আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সালমান আল-ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজে তার কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমি একজন পারসিক ছিলাম। আমার জন্মস্থান ছিল ইস্পাহানের অন্তর্ভুক্ত ‘জাই’ নামক গ্রাম। আমার পিতা ছিলেন গ্রামের সরদার। আর আমি তার নিকট ছিলাম আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়। আমার প্রতি তার ভালোবাসা এরূপ ছিল যে, তিনি সবসময় আমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে রাখতেন। অর্থাৎ (পূজার) আগুনের তত্ত্বাবধায়ক করে রাখতেন। যেমন কোনো বাদীকে আটকিয়ে রাখা হয় (তেমন আমাকে আবদ্ধ করে রাখতেন)। এতে করে আমি অগ্নিপূজায় খুবই মনোযোগী হলাম এবং এক পর্যায়ে আগুনের এমন খাদেম বনে গেলাম যে, মুহূর্তের জন্যও আগুন নিভতে দিতাম না। সেই সাথে আমার পিতার ছিল অঢেল ভূ-সম্পত্তি।
তিনি একদিন তার একটি গৃহ নির্মাণে ব্যস্ত হলেন এবং আমাকে বললেন, হে বৎস! আমি বর্তমানে আমার খামারে একটি গৃহ নির্মাণ করছি, তুমি যাও এবং তা দেখাশুনা করো। সেখানে তিনি যা করতে চান, সে বিষয়ে আমাকে নির্দেশনা দিলেন। অতঃপর আমি তার খামারের দিকে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে আমি খ্রীস্টানদের কোনো এক গির্জার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানে তারা ছালাত আদায় করছিল। আমি তাদের আওয়ায শুনতে পেলাম। মূলত আমার পিতা আমাকে গৃহবন্দী করে রাখার কারণে মানুষের চাল-চরিত্র সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। তাই যখন তাদের আওয়ায শুনতে পেলাম, তখন তাদের কর্মকা- দেখার জন্য আমি তাদের নিকট গেলাম। অতঃপর তাদের ছালাত দেখে আমার ভালো লাগল। ফলে আমি তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমাদের ধর্মের চেয়ে এ ধর্মই উত্তম। আল্লাহর কসম! আমি পিতার খামারে যাওয়া বাদ দিয়ে এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করব। আমি তাদের (খ্রীস্টানদের) জিজ্ঞেস করলাম, এ ধর্মের উৎপত্তি কোথায়? তারা বলল, সিরিয়ায়। তিনি বলেন, এরপর আমি আমার বাবার নিকট ফিরে এলাম। ইতোমধ্যে তিনি আমাকে খোঁজার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন এবং আমার কারণে তিনি সবকাজ থেকে বিরত ছিলেন। আমি আসার সাথে সাথে তিনি বলেন, হে বৎস! তুমি কোথায় ছিলে? আমি তোমাকে যে দায়িত্ব দেওয়ার, সেটা কি দেইনি? আমি বললাম, হে আববা! আমি কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যারা গির্জায় ছালাত আদায় করছিল। তাদের ধর্মাচরণ আমার খুবই ভালো লেগেছে। আল্লাহর কসম! আমি সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের নিকট অবস্থান করেছি। তিনি বললেন, হে বৎস! ঐ ধর্মের মধ্যে কোনো মঙ্গল নেই। তোমার ও তোমার বাপ-দাদার ধর্ম তার চেয়ে অধিক উত্তম। আমি বললাম, না, আল্লাহর কসম! কখনও তা নয়, ঐ ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর তিনি আমাকে ভয় দেখালেন এবং পায়ে বেড়ি পরিয়ে আমাকে বাড়ীতেই বন্দী করে রাখলেন। আমি খ্রীস্টানদের নিকট সংবাদ পাঠালাম যে, যখন তোমাদের নিকট শামের খ্রীস্টান ব্যবসায়ী কাফেলা আসবে, তখন তোমরা আমাকে জানাবে। তিনি বলেন, (কিছুদিন পর) তাদের নিকট শামের এক খ্রীস্টান ব্যবসায়ী কাফেলা আসে। অতঃপর তারা আমাকে সংবাদ প্রদান করে। আমি তাদের বললাম, যখন তারা তাদের প্রয়োজনাদি সেরে ফেলবে এবং দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে, তখন আমাকে জানাবে। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন তারা তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করল, তখন আমাকে সংবাদ দিল। অতঃপর আমি আমার পা থেকে বেড়ি খুলে ফেললাম এবং তাদের সাথে সিরিয়ার পথে যাত্রা করলাম।
সিরিয়া পৌঁছার পর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের মধ্যে এ ধর্মের ব্যাপারে সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি কে? তারা বলল, গির্জার পাদ্রী। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর আমি পাদ্রীর নিকট গেলাম এবং বললাম, আমি এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। অতএব আমি আপনার সাহচর্য লাভ করে গির্জাতেই আপনার খিদমত করতে চাই, আপনার নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই এবং আপনার সাথে ছালাত আদায় করতে চাই। অতঃপর তিনি (পাদ্রী) আমাকে গির্জাতে প্রবেশ করতে বললে আমি তার সাথে গির্জায় প্রবেশ করলাম। তিনি বলেন, তিনি অসৎ লোক ছিলেন। মানুষকে তিনি ছাদাক্বাহ দেওয়ার জন্য আদেশ করতেন এবং খুবই উৎসাহিত করতেন। কিন্তু যখন লোকজন তার নিকট (ছাদাক্বার) দ্রব্যাদি জমা দিত, তখন তিনি মিসকীনদের কিছুই না দিয়ে তা নিজের জন্য জমা করে রাখতেন। এভাবে তিনি স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে সাতটি কলস পূর্ণ করেন। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি যখন এরূপ কার্যকলাপ দেখলাম, তখন তার প্রতি ভীষণ ক্রুদ্ধ হলাম। এর কিছুদিন পর তিনি মারা গেলেন। খ্রীস্টানরা তাকে দাফন করার জন্য সমবেত হলো। আমি তাদের বললাম, এ ব্যক্তিটি অসৎ ছিল। তোমাদের সে ছাদাক্বাহ করার আদেশ দিত ও উৎসাহিত করত বটে, কিন্তু যখন তোমরা তাকে সম্পদ দিতে, তখন সে তা নিজের জন্য সঞ্চয় করে রাখত এবং মিসকীনদের তা থেকে কিছুই দিত না। তারা বলল, এ ব্যাপারে তোমার কী জানা আছে? তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, আমি তোমাদের তার সম্পদ সম্পর্কে অবহিত করব। তারা বলল, আমাদের তা জানিয়ে দাও। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি তাদের ঐ লোকটির (সম্পদ গচ্ছিত রাখার) স্থান দেখালাম। তারা সেখান থেকে স্বর্ণ-রৌপ্যপূর্ণ সাতটি কলস বের করল। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তারা তা দেখে বলল, আল্লাহর কসম! আমরা তাকে কখনও দাফন করব না। এরপর তারা তাকে শূলে চড়ালো এবং তার উপর পাথর নিক্ষেপ করল। এরপর এক ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করল।
তিনি (ইবনু আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এমন কোনো ব্যক্তি দেখিনি যে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে সে এ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম। পৃথিবীর মধ্যে আমি এরূপ দুনিয়াত্যাগী, আখিরাতের ব্যাপারে অধিক আগ্রহী এবং দিন-রাত ইবাদতকারী আর কাউকে দেখিনি। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইতোপূর্বে আমি অন্তর থেকে তার চেয়ে বেশি আর কাউকে ভালোবাসিনি। তার নিকট দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলাম। এরপর যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল তখন আমি তাকে বললাম, হে অমুক! আমি আপনার সাথে ছিলাম এবং আপনাকে যেভাবে অন্তর থেকে ভালোবেসেছিলাম ইতোপূর্বে আর কাউকে তেমন ভালোবাসিনি। আর আপনার নিকট আল্লাহর যে আদেশ পৌঁছেছে তা আপনি প্রত্যক্ষ করছেন। এখন কার প্রতি আপনি আমাকে সোপর্দ করছেন এবং আমাকে কী আদেশ করছেন? তিনি বললেন, হে বৎস! আল্লাহর কসম! এখন আমি আমার পথের উপর কাউকে দেখি না। মানুষজন ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ধর্ম পরিবর্তন করেছে। তারা তাদের অনুসৃত ধর্মাচরণের অধিকাংশই ত্যাগ করেছে। তবে মুছেলে (ইরাকের একটি শহর) এক ব্যক্তি আছে, সে অমুক। সে আমার পথে আছে। তুমি তার সাথে মিলিত হও। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর যখন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন এবং তাকে দাফন করা হলো, তখন আমি মুছেলের ব্যক্তিটির নিকট গেলাম। আমি তাকে বললাম, হে জনাব! অমুক ব্যক্তি আমাকে তার মৃত্যুর সময় অছিয়ত করেছেন যে, আমি যেন আপনার সান্নিধ্যে থাকি এবং তিনি আমাকে বলেছেন, আপনি তার পথের উপর আছেন। উত্তরে পাদ্রী বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট অবস্থান করো। আমি তার নিকট অবস্থান করতে লাগলাম। আমি তাকে তার বন্ধুর পথে উত্তম মানুষ হিসাবে পেলাম। তবে কিছুদিন পরে তিনিও মৃত্যুবরণ করলেন। যখন তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসল তখন আমি তাকে বললাম, হে গুরু! অমুক ব্যক্তি আমাকে আপনার নিকট আসার জন্য অছিয়ত করেছিলেন এবং আপনার সান্নিধ্য লাভের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহর পক্ষ হতে আপনার উপর যা উপস্থিত হয়েছে, তা আপনি দেখছেন (অর্থাৎ আপনার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে)। এখন আপনি কার নিকট যাওয়ার জন্য আমাকে অছিয়ত করছেন? আর আমাকে কী করার আদেশ দিচ্ছেন?
তিনি বললেন, হে বৎস! আল্লাহর কসম! আমার জানা মতে নাছীবীনের (একটি শহর) একজন ব্যক্তি আছে। যে আমাদের ধর্মের উপর অটল আছে, সে অমুক। তুমি তার সাথে মিলিত হও। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর যখন তিনি মারা গেলেন এবং তাকে দাফন করা হলো, তখন আমি নাছীবীনের লোকটির সাথে মিলিত হলাম এবং আমার বিষয়ে ও আমার সাথী যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাকে তা বললাম। তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে অবস্থান করো। অতঃপর আমি তার নিকট অবস্থান করলাম এবং তাকে তার সাথীদ্বয়ের মতো সৎ পেলাম। আমি একজন ভালো লোকের সাথে অবস্থান করলাম। আল্লাহর কসম! কিছুদিন যেতে না যেতেই তার মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে গেল।
যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল, তখন আমি তাকে বললাম, হে অমুক! অমুক ব্যক্তি আমাকে অমুক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার অছিয়ত করেছিলেন। অতঃপর অমুক ব্যক্তি আমাকে আপনার কাছে আসার অছিয়ত করেন। এখন আপনি আমাকে কার বিষয়ে অছিয়ত করছেন এবং কী করার নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, হে বৎস! আল্লাহর কসম! একজন ব্যক্তি ব্যতীত আমি আর কাউকে আমাদের সঠিক পথে দেখছি না, যার নিকট যাওয়ার জন্য তোমাকে আদেশ দিব। (ঐ ব্যক্তিটি হল) আম্মারিয়্যাহ-এর বাসিন্দা। তিনি হুবহু আমাদের পথেই রয়েছেন। তুমি চাইলে তার নিকট যেতে পারো। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর যখন তিনি মারা গেলেন এবং দাফন-কাফন করা হলো, তখন আমি আম্মারিয়্যাহ-এর ব্যক্তিটির নিকট গেলাম এবং আমার বৃত্তান্ত তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, তুমি আমার নিকট অবস্থান করো।
অতঃপর আমি তার নিকট অবস্থান করলাম। তিনি তার বন্ধুদের আদর্শ ও ধর্মের উপর ছিলেন। তিনি (সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি কিছু উপার্জনও করেছিলাম। এক পর্যায়ে কিছু গাভী ও বকরীর মালিক হয়ে গেলাম। অতঃপর তার উপর আল্লাহর হুকুম আসল (অর্থাৎ মৃত্যু ঘনিয়ে এলো)। যখন তার মৃত্যু উপস্থিত হলো, তখন আমি তাকে বললাম, হে গুরু! আমি (প্রথমে) অমুকের নিকট ছিলাম। অতঃপর তিনি অমুক ব্যক্তির ব্যাপারে অছিয়ত করেন। অতঃপর অমুক ব্যক্তি আবার অমুকের নিকট (যাওয়ার জন্য) অছিয়ত করেন। অতঃপর অমুক ব্যক্তি আবার আমাকে আপনার নিকট আসার জন্য অছিয়ত করেন। এখন আপনি কার নিকট যাওয়ার জন্য আমাকে অছিয়ত করছেন? আর আপনি আমাকে কী আদেশ করছেন? তিনি বললেন, হে বৎস! আমার জানা মতে এখন আর এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যে আমাদের ধর্মে রয়েছে এবং যার নিকট যাওয়ার জন্য তোমাকে আদেশ করব। তবে শেষ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ধর্মে প্রেরিত হবেন। আরব ভূমিতে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। আর তিনি এমন ভূমির দিকে হিজরত করবেন যা পাথরময় হবে এবং সেখানে খেজুর বৃক্ষ থাকবে। তার কিছু স্পষ্ট নিদর্শন থাকবে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, তবে ছাদাক্বাহ ভক্ষণ করবেন না। তাঁর উভয় কাঁধের মধ্যভাগে নবুঅতের সিলমোহর থাকবে। যদি তোমার ঐ দেশে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে, তবে তুমি যাও। তিনি বলেন, অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন এবং তাকে দাফন-কাফন করা হলো।
আল্লাহ তা‘আলা যতদিন চান, ততদিন আমি আম্মারিয়্যাতে অবস্থান করলাম। অতঃপর আমার নিকট দিয়ে কালব গোত্রের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা যাচ্ছিল। আমি তাদের বললাম, তোমরা আমাকে আরবে নিয়ে চলো। বিনিময়ে আমি তোমাদের এই গাভি ও বকরীগুলো প্রদান করব। তারা বলল, ঠিক আছে। অতঃপর আমি তাদের সেগুলো দিয়ে দিলাম আর তারা আমাকে নিয়ে চলল। যখন তারা আমাকে নিয়ে ‘ওয়াদী আল-কুরা’য় (একটি স্থানের নাম) নিয়ে আসল, তখন তারা আমার প্রতি অত্যাচার করল এবং দাস হিসাবে এক ইয়াহূদী ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করে দিল। ফলে আমি তার নিকট অবস্থান করে খেজুর গাছ দেখাশুনা করতে লাগলাম এবং ভাবলাম, আমার বন্ধু আমাকে যে ভূমির কথা বলেছিলেন, তা মনে হয় এটিই হবে। আমার মনে এমন চিন্তা-চেতনাই চেপে ছিল। আমি তার নিকট অবস্থানকালে বনী কুরায়যার বাসিন্দা, তার (মনিবের) চাচাতো ভাই মদীনা হতে আসল। অতঃপর সে আমাকে তার নিকট থেকে ক্রয় করে মদীনায় নিয়ে আসল। আল্লাহর কসম! মদীনা শহর দেখা মাত্রই আমার বন্ধুর বর্ণনা মতো আমি তাকে চিনে ফেললাম। আমি এখানে অবস্থান করতে লাগলাম। একদিন আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করলেন। তিনি মক্কাতে যতদিন থাকার থাকলেন। আমি গোলামী জীবনে ব্যস্ত থাকায় তার কোনো খবর পেলাম না। অতঃপর তিনি মদীনায় হিজরত করলেন। আল্লাহর কসম! আমি আমার মালিকের খেজুর গাছের মাথায় কাজ করছিলাম। আর আমার মনিব বসে ছিল। ইত্যবসরে তার চাচাত ভাই এলো এবং তার নিকট এসে থামল। অতঃপর সে বলল, হে অমুক! আল্লাহ বনী কায়লাহদের ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম! তারা কুবাতে মক্কা থেকে আজকে আগত এক ব্যক্তির নিকট সমবেত হয়েছে। তারা তাকে নবী বলে ধারণা করছে। তিনি বলেন, এ কথা শুনে আমার মধ্যে কম্পন শুরু হয়ে গেল। এক পর্যায়ে আমি ধারণা করলাম যে, আমি আমার মনিবের উপর পড়ে যাব। অতঃপর আমি খেজুর গাছ থেকে নেমে আসলাম এবং তার চাচাতো ভাইকে বলতে লাগলাম, তুমি কী বলছিলে? তিনি বললেন, আমার মনিব চটে গেলেন এবং আমাকে খুব জোরে আঘাত করলেন এবং বললেন, এ ব্যাপারে তোমার কী হয়েছে? তুমি তোমার কাজে যাও। তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, কিছুই না, আমি শুধু সে যা বলেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাচ্ছি।
তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার নিকট কিছু সম্পদ ছিল যা আমি সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। যখন সন্ধ্যা হলো তখন আমি তা নিয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলাম। তিনি কুবাতে ছিলেন। আমি তার নিকট গিয়ে বললাম, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, আপনি একজন সৎ ব্যক্তি। আর আপনার সাথে আপনার দরিদ্র সাথীরা রয়েছেন। আর এগুলো আমার নিকট ছাদাক্বাহ করার জন্য রয়েছে। আমি এগুলোর ব্যাপারে আপনাদেরকে অধিক হক্বদার বলে মনে করি।
তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এগুলো তার নিকট হাযির করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদের বললেন, ‘তোমরা খাও’। আর তিনি হাত সংযত করলেন এবং কিছুই খেলেন না। তিনি (সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এটি প্রথম আলামত। অতঃপর আমি তার নিকট থেকে চলে আসলাম এবং আরও কিছু দ্রব্য সঞ্চয় করলাম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় চলে আসলেন। এরপর আমি তার নিকট গেলাম এবং বললাম, আমি আপনাকে ছাদাক্বার সম্পদ খেতে দেখিনি আর এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া। যার দ্বারা আমি আপনার মেহমানদারী করলাম। তিনি বলেন, এবার রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলো থেকে খেলেন এবং ছাহাবীদের আদেশ করলে তারাও তার সাথে আহার করলেন। তিনি বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই দু’টি হলো (নবুঅতের) আলামত। অতঃপর ‘বাকীউল গারক্বাদে’ আমি নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম। তখন তিনি তার এক ছাহাবীর জানাযার পিছন পিছন যাচ্ছিলেন। তার পরিধানে দু’টি চাদর ছিল। তিনি তার সাথীদের সাথে বসেছিলেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। অতঃপর আমি তার পিঠের দিকে ঘুরে দেখতে লাগলাম। যেন আমার বন্ধুর বর্ণনা মোতাবেক ঐ মোহরটি দেখতে পাই। যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখলেন যে আমি তার পিছনে ঘুরছি, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাচ্ছি, যা আমার নিকট বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তিনি পিঠ থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন। আমি মোহর দেখতে পেলাম এবং তাকে চিনতে পারলাম (যে ইনিই নবী)। আমি তার উপর ঝুঁকে পড়লাম এবং তাকে চুমু দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘এদিকে এসো’। আমি ঘুরে এলাম এবং তার নিকট আমার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলাম। যেমন আপনার নিকট বর্ণনা করছি হে ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু! তিনি বলেন, এ ঘটনা ছাহাবীদেরও শ্রবণ করাতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পসন্দ করলেন। অতঃপর সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু গোলামীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যার দরুন বদর ও ওহুদ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
তিনি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে সালমান! তুমি (তোমার মালিকের সাথে দাসত্বমুক্তির ব্যাপারে) চুক্তি করো’। আমি তার সাথে তিনশ’ ছোট খেজুর গাছের চারা ফলদায়ক হওয়া পর্যন্ত গর্তে পানি দেওয়া এবং চল্লিশ উকিয়া আদায় করার উপর চুক্তি করলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ছাহাবীগণকে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইকে সাহায্য করো’। তারা আমাকে খেজুর গাছ (চারা) দিয়ে সাহায্য করলেন। এক ব্যক্তি ত্রিশটি চারা দিলেন, আরেকজন বিশটি, অপরজন পনেরটি, আরেকজন দশটি চারা দিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই তার সামর্থ্য অনুযায়ী আমাকে সাহায্য করলেন। এক পর্যায়ে আমার তিনশ’ চারা হয়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে সালমান! তুমি যাও এবং এগুলো রোপণ করার জন্য গর্ত খনন করো, যখন শেষ করবে তখন আমার নিকট আসবে, আমি নিজ হাতে তা রোপণ করব’। অতঃপর আমি গর্ত খনন করলাম। আর এ কাজে তার ছাহাবীগণ আমাকে সাহায্য করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম তখন তার নিকট গিয়ে তাকে সংবাদ দিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সাথে বাগানের দিকে চললেন। আমরা তাকে গাছের চারা দেওয়া শুরু করলাম আর তিনি নিজ হাতে তা রোপণ করতে লাগলেন। ঐ সত্তার কসম! যার হাতে সালমানের প্রাণ! ঐ চারাগুলোর একটিও মারা যায়নি। আমি গাছের চুক্তি আদায় করেছি। এখন আমার উকিয়ার অর্থের চুক্তিটি বাকী ছিল। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কোনো যুদ্ধের গনীমত হতে মুরগীর ডিমের ন্যায় স্বর্ণের এক টুকরা আসলে তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সালমান তার মুকাতাবের (মনিবের) ব্যাপারে কী করেছে? (অর্থাৎ সে মাল আদায় করেছে, না করেনি?) তিনি বলেন, আমাকে ডাকা হলো। অতঃপর তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সালমান এটি নাও এবং তোমার যে ঋণ আছে তা আদায় করো’।
অতঃপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার উপর যে ঋণ আছে, এটা কীভাবে তার বরাবর হবে? তিনি বললেন, ‘এটা নাও, কারণ আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারাই তোমার ঋণ আদায় করে দিবেন’। তিনি বলেন, আমি তা নিলাম এবং তাদের জন্য ওযন করলাম। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে সালমানের প্রাণ! তা চল্লিশ উকিয়া হলো। আমি তাদের হক্ব পূর্ণভাবে আদায় করলাম এবং মুক্তি লাভ করলাম। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে খন্দক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম। তারপর তার সাথে আর কোনো যুদ্ধেই আমি অনুপস্থিত থাকিনি।[1]
শিক্ষা :
১. কারও মনে যদি সত্য সন্ধানের উদগ্র বাসনা থাকে, তাহলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেনই।
২. সত্যের সন্ধানে সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এরূপ ত্যাগ হক্বের পথে চলার জন্য আমাদেরকে কিরূপ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে তা বুঝিয়ে দেয়।
৩. সৎ মানুষের সাহচর্য হক্বের উপর টিকে থাকার জন্য একান্ত যরূরী।
৪. সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, মানুষের জীবনে বিপদ আসবেই। সেজন্য যে কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষকে সম্মিলিতভাবে সাহায্য করতে হবে।
৫. স্বভাবগতভাবে মানুষ ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পিতা-মাতা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাকে বিধর্মীতে পরিণত করে।
৬. আল্লাহভীরু মনীষীদের জীবনী অধ্যয়ন করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়।
৭. সকল বিপদে স্রেফ আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে।
[1]. আহমাদ, হা/২৩৭৮৮, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮৯৪।
