সফরকালে আল্লামা ইবতিসাম ইলাহী যহীরের বিভিন্ন স্মৃতি চারণ ও মন্তব্য:
বাংলাদেশের প্রতি তার পিতা আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর রাহিমাহুল্লাহ-এর অনেক ভালোবাসা ছিল। যে বছরে বাংলাদেশের জন্ম হয় ঠিক সেই বছরেই আল্লামা ইবতিসাম ইলাহী যহীর হাফিযাহুল্লাহ-এর জন্ম হয়। সেই বছর তার পিতা বলেছিলেন, আমার নবজাতক শিশু দুই টুকরা হয়ে মারা গেলে আমি অতটা কষ্ট পেতাম না, আজকে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়াতে আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি। সেই সুবাদে ছোট থেকেই আল্লামা ইবতিসাম ইলাহী যহীর হাফিযাহুল্লাহ-এর অন্তরেও বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তার ফ্লাইট যখন প্রথম ঢাকায় ল্যান্ড করে, তখন বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল।
তিনি আরও স্মৃতিচারণ করে বলেন, তার পিতা যখন প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন, তখন তিনি বলেছিলেন, দ্বিতীয়বার আসলে তিনি বাংলায় বক্তব্য দিবেন। পিতার সেই স্মৃতিচারণে তিনিও বাংলা শিখতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তিনি মন্তব্য করেন, বাংলা ভাষার অক্ষরগুলো আরবী স্টাইলে লেখা হলে তার জন্য বাংলা ভাষা শেখা সহজ হতো। তিনি আরও বলেন, বাংলা বর্ণমালা আরবী স্টাইলে লিখিত হলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কালচারাল মিক্সিং বাড়ত এবং কখনোই হয়তো দেশ ভাগ হওয়ার সুযোগ আসত না। বাংলা যেহেতু সংস্কৃত স্টাইলে লেখা হয় আর উর্দূ লেখা হয় আরবী স্টাইলে, সেহেতু চরম বিপরীতমুখী দুই ভাষা উভয় দেশের মানুষের পক্ষে বুঝা কঠিন হয়ে যায়। যা ধীরে ধীরে কালচারাল ও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি করে।
তিনি বংলাদেশের মানুষের পোশাক-আশাক, চলাফেরা সবকিছু অবলোকন করে মন্তব্য করেন, সাংস্কৃতিকভাবে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের সাথে পাঞ্জাবের যতটুকু মিল আছে, তার চেয়ে বেশি মিল আছে পাঞ্জাবের সাথে বাংলাদেশের।
তিনি তার পিতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তার পিতা সফর করতে ও মানুষের সাথে কথা বলতে কখনো ক্লান্ত হতেন না, ছোট কোনো প্রোগ্রাম হোক অথবা একক কোনো ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হোক। সদাসর্বদা তিনি মানুষকে সাক্ষাৎ দেওয়ার জন্য এবং সফরের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। দাওয়াতী ফিল্ডে কখনোই কোনো ক্লান্তি তার চেহারা ও মানসিকতায় প্রকাশ পেত না। তার পিতা প্রচণ্ড সাহসী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় কখনোই মানুষের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এই জন্য সর্বাবস্থায় সত্য বলতে বিন্দু পরিমাণ কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
আল্লামা ইবতিসাম ইলাহী যহীর হাফিযাহুল্লাহ তার নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তার পিতা যখন মারা যান, তখন তারা সকলেই অনেক ছোট। একদিকে স্বামীর মৃত্যুর শোক, অন্যদিকে সন্তান মানুষ করার চাপে তার মাতা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং পিতার মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে তার মাতাও মারা যান। তারপর পরিবারের সকল দায়দায়িত্ব বড় ভাই হিসেবে তার মাথায় চেপে বসে। এই জন্য কখনোই সেভাবে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সকল পড়াশোনা বাড়িতেই করতে হয়েছে। তিনি গতানুগতিক কোনো মাদরাসার ছাত্র ছিলেন না। বরং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে পিতার লাইব্রেরির অসংখ্য ইলমী বই তাকে ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। তিনি এক পর্যায়ে কুরআন হিফয করে ফেলেন। এভাবে জেনারেল পড়াশোনার পাশাপাশি তার দ্বীনের জ্ঞানার্জনও চলতে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি জানার আগ্রহ থেকেই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক মাস্টার্স করেন। অতিরিক্ত মাস্টার্স করার কারণে পিএইচডি করার সুযোগ তিনি পাননি, তবে ইদানীং পিএইচডি শুরু করেছেন।
দাওয়াতী ময়দানে নিজস্ব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে, তিনি তার পিতার রেখে যাওয়া জমঈয়তে আহলেহাদীছের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ২০০৪ সালে দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। উল্লেখ্য যে, আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর রাহিমাহুল্লাহ-এর জমঈয়তে আহলেহাদীছ এবং মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পৃথক দুটি দল। সেই পৃথক দল থেকেই দাওয়াতী কাজ শুরু করেন তিনি। আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর রাহিমাহুল্লাহ তার জীবদ্দশাতেই রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে মারকাযী জমঈয়ত থেকে আলাদা হয়ে শুধু জমঈয়তে আহলেহাদীছ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে তার ভাই হিশাম ইলাহী যহীরের আগ্রহে মূল মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি এই শর্তে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের সাথে ঐক্য করার বিষয়ে একমত হন যে, তাকে তার কুরআন ও সুন্নাহ মুভমেন্টের কাজ চালু রাখার অনুমতি দিতে হবে। এই শর্তে একমত হয়ে জমঈয়তে আহলেহাদীছ বিলুপ্ত ঘোষণা করে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছের চীফ অর্গানাইজার হিসেবে ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম শুরু করেন। অন্যদিকে অলাভজনক ফাউন্ডেশনের মতো কুরআন ও সুন্নাহ মুভমেন্টের কাজও চলমান থাকে। পরবর্তীতে এই ঐক্য বেশিদিন টিকেনি। ফলশ্রুতিতে তার ভাই হিশাম ইলাহী যহীর পুনরায় মারকাযী জমঈয়ত থেকে বের হয়ে জমঈয়তে আহলেহাদীছ নামে এবং তিনি নিজে কুরআন ও সুন্নাহ মুভমেন্ট নামে পুরোদমে নতুনভাবে দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। যদিও বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে শুধু অন্যান্য আহলেহাদীছের সাথে নয়, বরং অন্যান্য স্কুল অফ থটের অনুসারীদের সাথেও তারা একই প্লাটফর্ম বা একই মঞ্চ থেকে দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তিনি তার সকল জুমআর খুৎবা ও বিভিন্ন সাপ্তাহিক দারস-তাদরীস পাঞ্জাব শহরের মূল কেন্দ্রে অবস্থিত লরেন্স রোডের মারকায থেকে প্রদান করে থাকেন। তিনি নিয়মিত মীনারে পাকিস্তান গ্রাউন্ডে ঈদের ছালাত পড়ান। ভয়ংকর করোনা মওসুমের লকডাউনের সময়েও তিনি তার প্রকাশ্য ঈদের ছালাত অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি সপ্তাহে দুইদিন নিয়মিত ‘দুনিয়া’ পত্রিকায় কলাম লেখেন। শুধু বাংলাদেশ সফর নিয়ে তিনি ৪টি প্রবন্ধ লিখেছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে কলাম কীভাবে লেখেন তা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, সফরের মধ্যেই তিনি অডিওর মাধ্যমে তার স্টাফের কাছে পাঠান। তার স্টাফ তার অডিও শুনে টাইপ করে পুনরায় তার কাছে পাঠায়। তিনি সংশোধন করে দিলে সেটিই পত্রিকায় চলে যায়। এভাবে কয়েক হাজার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
তার দৈনন্দিন রুটিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি নির্ধারিত কোনো মাদরাসায় কিতাব-ভিত্তিক দৈনিক কোনো দারসের সাথে সম্পৃক্ত নন। কয়েকবার কালোজাদুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রচুর পরিমাণে যিকির-আযকার ও কুরআন তেলাওয়াতের পিছনে সময় ব্যয় করেন। ফজরের পর থেকে সূর্য উঠা পর্যন্ত যিকির-আযকার ও তেলাওয়াতে ব্যস্ত থাকেন। সূর্য উঠলে বিশ্রামের জন্য ঘুমিয়ে যান। সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠেন এবং দৈনন্দিন কাজ শুরু করেন। কোথাও সফর থাকলে রওয়ানা দেন। মানুষজনের সাথে সাক্ষাৎ, কলাম লেখনী অথবা মারকাযে দারস ইত্যাদি সারাদিনের সকল কাজ শেষ করেন। রাতে খুব দ্রুত ঘুমাতে যান। রাতের ছালাত আদায় করেন। শেষ রাতে সুবহে ছাদিকের পূর্বেই উঠেন, ফজর পড়েন এবং পুনরায় যিকির-আযকারের মাধ্যমে দিন শুরু করেন।
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।