১. মার্চ ফর গাযা: [১২ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার]
ভারতের দারুল উলূম দেওবান্দ, সঊদী আরবের মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের ডান্ডি ইউনিভার্সিটি—তিন দেশ ও দুই মহাদেশের এই তিন প্রতিষ্ঠান আমাকে গ্লোবাল নাগরিক হিসেবে গ্লোবাল চিন্তা করতে অনেক সহযোগিতা করেছে। নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে উম্মাহ চেতনাকে বহন করে সকলের কল্যাণকামিতা এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার চিন্তা সবসময় বহন করার চেষ্টা করি। তবে আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজে এই ধরনের চিন্তা নিয়ে চলাফেরা করলে বহুমুখী বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
উম্মাহ-কেন্দ্রিক চিন্তা থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘরানার আলেম-উলামার সাথে স্বাভাবিক সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করি। গত সরকারের নতুন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের আলেম সমাজ ফুঁসে উঠলে সকল ঘরানার আলেমদের নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ তৈরি হয়। সেই গ্রুপটিতে শুরুতে শুধু শিক্ষাকেন্দ্রিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেও বিগত সরকারের বিদায়ের পর বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেখান থেকে কিছু উদ্যোগ হাতে নেওয়া হলেও সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিল ‘মার্চ ফর গাযা’ আয়োজন করা। ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট’ নাম দিয়ে এমন একটি কাজের বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলে দায়িত্বও বণ্টন করা হয়। বিভিন্ন ঘরানার উলামায়ে কেরামের সাথে যোগাযোগ করে ভিডিও বার্তা নেওয়ার কাজটি শায়খ আহমাদুল্লাহ করেন। প্রশাসনিক অনুমতির বিষয়গুলো সোহাগ ভাই গ্রহণ করেন। মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ, প্রেস রিলিজ, ইমাম ও মুয়াযযিনের কাছে দাওয়াতপত্র ও ঘোষণাপত্র ইত্যাদি কাজের খসড়া তৈরির দায়িত্ব এসে পড়ে আমার উপর। সার্বিকভাবে সবকিছু ফাইনাল করা এবং প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে ফাহিম আব্দুল্লাহ ভাইয়ের উপর। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়।
কাজের শুরুতে অতটা আগ্রহ না থাকলেও শেষের তিন দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। কাজের তুলনায় আমাদের টিম ছিল অনেক ছোট। সবকিছু ছিল এক প্রকার অগোছালো। এই ধরনের ফিল্ড প্রোগ্রাম আয়োজনের অভিজ্ঞতা অনেকের শূন্য। ফলত, বিভিন্ন ডিসিশন নিতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছিল। বিশেষ করে মার্চ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ অভিমুখে হবে নাকি সোহরাওয়ার্দী অভিমুখে হবে, মার্চ কোথায় থেকে শুরু হবে, কয়টা স্টার্টিং পয়েন্ট হবে, স্টার্টিং পয়েন্টগুলোতে কারা থাকবে, মেহমানরা পায়ে হেঁটে যাবেন নাকি ট্রাকে যাবেন, সকল মেহমান কোন স্পটে একত্রিত হবেন ইত্যাদি বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক কঠিন ছিল। সরাসরি কোনো প্রেস ব্রিফিং হবে নাকি শুধু প্রেস রিলিজ যাবে ইত্যাদি ডিসিশনগুলো নিয়েও অনেক দ্বিধা ছিল।
সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পরিবর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে। ৫টি স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে জনগণ আসবে। মেহমানগণ বায়তুল মুকাররমে একত্রিত হবেন, সেখান থেকে ট্রাকে করে মিছিলসহ তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাবেন। সকলের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত ছিল সেখানে কোনো অতিথি বক্তব্য দিবেন না। সকলের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে, যা পাঠ করবেন দৈনিক ‘আমার দেশ’-এর সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান।
অনুষ্ঠানের দিন যোহর ছালাতের পর সকল মেহমানের উপস্থিতিতে বায়তুল মুকাররমের খতীব সাহেব উক্ত সিদ্ধান্তগুলো সকলকে জানান। কারও দ্বিমত না থাকায় সকলে মিলে তারা মসজিদ থেকে বের হতে শুরু করেন। তবে ততক্ষণে বাহিরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে ছিল। লাখো জনতার উপচে পড়া ভিড়ে সকল নিয়ন্ত্রণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বায়তুল মুকাররম থেকে বের হতেই জনস্রোতে সকল পরিপল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। শুরুতে কেউ আর ট্রাকে না উঠে পায়ে হেঁটে মিছিল শুরু করেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশ্যে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমও ভেঙে পড়ে। ফলত, রাস্তার মধ্যে প্রচুর গাড়িও আটকা পড়ে যায়। যদিও স্বেচ্ছাসেবকগণ গাড়িগুলোকে আলাদা রাস্তা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। তবে জনস্রোতের তুলনায় সেই চেষ্টা ছিল নস্যি।
আমিও আমার জীবনে প্রথমবার এত ভিড় ঠেলে কোথাও যাচ্ছিলাম। খতীব সাহেব খাটো মানুষ হওয়ায় এবং তার পায়ের স্যান্ডেলও অনুপযোগী হওয়ায় তার অবস্থা ছিল খুব শোচনীয়। লাখো মানুষের ভিড় ঠেলে সোহরাওয়ার্দী পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের দেড় ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের পর। সেখানে জনতার চাপ ও ভিড় আরও বেড়ে যাওয়ায় এবং মাত্রাতিরিক্ত ধুলা চোখে-মুখে প্রবেশ করায় একদিকে যেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল, ঠিক তেমনি সবকিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখা যাচ্ছিল। রাস্তায় স্বেচ্ছাসেবকগণের ব্যারিকেড যতটুকু ছিল উদ্যানে প্রবেশের পরে সেটিও ভেঙে পড়ে। আমার সাথে শেষ পর্যন্ত ‘আদ-দাওয়াহ ইলাল্লহ’-এর চারজন কর্মী রিফাত, মুরসালিন, মাহফুজ ও আসিফ ছিল। তাদের সহযোগিতায় কোনোমতে স্টেজ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হই। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় স্টেজে পৌঁছে আমি অন্যান্য মেহমানদের খুঁজতে লাগলাম তারা ঠিকমতো পৌঁছেছেন কি-না।
ধীরে ধীরে অন্যান্য মেহমানগণও পৌঁছতে লাগলেন। মূল মেহমানগণ উপস্থিত হয়ে যাওয়াতে অনুষ্ঠান শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে যেহেতু সকলের অবস্থা ছিল এক প্রকার বিধ্বস্ত, ফলত স্টেজ পরিচালনায় সবকিছু এলোমেলো হতে থাকে। কুরআন তেলাওয়াতের পর একটি ডকুমেন্টারি দেখানোর কথা ছিল, কিন্তু মানুষের অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সেটিও বন্ধ করে দিতে হয়। স্টেজের ডান দিক থেকে জনগণের চাপে ব্যারিকেড ভেঙে যেতে থাকে। পরিস্থিতির হতবিহ্বলতায় মেহমানদের তালিকা ধরে স্টেজে উঠানো যায়নি। পরিচিত ও সামনে বসা চেহারা দেখে ডাকা হয়েছে। অতঃপর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি ঘোষণাপত্র পাঠের ঘোষণাটি দিয়ে দিই। ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক তার ঘোষণাপত্র পাঠ শুরু করেন। চারিদিক থেকে মানুষ স্রোতের মতো ভেঙে স্টেজের দিকে আসতে থাকে। ঘোষণাপত্র পাঠ শেষ হলে আমি স্টেজ থেকে নেমে যাই। স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় কিছু অসুস্থ রোগীর দায়িত্বে নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নিয়ে ভিড় থেকে বের হতে সক্ষম হই।
অনুষ্ঠানের বিশালতা ও ব্যাপকতায় আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে যাই। পরদিন থেকে ভারত, আমেরিকা এমনকি ইসরাঈলসহ সমগ্র বিশ্বের লিডিং পত্রিকাগুলোতে এই সমাবেশের নিউজ আসতে থাকে। সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গাটি হচ্ছে, ঘোষণাপত্রে অনেকটা জোর করেই আমি বাংলাদেশের দ্বিতীয় গাযা হওয়ার আশঙ্কাটি যুক্ত করেছিলাম এবং এই সমাবেশ থেকে ভারত সরকারের কাছেও একটি বার্তা দেওয়ার চিন্তা মাথায় ছিল। আল-হামদুলিল্লাহ, সেই চিন্তাটি খুবই সফলভাবে কাজে দিয়েছে। সবগুলো মিডিয়া এমনকি ভারতীয় মিডিয়াও খুব ফলাও করে প্রচার করেছে যে, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তা ও ওয়াকফ আইন ইত্যাদি নিয়ে মার্চ ফর গাযা সমাবেশ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এই বিষয়টি আমাকে অনেক মানসিক তৃপ্তি দিয়েছে। মনে হয়েছে আমি একটি সফল অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। এই দিকে অনুষ্ঠানের পরের দিনই জানতে পারি বাংলাদেশ সরকার পুনরায় পাসপোর্টে ‘ইসরাঈল ব্যতীত’ (Except Israel) বিষয়টি বহাল করেছে, আল-হামদুলিল্লাহ।
উক্ত অনুষ্ঠানের অকল্পনীয় সফলতা বাংলাদেশ, ভারত ও সমগ্র বিশ্বে পজিটিভ মেসেজ দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো সময় দেশের স্বার্থে ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে একতাবদ্ধ হতে পারে তার অন্যতম একটি প্রমাণ এই অনুষ্ঠানটি।
২. কেরানীগঞ্জ আল-ওয়ালিদাইন মসজিদ সফর: [১১ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার]
এদিকে ‘মার্চ ফর গাযা’র প্রস্তুতি চলমান থাকা অবস্থাতেই কয়েকটি বেদনাদায়ক সংবাদ আসে। কেরানীগঞ্জের একটি পুরাতন আহলেহাদীছ মসজিদ ‘আল-ওয়ালিদাইন জামে মসজিদ’-এ হামলা করে দখল করে নেওয়া হয়েছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ হাফিযাহুল্লাহ-এর একটি ইসলামী প্রোগ্রামের আয়োজন করেছিলেন। তাতেই যত রাগ একদল নামধারী মুসলিমের। তারা এই প্রোগ্রাম বন্ধ করার জন্য সকল সীমা অতিক্রম করে মসজিদটিই দখল করে নেয়। পরবর্তীতে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও বংশালের ইসহাক ভাইয়ের সহযোগিতায় মসজিদটি উদ্ধার করা হয়। একদিকে আহলেহাদীছ মসজিদ অন্যদিকে আব্বুর প্রোগ্রাম আয়োজন করতে গিয়ে এই অবস্থা হওয়ায় আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল। এইজন্য মার্চ ফর গাযা আয়োজনের এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি সেখানে জুমআর খুৎবা দিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই আমাদের ‘আদ-দাওয়াহ ইলাল্লহ’-এর দায়িত্বশীলরা জানাচ্ছিলেন, সেখানে খুৎবা দিতে নিষেধ করেছে স্থানীয় থানা প্রশাসন। দ্রুত বিষয়টি বাতিল করে জনগণকে জানাতে হবে। ‘মার্চ ফর গাযা’ আয়োজনের মিটিংয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকায় আমি এই মেসেজটি রিসিভ করতে পারিনি। শুক্রবার (১১ এপ্রিল) সকালে এই মেসেজ দেখে আমি সরাসরি ওখানকার ভাইদের সাথে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে সব বিষয় খুলে বললে আমি তাদেরকে উক্ত মসজিদেই জুমআর খুৎবা দেওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করি। সেখানে পৌঁছলে রাস্তাতেই মাশাইল সালাফিয়া মাদরাসার দায়িত্বশীল ভাইগণ আমাকে রিসিভ করেন। তারা বলেন, সকল দ্বীনী ভাই তাদের মাদরাসায় অপেক্ষা করছেন। আমি যেন সেখানেই খুৎবা দিই। হামলা হওয়া মসজিদে খুৎবা দিলে অনেক ঝামেলা হবে। প্রশাসন থেকে নাকি শক্তভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী মাদরাসাগুলোতে নাকি লাঠিসোঁটা জমা করা হচ্ছে। আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক খুৎবা দিলে তারা সবকিছু নিয়ে হামলা করবে। আমি তাদেরকে বললাম, উক্ত মসজিদে যদি আজ একজন ব্যক্তিও ছালাত আদায় না করে তবুও আমি একাই সেখানে খুৎবা দিব। আপনাদের কোনো দায়িত্ব নাই, সব দায়িত্ব আমার নিজের উপর। এইভাবে এক প্রকার জোরপূর্বক আমি আল-ওয়ালিদাইন মসজিদে পৌঁছি। সেখানকার ভাইয়েরা এবং মা-বোনেরা আমাকে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আমি তাদের চোখের কান্নামিশ্রিত ভালোবাসা ও মুখের তাকবীর ধ্বনি শুনে মনে মনে ভাবি, তাদের এই ভালোবাসার জন্য আমি জীবনও দিতে পারি, ইনশা-আল্লাহ।
উপস্থিতিদেরকে মসজিদে বসিয়ে তাদের মুখ থেকে কিছু কথা শোনার চেষ্টা করি। তাদের দাবি অনুযায়ী, থানা থেকে নাকি তাদেরকে এমন হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, আজ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক এখানে খুৎবা দিলে কোনো মসজিদের ইমামের চাকরি থাকবে না; সবাইকে গ্রেফতার করা হবে। আমি তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘোষণা করি, আজ যদি এখানে কোনো হামলা হয়, তাহলে আপনাদেরকে আমাকে রক্ষা করতে হবে না। আমি নিজেই সবার সামনে গিয়ে মার খাব; আমার লাশের উপর দিয়ে আপনাদেরকে মারতে আসতে হবে। আর যদি প্রশাসন কাউকে গ্রেফতার করতে আসে, তাহলে আমি সবার পক্ষ থেকে সকল দায় স্বীকার করে নিয়ে আমিই গ্রেফতার হয়ে যাব; আপনারা চিন্তা করবেন না। কেননা আজকের খুৎবার জন্য আপনারা দায়ী নন; আমি নিজেই দায়ী। এভাবে তাদেরকে আশ্বস্ত করলে তারা অনেকটা চিন্তামুক্ত হয় এবং খুশিতে তারা বলতে থাকে, তারা ও তাদের বাড়ির মহিলারা সবাই জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে।
জুমআর খুৎবা শুরুর কিছুক্ষণ পূর্বে সিভিল ড্রেসে একজন প্রশাসনের লোক সাক্ষাৎ করলেন আমার সাথে। তিনি আমাকে জানালেন, তারা দুই গাড়ি পুলিশ ফোর্সসহ মসজিদে উপস্থিত হয়েছেন। আমি নিশ্চিন্তে খুৎবা দিতে পারি। কোনো সমস্যা হলে তারা হেল্প করবে। আমি প্রশাসনের এই সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখে যারপরনাই আশ্চর্য হলাম। কেননা স্থানীয় দ্বীনী ভাইদের বক্তব্য ও প্রশাসনের ভূমিকা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গেল। মহান আল্লাহ যা করেন, কল্যাণের জন্যই করেন।
জুমআর খুৎবায় ‘আছহাবুল উখদূদ’-এর ঘটনা তুলে ধরলাম। আল্লাহর উপর ভরসা ও ধৈর্যধারণ বিষয়ে উপদেশ দিলাম। খুৎবা শেষে গ্রামের নারী-পুরুষের আনন্দের বন্যা দেখলাম। তাদের চোখে-মুখের এই নির্ভেজাল আনন্দ আমাকে চিরদিনের জন্য তাদের কাছে ঋণী করে দিয়েছে। সেখান থেকে ফিরে পুনরায় ‘মার্চ ফর গাযা’র কাজে যুক্ত হয়ে যাই এবং পরেরদিন শনিবার (১২ এপ্রিল) মার্চ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সর্বদা সক্রিয় ছিলাম, ফালিল্লাহিল হামদ!
৩. ব্রাহ্মণবাড়িয়া বায়তুল মামূর মসজিদ সফর: [১৭ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার]
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে জেদ্দার বিভিন্ন দাওয়া সেন্টারে দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণের সুবাদে সাঈদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তার প্রতিষ্ঠিত ‘কুরআন ও সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’ ব্যাপক কাজ করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। কুরআন ও সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের দাওয়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাওয়া হয়েছে। এমনকি মক্তব-কেন্দ্রিক একটি ধারাবাহিক সফরও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আয়োজিত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার খবরটি অতি দ্রুততার সাথে আমার কানে পৌঁছে। আমি দেরি না করে সাথে সাথে উক্ত মসজিদটি দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তবে তার পূর্বে প্রশাসনের অবস্থা ও হেফাজত ইসলামের ভূমিকা জেনে নেওয়া জরুরী ছিল। সেই সুবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলে নিই এবং ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’-এর মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের সাথে কথা বলি। তাদের দেওয়া সময় অনুযায়ী, ১৬ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টার দিকে রাজশাহী থেকে রওয়ানা দিই। আমরা সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছে যাই। সেখানে হালকা বিশ্রাম ও নাশতা শেষে সর্বপ্রথম ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’-এর মহাসচিব মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান সাহেবের সাথে সাক্ষাতের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে বড় মাদরাসা জামিয়া ইউনুসিয়াতে যাই। সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ একটি মিটিং হয়। সেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গমন করি। পুলিশ সুপার একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। টাখনুর উপর কাপড়। শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল। নির্ধারিত কোনো দিবসের কোনো শিরকী কর্মকাণ্ডে তিনি যুক্ত হন না। শহীদ মিনারে ফুল না দেওয়ায় তাকে নিয়ে বিভিন্ন দৈনিকে সংবাদও প্রকাশিত হয়। তিনি অত্যন্ত আন্তরিক ও উদার ব্যবহারের পরিচয় দিলেন। তার সাথে পরামর্শ করে সরাসরি পাঘাচংয়ে মসজিদের স্পটে চলে যাই। সেখানে সকলকে সাথে নিয়ে মসজিদের জায়গায় প্রকাশ্যে যোহরের ছালাত আদায় করি। ছালাত শেষে সংক্ষিপ্ত নছীহতমূলক কথা বলি। তারপর পার্শ্ববর্তী যে মাদরাসা থেকে উস্কানির তথ্য পাওয়া গেছে সরাসরি সেই মাদরাসায় গমন করি। সেখানে মাদরাসার কিছু মুরুব্বি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত থাকলেও অন্যরা পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছেন এবং সম্মানের সাথে আমাদেরকে আপ্যায়ন করেছেন, কথা বলেছেন। সেখান থেকে বের হয়ে পুনরায় হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান সাহেবের দারুল আরকাম মাদরাসায় গমন করি। সেখানে তার সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ শেষে মাগরিব ছালাত পড়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।
পরিশেষে সকলের উদ্দেশ্যে আমরা বলতে চাই, ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মতভেদ থাকবে, তবে ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করা যাবে না। পাকিস্তানে বিভিন্ন ফেরক্বার মধ্যে মতবিরোধ এতটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে যে, আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে বিভিন্ন ফেরক্বার আলেমদের হত্যা করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশকে বাঁচাতে চাইলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের মাতৃভূমিকে হেফাযত করুন- আমীন!
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক*
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।