কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

পাঠশালায় একদিন...

post title will place here

আমরা তো পাঠশালায় গিয়ে কত দুষ্টুমি করি, খেলাধুলা করি, হৈ-হুল্লোড় করি। ক্লাস ফাঁকা পেলেই গালগল্প জুড়ে দিই। শিক্ষক ক্লাসে আসার পরও তার চোখ ফাঁকি দিয়ে কতশত দুষ্টুমি করি। যেগুলো কেউ হয়তো জানতেও পারে না। শিক্ষক বারবার বলেন, মনোযোগ দিয়ে বই ধরতে; কিন্তু আমরা পাশের জনের সাথে চুপিসারে গল্প করতে মজে থাকি। কে শোনে কার কথা? আবার কখনো যদি শিক্ষক বলেন, আজকে অনেক পড়াব, কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না; তখন আমরা বারবার প্রশ্ন করে শিক্ষকের পড়ানোর গতি মন্থর করে দিই। শিক্ষক আমাদের এসব দুষ্টুমি ধরে ফেলার পরও কখনো ছাড় দেন, আবার কখনো ভালোবাসা মিশানো হালকা করে বকা দিয়ে আবার পড়ানো শুরু করেন। আবার কখনো কখনো অজানাকে জানার জন্য আমাদের মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে, যার কারণে শিক্ষকের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বারবার প্রশ্ন করে বসি, ভুলে যাই শিক্ষকের নিষেধাজ্ঞার কথা। 

বন্ধুরা চলো, এরকমই একটি গল্প শুনে আসি আজকে। গল্পটি অনেক পুরোনো হলেও বেশ মজার। শিক্ষক তার ছাত্রকে বারবার করে বলে দিলেন যে, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না; কিন্তু না, ছাত্রের সে কথা মনেই থাকে না। যার কারণে বারবার প্রশ্ন করে বসে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষক কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ছাত্রের ব্যাপারে? চলো! আমরা শুনে আসি আমাদের প্রিয় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিঃসৃত বাণী থেকেই।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘বনী ইসরাঈলের জনগণের সামনে মূসা আলাইহিস সালাম একদিন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ান। তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, মানুষের মাঝে কে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী? তিনি জবাব দেন, আমি সবচেয়ে বড় জ্ঞানী। এতে আল্লাহ তাআলা তাকে তিরস্কার করেন। কেননা তিনি জ্ঞানকে আল্লাহ তাআলার দিকে সম্পৃক্ত করেননি।

তখন আল্লাহ তাআলা তার নিকট অহী পাঠান, দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে আমার এক বান্দা আছে, যিনি তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। 

মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি কী উপায়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করব? আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি ঝুড়িতে একটি মাছ নাও। মাছটি যেখানে হারিয়ে ফেলবে, তিনি সেখানেই আছেন।

অতএব, তিনি রওনা হলেন এবং তার সাথে এক যুবক রওনা হলেন, তার নাম ইউশা ইবনু নূন। মূসা আলাইহিস সালাম ঝুড়ির মধ্যে একটি মাছ ভরে নিলেন। অতঃপর মূসা আলাইহিস সালাম ও সেই যুবক পায়ে হেঁটে রওনা দেন। অতঃপর তারা প্রকাণ্ড এক পাথরের নিকট আসেন এবং এখানে মূসা আলাইহিস সালাম ও যুবক দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় ঝুড়ির মধ্যকার মাছটি নড়াচড়া করে ঝুড়ির বাইরে এসে সমুদ্রের পানিতে পতিত হয়’। 

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মাছ থেকে পানির স্রোতধারা বন্ধ করে দেন। ফলে তা টানেলের মতো হয়ে যায় এবং মাছটির জন্য এভাবে একটি পথের ব্যবস্থা হলো। মূসা আলাইহিস সালাম ও যুবকের নিকট এটা খুবই আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল। অতঃপর তারা সেই পুরো দিন ও রাত পথ চলেন। মূসা আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গী মাছের বৃত্তান্ত সম্পর্কে তাকে জানাতে ভুলে যান। ভোর হলে মূসা আলাইহিস সালাম তার সঙ্গীকে বললেন, আমাদের সকালের খাবার নিয়ে আসো। আমাদের এই সফরে আমরা অনেক ক্লান্তির মুখোমুখি হয়েছি’ (আল-কাহফ, ১৮/৬২)

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তাদেরকে যে স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই স্থান অতিক্রম না করা পর্যন্ত তারা ক্লান্ত হননি’।

‘যুবক বললেন, আপনি দেখেছেন কি আমরা যখন সেই প্রস্তরের নিকট আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন মাছটি বিস্ময়করভাবে সাগরে তার পথ গ্রহণ করে নিয়েছে। আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম আর এটি স্মরণ করতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আমরা তো এটাই অন্বেষণ করছি’ (আল-কাহফ, ১৮/৬৪)। তারপর তারা দুজনেই তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে ফিরে আসেন’। 

সুফিয়ান ছাওরী রাহিমাহুল্লাহবলেন, লোকজন মনে করেন যে, সেই পাথরের নিকট আবে হায়াতের ঝরনা রয়েছে, সেই পানি মৃত কোনো কিছুকে স্পর্শ করলে তা জীবিত হয়ে যায়। তিনি বলেন, সেই মাছের কিছু অংশ খাওয়া হয়েছিল, অতঃপর যখন সেটার উপর আবে হায়াতের পানির ফোঁটা পড়ে, তখন সেটি জীবিত হয়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তারা উভয়ে তাদের পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে পাথরের নিকট এসে পৌঁছান, অতঃপর সেখানে তারা চাদরে আবৃত এক ব্যক্তিকে দেখতে পান। মূসা আলাইহিস সালাম তাকে সালাম দিলেন। তিনি বললেন, আপনার যমীনে কি এই সালামের প্রচলন রয়েছে? তিনি বললেন, আমি মূসা। 

তিনি প্রশ্ন করলেন, বনী ইসরাঈলের মূসা? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে মূসা! নিশ্চয়ই আপনার নিকট আল্লাহ তাআলার এমন ইলম রয়েছে, যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই আর আল্লাহ তাআলা আমাকেও ইলম শিক্ষা দিয়েছেন, যা আপনি জানেন না। 

‘মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনাকে যে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তা শেখার উদ্দেশ্যে কি আমি আপনার সাথে থাকতে পারি? তিনি বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেন না আর যে বিষয়ে আপনার কিছুই জানা নেই, সে বিষয়ে আপনি কীভাবে ধৈর্য ধারণ করবেন? তিনি বললেন, আল্লাহ চান তো, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন আর আমি আপনার কোনো ব্যাপারেই বিরোধিতা করব না’ (আল-কাহফ, ১৮/৬৬-৬৯)

খাযির আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, ‘আপনি যদি আমার সাথে চলতে চান, তবে আপনি আমার নিকট কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না, যতক্ষণ না আমি আপনাকে নিজের থেকে তা বর্ণনা করি’ (আল-কাহফ, ১৮/৭০)। তিনি (মূসা) বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে।

খাযির ও মূসা আলাইহিমাস সালাম সমুদ্রের তীর ধরে পায়ে হাঁটতে থাকলেন। তাদের পাশ দিয়ে একটি নৌকা অতিক্রম করছিল। তারা উভয়ে তাদের সাথে কথা বলেন এবং তাদেরকে নৌকায় তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তারা খাযিরকে চিনে ফেলল এবং কোনো ভাড়া ছাড়াই তাদের দুজনকে নৌকায় তুলে নিল। খাযির নৌকার একটি তক্তা খুলে নিলেন। 

তখন মূসা আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, ‘তারা আমাদেরকে ভাড়া ছাড়াই নৌকায় তুলে নিল আর আপনি নৌকাটির একটি তক্তা খুলে ফেললেন, যাতে আপনি তাদেরকে ডুবিয়ে দিতে পারেন। আপনি তো একটি ন্যক্কারজনক কাজ করলেন! 

খাযির বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না? মূসা বললেন, আমার ভুলে যাওয়ার জন্য আপনি আমাকে পাকড়াও করবেন না। আমার ব্যাপারটিকে আপনি কঠিন করে ফেলবেন না’ (আল-কাহফ, ১৮/৭১-৭৩)

তারা নৌকা হতে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে চলছিলেন, এসময় তারা এক বালককে দেখতে পান, যে অন্য বালকদের সাথে খেলাধুলা করছে। খাযির আলাইহিস সালাম ছেলেটির মাথা হাত দিয়ে ধরে তা ছিন্ন করে দিলেন এবং তাকে হত্যা করলেন। মূসা আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, একটা নিষ্পাপ বালককে আপনি মেরে ফেললেন! অথচ সে তো কাউকে হত্যা করেনি? আপনি তো বড় অন্যায় কাজ করলেন! খাযির বললেন, আমি কি আপনাকে বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না?’ (আল-কাহফ, ১৮/৭৪-৭৫)

বর্ণনাকারী বলেন, পূর্বের কথার চেয়ে এ কথাটা বেশি শক্ত ছিল। মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, ‘অতঃপর আমি যদি আপনার নিকট কোনো প্রশ্ন করি, তাহলে আপনি আমাকে আর সঙ্গে রাখবেন না। আমার পক্ষ থেকে আপনার কাছে ওযর পৌঁছেছে। পুনরায় তারা রওনা দেন, অতঃপর তারা এক জনপদের অধিবাসীর কাছে আসেন এবং সেখানকার মানুষদের নিকট খাবার চান। কিন্তু তারা মেহমান হিসেবে তাদের মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অতঃপর তারা সেখানে একটি দেয়াল দেখতে পান, যা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল’ (আল-কাহফ, ১৮/৭৬-৭৭)। বর্ণনাকারী বলেন, দেয়ালটি ঝুঁকে পড়েছিল। খাযির আলাইহিস সালাম হাত দিয়ে এরকম করেন। অতঃপর তিনি তা ঠিক করে দেন। 

মূসা আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, আমরা এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট আসলাম, যারা আমাদেরকে মেহমান হিসেবেও গ্রহণ করেনি এবং আমাদেরকে খেতেও দেয়নি। আপনি ইচ্ছা করলে এই কাজের জন্য অবশ্যই মজুরি নিতে পারতেন। 

খাযির বললেন, এটাই আপনার ও আমার বিচ্ছেদ (এর সময়)। আপনি যেসব বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, অচিরেই আমি আপনাকে সেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা বলে দিব’ (আল-কাহফ, ১৮/৭৭-৭৮)। 

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম-এর উপর রহম করুন। আমাদের আশা হয় যে, যদি তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন; তাহলে তাদের আরও কিছু বৃত্তান্ত তিনি বর্ণনা করতেন’। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মূসা আলাইহিস সালাম শর্তের কথা ভুলে যাওয়ার কারণেই প্রথম প্রশ্নটি করেছেন। তিনি বলেন, একটি চড়ুই পাখি এসে তাদের নৌকার কিনারে বসে, তারপর তা সমুদ্রে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। 

তখন খাযির তাকে (মূসা আলাইহিস সালাম-কে) বললেন, এই চড়ুই পাখি সমুদ্রের পানি যতটুকু কমিয়েছে আমার ও আপনার জ্ঞান আল্লাহ তাআলার জ্ঞানভাণ্ডার হতে ততটুকুই কমিয়েছে’।[1]

মূসা আলাইহিস সালাম খাযির আলাইহিস সালাম-কে যে প্রশ্ন করেছিলেন, সেগুলোর ব্যাখ্যা হলো- নৌকাটি কিছু দরিদ্র ব্যক্তির ছিল, তারা সাগরে কাজ করত, আমি ইচ্ছা করলাম নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করতে। কারণ তাদের সামনে ছিল এক রাজা, যে বলপ্রয়োগ করে প্রত্যেকটি (ভালো) নৌকা ছিনিয়ে নিত’ (আল-কাহফ, ১৮/৭৯)

আর কিশোরটির পিতামাতা ছিল মুমিন। অতঃপর আমরা আশঙ্কা করলাম যে, সে সীমালঙ্ঘন ও কুফরীর দ্বারা তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। তাই আমরা চাইলাম যে, তাদের রব যেন তাদেরকে তার পরিবর্তে এক সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় উত্তম ও দয়া-মায়ায় ঘনিষ্ঠতর’ (আল-কাহফ, ১৮/৮০-৮১)

আর ঐ প্রাচীরটি ছিল নগরবাসী দুই ইয়াতীম কিশোরের এবং এর নিচে আছে তাদের গুপ্তধন। তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। কাজেই আপনার প্রতিপালক চাইলেন যে, তারা পরিণত বয়সে পৌঁছাক এবং তাদের গুপ্তধন নিজেরাই বের করুক। এটা আপনার প্রভুর দয়া আর আমি নিজ থেকে কিছু করিনি। এটা হলো সেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা, যাতে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি’ (আল-কাহফ, ১৮/৪২)


শিক্ষা:

১. নিজেকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী মনে না করা। 

২. প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে জানা না থাকলে ‘আল্লাহু আ‘লাম’ বা আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন বলা। 

৩. ব্যক্তি যতই সৎ হোক না কেন ভুলে যাওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়।

৪. ব্যক্তি যতই জ্ঞানী হোক তারপরও আরও বেশি জ্ঞানার্জন করা মুস্তাহাব।

৫. মাদরাসায় ছাত্র ভর্তি নেওয়ার সময় তার থেকে অঙ্গীকার নেওয়া বৈধ।

৬. সফরে কাউকে সঙ্গী হিসেবে নেওয়া মুস্তাহাব। যেমন- মূসা আলাইহিস সালাম ইউশা আলাইহিস সালাম-কে সাথী হিসেবে নিয়েছিলেন।

৭. সঠিক জ্ঞানার্জনের জন্য যদি কোনো দূর দেশে ভ্রমণ করতে হয়, তবে তা-ই করতে হবে। 

৮. শিক্ষকের সাথে ভদ্রতা বজায় রাখা। কখনো ভুল বা বেয়াদবী হয়ে গেলে মাফ চেয়ে নেওয়া।

৯. কেউ মেহমান হলে তাকে আপ্যায়ন করানো ওয়াজিব।

১০. কোনো বিষয় বাহ্যিকভাবে দেখেই হুকুম না দেওয়া, বরং রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা।

* কুল্লিয়া ২য় বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪০১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬০৫৭; তিরমিযী, হা/৩১৪৯।

Magazine