কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ঈদ শোভাযাত্রার নামে তামাশা!

দেশে কী শুরু হলো? ঈদ শোভাযাত্রার নামে তামাশা! দৃঢ় কণ্ঠে এর প্রতিবাদ জানাই। ফেবুতে দেখলাম ঈদ শোভাযাত্রার ছবি। নানারকম মূর্তি নিয়ে র‌্যালি!!! মাআযাল্লাহ, আল্লাহ তাআলা এসব থেকে জাতিকে হেফাযত করুন।

যদিও ছবিগুলোতে কোনো আলেম বা মাদরাসার শিখার্থীদের উপস্থিতি নজরে পড়েনি। তারপরও এটি আমাদের ব্যর্থতা। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। তাছাড়া ঈদ উপলক্ষ্যে হওয়ায় এর স্পষ্টীকরণও জরুরী।

হ্যাঁ, দুচারজন দাড়ি-টুপিওয়ালা থাকলে বা মাদরাসার ছাত্র থাকলেই সব দোষ হুজুরদের দেওয়া যায় না। কারণ এর আয়োজনে কে ছিল, সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিশ্চয়ই আয়োজক ছিলেন না।

[ক]

ঈদ নিয়ে আনন্দ হবে, মিছিল হবে, র‌্যালি হবে—সেটাই স্বাভাবিক। নির্দোষ খেলাধুলা, শারঈ সীমার মধ্যে নাশীদ হবে—এসবই আনন্দের অনুষঙ্গ। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়েও হয়েছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের আনন্দে শরীক হয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিনটাকে ম্যাড়ম্যাড়ে করে দেননি। বরং স্বাভাবিক আনন্দের সব উপকরণই সে সমাজে বিদ্যমান ছিল।

তাই বলে, ইসলাম আনন্দের নামে যা ইচ্ছা তা-ই করার অনুমতি দেয় না। মূর্তি বা ভাস্কর্য যে নামই দেন না কেন, এর কোনো অনুমতি ইসলামে নেই। তা ঈদের দিনে হোক বা দেশের জাতীয় দিবসে হোক। ইসলাম এক কথায় এগুলোকে হারাম বলে ঘোষণা করে।

তাও যে সে-ই হারাম না, কঠোর পর্যায়ের হারাম, যা শিরকের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই করা যাবে না। আর করলে এর পাপের মাত্রা ভয়াবহ।

[খ]

তো আমরা কী করলাম? জুলাই ২৪-এর স্বাধীনতার সুযোগে এর অপব্যবহার করলাম, স্রেফ অপব্যবহার।

আগে আমরা ঈদে মিছিল বের করতে পারতাম না, গুটিকতক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই এই উদযাপন, মিছিল সীমাবদ্ধ ছিল। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। এমনকি এত বাঁধভাঙাভাবে ঈদ উদযাপন করা যায়, সে ধারণাও অনেকের ছিল না। আর সে জনগণ যদি হয়, ইসলামপন্থি, কিংবা দাড়ি-টুপিওয়ালা, তাহলে তো কথাই নেই। পরিণাম গুম, খুন নয়তো আয়নাঘর।

এবার সে অবস্থা নেই। আমরাও হাফ ছেড়ে বেঁচেছি, ঈদ আনন্দকে উপভোগ করতে চেয়েছি। করেছিও।

কিন্তু গুটিকতক পাশ্চাত্য ও হিন্দু প্রভাবিত উর্বরমস্তিষ্কের বিকৃতমনা মানুষ এ নির্দোষ ঈদ উৎসবকেও বিতর্কিত করতে লাগল। এমন কিছু জিনিস আনন্দের অনুষঙ্গ হিসেবে ঢুকিয়ে দিল যা না ইসলামের, না এদেশীয় কালচার। কেন সেটা পরে বলছি। আগে দেখি, কী ছিল সে মিছিলে।

[গ]

এবারের ঈদ মিছিলে ছিল মোল্লা নাসিরুদ্দীন, আলীবাবা, আলাদিন, হাতি, বোরাক ইত্যাদি। সব ছবি আমার কাছে নেই। আবার কিছু ছবি কী জন্য মিছিলে চলে আসল, তা-ও বুঝিনি।

আচ্ছা, এসব কাদের কালচার? ইসলামের—মুসলিমের?

কস্মিনকালেও না। কারণ এরা রূপকথার চরিত্র কিংবা গল্পের আসরেই বেশি মানায়। তাও এসব গল্প কারা বলেন? হুজুররা? মাদরাসায় এসব পড়ানো হয়?

উত্তর– না।

এসব সেক্যুলারপন্থিদের গল্প। কেবল নামে মুসলিম হওয়ায় এদেরকেই মুসলিম কালচারের অংশ বানিয়ে দেওয়া হলো। মোদ্দাকথা, এসব চরিত্র কখনই প্রকৃতার্থে মুসলিম ও ইসলামকে প্রতিনিধিত্ব করে না।

দ্বিতীয়ত, এসব কি আমাদের দেশের ঐতিহ্য? এর উত্তরও– না। এসব আরব-পারস্যের চরিত্র এ স্বদেশে এসেছে ঠিকই কিন্তু এরা কোনোভাবেই এদেশের মাটি, সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে না।

অতএব, কোনো বিচারেই এবারের ঈদ মিছিলের এসব চরিত্র যৌক্তিকতার নিরিখে টেকে না।

[ঘ]

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, এসব আমাদের সংস্কৃতি (নিশ্চিতভাবেই এসব আমাদের না, না মুসলিমদের না বাংলাদেশীদের)। এরপরও ইসলাম এসব মূর্তি বা ভাস্কর্য সমর্থন করে না। এসব বিনা দ্বিধায় হারাম।

ইসলামের যে কয়টি সার্বজনীন বিধান আছে, তার মধ্যে এটা অন্যতম। সকল ফিক্বহী মাযহাবই একমত, মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম। [এনিয়ে দালীলিক আলোচনা এখানে করছি না। পাঠক একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন।]

মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা আমরা আগেও করেছি; হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে থেলিসের মূর্তি কিংবা শেখ মুজিবের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধেও আমরা বলেছিলাম। সেটাকে রাজনীতির মারপ্যাঁচে ফেলা দেওয়া হয়েছিল। আজকেও আমরা, হুজুররা, এর বিপক্ষে বলছি। এসব করা যাবে না।

এমনকি আপনারা যদি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূর্তি বানাতে চান, সর্বপ্রথম আমরাই এর বিরোধিতায় মাঠে নামব। যদি খুলাফা কিংবা কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্বের ছবি বানান, তাও আমরাই মাঠে থাকব। অথচ এসব করতে পারলে আমাদেরই লাভ হওয়ার কথা, বিনা কষ্টে ইসলামের দাওয়াতটা প্রচার হয়ে যেত। কিন্তু আমরা নিষেধই করব, হারামই বলব। কারণ এটাই ইসলামের বিধান।

বি.দ্র.– অনেকে তুরস্ক, মিশর বা মালয়েশিয়াতে ভাস্কর্যের দোহাই দেন। ইসলাম সম্পর্কে জানলে এসব দিতেন না। আর সেসব দেশ কেন, কোনো দেশই আমাদের দলীল না। আমরা তো কেবল কুরআন-সুন্নাহর কথাই বলি।

শরীআর এই বিধান নিয়ে আপনাদের কোনো সন্দেহ থাকলে আপনারা কেবল একজন হক্বপন্থি আলেমের ফতওয়া আনুন, যিনি জায়েয বলেছেন। আমি পৃথিবীর লক্ষাধিক আলেমের ফতওয়া দিতে পারব যারা হারাম বলবেন। এমনকি সেসব দেশের, যাদের কথা আপনারা রেফারেন্স হিসেবে আনেন, সেসব দেশের আলেমদের ফতওয়াও দিতে পারব, যারা অকপটে হারাম বলেছেন।

[ঙ]

জানি না, যারা মূর্তির এসব আইডিয়া নিয়ে আসলেন, তাদের মাথায় কী আছে? মস্তিষ্ক নাকি...? নকলবাজ বোধহয় এদেরকেই বলে।

অথচ মূর্তি না বানিয়ে, সুন্দর সুন্দর অনেক রেপ্লিকাই তো বানানো যায়, প্রাণী না হলেই হলো। জাতীয়ভাবে এসব আয়োজনে দরকার পড়লে আমরা আইডিয়া দিয়ে দেব, তারপরও এমন হাস্যকর আইডিয়া নিয়ে জাতির সামনে নিজেদের ছোট না করার অনুরোধ রইল।

এবার কিছুটা আলোচনা করি কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে এসব করলেন। যদিও এসব আমার অনুমান, তবুও বুদ্ধিমান ও সচেতন পাঠক খুব একটা দ্বিমত করবেন না বলেই ধারণা করি।

(১) হতে পারে, খুব ভালো নিয়্যতে ঈদকে উৎসবে রূপান্তরিত করতেই ইসলামপ্রিয় কিছু মানুষ এমন করেছেন। এটাই সবচেয়ে ভালো ধারণা মুসলিমদের প্রতি।

কিন্তু এমন হয়ে থাকলেও এসব ভুল। কারণ—

প্রথমত, এটা ইসলামে হারাম।

দ্বিতীয়ত, তারা উলামায়ে কেরামের পরামর্শ নিয়েছেন বলে শুনিনি। এমনকি ধর্ম উপদেষ্টা মহোদয়ও জানতেন না বলেই জানি। অথচ ঈদ একটি ইবাদত। এতে নতুন কিছু জায়েয হলেও প্রবিষ্ট করানো যায় না। আর এগুলোতো মূর্তি—সরাসরি হারাম।

এমতাবস্থায়, তাদের সদিচ্ছার প্রমাণ তারা কেবল একভাবেই দিতে পারেন। তা হচ্ছে সংবাদ সম্মেলন করে ভুল স্বীকার করা ও জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া, ইসলাম সম্পর্কে জাতিকে বিভ্রান্ত করার কারণে। আর পাপের জন্য ক্ষমা আল্লাহর নিকটই চাইতে হবে। সেটা গোপনে হওয়াই ভালো।

(২) ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যাকারী লোকজন এসবের পেছনে ইন্ধন দিতে পারেন। লোকজ, লোকায়ত, সহজাত, সামাজিক ইসলামের এসব নানাবিধ ধারার লোকজন এসবের পেছনে কাজ করতে পারেন। অবশ্য তারাও যুক্তির বাইরে, কুরআন-হাদীছের কোনো দলীল এর সপক্ষে দিতে পারবেন না।

এর কারণ ইসলামকে এর সীমানার বাইরে গিয়ে সহজীকরণ। এদের মূল উদ্দেশ্য ইসলাম মানা নয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ নয়; বরং বাপ-দাদার সূত্রে মুসলিম হওয়ায় সেটা উপেক্ষা করা যায় না, আবার প্রকৃতভাবে ইসলাম মানাও যায় না। এমতাবস্থায় নামমাত্র ইসলাম মানার স্বার্থে ইসলামকে বিকৃতরূপে ব্যাখ্যা করার দরকার হয়ে পড়ে।

স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এসব ধারা-উপধারা ইসলাম নয়। বরং এর বিকৃত উপস্থাপনা মাত্র। এদের ষড়যন্ত্র থেকে সজাগ থাকাটাও ফরয, ঈমানের দাবি।

(৩) সেক্যুলারদের নীলনকশা। কারণ বৈশাখী উৎসব। ইতোমধ্যেই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে কথা উঠেছে। ফলে সেটাকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে ঈদ আয়োজনে মূর্তির সংযোজন। যেন পরবর্তীতে পয়লা বৈশাখেও তার পক্ষে যুক্তির অবতারণা করা যায়। তাতে নামধারী ও আধুনিক কিছু মুসলিমকে তারা পাশে পাবে, আগেও পেয়েছে।

অথচ জেনে রাখা উচিত, আমরা মুসলিমরা সব ধরনের অনুষ্ঠানেই প্রাণীর মূর্তি, রেপ্লিকা, বা ভাস্কর্য সব কিছুরই বিরোধী। সেটা ঈদ হোক বা পয়লা বৈশাখ।

[চ]

আমরা আদতেই জানি না কে, কী নিয়্যতে এসব করেছে। আমরা এর নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু তদন্ত চাই। চাই, যারা এসবের পেছনে ছিল তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক, কেন এসব করেছেন এসবের ব্যাখ্যাও আমরা তাদের মুখ থেকে শুনতে চাই।

যদি দ্বিতীয় বা তৃতীয় কারণে এসব করা হয়ে থাকে, তবে কেবল ক্ষমা চাইলেই হবে না, তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিও আমরা জানাচ্ছি। ইসলাম ও মুসলিমদের কালচার নিয়ে ছেলেখেলা করার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

হ্যাঁ, এসবের পেছনে যদি বায়তুল মোকাররমের খত্বীবও থেকে থাকেন, তারও শাস্তি হওয়া উচিত [যদিও আমি শতভাগ নিশ্চিত উনি এমন করতে পারেন না]। অতএব, সুশীল, ক্ষমতাবান ইত্যাদির ছুতোয় যেন কোনো অপরাধী পার না পায়।

[ছ]

শেষ করছি, কিছুটা আপাত আফসোস নিয়ে।

আমি ঈদ আনন্দ আয়োজন বা মিছিল–র‌্যালির বিরোধী না। আমার, আমাদের বিরোধিতা কেবল প্রাণীর মূর্তি, গান-বাদ্য, ও অনৈসলামিক অনুষঙ্গের। আমরা চাই, ঈদ উদযাপিত হোক আনন্দময়ভাবে। কাউকে হেয় না করে, কাউকে কষ্ট না দিয়ে, কারও ধর্মের উপর আঘাত না করে। ঈদের আনন্দ হোক নির্দোষ, পবিত্র।

এতদিন উৎসব হয়নি। এবার বেশ কিছুটা হয়েছে, বাড়াবাড়িও হয়েছে। সামনে আমরা বাড়াবাড়িটা ছেঁটে ফেলে দেব ইনশা-আল্লাহ। আমাদের ঈদ ঈদের মতোই হবে। সকলে মিলে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমরা উদযাপন করব আমাদের ঈদ। আল্লাহ তাআলা সে তাওফীক্ব দিন- আমীন!

সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Magazine