প্রতিটি জীবনকে সুস্থ বা জীবিত রাখতে আহার গ্রহণের বিকল্প নেই, চাই তা পশু-পাখি হোক অথবা মানুষ হোক। আহার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হোক অথবা বিলম্বে হোক, তা অত্যাবশ্যক। ঠিক অনুরূপভাবে আত্মাকে সুস্থ বা জীবিত রাখতে চাইলে আত্মার খোরাক অত্যাবশ্যক। আর এই খোরাক মাস শেষে পাওয়া বেতনের মাধ্যমে জুটে না, আবার প্রাসাদতুল্য দালানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ফুল স্পিড ইন্টারনেটের মাধ্যমেও জুটে না; বরং তার প্রশান্তি জুটে একমাত্র আল্লাহরই স্মরণে। আল্লাহ তাআলা বলেন,أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘জেনে রেখো! আল্লাহর যিকিরের মাঝেই আত্মা প্রশান্তি লাভ করে’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৮)।
যিকির-আযকার থেকে বিমুখ আত্মা তেমনভাবে ছটফট করে, যেমনভাবে পানিশূন্য জায়গায় মাছ ছটফট করে। আজ প্রায় আত্মাই নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। কিছু আত্মা তার যৌবনেই বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে, আবার কিছু আত্মা বার্ধক্যজনিত দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে। আমরা প্রায় সকলেই আত্মিক দুরারোগ্য রোগে ভুগছি। যতই মৌখিক দাবি করি না কেন, আমরা সকলেই কিন্তু আত্মিক প্রশান্তি থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছি। আত্মাগুলো প্রায় অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা ঘুটঘুটে অন্ধকারের অনিষ্ট ছায়া ফুটফুটে সুন্দর শিশুটিকেও নিমিষেই পাকড়াও করে ফেলছে আর টগবগে যুবককেও নানা রঙের প্রলোভন দেখিয়ে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করছে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদে শারীরিক সুস্থতার জন্য আহার ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও ক্ষুধার্ত আত্মার একটিই মাত্র খোরাক; আর তা হলো মালিকের স্মরণ। যিনি এই আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন। যেহেতু শরীরের উপাদানসমূহ পৃথিবীর উপাদান দিয়েই তৈরি, তাই তার জন্য চাই পৃথিবীর উৎপাদিত খাদ্য। কিন্তু আত্মা তো স্বয়ং প্রভুর তরফ থেকেই এসেছে, তাই আত্মার ক্ষুধা মিটে একমাত্র তাঁরই স্মরণে। সেই খাবার এমন এক জিনিস, যা আমাদের এই চর্মচক্ষে দেখা আদৌ সম্ভব নয়; ঠিক যেমনভাবে আত্মাকেও দেখা সম্ভব নয়।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সংক্ষেপে যিকির-আযকারের গুরুত্ব ও ফযীলত নিয়ে আলোচনা করব, যা ব্যাধিগ্রস্ত আত্মাসমূহকে রোগমুক্তকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এবং আরও নানাবিধ সমস্যা দূরীকরণে সক্রিয় অবদান রাখবে।
আমরা কেন যিকির-আযকার করব?
আমরা যিকির-আযকার করব, তার কারণ হলো, যিকির-আযকার হচ্ছে একটা ইবাদত আর আল্লাহ বান্দাকে তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। সেই সম্পর্কে আল্লাহ বারংবার নির্দেশ প্রদান করেছেন আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গুরুত্ব ও ফযীলত আমাদের জন্য বারংবার উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করো আর আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫২)। তিনি অন্যত্র বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো’ (আল-আহযাব, ৩৩/৪১)।
আমরা মানুষ জাতি আমাদের মহামহিম প্রভুর প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ। চুলের ডগা থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যার দেওয়া অথবা আমাদের মহামূল্যবান শরীর নামক মেশিনটি যিনি বিনামূল্যে দিয়েছেন, সেই মহৎ দানের বিনিময়ে কি আমরা তার জন্য নগণ্য কিছু দিতে পারি না? তার জন্য কি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ মিনিটও দেওয়ার সময় হয় না আমাদের; অথচ সেই সময়টাও তাঁরই দেওয়া?
তিনি এত কিছু দেওয়ার পরও আমাদের কাছ থেকে চেয়েছেন শুধু তাঁর স্মরণ। কিন্তু হায় আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ! আমরা কেউই এই গণ্ডির বাইরে নই, তবে একমাত্র তারা ব্যতীত আল্লাহ যাদেরকে তাওফীক্ব দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের সকলকেই তাওফীক্ব দান করুন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তা দ্বারা অনুধাবন করে না; তাদের চোখ রয়েছে, তা দ্বারা দেখে না আর তাদের কান রয়েছে, তা দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৭৯)।
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কতবার তাকে স্মরণ করার কথা বলেছেন! আল্লাহর এসব নির্দেশ কানগুলো শুনেছে, চোখগুলো দেখেছে, কিন্তু তাদের অন্তর থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ে ভাববার বিন্দুমাত্র সময় পায়নি। তাই কাজেও বাস্তবায়ন হয়ে উঠেনি। আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন, وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ ‘আমার বান্দাদের মধ্যে খুব অল্পই কৃতজ্ঞ’ (সাবা, ৩৪/১৩)। এরপরে আল্লাহ বলেন,لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি তোমাদের বাড়িয়ে দিব আর যদি না করো, তাহলে আমার শাস্তি বড়ই কঠিন’ (ইবরাহীম, ১৪/৭)। অর্থাৎ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দার নেয়ামত বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ তা না করলে আল্লাহ তাকে এমনি ছেড়ে দিবেন না; বরং তাকে কঠিনভাবে পাকড়াও করবেন। তারপর তিনি বলেন, قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ ‘তোমরা খুব কমই আল্লাহকে স্মরণ করো’ (আন-নামল, ২৭/৬২)।
আসুন! এখন পূর্বের কথায় ফিরে যাওয়া যাক, মানুষ আসলেই ভীষণ অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ আমাদের সকলকেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
যিকির-আযকারের ফযীলত:
(১) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়: আল্লাহ তাআলা বলেন,وَالذَّاكِرِينَ اللَهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا ‘...আর আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ এবং অধিক স্মরণকারী নারীদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৫)। অর্থাৎ আল্লাহকে অধিক স্মরণ করলে তার জন্য দুটি পুরস্কার রয়েছে— ১. আল্লাহ তাতে সন্তুষ্ট হয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন এবং ২. তার জন্য উত্তম প্রতিদান প্রস্তুত রাখেন আর তা হলো জান্নাত।
(২) যিকির-আযকার হলো অন্তর পরিষ্কার করার উপকরণ: হাদীছে এসেছে, আবুদ দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,إِنّ لِكُلِّ شَيْءٍ جَلَاءً وَإِنَّ جَلَاءَ الْقَلُوْبِ ذِكْرُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘প্রতিটি জিনিসেরই পরিষ্কারক আছে আর অন্তরের পরিষ্কারক হলো আল্লাহর যিকির’।[1] অধিক পাপকর্ম আর আত্মার নিয়ন্ত্রণকারীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কারণে অন্তরে মরিচা ধরে যায় আর এই মরিচা দূরীকরণে আল্লাহকে স্মরণ করা অত্যাবশ্যক।
(৩) অন্তরসমূহকে প্রশান্তি দানকারী: আল্লাহ তাআলা বলেন,الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রেখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি পায়’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৮)।
(৪) পৃথিবীতে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্মরণ হলো আল্লাহকে স্মরণ: আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ‘আল্লাহর স্মরণ সবচেয়ে বড়। আর আল্লাহ জানেন, যা তোমরা করো’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৫)।
(৫) আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা উত্তম কর্ম হলো যিকির-আযকার: আবুদ দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ألا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أعْمالِكُمْ، وأزْكاها عِنْدَ مَلِيكِكُمْ، وَأرْفَعِها في دَرَجاتِكُمْ، وَخَيْرٍ لكُمْ من إنْفاقِ الذَّهَبِ والوَرِقِ، وَخَيْرٍ لكُمْ من أن تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ، فتَضْرِبوا أعْناقَهُمْ، وَيَضْرِبوا أعْناقَكُمْ؟ " قالوا: بلى. قال: "ذِكْرُ اللهِ تعالى"، فقال مُعاذُ بن جَبلٍ: ما شَيْءٌ أنْجى من عَذابِ اللهِ من ذِكْرِ اللهِ.
‘আমি কি তোমাদের সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা তোমাদের মালিকের নিকট সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা সমুন্নতকারী, আল্লাহর পথে সোনা ও রূপা ব্যয় করার চেয়েও তোমাদের জন্য কল্যাণকর আর এর চেয়েও মঙ্গলজনক হবে যে, তোমরা শত্রুর সম্মুখীন হয়ে তাদের গর্দানে আঘাত করবে আর তারা তোমাদের গর্দানে আঘাত করবে?’ ছাহাবীগণ বললেন, ‘জি, হ্যাঁ, বলুন’। তিনি বললেন, ‘তা হলো আল্লাহর যিকির’। মুআয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর যিকির অপেক্ষা আল্লাহর আযাব থেকে অধিক মুক্তিদানকারী আর কোনো কিছু নেই’।[2]
(৬) সফলতা অর্জনের অনেক বড় হাতিয়ার: আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সাথে মুখোমুখি হবে, তখন তোমরা সুদৃঢ় থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (আল-আনফাল, ৮/৪৫)।
(৭) যে আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً.
‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা আমার ব্যাপারে যেমনটি ধারণা করে, আমি তার সাথে ঠিক তেমনটি আচরণ করে থাকি। আমার বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে, আমিও তখন তাকে স্মরণ করি। সে যখন আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। সে যখন আমাকে এক দল লোকের মাঝে স্মরণ করে, আমিও তাকে স্মরণ করি একদল (ফেরেশতাদের) মাঝে, যারা তাদের চেয়ে উত্তম। যখন সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। যখন সে আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে, তখন আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে যাই আর যখন সে আমার দিকে হেঁটে আসে, তখন আমি তার দিকে দ্রুত অগ্রসর হই’।[3]
(৮) যিকির-আযকারের বৈঠক ফেরেশতামণ্ডলী বেষ্টন করে রাখেন: আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ تَعَالَى يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلَا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ.
‘যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর কোনো ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তা নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হয়, তাদেরকে রহমত ঢেকে নেয়, ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের কাছে তাদের কথা স্মরণ করেন’।[4]
(৯)যিকির-আযকারকারী ব্যক্তির কথা আল্লাহর নিকটে উল্লেখ করা হয়: নু‘মান ইবনে বাশীর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ مِمَّا تَذْكُرُونَ مِنْ جَلاَلِ اللَّهِ التَّسْبِيحَ وَالتَّهْلِيلَ وَالتَّحْمِيدَ يَنْعَطِفْنَ حَوْلَ الْعَرْشِ لَهُنَّ دَوِيٌّ كَدَوِيِّ النَّحْلِ تُذَكِّرُ بِصَاحِبِهَا أَمَا يُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَكُونَ لَهُ - أَوْ لاَ يَزَالَ لَهُ - مَنْ يُذَكِّرُ بِهِ.
‘তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ)-এর মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর যে মহিমা বর্ণনা করো, তা মৌমাছির গুনগুন আওয়াজের ন্যায় শব্দ করে আরশের চারপাশে ঘুরতে থাকে। সেগুলো যিকিরকারীর কথা স্মরণ করতে থাকে। তোমাদের কেউ কি এটা পছন্দ করে না যে, আল্লাহর নিকট অনবরত তাকে উল্লেখকারী কেউ থাকুক?’[5]
(১০) দু‘আর আগে যিকির-আযকার: বলা হয়, الأَذْكار أَكَبَر مِن الدُّعاء অর্থাৎ দু‘আর চেয়ে যিকির বড় বা দু‘আর আগে যিকির। সূরা আল-ফাতিহার শুরুই হয়েছে যিকির-আযকার দিয়ে (আল-হামদু থেকে ইয়্যাকা না‘বুদু পর্যন্ত) আর শেষ হয়েছে দু‘আ দিয়ে (ইহদিনা থেকে শেষ পর্যন্ত)। সূরা আল-ফাতিহার অসংখ্য শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হলো, আল্লাহর কাছে নিজের জন্য কিছু চাওয়ার পূর্বে তাঁর প্রশংসা করা।
আল্লাহর যিকির-আযকার করলে ব্যক্তি দু‘আ করার পূর্বেই আল্লাহ তার চাওয়া-পাওয়া পূরণ করে দিতে পারেন। যেমন ইউনুস আলাইহিস সালাম পানিতে মাছের পেটে থাকাকালীন বারবার আল্লাহর যিকির করায় আল্লাহ তাকে সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন। মাছের পেটের ভিতর থেকে একমাত্র আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই তাঁকে নাজাত দেওয়া হয়েছিল। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন,فَلَوْلَا أَنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُسَبِّحِينَ - لَلَبِثَ فِي بَطْنِهِ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘সে (ইউনুস আলাইহিস সালাম) যদি তিনি আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণাকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি কিয়ামত পর্যন্ত মাছের পেটেই অবস্থান করতেন’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১৪৩-১৪৪)।
উপর্যুক্ত আলোচনায় যিকির-আযকারের ফযীলত দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে গেল। যদি আমরা সুস্পষ্টভাবে জানার পরও কাজে বাস্তবায়ন করতে অক্ষম হয়ে পড়ি, তাহলে আমাদের জীবিত আর মৃত ব্যক্তির মাঝে কোনোই পার্থক্য থাকবে না। যিকির না করার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবূ মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَثَلُ الَّذِي يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِي لَا يَذْكُرُ مَثَلُ الْحَيّ وَالْمَيِّت ‘যে ব্যক্তি তার রবকে স্মরণ করে আর যে স্মরণ করে না, তাদের উদাহরণ হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো’।[6]
মৃত ব্যক্তি যেমন অনুভব ও অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি মৃত আত্মাও অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। যার ফলে বান্দা তার রবকে যথাযথভাবে চিনতে ব্যর্থ হয়। তখন বান্দা তার রবের ইবাদত করে প্রকৃত স্বাদ পায় না আর অতি সহজেই পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আত্মার সজীবতা দান এবং তাকে জীবিত রাখতে যিকির-আযকারের কোনো বিকল্প নাই। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর যিকিরকারী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
হুসাইন আহমাদ আল-ইয়াদী
শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. শুআবুল ঈমান, ১/৩৯৬।
[2]. তিরমিযী, হা/৩৩৭৭, হাদীছ ছহীহ।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪০৫।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/১৪৫৫, হাদীছ ছহীহ।
[5]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮০৯।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪০৭।