কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মানুষকে ক্ষমা করা শিখতে হবে!

post title will place here

নিশ্চয় অন্যায়, সমালোচনা, মিথ্যা অপবাদ, উপহাস, কটুকথা ইত্যাদিতে হৃদয় ব্যথিত হয়। কারও মনে কষ্ট দেওয়া একজন মুসলিমের কাজ নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কাউকে কষ্ট দেননি। অনেক সময় বহু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও এ বিষয়টি ভুলে যান। কিন্তু যাকে কষ্ট দেওয়া হলো, তার সেই সময় করণীয় কী? আঘাত পেয়ে উগ্র হয়ে সে কি প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে, না-কি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির আশায় সেই মুসলিম ভাইকে ক্ষমা করবে? আল্লাহ তাআলা বান্দার সাথে তেমনই ব্যবহার করেন, যেমন বান্দা আল্লাহ তাআলার অপর বান্দাদের সাথে করে থাকে। তাই বান্দা যখন অন্যের উপর দয়া করে, তখন আল্লাহ তাআলাও তার উপর দয়া করেন। অনুরূপভাবে যখন বান্দা অন্যকে ক্ষমা করে দেয়, তখন আল্লাহ তাআলাও সেই বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ ‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয়, তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ক্ষমা করেন’ (আন-নূর, ২৪/২২)

এ আয়াতের প্রেক্ষাপট হলো এই যে, যখন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তখন কিছু ছাহাবায়ে কেরামও এই দোষারোপে লিপ্ত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিসত্বাহ ইবনু উছাছা। মিসত্বাহ ইবনু উছাছা হলেন আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাসতুতো ভাই। তিনি আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করে মদীনা এসেছিলেন, তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু।

মিসত্বাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি আর কখনো তোমার কোনো খরচ বহন করব না। অতঃপর উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়। আয়াতটি শোনামাত্রই তিনি মিসত্বাহকে ক্ষমা করে দিলেন এবং বলতে লাগলেন, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি চাই যে, আল্লাহ আমার গুনাহ ক্ষমা করুন।[1]

বিভিন্ন সময়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যারা কষ্ট দিত, যারা তাঁর সাথে অশিষ্ট আচরণ করত, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।

عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما أَنَّهُ غَزَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِبَلَ نَجْدٍ فَلَمَّا قَفَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَفَلَ مَعَهُ فَأَدْرَكَتْهُمُ الْقَائِلَةُ فِى وَادٍ كَثِيرِ الْعِضَاهِ فَنَزَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَفَرَّقَ النَّاسُ يَسْتَظِلُّونَ بِالشَّجَرِ فَنَزَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَحْتَ سَمُرَةٍ وَعَلَّقَ بِهَا سَيْفَهُ وَنِمْنَا نَوْمَةً فَإِذَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْعُونَا وَإِذَا عِنْدَهُ أَعْرَابِىٌّ فَقَالَ إِنَّ هَذَا اخْتَرَطَ عَلَىَّ سَيْفِى وَأَنَا نَائِمٌ فَاسْتَيْقَظْتُ وَهْوَ فِى يَدِهِ صَلْتًا فَقَالَ مَنْ يَمْنَعُكَ مِنِّى فَقُلْتُ اللَّهُ ثَلاَثًا وَلَمْ يُعَاقِبْهُ وَجَلَسَ.

জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় প্রায় দুপুর বেলায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমরা কোনো এক জায়গায় গাছের নিচে অবস্থান করছিলাম। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এক গাছের নিচে অবস্থান করছিলেন। তাঁর তরবারি সেই গাছে ঝুলছিল। আমাদের চোখে একটু ঘুম নেমে এসেছিল। সহসা আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আওয়াজ শুনে তাঁর কাছে পৌঁছলাম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই লোকটি আমার তরবারি কোষমুক্ত করে আমাকে বলে, আপনাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? আমি বললাম, আল্লাহ তাআলা আমাকে রক্ষা করবেন। এ প্রশ্ন সে তিনবার করে এবং আমি তাকে একই উত্তর দিই’। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বেদুঈনকে কোনো শাস্তি দিলেন না।[2]

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! উহুদের দিনের চেয়ে বড় কষ্ট আপনার জীবনে কি কখনো এসেছে? নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি সব থেকে বেশি যন্ত্রণা সহ্য করেছি, যে দিন (তায়েফে) আমি আবদে ইয়ালীল ও তার ভাইদের কাছে দাওয়াতের বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমার কথায় সাড়া দেয়নি।

চিন্তিত হয়ে মক্কার পানে হেঁটে যাচ্ছিলাম। (মক্কা ও তায়েফের মাঝে) ক্বারনুছ ছাআলিবে পৌঁছে আমার জ্ঞান স্বাভাবিক হয়। আকাশে লক্ষ করলাম এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া করেছে এবং সেই মেঘের মধ্যে জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে দেখলাম, তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, আপনার জাতি যা উত্তর দিয়েছে, আল্লাহ তাআলা তা শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। আপনি তাকে যা আদেশ করবেন, তিনি তা অবশ্যই পালন করবেন’। পাহাড়ের ফেরেশতা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাম করে বললেন, যদি আপনি চান, আমি মক্কার এই দুই পাহাড় এদের উপর চাপিয়ে দিব। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘(না) বরং আমি আল্লাহ তাআলার কাছে আশা করি যে, তিনি এদের মধ্যে কিছু এমন মানুষ তৈরি করবেন, যারা একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে এবং আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে অংশীদার করবে না’।[3]

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كُنْتُ أَمْشِى مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانِىٌّ غَلِيظُ الْحَاشِيَةِ فَأَدْرَكَهُ أَعْرَابِىٌّ فَجَبَذَهُ بِرِدَائِهِ جَبْذَةً شَدِيدَةً حَتَّى نَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ أَثَّرَتْ بِهَا حَاشِيَةُ الْبُرْدِ مِنْ شِدَّةِ جَبْذَتِهِ ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ مُرْ لِى مِنْ مَالِ اللَّهِ الَّذِى عِنْدَكَ. فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ ضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ.

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম, তাঁর গায়ে ছিল মোটা পাড়বিশিষ্ট একটি নাজরানী চাদর। হঠাৎ এক বেদুঈন এসে তাঁর চাদর ধরে এত জোরে টান দিল যে, তাঁর ঘাড়ে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেল। সে বেদুঈন বলতে লাগল, মুহাম্মাদ! আল্লাহ-প্রদত্ত প্রচুর সম্পদ আপনার কাছে আছে, কিছু আমাকে দেওয়ার নির্দেশ দিন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, তারপর তাকে কিছু দেওয়ার জন্য বললেন।[4] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে একটুও তিরস্কার করলেন না।

উসামা ইবনু যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘দ ইবনু উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন। কারণ তিনি অসুস্থ ছিলেন। রাস্তায় কিছু মুসলিম, মুশরিক ও ইয়াহূদীদের একটি বৈঠক দেখে থেমে গেলেন, বৈঠকে মুনাফেক্বদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইও উপস্থিত ছিল (এ ঘটনা তার বাহ্যিক ইসলাম প্রকাশের পূর্বের)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কুরআন শোনালেন এবং আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন। ইবনু উবাই বলতে লাগল, হে ব্যক্তি! আপনি যা বলছেন তা যদি সত্য হতো, তাহলে এর চেয়ে ভালো কোনো কথা-ই হতো না। তাই আমাদের বৈঠকে এসে এসব বলে আমাদেরকে কষ্ট দিবেন না, ফিরে যান, যারা আপনার কাছে আসবে তাদেরকে এই গল্প শোনাবেন। সেই মজলিসে আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! না, আপনি অবশ্যই এই বার্তা আমাদেরকে শোনান, আমাদের খুব ভালো লাগে। অতঃপর মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে গালমন্দ শুরু হয়ে যায়, এমনকি তারা পরস্পরকে আঘাত করার উপক্রম হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবেশটা শান্ত করলেন, তারপর সা‘দ ইবনু উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে পৌঁছে তাকে এই ঘটনা শোনালেন। সা‘দ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আব্দুল্লাহকে ক্ষমা করে দিন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিলেন। উসামা ইবনু যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথীবর্গ মুশরিক ও আহলে কিতাবদেরকে ক্ষমা করে দিতেন, যেমন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আদেশ করেছেন এবং তাদের কষ্টে ধৈর্যধারণ করতেন।[5]

যদি আমাদের হৃদয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রকৃত ভালোবাসা থাকে, তাহলে আমরাও পরস্পরকে ক্ষমা করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ ‘যদি তোমরা শাস্তি দাও, তাহলে ঠিক ততটুকুই শাস্তি দিবে, যতটুকু অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। কিন্তু যদি ধৈর্যধারণ কর, তাহলে ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম’ (আন-নাহল, ১৬/১২৬)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই আদর্শে আদর্শিত হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

হাসান আল-বান্না মাদানী

কালিয়াচক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত; মুহাদ্দিছ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭৫০।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯১০।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৯৫; ফাতহুল বারী, ৬/৩১৫-৩১৬।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৭।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৬৬।

Magazine