মৃত্যু এক অমোঘ সত্য। জগতে যার প্রাণ আছে, তাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। আল্লাহ তাআলাই জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন। মৃত্যুর মাধ্যমে শুরু হবে আমাদের বারযাখী বা পারলৌকিক জীবন। কবর পরকালের প্রথম ঘাঁটি। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় ভালো আমল করবে এবং আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য প্রস্তুতি নেবে, কবর তার জন্য সুখ ও আনন্দের ঘর। আর যে ব্যক্তি খারাপ আমল করবে এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তার জীবন পরিচালনা করবে না, কবর তার জন্য ভীতি ও অন্ধকারের ঘর। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কবর পরকালের প্রথম ঘাঁটি। কেউ যদি এখান থেকে মুক্তি পায়, তাহলে পরবর্তী ঘাঁটিগুলো তার জন্য সহজ হবে। আর যদি কেউ কবর থেকে মুক্তি না পায়, তাহলে পরবর্তী ঘাঁটিগুলো তার জন্য আরও কঠিন হবে’।[1]
কবরজীবন কেমন হবে, তার প্রথম প্রহর কীভাবে কাটবে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি দীর্ঘ হাদীছ আমরা পাই। এ পর্বে এমনই একটি হাদীছ উপস্থাপন করব।
বারা ইবনু আযেব রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে জনৈক আনছারীর জানাযায় বের হলাম, আমরা তার কবরের কাছে যখন পৌঁছলাম, তখনও কবর খোঁড়া হয়নি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন, আমরা তার চারপাশে বসলাম, যেন আমাদের মাথার ওপর পাখি বসে আছে। তার (রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাতে একটি কাঠ ছিল, তিনি মাটি খুঁড়ছিলেন, অতঃপর মাথা উঠিয়ে বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর নিকট কবরের আযাব থেকে পানাহ চাও’ দুই অথবা তিন বার বললেন। অতঃপর বললেন, ‘নিশ্চয় মুমিন বান্দা যখন দুনিয়া হতে প্রস্থান ও আখেরাতের জীবনে পা রাখার সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়, তখন তার নিকট আসমান থেকে সাদা চেহারার ফেরেশতাগণ অবতরণ করেন, যেন তাদের চেহারা সূর্য। তাদের সাথে জান্নাতের কাফন ও জান্নাতের সুগন্ধি থাকে, অবশেষে তারা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে বসে যায়। অতঃপর মালাকুল মাউত আসেন ও তার মাথার নিকট বসেন, তিনি বলেন, হে পবিত্র রূহ! তুমি আল্লাহর মাগফেরাত ও সন্তুষ্টির দিকে বের হও। তিনি (রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘ফলে রূহ বের হয় যেমন মটকা বা কলসি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তিনি তা গ্রহণ করেন, যখন গ্রহণ করেন তিনি নিজ হাতে না রেখে চোখের পলকে তার সঙ্গে নিয়ে আসা কাফন ও সুগন্ধির মধ্যে রাখেন, তার থেকে উৎকৃষ্টতর ঘ্রাণ বের হয়, যা দুনিয়াতে পাওয়া যায়’। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অতঃপর তাকে নিয়ে তারা ওপরে ওঠে, তারা যখনই তার রূহসহ ফেরেশতাদের কোনো দলকে অতিক্রম করে তখনই তারা বলে, কার এই পবিত্র রূহ? তারা বলে, অমুকের সন্তান অমুক, সবচেয়ে সুন্দর নামে তাকে ডাকে, যে নামে দুনিয়াতে ডাকা হতো, তাকে নিয়ে তারা দুনিয়ার আসমানে পৌঁছে, তার জন্য তারা আসমানের দরজা খোলার অনুরোধ করেন। তাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়, তাকে প্রত্যেক আসমানের নিকটবর্তীরা পরবর্তী আসমানে অভ্যর্থনা জানিয়ে পৌঁছে দেয়, এভাবে তাকে সপ্তম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দার দফতর ইল্লিয়ীনে লিখো এবং তাকে যমীনে ফিরিয়ে দাও। কারণ আমি তা (মাটি) থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, সেখানে তাদেরকে ফেরত দেব এবং সেখান থেকেই তাদেরকে পুনরায় উঠাবো’। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অতঃপর তার রূহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, এরপর তার নিকট দুজন ফেরেশতা আসবে, তারা তাকে বসাবে অতঃপর বলবে, তোমার রব কে? সে বলবে, আল্লাহ। অতঃপর তারা বলবে, তোমার দ্বীন কী? সে বলবে, আমার দ্বীন ইসলাম। অতঃপর বলবে, এই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল? সে বলবে, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতঃপর তারা বলবে, কীভাবে জানলে? সে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি, তাতে ঈমান এনেছি ও তা সত্যায়ন করেছি। অতঃপর এক ঘোষণাকারী আসমানে ঘোষণা দিবে, আমার বান্দা সত্য বলেছে। অতএব তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তাকে জান্নাতের পোশাক পরিধান করাও এবং তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলে দাও’। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ফলে তার কাছে জান্নাতের সুঘ্রাণ ও সুগন্ধি আসবে, তার জন্য দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত তার কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হবে’। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তার নিকট সুদর্শন চেহারা, সুন্দর পোশাক ও সুঘ্রাণসহ এক ব্যক্তি আসবে, অতঃপর বলবে, তোমাকে সন্তুষ্ট করবে এমন বিষয়ের সুসংবাদ গ্রহণ করো। এটা তোমার ঐ দিন, যার ওয়াদা তোমাকে করা হতো। সে তাকে বলবে, তুমি কে? তোমার এমন চেহারা যে শুধু কল্যাণই নিয়ে আসে? সে বলবে, আমি তোমার নেক আমল। সে বলবে, হে আমার রব! ক্বিয়ামত ক্বায়েম করুন, যেন আমি আমার পরিবার ও সম্পদের কাছে ফিরে যেতে পারি’।
তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আর কাফের বান্দা যখন দুনিয়া থেকে প্রস্থান ও আখেরাতে যাত্রার সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়, তার নিকট আসমান থেকে কালো চেহারার ফেরেশতারা অবতরণ করেন, তাদের সাথে থাকে ‘মুসূহ’ (মোটা কাপড়), অতঃপর তারা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে বসে যায়, অতঃপর মালাকুল মাউত আসেন ও তার মাথার কাছে বসেন। অতঃপর বলেন, হে খবীছ আত্মা! আল্লাহর রাগ ও গযবের জন্য বের হও’। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ফলে তাকে তার শরীর থেকে পৃথক করা হয়, অতঃপর সে তাকে টেনে বের করে, যেমন ভেজা উল থেকে (লোহার) সিক বের করা হয়। যখন গ্রহণ করেন তিনি নিজ হাতে না রেখে চোখের পলকে ফেরেশতারা তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা ঐ মোটা কাপড়ে রাখে, তার থেকে মৃত দেহের যত কঠিন দুর্গন্ধ দুনিয়াতে হতে পারে, সে রকমের দুর্গন্ধ বের হয়। অতঃপর তাকে নিয়ে তারা ওপরে উঠে, তাকেসহ তারা যখনই ফেরেশতাদের কোনো দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখনই তারা বলে, এ খবীছ রূহ কার? তারা বলে, অমুকের সন্তান অমুকের, সবচেয়ে নিকৃষ্ট নাম ধরে ডাকা হয় যার মাধ্যমে তাকে দুনিয়াতে ডাকা হতো। এভাবে তাকে নিয়ে দুনিয়ার আসমানে যাওয়া হয়, তার জন্য দরজা খুলতে বলা হয়, কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হবে না’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেলাওয়াত করেন,لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ‘তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সুচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৪০)। ‘অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, তার আমলনামা যমীনের সর্বনিম্নে অবস্থিত সিজ্জীনে লিখো। অতঃপর তার রূহ সজোরে নিক্ষেপ করা হয়’। অতঃপর তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেলাওয়াত করেন,وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ‘আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোনো জায়গায় নিক্ষেপ করল’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩১)। ‘তার রূহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, অতঃপর তার নিকট দুজন ফেরেশতা আসে ও তাকে বসায়, তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার রব কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। অতঃপর তারা বলে, তোমার দ্বীন কী? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। অতঃপর তারা বলে, এ ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। অতঃপর আসমান থেকে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে যে, সে মিথ্যা বলেছে, তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও, তার দরজা জাহান্নামের দিকে খুলে দাও। ফলে তার নিকট তার তাপ ও বিষ আসবে এবং তার ওপর তার কবরকে এমন সংকীর্ণ করা হবে যে, তার পাঁজরের হাড় একটির মধ্যে অপরটি ঢুকে যাবে। অতঃপর তার নিকট বীভৎস চেহারা, খারাপ পোশাক ও দুর্গন্ধসহ এক ব্যক্তি আসবে, সে তাকে বলবে, তোমাকে দুঃখ দিবে এমন বিষয়ের সুসংবাদ গ্রহণ করো, এটা হচ্ছে তোমার ঐ দিন, যার ওয়াদা তোমাকে করা হতো। সে বলবে, তুমি কে? তোমার এমন চেহারা কেবল অনিষ্টই নিয়ে আসে? সে বলবে, আমি তোমার খবীছ আমল (অসৎকর্ম)। সে বলবে, হে রব! ক্বিয়ামত ক্বায়েম করো না।[2]
উক্ত হাদীছে আখেরাতের প্রথম মনযিল কবরে মুমিন ব্যক্তির শান্তি ও কাফের ব্যক্তির শাস্তির ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়াবী জীবনে আমরা সৎকাজ করার ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
উম্মে আয়মান
পলাশী, রাজশাহী।
[1]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২৬৭, হাদীছ হাসান।
[2]. আহমাদ, হা/১৮৫৫৭; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৫৩, হাদীছটি ছহীহ।