ডেঙ্গুর বর্তমান চিত্র:
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি বছরই বাড়ছে। গরমের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। আর এর ফলেই ডেঙ্গু সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নেয়। চলতি বছর (২০২৫) এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২,৯৮৬ জন। এর মধ্যে ৬০.৫% পুরুষ এবং ৩৯.৫% নারী। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২,৭৩৫ জন আর মারা গেছেন ২১ জন।
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক।
- ২০২৪ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১,০১,২১৪ জন; মারা গেছেন ৫৭৫ জন।
- ২০২৩ সালে রেকর্ড গড়ে আক্রান্ত হন ৩,২১,১৭৯ জন; মারা যান ১,৭০৫ জন।
- ২০২২ সালে মারা যান ২৮১ জন; আক্রান্ত ৬২,৩৮২ জন।
- করোনা মহামারির সময় (২০২০) সংক্রমণ তুলনামূলক কম হলেও, ২০২১ সালে আক্রান্ত হন ২৮,৪২৯ জন এবং মারা যান ১০৫ জন।
কেন বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রভাব বেশি?
ডেঙ্গুর মূল বাহক এডিস মশা উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে এর জন্য অনুকূল পরিবেশ সবসময়ই বিরাজমান। এর পাশাপাশি—
১. জলবায়ু পরিবর্তন ও গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
২. অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পানি নিষ্কাশনের অভাব।
৩. পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি।
এসব কারণ ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডেঙ্গুর লক্ষণ:
ডেঙ্গুর উপসর্গ হালকা থেকে মারাত্মক হতে পারে—
১. সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর: হঠাৎ উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, বমি, লাল ফুসকুড়ি, পিঠব্যথা।
২. রক্তক্ষরা ডেঙ্গু: উচ্চ জ্বরের পাশাপাশি রক্তপাত, ত্বকে দাগ, রক্তের প্লাটিলেট হ্রাস, শক।
৩. ডেঙ্গু শক সিনড্রোম: রক্তচাপ হ্রাস, তীব্র দুর্বলতা, পেটব্যথা, বমি, ঘাম, শীতলতা।
ডেঙ্গু প্রতিরোধই প্রধান করণীয়:
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই সর্বোত্তম। এজন্য—
১. বাড়ির আশপাশে পানি জমতে দেবেন না।
২. পরিত্যক্ত টায়ার, বোতল, ডাবের খোসা, ফুলের টব ইত্যাদি সরিয়ে ফেলুন।
৩. মশা জন্মানোর সম্ভাব্য স্থান পরিষ্কার রাখুন।
৪. সরকার ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ—দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, আপনার বাড়ির পাশের মশা আপনাকেই আক্রমণ করবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও সহায়ক ঘরোয়া উপায়:
যদিও ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কিছু প্রাকৃতিক উপায় সহায়ক হতে পারে—
১. মধু– ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে।
২. কালিজিরা তেল– পরিমিত সেবন উপকারী (ডাক্তারের পরামর্শসহ)।
৩. নিমের তেল– মশা তাড়াতে পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে বা ত্বকে লাগানো যায়।
৪. নারকেল তেল– মশা প্রতিরোধে সহায়ক।
৫. হলুদ – রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৬. দুধ, কলা, ডিম– পুষ্টি জোগায়, ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে।
৭. পেঁপে পাতা ও পাকা পেঁপে– প্লাটিলেট বৃদ্ধি করে।
৮. ড্রাগন ফল– রক্তের সাদা কণিকা (WBরাযিয়াল্লাহু আনহু) বৃদ্ধি করে।
৯. মিষ্টি কুমড়া ও বীজ– প্লাটিলেট তৈরিতে সহায়ক।
১০. লেবু– ভিটামিন সি সরবরাহ করে, প্লাটিলেট রক্ষা করে।
১১. দেশি মাছ– রক্ত বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ডেঙ্গু রোগীর যত্ন:
১. শরীর ঠাণ্ডা রাখতে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছুন।
২. প্রচুর পানি ও ওরস্যালাইন দিন।
৩. রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করুন।
৪. নিজে থেকে ওষুধ সেবন না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন:
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরী। প্রতিটি পরিবার ও সমাজ যদি নিজের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে ডেঙ্গুর ছোবল অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। সচেতনতাই হতে পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।