কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বিবাদ-বিদ্বেষ

মানুষের মাঝে মতভেদ ও বিবাদ হওয়া অতি স্বাভাবিক, যা কখনো দুনিয়াবী বিষয়ে হতে পারে, আবার কখনো দ্বীনী বিষয়ে। দুনিয়াবী বিষয়ে প্রবৃত্তির কঠোরতা বিবাদের বড় একটা কারণ। সম্প্রতি আমরা পার্থিব জীবনের উপর অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি, তাই সমাজে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে মতভেদ ও বিবাদ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। ফলে মানুষ পরস্পর হতে দূরে সরে যায়, একে অপরের সাথে কথা বলা ছেড়ে দেয়, সমালোচনা করে এবং ভিত্তিহীন কুধারণা করে বসে।

এ যুগে ইন্টারনেট সুলভ হওয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়া অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হওয়ার কারণে তথ্য সংগ্রহ করা অতি সহজ হয়েছে। ফলে যখন একই বিষয়ে একজনের কাছে একাধিক অভিমত একত্রিত হয়ে যায়, তখন সে বুঝতে পারে না যে, এ মতসমূহের মাঝে আমি কোনটি গ্রহণ করব। অতঃপর সে বিষয়ে কারও সাথে আলোচনা করতে গিয়ে মতভেদ করে বসে এবং প্রকৃত ইলমের অভাবে মতভেদ বিভেদের পর্যায়ে পৌঁছে যায়; অথচ মতভেদযুক্ত বিষয়ে কোনো মতকে প্রাধান্য দেওয়ার অধিকার একমাত্র উলামায়ে কেরামের। কারণ পর্যাপ্ত ইলম ছাড়া তা সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ‘আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না’ (আল-ইসরা, ১৭/৩৬)

আমাদের কর্তব্য, সমাজ থেকে বিবাদ-বিভেদ দূরীভূত করার চেষ্টা করা। যদি আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনচরিতে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাব যে, তিনি নবুঅতের আগে থেকেই বিবাদ নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতেন।

যখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স ছিল ৩৫ বছর, তখন কুরাইশ গোত্রের লোকেরা কা‘বাঘরের পুনর্নির্মাণ শুরু করে। এক পর্যায়ে কা‘বার দেয়ালে হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপনের বিষয়টি যখন সামনে আসে, তখন তাদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়, প্রত্যেক গোত্রের মানুষ চায় যে, এ মর্যাদা যেন তারাই লাভ করে। এ মতভেদ এক সময় ভীষণ আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় আবূ উমাইয়া আল-মাখযূমী নামক একজন বলে যে, এ বিবাদের সমাধান হলো এই যে, সর্বপ্রথম যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে, আমরা তাকেই বিচারক হিসেবে মেনে নেব। অতঃপর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম সেখানে প্রবেশ করেন এবং যেহেতু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাই সবাই তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেন যে, আপনারা বড় একটি কাপড় নিয়ে আসুন, কাপড়ের মধ্যস্থলে হাজারে আসওয়াদ রেখে দিন, অতঃপর তাদের নেতাগণকে সেই কাপড়ের বিভিন্ন প্রান্ত ধরে তা উত্তোলন করার পরামর্শ দেন, তারা এরূপ করলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথরটি নিজ হাতে নিয়ে কা‘বার দেয়ালে স্থাপন করেন। এভাবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী হওয়ার পূর্বেই সমাজের মধ্য হতে বিবাদ দূর করার এক সফল প্রচেষ্টা করেন।[1]

পক্ষান্তরে আজ সমাজে অন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে, ভিত্তিহীন কুধারণা ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু তা দূরীভূত করার যথাযথ চেষ্টা করা হচ্ছে না কিংবা এ দায়িত্ব অযোগ্যরা পালন করছে।

ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আমরা পৃথক হয়ে যাচ্ছি, দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি, যা ইসলামের সাথে যায় না।

বিবাদ-বিদ্বেষের ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْإِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا إِلَّا رَجُلًا كَانَتْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا.

‘প্রত্যেক সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয় এবং প্রত্যেক সে বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যে আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করে না। কিন্তু যার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব থাকে তাদের ব্যাপারে বলা হয় যে, এদেরকে আপস করার অবকাশ দাও, এদেরকে আপস করার অবকাশ দাও, এদেরকে আপস করার অবকাশ দাও’।[2]

ছহীহ মুসলিমে হাদীছটির পরবর্তী বর্ণনায় সম্পর্কচ্ছেদের শব্দ এসেছে এবং হাদীছটি ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ ‘সম্পর্কচ্ছেদ করা নিষিদ্ধ’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।[3]

তাই যদি কেউ নিজের ভাইয়ের সাথে বিবাদ করে, সম্পর্কচ্ছেদ করে এবং সমাধানের চেষ্টা না করে, তাহলে সে আল্লাহ তাআলার বিশেষ ক্ষমা হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে।

সমাজে বিবাদ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু বিবাদকে অনিষ্পন্ন রেখে দেওয়া স্বাভাবিক নয়। তাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাদ নিষ্পত্তির ফযীলত বর্ণনা করেছেন।

عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ قَالُوا بَلَى قَالَ صَلاَحُ ذَاتِ البَيْنِ فَإِنَّ فَسَادَ ذَاتِ البَيْنِ هِيَ الحَالِقَةُ.

আবুদ দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলব না, যা ছিয়াম, ছালাত ও ছাদাক্বা থেকেও উত্তম?’ ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অবশ্যই বলুন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘পরস্পরের সম্পর্ক ভালো করা, কারণ সম্পর্কচ্ছেদ মুণ্ডন করে’।[4] অর্থাৎ দ্বীনকে মুণ্ডন করে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঐক্যের প্রয়োজন, তা নষ্ট করে। ফলে দ্বীনের দুর্গে ফাটল ধরে।[5]

বিবাদ নিষ্পত্তি ছালাত ও ছিয়ামের চেয়েও উত্তম বলে সম্ভবত এক শ্রেণির আমলকে আরেক শ্রেণির আমলের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ বিবাদ এক পর্যায়ে জানমালের ক্ষতি ও সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এগুলোর সম্পর্ক হাক্বুল ইবাদ বা বান্দার অধিকারের সাথে, যা আল্লাহর নিকট অধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত। তাই এই মীমাংসা ও নিষ্পত্তির শ্রেণি ছালাত ও ছিয়ামের শ্রেণির চেয়ে উত্তম।[6]

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে বিবাদ নিষ্পত্তির বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। বিবাদ হলে কখনো ছাহাবীরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন, কখনো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাদের কাছে যেতেন।

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ t أَنَّ أَهْلَ قُبَاءٍ اقْتَتَلُوا حَتَّى تَرَامَوْا بِالحِجَارَةِ فَأُخْبِرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِذَلِكَ، فَقَالَ اذْهَبُوا بِنَا نُصْلِحُ بَيْنَهُمْ.

একদা কুবার কিছু মানুষ বিবাদে জড়িয়ে পড়েন, এমনকি তারা পরস্পরের উপর পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবগত হওয়া মাত্রই বললেন, ‘চলো তাদের মাঝে গিয়ে সমাধান করি’।[7]

যুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু ও এক আনছারী ছাহাবীর মাঝে জমির পানি সিঞ্চনের বিষয়ে মতভেদ হয় যে, কে আগে সেচ দিবে? বিষয়টি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌঁছালে তিনি তাদের মধ্যে ফয়সালা করেন। যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জমি আগে পড়ত (এবং উঁচু ছিল), তাই তাকে আগে সেচ করার অনুমতি দেন। আনছারী ছাহাবী এতে অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, তিনি (যুবাইর) আপনার ফুফুর ছেলে তাই এরূপ বিচার করলেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘যুবাইর! তুমি ততক্ষণ সেচ করতে থাকবে, যতক্ষণ না পানি গাছের চারপাশে থাকা বাঁধ পর্যন্ত উঁচু হয়ে যায় অর্থাৎ পূর্ণরূপে সেচ করার পর পানি ছাড়বে’।[8]

এক ব্যক্তি কা‘ব ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, কা‘ব ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু তার কাছ থেকে সে ঋণ ফেরত চাচ্ছিলেন এবং তাদের আওয়াজ উঁচু হচ্ছিল। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘ব ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডাক দিলেন, অতঃপর তাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘তুমি অর্ধেক মাফ করে দাও’। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা শুনে তিনি অর্ধেক মাফ করে দিলেন।[9]

অনুরূপভাবে আমাদের মাঝেও যখন কোনো বিষয়ে বিবাদ হয়, তখন আমাদের দায়িত্ব হলো আমরা সে বিবাদ দূর করার চেষ্টা করব। আমরা অনেক সময় দেখি যে, চোখের সামনে অন্যায় হয়, কাউকে অপমানিত করা হয়, কারও নামে গুজব ছড়ানো হয়, আলেম-উলামার মতো সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারীদের সাথে অসভ্যতা করা হয়; কিন্তু আমরা অধিকাংশই নীরব থাকি। এ সমাজ সে সমাজ নয়, যার স্বরূপ ইসলাম পেশ করে।

দ্বীনী বিষয়ে মতভেদ হলে এর সমাধান করবেন উলামায়ে কেরাম। তাই নানা ভিডিও দেখে একাধিক আলেমের ফতওয়া শোনার পর নিজেরাই সমাধান করার চেষ্টা না করে যদি আমরা কোনো সুযোগ্য আলেমের শরণাপন্ন হই এবং নিখুঁত ইলমকে সম্মান জানিয়ে তার নির্দেশনা গ্রহণ করি, তাহলেই আমাদের মধ্য থেকে খুব সহজেই সমস্ত দ্বীনী বিবাদের অবসান ঘটবে ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহই তাওফীক্ব প্রদানকারী।

উসওয়াতুন হাসানাহ

কালিয়াচক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত; মুহাদ্দিছ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৫২।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৫।

[3]. রিয়াযুছ ছালেহীন, পৃ. ৪৫১।

[4]. তিরমিযী, হা/২৫০৯।

[5]. তিরমিযী, হা/২৫০৮; শারহুত্ব ত্বীবী, ১০/৩২১৪।

[6]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ৮/৩১৫৩।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৩।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩৫৯; ফাতহুল বারী, ৫/৩৭।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭১।

Magazine