কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কঠিন বিপদে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতেন

post title will place here

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য আর এই জগতকে সৃষ্টি করেছেন আমাদের উপকারের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই পৃথিবীতে আমাদের পরীক্ষা নিতে থাকেন। কখনো দুঃখ-বেদনা, আবার কখনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَنَبْلُوكُمْ بالشر والخَيْرِ فِتْنَةً ‘আমরা মন্দ ও ভালো দ্বারা তোমাদেরকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি’ (আল-আম্বিয়া, ২১/৩৫)

আনন্দকালীন ইবাদতে তৎপর হলেও আমাদের অনেকেই বিপদকালীন ইবাদত হতে উদাসীন। অনেকে সুস্থতা ও সচ্ছলতায় যদিও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকে এবং তাঁর ইবাদত করে, কিন্তু দুঃখ-কষ্টের সময় তাঁকে ভুলে গিয়ে ইবলীসের অনুসরণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

‘আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধার সাথে, তার মঙ্গল হলে তাতে তার চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং কোনো বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্ব চেহারায় ফিরে যায়। সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়াতে ও আখেরাতে, এটাই তো সুস্পষ্ট ক্ষতি’ (আল-হজ্জ, ২২/১১)

মুসলিমরা কি বিপদকালে দ্বীন ত্যাগ করা মুরতাদদের অনুসরণ করবে?

ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহবলেন, মানুষের জীবনে বিপদ যেকোনো সময় সহসায় আসতে পারে এবং বিপদ কখনো খুব বড়ও হতে পারে। যখন বড় কোনো বিপদ এসে পড়ে, তখন মানুষকে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়। সাধারণত মানুষ আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায় এবং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে স্বস্তির সন্ধানে গুনাহের পথে হাঁটতে শুরু করে। ভীষণ সংকটে মানুষ যদি আল্লাহ তাআলাকে না ভুলে যায়, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পদ্ধতি অনুযায়ী এই বিপদের হতাশাময় সময়টাকে অতিবাহিত করার চেষ্টা করে, তাহলে সে পৃথিবীতে সেই বিপদ থেকে বেঁচে যাবে এবং আখেরাতে সফলকাম হবে।[1]

বিপদের সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কী শিক্ষা দিয়েছেন?

১. আল্লাহ তাআলার কাছে নিরাপত্তা চাওয়া: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিতেন যে, ‘তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে নিরাপত্তা চাও’।[2] আর তিনি নিজেও সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলার কাছে নিরাপত্তা কামনা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَعْ هَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ حِينَ يُصْبِحُ وَحِينَ يُمْسِي ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল-সন্ধ্যায় এই দু‘আগুলো ছাড়তেন না’। দু‘আ—

اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِى دِينِى وَدُنْيَاىَ وَأَهْلِى وَمَالِى.

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে নিরাপত্তা দান করুন। নিরাপত্তা দান করুন আমার দ্বীন, দুনিয়া, পরিবার ও সম্পদের মধ্যে’।[3]

২. আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো মহাবিপদের সম্মুখীন হতেন, তখন একমাত্র আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি নির্ভরশীল হতেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করছেন, সাথে আছেন আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু। মক্কার কুরাইশরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। শত্রুদের চোখ এড়িয়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু আশ্রয় নেন ‘ছাওর’ নামক এক গুহায়। কিন্তু শত্রুবাহিনী ঠিক গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু শঙ্কিত হয়ে পড়েন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন,لَوْ أَنَّ أَحَدَهُمْ نَظَرَ تَحْتَ قَدَمَيْهِ لأَبْصَرَنَا ‘হে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কাফেররা আমাদের এত কাছে চলে এসেছে যে, তাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের পায়ের দিকে তাকায়, তাহলেই আমাদেরকে দেখতে পাবে’।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হওয়ার এক বড় উদাহরণ পেশ করলেন। আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বললেন, مَا ظَنُّكَ يَا أَبَا بَكْرٍ بِاثْنَيْنِ اللَّهُ ثَالِثُهُمَا؟ ‘হে আবূ বকর! এমন দুইজনের বিষয়ে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ তাআলা?’[4]

ইবনু হাজার আসক্বালানী রাহিমাহুল্লাহবলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তো সবার সঙ্গে আছেন, তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে। কিন্তু এখানে তাদের দুজনের সাথে আল্লাহ তাআলা আছেন, এর অর্থ হলো আল্লাহ তাআলা তাদের সহযোগিতা করবেন’।[5]

বিপদের সময় যেমন আল্লাহ তাআলার প্রতি নির্ভরশীল হতে হবে, তেমনি এই পৃথিবী আল্লাহ তাআলা পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছেন- এই বিশ্বাস রেখেই ধৈর্যধারণ করতে হবে।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে বিপদ:

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যত বড় বড় বিপদ এসেছে, তার কিছুই এখনো আমাদের উপর আসেনি। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে এমন একটা বছর গেছে, যার নামই ‘আমুল হুযন’ (عام الحزن) বা ‘দুঃখের বছর’।

চাচা আবূ তালেব রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য ছিলেন এক দুর্গের মতো। যতদিন আবূ তালেব জীবিত ছিলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আক্রমণের কারও সাহস ছিল না। আবূ তালেব যখন মারা যান, তার দুই-তিন মাস পরেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা ইন্তেকাল করেন, যিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে দীর্ঘ ২৫ বছর জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য ছিলেন বড় এক নেয়ামত, যিনি দুঃখ ও উদ্বেগের সময়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সাহস ও সান্ত্বনা দিতেন। নিজের সম্পদ দিয়েও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সহযোগিতা করতেন। একই বছরে পরপর প্রিয় দুজন মানুষ মারা যাওয়ার পরেও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যধারণ করেছেন।[6]

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাঁর ছেলে ইবরাহীমকে দেখতে গেলাম, যখন সেখানে পৌঁছলাম ইবরাহীম রাযিয়াল্লাহু আনহু তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন। নিজের সন্তানের এই অবস্থা দেখে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

সে সময় আব্দুর রহমান ইবনু আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু মনে করলেন যে, এরূপ কান্না করা হয়তো ধৈর্যের পরিপন্থী। তাই তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সম্বোধন করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি ধৈর্যের কথা বলেন আর আপনিই এভাবে কাঁদছেন! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, يَا ابْنَ عَوْفٍ إِنَّهَا رَحْمَةٌ ‘হে ইবনু আউফ! এটি আমার মধ্যে দয়া থাকার প্রমাণ’। অতঃপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,إِنَّ العَيْنَ تَدْمَعُ، وَالقَلْبَ يَحْزَنُ، وَلاَ نَقُولُ إِلَّا مَا يَرْضَى رَبُّنَا، وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ يَا إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ ‘চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এসেছে, হৃদয় ব্যথিত হয়েছে। তবুও আমরা এমন কোনো কথা বলব না, যা মহান স্রষ্টা পছন্দ করেন না। ইবরাহীম তুমি আমাদেরকে ছেড়ে যাচ্ছ, তাই আমরা ব্যথাপ্রাপ্ত’।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কোনো কথা বলতেন না, যাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অসন্তুষ্ট হন। দুঃখের সময় সাধারণত মানুষ আল্লাহ তাআলার প্রতি কুধারণা করে বসে এবং নিরাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত বড় বড় আঘাত পেয়েও না আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে কখনো বিরূপ মন্তব্য করেছেন আর না তাঁর কোনো সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যেহেতু বিপদ একমাত্র আল্লাহ তাআলাই দূরীভূত করতে পারেন, তাই যত কঠিন বিপদ হবে, তত বেশি আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করা উচিত। কারণ একমাত্র আল্লাহ তাআলাই আমাদের সে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।

বিপদের সময় দু‘আ:

(১) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,دَعْوَةُ ذِي النُّونِ إِذْ دَعَا وَهُوَ فِي بَطْنِ الحُوتِ: لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ، فَإِنَّهُ لَمْ يَدْعُ بِهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلاَّ اسْتَجَابَ اللَّهُ لَهُ. ‘ইউনুস আলাইহিস সালাম যখন মাছের পেটে ছিলেন, তখন তিনি আল্লাহকে ডেকে বলেছিলেন, لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ، হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই। আপনি পবিত্র আর আমি যুলমকারীদের মধ্যে ছিলাম’। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বিপদের সময় এ দু‘আ পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার দু‘আ কবুল করবেন’।[7]

(২) আবূ বাকরা নুফাই ইবনু হারেছ হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দু‘আ হচ্ছে-دعوة المكروب: اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو؛ فَلَا تَكِلْنِيْ إلَى نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ وأَصْلِحْ لِي شَأنِيْ كُلَّهُ لَا إلهَ إلَّا أَنْتَ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার দয়ার প্রত্যাশী, তাই আপনি আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও একা অসহায় ছেড়ে দিবেন না এবং আমার সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দিন। আপনি ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই’।[8]

(৩) উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, مَا مِنْ عَبْدٍ تُصِيبُهُ مُصِيبَةٌ، فَيَقُولُ: {إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ} اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا، إِلَّا أَجَرَهُ اللهُ فِي مُصِيبَتِهِ، وَأَخْلَفَ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا ‘কোনো বান্দা বিপদের সময় যদি বলে, {إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ} اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا আমরা সবাই আল্লাহরই এবং আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। হে আল্লাহ! এই বিপদে আপনি আমাকে নেকী দান করুন এবং এর থেকে উৎকৃষ্ট কিছু আমাকে দান করুন’। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সেই বিপদে তাকে নেকী দান করবেন এবং তার থেকে উত্তম প্রতিদান তাকে দান করবেন’।

উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, যখন আমার স্বামী আবূ সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু মারা গেলেন, তখন আমি সেভাবেই দু‘আ করলাম, যেভাবে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে শিখিয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা আমাকে আমার স্বামীর চেয়েও উত্তম অর্থাৎ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দান করলেন।[9]

(৪) আসমা বিনতু উমাইস রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কিছু শব্দ শিখিয়েছেন, যেটি আমি বিপদের সময় বলব আর তা হলো, اللهُ اللهُ رَبِّيْ، لَا أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا ‘আল্লাহ আল্লাহ আমার রব, তাঁর সাথে আমি কাউকে অংশীদার বানাই না’।[10]

(৫) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এরূপ দু‘আ করতেন, আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করতেন এবং তাঁর একত্ব প্রকাশ করতেন। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, كان إذا حزبه شيء قال: يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ، بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ. ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যখন কোনো বড় বিপদ এসে যেত, তখন তিনি এই দু‘আটি পাঠ করতেন, يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ، بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ ‘হে চিরঞ্জীব! হে সর্বসত্তার ধারক! আপনার রহমত দ্বারা আমি আপনার কাছে সাহায্য ও সহযোগিতা চাই’।[11]

(৬) ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠিন বিপদের সময় এই দু‘আ পড়তেন,[12]

لَا إِلَهِ إِلَّا اللهُ الْعَظِيْمُ الْحَلِيْمُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ، لَا إلَهَ إلّا اللهُ رَبُّ السَّمَواتِ ورَبُّ الأرْضِ، ورَبُّ العَرْشِ الكَرِيْمِ.

এই দু‘আয় আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব, মাহাত্ম্য ও একত্ব প্রকাশ করা হয়েছে।

বিপদে ধৈর্য ও ছালাত:

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদের সময় ছালাতের দিকে ছুটে যেতেন। কিন্তু কত মানুষ বিপদে পড়লে আল্লাহর আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে শয়তানের শরণাপন্ন হয়। বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি কঠিন অধ্যায়। মুসলিমদের অস্তিত্ব নিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন উৎকণ্ঠায়। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,لَقَدْ رَأَيْتُنَا لَيْلَةَ بَدْرٍ وَمَا مِنَّا رجل إِلاَّ نَائِمٌ إِلاَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنَّهُ كَانَ يُصَلِّى إِلَى شَجَرَةٍ وَيَدْعُو حَتَّى أَصْبَحَ ‘সবাই ছিল ঘুমন্ত। কিন্তু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছিলেন এবং দু‘আ করতে থাকলেন সকাল পর্যন্ত’।[13]

বিপদের সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছালাতের দিকে অগ্রসর হতেন। কারণ আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও’ (আল-বাকারা, ২/১৫৩)

বিপদাপদে এই দুটিই শক্তি প্রাপ্তির কারণ। ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বিপদকালে অবিচল থাকতে যা সর্বাধিক সহায়তা করে, তা হলো ছবর ও ছালাত।[14]

বিপদ থেকে বাঁচার উপায়:

ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহবর্ণনা করেছেন, উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,سُبْحَانَ اللَّهِ مَاذَا أُنْزِلَ اللَّيْلَةَ مِنَ الْفِتَنِ وَمَاذَا فُتِحَ مِنَ الْخَزَائِنِ أَيْقِظُوا صَوَاحِبَاتِ الْحُجَرِ... ‘কোনো এক রাত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘সুবহানাল্লাহ! আজকে কত প্রকার ফেতনা নাযিল হয়েছে এবং আজকে কত সম্পদের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে! বাড়ির মহিলাদেরকে জাগাও...’।[15]

ইবনু হাজার রাহিমাহুল্লাহবলেন, উক্ত হাদীছে প্রমাণিত হয় যে, অনিষ্টের আশঙ্কায় ছালাতের দিকে অগ্রসর হওয়া মুস্তাহাব।[16]

কারণ ভবিষ্যতে এ পৃথিবীতে বহু ফেতনা ছড়াবে, ধনসম্পদের প্রাচুর্য সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় শিখালেন। শুধু ইহকালের নয়, বরং পরকালের কষ্ট থেকেও বাঁচার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللَّهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ.

‘যে লোক কোনো ঈমানদারের দুনিয়ার কোনো কষ্ট দূর করে দিবে, আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের দিন তার কোনো কষ্ট দূর করে দিবেন। যে লোক কোনো দুস্থকে সহায়তা করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে সাহায্য করবেন, বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ ততক্ষণ তাকে সহযোগিতা করতে থাকেন’।[17]

আমরা বুঝতে পারলাম যে, যদি কেউ সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলার কাছে দু‘আ করতে থাকে, হে আল্লাহ! বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, তাহলে সে অবশ্যই রক্ষা পাবে ইনশা-আল্লাহ! আর যদি বিপদ এসেই পড়ে, তাহলে তাকে একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হতে হবে এবং আল্লাহকেই স্মরণ করতে হবে। কেবল তাঁরই নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে, ধৈর্যধারণ করতে হবে, ছালাত আদায় করতে হবে এবং সবসময় অপর মুমিন ভাইদের সহযোগিতা করতে হবে। মুমিনদের সাথে সরল ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে, যাতে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়ে তার সকল পথ সহজ করে দেন। বিপদের সময় মানুষ কত ধরনের বিভ্রান্তিতে পড়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হে মহান স্রষ্টা! আমাদের সকলকে বড় বিপদ থেকে রক্ষা করুন। কারণ আমরা জানি না বড় বিপদের সময় আমাদের অবস্থান কী হবে, কিন্তু বিপদ এসে পড়লে আমাদেরকে ধৈর্যধারণের তাওফীক্ব দান করুন। আমাদের সকলকে কঠিন বিপদের সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের উপর অবিচল থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

হাসান আল-বান্না মাদানী

কালিয়াচক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত; মুহাদ্দিছ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. মাদারিজুস সালিকীন, ১/৩৯৯।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৪২।

[3]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৭৪।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৫৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৮১।

[5]. ফাতহুল বারী, ৭/১১।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩০৩।

[7]. তিরমিযী, হা/৩৫০৫।

[8]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৯০।

[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯১৮।

[10]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮৮২।

[11]. তিরমিযী, হা/৩৫২৪।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩৪৬।

[13]. মুসনাদ আহমাদ, হা/১১৬১।

[14]. তাফসীর ইবনে কাছীর, (বৈরূত প্রকাশিত), ১/৩৩৭।

[15]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৫।

[16]. ফাতহুল বারী, ১/২১১।

[17]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯।

Magazine