)।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং পরিহার করো তাগূতকে। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা যমীনে ভ্রমণ করো অতঃপর দেখ, অস্বীকারকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে’ (আন-নাহল, ১৬/৩৬)।
মহান আল্লাহ মানুষের প্রাণ রক্ষাকে অপরিহার্য করেছেন এবং রক্তপাতের বিষয়ে সীমালঙ্ঘনকে নিষিদ্ধ করে এরশাদ করেছেন, ‘আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন’ (আল-আনআম, ৬/১৫১)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। আর যে ঐ কাজ করবে সীমালঙ্ঘন ও অন্যায়ভাবে, আমি অচিরেই তাকে আগুনে প্রবেশ করাব। আর সেটি হবে আল্লাহর উপর সহজ’ (আন-নিসা, ৪/২৯-৩০)।
একইভাবে আল্লাহ তাআলা সম্পদ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা’ (আন-নিসা, ৪/২৯)।
আল্লাহ বিবেক-বুদ্ধির হেফাযতের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ (আল-মায়েদা, ৫/৯০-৯১)।
আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহর মধ্যে মানুষের সম্মানে আঘাত করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয় তাদের কোনো অপরাধ ছাড়াই, তারা অপবাদের ও সুস্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৫৮)।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা সচ্চরিত্রা সরলমনা মুমিন নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত। আর তাদের জন্য রয়েছে বিরাট আযাব’ (আন-নূর, ২৪/২৩)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! কোনো মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোনো মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না তারাই তো যালেম৷ হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। কতক ধারণা পাপের অন্তর্ভুক্ত। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাক। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ খুব বেশি তওবা কবুলকারী, অতি দয়ালু’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১১-১২)।
সুতরাং একজন মুমিনের জন্য উল্লেখিত অত্যাবশ্যকীয় পাঁচটি বিষয়ের হেফাযত করা জরুরী। এর মাধ্যমে তার চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ও জীবনের স্থিতি রক্ষিত হবে। সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে তাদের দ্বীন ও দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিল করতে সক্ষম হবে। আর এ লক্ষ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন নেকী অর্জনের জন্য মানুষের একে অপরকে সহযোগিতা করা কর্তব্য।
সম্মানিত হাজীগণ! আপনারা নিজেদের জন্য, নিজেদের পিতামাতা এবং যাদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক রয়েছে তাদের সকলের জন্য দু‘আ করুন। কারণ কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ ‘আমীন’ বলেন। আপনারা আমাদের ফিলিস্তীনী ভাইদের জন্য দু‘আ করুন। তারা আজ ভীষণ দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত, শত্রুদের আঘাতে তাদের রক্ত ঝরছে, তাদের ঘরবাড়ি ও ভূ-খণ্ড শত্রুদের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হচ্ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ঔষধ-পথ্য, খাবার, পানীয় ও বস্ত্র থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৬৯৫।
[2]. ইবনু মাজাহ, হা/২৩৪০; সিলসিলা ছহীহা, হা/২৫০।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮।