কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসরাঈলি পণ্য বয়কটের ডাক ও প্রসঙ্গ কথা

post title will place here

বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়েই সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ফিলিস্তীনে বর্বর ইসরাঈলের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিপক্ষে অবস্থান। মূলত ফিলিস্তীনে ইসরাঈলের হামলা কেবল দেশ দখলের লড়াই নয়; এটি হচ্ছে আদর্শের লড়াই, দুটি সভ্যতার সংঘাত। অন্য কথায় বলা যায় বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান আপাদমস্তক বিপরীত দুটি সহস্রকালব্যাপী চলমান লড়াই। ফিলিস্তীন এখানে কেবল অনুষঙ্গ মাত্র।

মূল কারণ মুসলিম সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত। ফিলিস্তীন ও ইসরাঈল এখানে মুসলিম বিশ্ব আর পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। এখানেই আমাদের মুসলিমদের চিন্তার বিষয়। ফিলিস্তীন কেবল একটা অঞ্চল নয়; এটা আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর সভ্যতার প্রতিনিধি। তাদের পরাজয় মানে আমাদের সকলের পরাজয়। এখানে শীআ-সুন্নী, খারেজী-মুরজিয়া কিংবা মাযহাবী-সালাফী কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এখানে একটাই পরিচয় মুসলিম। আমাদের, মুসলিমদের, এই বিষয়টাই মাথায় ঢুকাতে হবে। অথচ এখানেই আমরা ব্যর্থ। অনেক মুসলিম দেশ ও ব্যক্তি এই দ্বন্দ্বটাই বুঝতে পারছেন না, কিংবা চাইছেন না। আমাদের মাঝেই সরাসরি ইসরাঈলের সমর্থক যেমন আছেন, তেমন আছেন নীরব সমর্থক। এটাই মুসলিম হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা।

মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তীনের বিপক্ষে যত যুক্তি কিংবা ধারণাই আসুক, আমাদের প্রথম বিবেচ্য বিষয় দুই সভ্যতার সংঘাত। এমতাবস্থায় পাশ্চাত্য সভ্যতার পক্ষে দাঁড়ানো কিংবা তাদের পক্ষে কথা বলা নতুবা মনে মনে সমর্থন করাও ইসলামী শরীআহ অনুযায়ী জায়েয নয়। ইদানীং ঈমান ও কুফরের সংঘাতটাও খুবই স্পষ্ট। সামনে এমন সময় আসছে, যখন আপনি মাঝামাঝি কোনো দলে থাকতে পারবেন না। ঈমান ও কুফরের কোনো একটাকে বেছে নিতে হবে, নয়তো আপনার কার্যকলাপ কোনো একটার দিকে যাবে— হয় ঈমানের দিকে নয়তো কুফরের পক্ষে। এরই প্রস্তুতি এখন থেকেই নেওয়া উচিত।

আজকের পরিস্থিতিতে মুসলিম হিসেবে আমাদের করণীয় অনেক কিছুই আছে। আজ কেবল একটি ইস্যু নিয়েই লিখছি। সেটা হচ্ছে পণ্য বয়কট কিংবা বর্জন। ফিলিস্তীনের পক্ষে আজ বিভিন্ন পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে। এর কারণ ও যৌক্তিকতা রয়েছে। ঈমান, ইসলাম ও নিজের মুসলিম পরিচয় রক্ষার্থে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থবিরোধী প্রতিষ্ঠানের পণ্য বয়কট করা আজ ঈমানেরই দাবি। এটা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত জিহাদের ন্যায়, তেমনই অর্থনৈতিক জিহাদেরও অংশ বটে।

[এক]

প্রথমেই বলতে চাই, কেন আমরা পণ্য বয়কট করব? না জেনে হুজুগে পড়ে পণ্য বয়কট খুব একটা কাজের কথা না। স্মরণ রাখা দরকার, অমুসলিমদের সকল পণ্য ব্যবহার, তাদের সাথে লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করা নাজায়েয নয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে সেসব পণ্য যেগুলো—

(১) সত্তাগতভাবে হারাম হয়। যেমন- মদ। সত্তাগতভাবে হারাম পণ্য মুসলিমদের উৎপন্ন হলেও হারাম।

(২) মুসলিমদের বিপক্ষে ব্যবহার করা হয়। এজন্যই অস্ত্র বিক্রি জায়েয হলেও, ডাকাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি হারাম। এমনিভাবে যারা মুসলিমদের বিপক্ষে লড়াইয়ে রত, তাদের কাছেও অস্ত্র বিক্রি জায়েয নয়। 

(৩) যার ব্যবসা লব্ধ অর্থ ইসলাম ও মুসলিমের বিপক্ষে ব্যবহার করা হয় কিংবা মুসলিমদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া সাধারণ নীতি হচ্ছে অমুসলিমদের পণ্য ব্যবহার নাজায়েয নয়। অতএব, আমরা ইসরাঈল বা অন্য মুসলিম-বিদ্বেষী দেশের যেসব পণ্য বয়কট করার কথা ভাবছি তা সত্তাগত নাজায়েয হিসেবে নয়; বরং তা মুসলিমদের বিপক্ষে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে। এর মধ্যে কিছু আছে যেগুলো ইসরাঈলের দখলদারিত্বের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, সেগুলো ব্যবহার করা নিশ্চিতই হারাম। বাকী যেসব পণ্য মুসলিমদের বিপক্ষে কোনোরূপ সরাসরি কাজে জড়িত নয়, ইসরাঈলের সেসব পণ্য বর্জনের কারণ হচ্ছে—জিহাদ। 

আমরা নিশ্চয়ই জানি, জিহাদের একটি অংশ হচ্ছে বয়কট বা অবরোধ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বারে বানূ নাযীরকে অবরুদ্ধ রেখেছিলেন। অর্থনৈতিক অবরোধও মূলত জিহাদেরই একটি অংশ। যদি সকল মুসলিম দেশ থেকে একযোগে ইসরাঈলের বা মুসলিম-বিদ্বেষীদের সাথে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা যেত, তা হতো সবচেয়ে ভালো উপায়। যেহেতু নানা কারণে তা করা যাচ্ছে না, সে হিসেবে ব্যক্তিগত পর্যায়ের অবরোধ হিসেবেই আমি পণ্য বয়কটকে দেখছি। অর্থাৎ ব্যক্তির তরফ থেকে একপ্রকার অবরোধ হচ্ছে সে দেশের ও সে দেশ সংশ্লিষ্ট পণ্য বর্জন করা। এটা আর্থিক জিহাদেরই একটি পর্যায়, যদি তা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন।

[দুই]

দ্বীন মানার ক্ষেত্রে আমাদের বাঙালিদের একটা খুব কিউট অভ্যাস আছে— যে কাজে রিস্ক আছে বা হুমকি-ধামকি আছে কিংবা কিছু হারানোর ভয় আছে, সে সব কাজে আমরা নেই। এই অজানা ভয়ে অনেকে এমন অনেক কাজ ছেড়ে দেন, যা খুব সহজেই করতে পারতেন।

এমনই এক সহজ কাজ পণ্য বয়কট। কোনো রিস্ক নেই, হুমকি-ধামকি নেই, থাকার মধ্যে আছে কেবল একটুখানি খোঁজাখুঁজির কষ্ট। এটাও আমাদের হয় না। চিরাচরিত রিস্ক ফ্রি লাইফের অভ্যাস এক্ষেত্রে আমাদের কাজে আসেনি। খুব সহজেই পণ্য বয়কটের মাধ্যমে আমরা দ্বীনের জন্য যে কুরবানী বা মুসলিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারতাম, তা-ও কেন যে আমাদের দ্বারা হচ্ছে না— আমার বুঝে আসে না।

একসময় প্রশ্ন উঠত, পণ্য বয়কট করে কী লাভ? ইদানীং তা আর খুব বেশি উঠে না। কারণ গাযা ইস্যুতে পণ্য বয়কটের ফলাফল আমাদের সামনে। ম্যাকডোনাল্ড, কোকাকোলা বা স্টারবাকস্-এর মতো কোম্পানিরও লস আমাদের চোখের সামনে। আমাদের দেশেও ইসরাঈলী সমর্থক পণ্যের ভাটা কাল চলছে। কোকাকোলা বা পেপসির বিকল্প হিসেবে মোজো কেমন চলছে তা আশেপাশের দোকানে একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। মোজো নাকি সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, এমনি তাদের চাহিদা। সুতরাং, পণ্য বয়কট করলে যে আর্থিক প্রতিবাদটা হয় তা অন্তত সবাই বুঝে গেছে।

এরপরও কেন পণ্য বয়কট প্রসার লাভ করছে না? কেন দোকানে দোকানে এখনো সেসব পণ্যের সয়লাব? না দোকানি, না ক্রেতা কেউই পণ্য বয়কট খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না। কেন?

মূল কারণ, ঈমানী। ঈমান বা ইসলাম এখনো আমাদের ততটা প্রিয় হয়ে উঠেনি যতটা হওয়া দরকার ছিল। আমরা এখনো ব্যক্তিস্বার্থকেই দ্বীনের চাইতে প্রাধান্য দেই। এমন মানুষদের প্রতি নছীহত, আমার না, খোদ কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল ইযযতের কথা— ‘বলুন, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক্ব সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’ (আত-তাওবা, ৯/২৪)

সহজ ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ব্যক্তি, সম্পদ বা জীবনোপকরণ এর কোনোটা যদি আল্লাহ, রাসূল ও জিহাদের চাইতে প্রিয় হয় তবেই বিপদ। আর কে না জানে, পণ্য বয়কট জিহাদেরই দুর্বল রূপ মাত্র। প্রকৃত জিহাদ তো অনেক দূরের কথা, দুর্বল ও রিস্ক ফ্রি জিহাদেই আমরা নেই। কারণ নিশ্চয়ই উপরে বর্ণিত তিন ক্যাটাগরির (ব্যক্তি, সম্পদ বা জীবনোপকরণ) কোনো একটা। তাহলে হেদায়াত তো দূরের কথা আল্লাহর শাস্তির অপেক্ষা করাই সম্ভবত আমাদের নিয়তি।

আর ব্যবসায়ী ভাইদের তো কোনো ওযর নেই। সরাসরিই তাদের কথা আয়াতে এসেছে। তারপরও দোকানে সেসব পণ্য টাল দিয়ে রাখুন, ব্যবসা করুন; আর আল্লাহর আযাবের অপেক্ষায় থাকুন। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য; আযাব আসবেই, তখন আর কিছু করার থাকবে না।

সুধী পাঠক! এরপরও স্বয়ং আল্লাহ তাআলার এই ধমকি কি আমাদের অন্তরে কোনো রেখাপাত করবে না?

দ্বিতীয় আরেকটা কারণ বলতে চাই। আমাদের অনেকে মন থেকেই চান পণ্য বয়কট করতে। কিন্তু করতে পারেন না, কারণ অলসতা। একটু খুঁজে বিকল্প পণ্য বের করা কিংবা একটু দূরের দোকানে গিয়ে সদাই করার কষ্টটুকুও স্বীকার করতে রাজী নন। ভাবেন, একদিন বা একবার করলে কী এমন ক্ষতি!

এদের অনেকেই আবার জিহাদের ময়দানে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। মনে মনে তৃতীয় মালহামা, হিন্দুস্তানের যুদ্ধ বা ইমাম মাহদীর সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এমন আশাবাদী কেউ থাকলে স্বপ্ন দেখা ভুলে যান। যিনি ১০০ গজ দূরের দোকানে যাওয়ার কষ্টটুকু সহ্য করতে পারেন না, তিনি করবেন জিহাদ! আপনি চাইলেও আল্লাহর খাতায় আপনার নাম থাকবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত।

প্রিয় ভাই, এবার চিন্তা করুন একবার বা একদিন পণ্য বয়কট না করলে কী ক্ষতি, কার ক্ষতি। ভাই, ক্ষতি অন্যের না; আপনার নিজের। নিজের ঈমানী পরীক্ষায় আপনি ফেল, ইসলামের প্রতি মুহাব্বতের পরীক্ষায় আপনি ফেল, জিহাদের পরীক্ষায় আপনি ফেল।

অনেকে পণ্যের কোয়ালিটির কথা বলে পণ্য বয়কট না করার যুক্তি দেন। আরে ভাই, নিজের কোয়ালিটির খবর নিন। আপনার ঈমানের কোয়ালিটি, আমলের কোয়ালিটি ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কোয়ালিটি কোনোটাই তো ঠিক নেই। আর আপনি আছেন পণ্যের কোয়ালিটি নিয়ে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, দু-একটা প্রোডাক্ট বাদে বাকী সব পণ্যই উনিশবিশ। মিডিয়ার কারণে আমরা কোনো কোনো প্রোডাক্টকে অপরিহার্য বানিয়ে নিয়েছি। অথচ বিকল্প পণ্য কোনো অংশেই খারাপ নয়। কেবল ব্যবহারের অভ্যস্ততা প্রয়োজন। তাছাড়া ঈমান, ইসলামের জন্য না হয় খারাপ পণ্যই ব্যবহার করলাম। আর কে না জানে, আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করলে তাঁর প্রতিদান শতগুণে ফিরে আসে; উভয় জাহানেই— দুনিয়াতে যেমন, আখেরাতেও। আর ফিলিস্তীন ইস্যু তো আমাদের জীবনের প্রশ্ন, ঈমানের প্রশ্ন, পরিচয়ের প্রশ্ন।

[তিন]

এবার পণ্য বয়কট নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসার কথা আলোচনা করব। এ আলোচনায় উদাহরণ দিতে গিয়ে নানা ইস্যুতে নানা দেশের নাম আসবে। এগুলো তো কেবল উপমা মাত্র। বস্তুত ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থবিরোধী সব প্রতিষ্ঠানকেই বর্জন করা উচিত, হোক তা দেশি কিংবা বিদেশি কিংবা ইসরাঈলি বা ভারতীয়।

আমাদের অনেকেই বলে থাকেন, ইসরাঈলি পণ্য বর্জন করলে কীই বা লাভ। আমি একজন ইসরাঈলি পণ্য বয়কট করলেই বা কী না করলেই বা কী? তাতে ইসরাঈলের কী যায় আসে?

আসলেই, একজন ক্রেতা/ভোক্তা যদি ইসরাঈলি পণ্য বয়কট করেন, তাহলে কিন্তু বাহ্যত কোনো ক্ষতিই পরিলক্ষিত হয় না। ধরে নিলাম সারা বিশ্বে কেবল আপনি বা আমি একজনই মাত্র একটা পণ্য বর্জন করলাম। তাতে পণ্যের উৎপাদনে যেমন হেরফের হবে না, তেমনই লাভেও না। তবে তাত্ত্বিকভাবে কিছুটা লোকসান হবেই, তা যতই ক্ষুদ্রতর হোক, হয়তো দশমিকের পর আরও ৫০০০টি শূন্য যোগ করলে যে সংখ্যা দাঁড়ায় তত শতাংশ পরিমাণ। মোটকথা হচ্ছে, যাররা (ন্যূনতম) পরিমাণ হলেও ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে যদি বিশাল একটা অংশ ত্যাগ করে, তবে ক্ষতির সে শতাংশ বাড়তে থাকবে, তার প্রভাব উৎপাদনেও পড়তে বাধ্য। অনেকটা বিন্দু বিন্দু জলের সাগরের মতো। এক ফোঁটা কমলে কোনো কিছুই কমে না, কিন্তু যদি এক ফোঁটা ফোঁটা করে কমতে থাকে একসময় পরিবর্তন চোখে পড়বেই।

এখন সুধী পাঠক! আমার/আমাদের ক্ষমতা তো অতটুকুই, নাকি? আল্লাহ তাআলা আমাকে/আপনাকে তো ১% বা ৫০% ক্ষতি করার সামর্থ্য দেননি। ফলে সেটা না করতে পারার জন্য আমাকে জিজ্ঞাসাও করবে না। কিন্তু আমার সামর্থ্য যতটুকু, ততটুকু যদি না করি, জিজ্ঞাসিত আমিই হব, আপনি না। সুধী পাঠক! এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কার কতটা ক্ষতি হলো, তা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমার দায়িত্ব আমি কতটুকু পালন করলাম। কীভাবে আমার ঘৃণা প্রকাশ করলাম।

আচ্ছা, এটা কি সম্ভব যে, যার দ্বারা বা যার ইন্ধনে আমার ভাই-বোন অত্যাচারিত হলো, আমি তার দোকান থেকেই চাল কিনে খাই! শুনতে কেমন লাগল। কেউ যদি এমন করে আপনি তাকে নিশ্চয়ই সাধুবাদ জানাবেন না, তাই না? পণ্য বয়কটের মূল উদ্দেশ্য এখানেই। ক্ষতি কতটুকু কার হলো সেটা গৌণ বিষয়।

হ্যাঁ, আর্থিকভাবেও এই প্রতিবাদ কার্যকরী যদি সকলে মিলে এই কাজ করা যায়। আর এটা অসম্ভব কিছুও না। এরূপ অনেক উদাহরণ আছে, নিকট অতীতেই। আমরা, মুসলিমরা যদি একটু ঈমানের চোখ দিয়ে তাকাই, তাহলেই সম্ভব। আর কে না জানে, ইয়াহূদীদের জোর অর্থের কারণেই। ফলে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে দেখলে নিশ্চয়ই তারা তাদের পলিসি পাল্টাতে বাধ্য।

যাই হোক, পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু আবেগের কথা শেয়ার করি। এক লোক পেপসি পান করেন না; কারণ পেপসি ইসরাঈলি। তো, কোনো এক অনুষ্ঠানে একজন তাকে খুব জোরাজুরি করলেন পেপসি পানের জন্য। আর শেষ পর্যায়ে মোক্ষম যুক্তি (!) দিলেন যে, ‘আপনি একজন খেলেই বা ইসরাঈলের কী লাভ, আর না খেলেই বা তার কী লোকসান। তাতে তো কিছুই হচ্ছে না। ফলে অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ। তার চাইতে খেয়েই ফেলুন’।

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মানছি আমি একজন না খেলে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু, লাভ-ক্ষতি আমি দেখছি না। আমার সমস্যা হচ্ছে পেপসি আমি খেতেই পারছি না। যখনই তা খেতে যাই, তখনই আমার চোখের সামনে ফিলিস্তীনি ভাইদের রক্তমাখা লাশ ভেসে ওঠে। আমার ভাইদের রক্ত লেগে আছে এমন খাদ্য আমি কীভাবে খাই’।

এরপর দ্বিতীয় ভদ্রলোক আর একটা কথাও বলেননি। আসলে বলার কিছু থাকেও না। লাভ-ক্ষতি এখানে আসলেই গৌণ; মুখ্য হচ্ছে অনুভূতি। এটা আদতেই চেতনার বিষয়, এত গভীর আবেগে কেউ তাঁর ভাইকে ভালোবাসলে কেবল পানীয় কেন, অনেক কিছুই ত্যাগ করা যায়। এখন আপনার ভালোবাসা আপনার কাছেই থাকুক। আপনি কী পণ্য, কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা আপনার হাতেই তোলা থাকল। ফিলিস্তীনি ভাইদের, তাদের শিশুদের, স্ত্রী-বোনদের রক্তমাখা ছবি উপেক্ষা করেও আপনি যদি তা ভোগ/ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে আমি শতবার বললেই বা কী লাভ। মস্তকবিহীন শরীর কিংবা শরীরহীন শিশুর মাথা যখন আপনাকে জাগাতে পারে না, তখন আমি আপনার হাত-পায়ে ধরলেও কিছু হওয়ার কথা না।

আবার অনেকের জিজ্ঞাসা, কতটি দেশের পণ্য ত্যাগ করবেন? ভারত, চীন, ইউএসএ, ফ্রান্স সবাই তো একই দোষে দোষী। এভাবে বয়কট করতে থাকলে কিছুই তো ব্যবহার করার উপায় নেই।

খুব যৌক্তিক প্রশ্ন। তবে পণ্য বয়কটের ক্ষেত্রে ঠিক মানানসই নয়। আপনি যতগুলো পারেন সবগুলোই বয়কট করেন। সেটা নির্ভর করছে আপনার ঈমান, আমল আর তাক্বওয়ার উপর। সবগুলো যদি করতে পারেন, তাহলে তো নূরুন আলা নূর, সোনায় সোহাগা। আর যদি না পারেন যে কয়টি পারেন করুন।

এটা তো কোনো যুক্তি হতে পারে না যে, আমি যখন ভারতের পণ্য বয়কট করছি না, তাহলে ইসরাঈলেরটাও বয়কট করব না। বস্তুত এটা কোনো বিধিবদ্ধ আইনের অধীন না, এটা নিতান্তই আপনার ইখতিয়ারে। আপনি প্রেফারেন্স তালিকা নির্ধারণ করে না হয় বয়কট করুন। হ্যাঁ, এটা আমরা বলি যে, বয়কট যেন হয়, ইসলাম ও মুসলিমের স্বার্থে; নিজের জাগতিক স্বার্থের জন্য না।

আর প্রশ্নের দ্বিতীয়াংশে যা বলা হলো, সেটাও অনেকটা খোঁড়া যুক্তি। ইসলামে এর সমাধানও আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, ওসব দেশ থেকে যেসব পণ্য আসে তা জরুরী বা আবশ্যকীয় পণ্য নয়। বেশিরভাগই বিলাসদ্রব্য, আর তা না হলেও এগুলোর বিকল্প পণ্য আছে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, সেসব দেশের কিছু পণ্য এমন যে, এগুলো ছাড়া বাঁচার উপায় নেই (যদিও আমি এমন একটাও পাইনি), তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। আপনি কেবল সেটাই ব্যবহার করুন, ততটুকু যতটুকু বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। নিজের শখ মেটানোর জন্য নয়। যেমনিভাবে জীবন রক্ষার খাতিরে শর্তসাপেক্ষে রক্ত, শূকরের মাংস ইত্যাদি খাওয়াও ইসলামে জায়েয রয়েছে। সে হিসাবে এসব দেশের পণ্য তো আর মূলত নাজায়েয নয়, বরঞ্চ কোনো ঈমানী কারণের প্রেক্ষিতেই আপনি বর্জন করছেন। ফলে জরুরী পরিস্থিতিতে সেসব পণ্য ব্যবহার করলে আপনার বয়কট ভঙ্গ হওয়ার কথাও আসে না। 

আবার এটাও দেখা যায় যে, যতদিন ইস্যু গরম থাকে ততদিন পণ্য বয়কট করা হলো। কিছুদিন পর আবার সেই আগের অবস্থা। তাহলে কী দরকার এভাবে লোক হাসানোর?

এটা অনেকেই বলেন। আমি নিজেই অনেকের মুখে শুনেছি। হ্যাঁ, এটা বাস্তব যে, অনেকেই এমন করে থাকেন। এটা নির্ভর করে উনার ঈমানের দৃঢ়তা কতটুকু এর উপর। তবে পরে আবার ব্যবহার করার সম্ভাবনা থাকবে বলে যে এখন বয়কট করতে পারবেন না, তা কিন্তু কোনো কাজের কথা না। প্রথমত, যতদিন করলেন ততদিন তো ছওয়াব পেলেন, প্রতিবাদ করলেন। আর কে-ই বা বলতে পারবে যে, আপনি একেবারেই তা বর্জন করছেন না। সেটাও তো হতে পারে।

একটা উদাহরণ দিই, পাপ করতে অভ্যস্ত হলে কি তওবা করার দরকার নেই? তওবা করুন, পুনরায় পাপ হয়ে গেলে আবার তওবা করুন। এভাবে একই পাপের জন্য ৭০ বার তওবা করলেও আল্লাহ তা ক্ষমা করেন (আরবে ৭০ সংখ্যা সাধারণত অসংখ্য বুঝাতে ব্যবহৃত হতো, যেমন এককালে আমাদের সামাজিক সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল কুড়ি। এক কুড়ি দুই কুড়ি এভাবে হিসাব করা হতো)।

হয়তো বলবেন, যে পাপ আমি জানি যে আবার করব, তাতে তো তওবা পূর্ণরূপে হয়ই না। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, আপনি যদি ভবিষ্যতেও সে পাপ করার ইচ্ছা ত্যাগ না করেন তাতে তওবা যথাযথ হয় না। কিন্তু তাই বলে তওবা ছেড়ে দেওয়াটা নিতান্তই মূর্খতা, এটা শয়তানেরই চাল। কেননা তওবা পুরা না হলেও ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) তো হয়, বান্দা আল্লাহমুখী তো হয়। এভাবেই হয়তো কোনো একদিন খালেছ তওবা নছীব হবে।

প্রিয় ভাই, পণ্য বয়কটও তেমনই। যতদিন পারেন করেন, যতগুলো পারেন করেন। আপনার ঈমান যতদিন আপনাকে এ পথে চালায় ততদিন চলুন। আল্লাহর দিকে আপনার এই পদক্ষেপের দরুন আল্লাহর রহমত আপনার দিকে আরও বেশি করে অগ্রসর হবে, তাতে হয়তো আপনি বাকী জীবনও এমনিভাবে চলতে পারবেন।

লোক হাসানোর যে কথা আমরা চিন্তা করি সেটা অমূলক নয়। আমাদের পরিবারের অনেকেই এমন বলে ফেলেন। আসলে যারা বলেন, তারা দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকিফহাল নন। ফলে তারা এসব বিষয় দুনিয়াবী ও সামাজিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন। না হয়, কিছুটা হাসি সহ্যই করলেন দ্বীনের জন্য, আল্লাহর জন্য।

তবে একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত, এভাবে দ্বীনের ইস্যুকে খেলতামাশার বস্তু যেন আমরা বানিয়ে না ফেলি। এটা মারাত্মক অপরাধ। হ্যাঁ, যদি খালেছ নিয়্যতে আমি কোনো আমল করি, তারপর তা ছেড়ে দিই; তারপর পুনরায় শুরু করি, আবার ছেড়ে দিই; আবার শুরু করি আবার ছাড়ি, তাতে সমস্যা ততটা মারাত্মক নয়, যতটা মারাত্মক হয় ইচ্ছাকৃতভাবে জেনেশুনে কোনো আমলকে ধরা ও ছাড়া হয়। এরূপ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

আরও একটা কথা আমাদের মধ্যে খুব প্রচলিত যে, ‘ইয়াহূদীদের পণ্য যদি বয়কট করতে হয় তবে facebook amazon, ebay, google, IBM সবই করুন। দেখি আপনাদের কত জাযবা’। [এসব পণ্য কাদের সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই, কিংবা মুসলিমদের বিপক্ষে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তাও নিশ্চিত নই।]

ফলে আমাদের অনেকেই বয়কটের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। অথচ এই কথা শুনতে যৌক্তিক মনে হলেও আসলে এর কোনো ভিত্তি নেই। অন্তত ইসলামী ব্যাখ্যানুসারে নেই। কেননা—

(১) সবাই সব পণ্য বয়কট করবে বা করতেই হবে এমন কোনো নির্দেশনা নেই। বরং যার যার ক্ষমতা, সামর্থ্য ও সুযোগ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। কেননা এটা ফরযে আইন বিধান নয়। এটা জিহাদের অংশ, ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি ভালোবাসার—আবেগের প্রকাশ। ফলে যার ঈমান যতটুকু দাবি করে তিনি ততটুকুই করবেন। যতদিন সম্ভব ততদিন করবেন। হ্যাঁ, উত্তম হচ্ছে সবকিছু, সবসময়ের জন্য বয়কট করা। তবে কেউ না করতে পারলে তিনি মুসলিমই না, বরং কাফের এমন বলার কোনো সুযোগ নেই; কেবল ঈমানের দাবি তিনি পরিপূর্ণভাবে পালন করেননি এটুকু বলা যায়। অবশ্য কেউ ওদের কার্যকলাপকে ভালোবাসলে ঈমান থাকার সম্ভাবনা নেই। 

(২) ‘নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ’ করার নীতি ইসলামে নেই। একটু বুঝিয়ে বলি। উদাহরণ হিসেবে fছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরাযিয়াল্লাহু আনহুআলাইহিস সালামআলাইহিস সালামook-ই সম্ভবত আদর্শ। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ‘ফেসবুক ইয়াহূদীদের দ্বারা পরিচালিত, তাতে মুসলিমদের স্বার্থের অনেক হানি করা হয়’।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফেসবুকে আপনার আসার কারণ কী? তাতে লাভ কতটুকু আর ক্ষতি কতটুকু? যদি ফেবু ব্যবহারে কোনোরূপ হারামে জড়িত না হোন (যেমন অশ্লীলতা ও বেপর্দা—এ দুটোই সবচেয়ে বেশি হয়) এবং আপনার নিয়্যত যদি নেক হয় তবে ফেবু ব্যবহার ছেড়ে দিলে ইয়াহূদীদের যে ক্ষতি, তার চাইতে আপনার ক্ষতি বেশি। এটা পরিমাপ করবে শারঈ মাসলাহা-মাফসাদা (লাভ-ক্ষতি) এর নীতি। যেমন আজ যদি ফেসবুক ব্যবহার না করতেন, তাহলে জানতেন কি, ফিলিস্তীনে কী হচ্ছে? জানতেন কি, এখন কী করা উচিত, কিংবা কখন মুসলিমরা সম্মিলিতভাবে কী আন্দোলন করছে? সম্ভবত আমাদের বেশিরভাগই জানতেন না।

অতএব, ঢালাওভাবে অন্য সব পণ্যের সাথে এসবের তুলনা করা মোটেও ঠিক নয়। কেননা কোনো পানীয় ত্যাগ করায় মুসলিম উম্মাহর কোনোই ক্ষতি নেই, তাছাড়া এসবের বিকল্পও আছে। অন্যদিকে ফেসবুকের বিকল্প যদি তৈরি করা যায় সেটাই সর্বোত্তম, না হওয়া পর্যন্ত সেটাকে নিজেদের কাজে লাগানোই বরং উত্তম। যেমন— দাওয়াতের কাজ করা, ইলম অর্জন করা, দেশের, মুসলিম উম্মাহর খবরাখবর জানা, নিজ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই উকায মেলায় যেতেন। কেন? কাফেররা যে উদ্দেশ্যে যেত সে উদ্দেশ্যে নয়, বরং দাওয়াতের জন্য। কারণ নানা এলাকার লোকের কাছে সহজে দাওয়াত পৌঁছানো যাচ্ছে। ফেসবুকও অনেকটা এমন। আপনার নিয়্যত ও পদ্ধতি যদি ঠিক থাকে, তবে সমস্যা নেই।

তবে লক্ষ রাখা উচিত এসব কাজে ফেসবুক ব্যবহার যেন আমাদের হারামে লিপ্ত না করে। কেননা এসব কাজ করার আরও অনেক মাধ্যম আছে, ফেবু একমাত্র মাধ্যম নয়। ফলে একটি সহজ পথ অনুসরণ করতে গিয়ে হারামে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে সে পথ ব্যবহারও হারামই হয়।

(৩) তাছাড়া অমুসলিমদের সকল পণ্য ব্যবহারই যদি নিষেধ হতো, তবে যুদ্ধাস্ত্র, মোবাইল, বিমান এমন সবই তো নিষিদ্ধ হয়ে যেত। অথচ সেসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না। মূলত যেসব পণ্য সত্তাগতভাবে হালাল, সেগুলো ব্যবহার করা হালাল, যদি তা প্রয়োজনীয় হয়, কিংবা উম্মাহর (ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক) কল্যাণে লাগে। আর যেসব পণ্য হারাম, তা কেবল অমুসলিম কেন, মুসলিমের তৈরি হলেও হারাম।

এসবের আলোকেই ফেসবুক ব্যবহারের বিধান কার্যকর হবে। কেবল একটি নীতি জেনে তা নিয়ে তর্ক করা জ্ঞানীদের মানায় না। ফেসবুক যিনি কল্যাণের কাজে, প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করবেন তার জন্য জায়েয। পাঠক খেয়াল রাখবেন, জায়েয বা বৈধ বলছি— ওয়াজিব বা মুস্তাহাব, এমনকি উত্তম বলছি না।

অন্যথা যিনি হারামে লিপ্ত হয়ে পড়েন তাঁর জন্য, উম্মতের যত কল্যাণই তাতে চোখে পড়ুক, হারাম। সেক্ষেত্রে কল্যাণ-অকল্যাণ মূলনীতির আগে হালাল-হারাম মূলনীতি প্রযোজ্য হবে। হ্যাঁ, যদি কেউ তাক্বওয়ার কারণে সব কিছুই বর্জন করতে পারেন, তাঁর নিকট থেকে আমরা দু‘আর প্রত্যাশাই করি।

[চার]

পণ্য বয়কটের একটি কমন সমস্যা হচ্ছে অতিরঞ্জন ও অবিশ্বস্ততা। অর্থাৎ যেকোনো একটি তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হলো, অথচ দেখা যায় ইসরাঈলের সাথে এর বেশির ভাগেরই কোনো সম্পর্ক নেই। ভুল তথ্যের কারণে কোনো পণ্যের ব্যাপারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হলো। হ্যাঁ, এটা খুবই আপত্তিকর যে, ইসরাঈলি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে যে তালিকা দেওয়া হলো, তাতে অন্য দেশের পণ্যের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।

ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। আপনি কোনো পণ্য পছন্দ না-ই করতে পারেন, সে সম্পর্কে মানুষকেও সচেতন করতে পারেন। কিন্তু তা নিশ্চিতরূপেই মিথ্যা বলে না। ধরে নিন, অমুক কোম্পানির মালিক কাদিয়ানী হওয়ায় তার প্রোডাক্ট আপনার অপছন্দের। কিন্তু মিথ্যা তথ্য দিয়ে আপনি যদি সে কোম্পানির বিরুদ্ধে ইয়াহূদী ট্যাগ দিয়ে প্রচারে নামেন তবে তা কীভাবে ইসলামী হয়?

অতএব, স্পেসিফিক্যালি পণ্যের নাম দেওয়ার পূর্বে সকলেরই উচিত সচেতন হওয়া। কেউ একজন একটি তালিকা দিল, আর আমি গ্রহণ করলাম, এমন করা একদমই উচিত না। অন্ততপক্ষে তিনটি বিষয়ের কোনো একটি নিশ্চিত করুন—

(১) যিনি তালিকা করেছেন তিনি আপনার নিকট নিঃসন্দেহে দ্বীনদার এবং যার বিশ্বস্ততা প্রমাণিত।

(২) নিজে যাচাই-বাছাই করুন, তারপর অন্যের সাথে শেয়ার করুন।

(৩) অন্ততপক্ষে তালিকায় রেফারেন্স এর উল্লেখ আছে কি না দেখুন। অন্তত যারা জানতে চান তারা যেন যাচাই করে নিতে পারেন।

এক্ষেত্রে আমাদের সমাজে নানারূপ লিফলেট বা তালিকা পাওয়া যায়। এসব তালিকার বেশিরভাগই ইন্টারনেট থেকেই সংগৃহীত। ফলে এর পরিপূর্ণ যথার্থতা নিরূপণ করা অনেকের জন্যই কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এসব তালিকা iরাযিয়াল্লাহু আনহুমরাযিয়াল্লাহু আনহুlআলাইহিমাস সালামsivআলাইহিস সালাম নয়। অর্থাৎ ইসরাঈলের সাথে সম্পর্কিত সব পণ্যই সেসবে উল্লেখ করা হয় না; আদতে তা সম্ভবও নয়। ফলে অনেক কিছুই বাদ পড়ে যায়। তাছাড়া এসব তালিকা প্রস্তুতির মূল ও অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র উৎস হচ্ছে ইন্টারনেট; ফলে বিশ্বস্ততার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আমরা কী করব? সুধী পাঠক! একটু খুঁজুন, ঘাটুন। পেয়ে যাবেন। তাছাড়া যাকে বিশ্বস্ত মনে হয় তাঁর তালিকা ফলো করুন। এটা যৌক্তিক না যে, আপনি খুঁজবেন না বিধায়, কিংবা নিশ্চিত না বিধায় কোনো কিছুই বয়কট করবেন না। বরং সতর্কতার দাবি তো এটাই যে, আপনি খোঁজার কষ্ট না করতে চাইলে, আপনার প্রাপ্ত তালিকার সব কিছুই বর্জন করুন। মনে রাখবেন, ভোক্তা হিসেবে পণ্য ব্যবহার ও পছন্দ করার অধিকার আপনারই। কোনো কোম্পানি তাদের প্রডাক্ট ব্যবহার না করার জন্য আপনাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে না। ফলে নিশ্চিত না হলে, প্রাপ্ত তালিকার সবকিছুই বর্জন করুন, সন্দেহমুক্ত থাকবেন।

আরেকটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ইসরাঈলি পণ্য বয়কটের দ্বারা আমরা কিন্তু কেবল ইসরাঈলি মালিকানাধীন কোম্পানির পণ্যের কথা বলছি না, বরং এ বয়কট প্রধানত আরও কিছু শ্রেণির পণ্যের ব্যাপারেও কার্যকর হবে। যেমন— যেসব পণ্য সরাসরি ইসরাঈলি প্রোডাক্ট; যেসব পণ্য অন্য দেশীয় কিন্তু ইসরাঈলের দখলদারিত্বের সাথে সম্পর্কিত; যে সকল পণ্যের দ্বারা ইসরাঈল রাষ্ট্র উপকৃত হচ্ছে। যথা- কাঁচামাল জোগান দেওয়া ইত্যাদি।

সম্পূরক হিসেবে এবার আরও কিছু পণ্যের কথা বলি। মুসলিম হিসেবে এসব পণ্যও বয়কট করা উচিত। সেগুলোর অন্যতম হলো—

(১) যেসব প্রতিষ্ঠান সরাসরি ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের বিপক্ষে অবস্থান নেয় ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেমন- ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতার প্রসার।

(২) ফ্রান্সের প্রোডাক্ট। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননা, হিজাব–নিকাব নিষিদ্ধ ইত্যাদি এবং তা রাষ্ট্রীয় আনূকুল্যে। ফ্রান্স ভবিষ্যতে যতই ইসলামপন্থি হোক, এর পণ্য জ্ঞানত আমরা কোনোদিনই ব্যবহার করব না। কারণ ইস্যু হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে। সেখানে কম্প্রোমাইজের কোনো সুযোগই নেই।

(৩) যেসব প্রতিষ্ঠান অমুসলিম ও কাদিয়ানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। নানা জায়গায় বিশেষত উত্তরবঙ্গে মুসলিমদের কাদিয়ানীতে ধর্মান্তকরণ কাজে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত।

(৪) ভারতীয় প্রোডাক্ট। কারণ, সামজিক ও সাংস্কৃতিক ময়দানে এরাই মূলত এ দেশে ইসলামের মূল বিপক্ষ শক্তি। বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের আস্ফালন ও অনৈসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারে এদের ভূমিকাই সর্বাধিক।

(৫) যেসব সংস্থার পণ্য দেশে অশ্লীলতার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পরিচিত; পাশাপাশি দেশীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ।

এসব পণ্য বয়কট করা এখন সময়ের দাবি। মুসলিম হিসেবে নিজেদের পরিচয়, স্বকীয়তা রক্ষা করতে চাইলে, আল্লাহর রহমতের আশা করলে আর আখেরাতের সফলতা চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।

সুধী পাঠক! আমি জানি ফিলিস্তীনের বর্তমান ইস্যুতে এটুকুতেই, শুধু পণ্য বয়কটেই, আমাদের দায়িত্ব শেষ নয়। আমাদের দুর্বলতাও আমি স্বীকার করি। কিন্তু আপাতত এসব পণ্যই যদি বয়কট না করতে পারি তবে বড় দায়িত্ব কীভাবে পালন করব। তার চাইতে বড় কথা, এসব পণ্য বয়কট না করতে পারলে জিহাদের জন্য আল্লাহর তালিকায় আমার নামই তো থাকবে না। বয়কট দিয়ে শুরু করতে পারলে নামটা আল্লাহর প্রিয় মানুষদের তালিকায় থাকার আশা রাখি। আর আশা রাখি আল্লাহর রহমতের। আমার সাধ্যমতো আমি এগুলো করলে আল্লাহর রহমত তো আমার দিকে আসার কথা। তাই নয় কি?

মুস্তফা মনজুর

সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Magazine