কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

রাগ প্রশমনের নববী পদ্ধতি

post title will place here

রাগ আল্লাহ তাআলার জন্য যদি না হয়, তাহলে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ক্রোধ কত রকম ক্ষতি করতে পারে, তা যদি সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, তাহলে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হবে। মানুষ ক্রোধের বশে বড় বড় অপরাধ, নানা ধরনের অনাচার এবং এমন এমন কাজ করে বসে, যার কারণে পরক্ষণে সে নিজেই অনুতপ্ত হয়। এসব কিছু লক্ষ করলে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, রাগ মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর!

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগের সময় কীভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, তা আমাদের জন্য একটি অনুকরণীয় আদর্শ। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষের থেকে কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু তিনি রাগান্বিত না হয়ে সর্বদা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং উম্মতকেও এই শিক্ষাই দিয়েছেন।

রাগের সময় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুনাইনের যুদ্ধের পর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনীমতের মাল বণ্টন করলেন এবং বণ্টনে তিনি কিছু মানুষকে প্রাধান্য দিলেন। যেমন- আক্বরা ইবনে হাবেস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ১০০টি উট দিলেন এবং উয়াইনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কেও ১০০টি উট দিলেন। এমনিভাবে আরও কিছু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের দান করলেন। এ দৃশ্য দেখে একজন বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ! এই বণ্টনে ন্যায়-নীতি অনুসরণ করা হয়নি। বণ্টনের সময় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করা হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ কথা সহ্য করতে পারলেন না। তাকে বললেন, তুমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এমন মন্তব্য কর! আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই তোমার এ কথা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানাব। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানানো হলে তিনি বিন্দু পরিমাণ রাগান্বিত না হয়ে কেবল এতটুকুই বললেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠা না করেন, তাহলে কে এমন আছে যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে?’ তিনি মূসা আলাইহিস সালাম-এর কথা স্মরণ করলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম-এর উপর রহম করুন। নিশ্চয়ই তাঁকে এর চাইতেও অধিক কষ্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও তিনি ধৈর্যধারণ করেছিলেন’।[1]

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক দাওয়াতী সফরের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তায়েফে গিয়েছিলেন।[2] সাড়া না পেয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ফিরে আসছিলেন। পথে জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে এসে বললেন, আল্লাহ তাআলা আপনার এই কঠিন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে প্রেরণ করেছেন। আপনি আপনার জাতির ব্যাপারে যা আদেশ করবেন, পাহাড়ের ফেরেশতা তা পালন করবেন। এরপর পাহাড়ের ফেরেশতা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ডেকে বললেন, আপনি আপনার জাতির ব্যাপারে যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, আমরা সেটি পালন করতে প্রস্তুত। আপনি চাইলে পাহাড় চাপা দিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেব।

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাতির কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইলেন না। তিনি বললেন, ‘বরং আমি আশাবাদী যে, আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ সৃষ্টি করবেন, যারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক স্থাপন করবে না’।[3]

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হাঁটছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল মোটা পাড় বিশিষ্ট একটি নাজরানী চাদর। এমতাবস্থায় এক বেদুঈন ছাহাবী এসে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাদর ধরে এত জোরে টান দেন যে, তার ঘাড়ে সেই চাদরের দাগ বসে যায়। অতঃপর সেই ছাহাবী বলেন, মুহাম্মাদ! আল্লাহ তাআলা আপনাকে যে সম্পদ দান করেছেন, তা হতে আমাকে কিছু দেওয়ার আদেশ প্রদান করুন।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। তারপর তাকে কিছু দেওয়ার আদেশ দিলেন।[4]

এমন কিছু ঘটলে ক্রোধ সংবরণ করা মোটেও সহজ নয়। কিন্তু যার হৃদয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রকৃত ভালোবাসা আছে, তার জন্য এটি কঠিন নয়।

রাগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা প্রদান:

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন ক্রোধ সংবরণের নযিরবিহীন উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন, তেমনই ছাহাবায়ে কেরামকেও এর শিক্ষা দিয়েছেন। কেননা ক্রোধ দমন করা এমন এক গুণ, যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষকে ক্ষমাকারী। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৪)

আর যারা ক্রোধ দমন করতে পারে এবং মানুষদের ক্ষমা করে দেয়, তারা মুহসিনদের (সৎকর্মশীল) অন্তর্ভুক্ত।[5]

ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ছাহাবী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আমাকে উপদেশ প্রদান করুন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘তুমি রাগ করো না’। সেই ছাহাবী বারবার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে লাগলেন, আপনি আমাকে কিছু উপদেশ প্রদান করুন। উত্তরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই বাক্য বারংবার বলতে লাগলেন, ‘তুমি রাগ করো না, তুমি রাগ করো না’।[6]

ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বারবার ক্রোধ দমনের নির্দেশ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, ক্রোধ কতটা খারাপ ও ক্ষতিকারক।[7]

রাগের সময় করণীয়:

সুলায়মান ইবনে সুরদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একবার আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে উপবিষ্ট ছিলাম। তাঁর সম্মুখেই দুজন ব্যক্তি গালাগালি করছিল। তাদের একজন অপরজনের প্রতি এত রেগে গিয়েছিল যে, তার চক্ষুদয় রক্তিম হয়ে গিয়েছিল এবং ঘাড়ের রগগুলো ফুলে উঠেছিল। তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি একটি বাক্য জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ত, তবে তার রাগ দূর হয়ে যেত। বাক্যটি হলো- আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম’। তখন লোকেরা সে ব্যক্তিকে বললেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলছেন, তা কি তুমি শুনছ না? তিনি বললেন, আমি নিশ্চয়ই পাগল নই।[8]

ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কেউ যদি রাগের সময় ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম’ পড়ে, তাহলে তার রাগ শেষ হয়ে যাবে। হাদীছটি দ্বারা এটাও বুঝা যায় যে, রাগ শয়তানের কুমন্ত্রণার কারণে হয়ে থাকে, যদি তা আল্লাহর জন্য না হয়। রাগ এমন এক অবস্থা, যাতে মানুষ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অসার কথাবার্তা বলতে শুরু করে। এক পর্যায়ে অন্যের বিপক্ষে শত্রুতা পোষণ করতে আরম্ভ করে। হাদীছে উল্লিখিত ব্যক্তি সম্ভবত মুনাফেক্ব ছিল কিংবা কোনো রুক্ষভাষী বেদুঈন ছিলেন।[9]

ক্রোধের সময় মুখে অমার্জিত ভাষা চলে আসা স্বাভাবিক। তাই এ সময় নীরব থাকাই বাঞ্ছনীয়।

ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন কেউ রাগান্বিত হবে, সে যেন চুপ থাকে’।[10]+[11]

রাগী না হওয়া কি দুর্বলতা:

বহু মানুষ মনে করে যে, কেউ আমার প্রতি অন্যায় করল আর আমি কিছুই বললাম না, তাহলে তো আমি দুর্বল!
আদতে কি ব্যাপারটা এমন?

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَال ليسَ الشديدُ بالصُّرَعة إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ.‏

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সেই আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে’।[12]

উক্ত হাদীছে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেই আসলে ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
রাগ প্রশমন তাক্বওয়ার পরিচায়ক। যদি কেউ ক্রোধ দমন করতে পারে, তাহলে মানুষ তার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে এবং তার প্রতি আগ্রহী হয়।
সমাজে যদি সবাই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে সমাজে শান্তি ও ভালোবাসা বিরাজ করবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

হাসান আল-বান্না মাদানী

কালিয়াচক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত; মুহাদ্দিছ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬২।

[2]. পাথর মেরে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি মর্মে যা কিছু বলা হয় সব দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। দেখুন: আকরাম আল-উমরী, আস-সীরাহ, ১/১৮৫। কিন্তু উপরিউক্ত হাদীছ থেকে সেই অতল বেদনা প্রতীয়মান হয়।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৯৫।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৭।

[5]. তাফসীরে ত্ববারী, ৭/২১৫।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৬।

[7]. শারহু মুসলিম, ১৬/১৬৩।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬১০।

[9]. শারহু মুসলিম, ১৬/১৬৩।

[10]. আহমাদ, হা/২১৩৬; আদাবুল মুফরাদ, হা/১৮৪।

[11]. রাগের সময় করণীয় মর্মে আরও কিছু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন- ‘যে ব্যক্তি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে যাবে, সে যেন বসে পড়ে। তারপরও যদি তার রাগ না কমে, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে’ (আহমাদ, হা/২১৩৪৮)। হাদীছটির সনদ দুর্বল (দেখুন: আলবানী, যঈফা, হা/৬৬৬৪)। কিন্তু মুসনাদ আহমাদ, হা/১১১৪৩-এ আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীছে এই বাক্যটি আছে, ‘যখন কেউ ক্রোধ অনুভব করবে, তখন মাটি মাটি (উদ্দেশ্য মাটিতে বসে যাওয়া হতে পারে)’। কিন্তু এই হাদীছটির সূত্রে আলী ইবনে যায়েদ ইবনে জুদআন আছেন, যিনি দুর্বল বর্ণনাকারী। তাই উভয় হাদীছকে সামনে রেখে বলা যেতে পারে যে, ক্রোধের সময় মাটিতে বসে যাওয়া একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। আধুনিক কিছু গবেষণায় মাটি বা প্রকৃতির নিকটবর্তী হওয়া প্রশান্তি ও স্থিরতার কারণ হিসেবে বিবেচিত। ওয়াল্লাহু আ‘লাম।

দ্বিতীয় হাদীছ ‘যদি কোনো ব্যক্তি রাগান্বিত হয়ে যায়, তাহলে সে যেন ওযূ করে নেয়’। এই হাদীছটির সনদে মুহাম্মাদ ইবনে আতিয়্যাহ নামক একজন আছেন, যার অবস্থা অজ্ঞাত। তাই হাদীছটি যঈফ (দেখুন: তাহযীবুত তাহযীব, ৯/৩৪৫)

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৯।

Magazine