কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইউরিন ইনফেকশন : প্রকৃতি, কারণ ও প্রতিকার

post title will place here

সুস্থতা মহান আল্লাহ প্রদত্ত একটি বিশেষ নেয়ামত। যখন আমরা অসুস্থ হই, তখন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করি। হাদীছে এসেছে, ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ ‘দুটি জিনিসের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ বেশি প্রতারিত হয়, একটি হলো সুস্থতা, অপরটি হলো অবসর’।[1]

আমাদের শরীরে বার্ধক্যজনিত কারণে ভেজাল খাদ্য খাওয়ার কারণে, অসচেতনতা প্রভৃতি কারণে নিজের অজান্তেই রোগ বাসা বাঁধছে। তেমনি আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার সুস্থতার জন্য সেই রোগ নিরাময়ের জন্য তার ঔষধও পাঠিয়েছেন।

বক্ষ্যমান প্রবন্ধে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রকট আকার ধারণ করা ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবজনিত সমস্যা, তার উপসর্গ ও তা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবজনিত সমস্যা : মূত্রতন্ত্রের যেকোনো অংশে যদি জীবাণুর সংক্রমণ হয়, তাহলে সেটাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) বলা হয়। কিডনি, মূত্রনালি একাধিক অংশে একসঙ্গে এই ধরনের ইনফেকশন হতে পারে। সাধারণত এই সমস্যাটি নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে হলেও নারীদের মধ্যে ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। নানা কারণে মানুষ আজকাল ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সমস্যায় ভোগেন। দীর্ঘদিন এ সমস্যায় ভুগলে কিডনি অকেজো হতে পারে। এছাড়াও মূত্রথলিতে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইউটিআই হলো এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ। যখন এর ফলে মূত্রনালির নিম্নাংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে মূত্রথলির সংক্রমণ (সিস্টাইটিস) বলে আর যখন এর ফলে মূত্রনালির ঊর্ধ্বাংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে কিডনির সংক্রমণ (পায়েলোনেফ্রাইটিস) বলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ই-কলি নামের একটি ব্যাকটেরিয়াই এই রোগের উৎস।

ইউরিন ইনফেকশনের উপসর্গ : ইউরিন ইনফেকশনের প্রধান উপসর্গগুলো হলো— ১. প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করা, ২. একটু পরপর প্রস্রাব লাগা কিন্তু ঠিকমতো না হওয়া, ৩. প্রস্রাবের রং লালচে হওয়া, ৪. প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, ৫. দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব, ৬. নারীদের গোপনাঙ্গে ব্যথা অনুভব করা, ৭. পুরুষদের মলদ্বারে ব্যথা অনুভব করা, ৮. বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, ৯. তলপেটে বা পিঠে তীব্র ব্যথা অনুভব করা, ১০. সারাক্ষণ জ্বর জ্বর ভাব অথবা কাঁপুনি দিয়ে ঘনঘন জ্বর হওয়া। বিশেষ করে গরমের দিনে খুব সহজেই মূত্রাশয়ের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।

ইউরিন ইনফেকশনের কারণ :

(১) পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না খাওয়ার ফলেই বেশিরভাগ মানুষ এই সংক্রমণে ভোগেন। এক্ষেত্রে পানিশূন্যতার কারণে মূত্রথলিতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়।

(২) নারী-পুরুষ অনেকেই টাইট অন্তর্বাস পরেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। টাইট অন্তর্বাস ব্যবহারের ফলে যৌনাঙ্গ অতিরিক্ত আর্দ্র অবস্থায় থাকে। যার ফলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায়।

(৩) মলত্যাগের সময় পায়ুপথ থেকে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে প্রবেশ করলে।

(৪) মলত্যাগের পর পায়ুপথে পেছন থেকে সামনের দিকে টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করলে টিস্যুর সংস্পর্শে ব্যাকটেরিয়া অনুপ্রবেশ করতে পারে।

(৫) কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে (বিশেষ করে শিশুদের) ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।

(৬) যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যাদের ডায়াবেটিস বা ক্যান্সার রয়েছে অথবা যারা ক্যান্সারের ওষুধ নিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও এ ইনফেকশনের ঝুঁকি বেশি।

(৭) যারা হাই কমোড ব্যবহার করেন তাদেরও ঝুঁকি বেশি। কারণ কমোডের বসার জায়গায় লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে চলে আসতে পারে।

(৮) যারা অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখেন তাদের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে।

(৯) ক্যাথিটার লাগালেও ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। তাছাড়া যাদের মূত্রপথে পাথর তৈরি হয় কিংবা প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয় তাদেরও ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেশি।

(১০) গর্ভাবস্থায় এই ইনফেকশন দেখা দিতে পারে অনেকের।

(১১) মাসিকের রাস্তায় সঠিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে না পারলে কিংবা মাসিকের বর্জ্য মূত্রপথের সংস্পর্শে এসেও ইনফেকশন ঘটাতে পারে।

(১২) মূত্রনালিতে ব্লকেজ তথা কিডনিতে পাথর বা বর্ধিত প্রোস্টেট প্রস্রাবকে মূত্রাশয়েই আটকে দিতে পারে, যা প্রস্রাবে ইনফেকশনের অন্যতম আরেকটি কারণ।

ইউরিনারি ইনফেকশন প্রতিরোধের উপায় :

(ক) প্রস্রাব আটকে না রাখা : দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখা হতে পারে ইউরিনারি ইনফেকশনের প্রধান কারণ। প্রস্রাব যদি মূত্রাশয়ে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হয়, তাহলে তাতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতি ২০ মিনিটে মূত্রস্থিত ই-কলি ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর বেশিসংখ্যক ব্যাকটেরিয়া মানে বেশি ব্যথা। তাই নিঃসন্দেহে সেরা উপায় হলো প্রচুর পানি পান করা এবং মূত্রত্যাগের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া বের করে দেওয়া।

(খ) প্রচুর পানি পান করা : যেকোনো রোগের প্রতিরোধক হলো প্রচুর পানি পান করা। ইউরিনারি ইনফেকশনের জন্য এটাই একক এবং সেরা উপায়। গবেষণায় জানা গেছে, প্রচুর পানি পান শুধু মূত্রত্যাগের সময় জ্বালাপোড়াই কমায় না, ইউরিনারি ইনফেকশনও দূর করে।

(গ) ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়া : নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ কমিয়ে দিতে পারে ইউরিনারি ইনফেকশনের সম্ভাবনা। দিনে ১০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণে শরীরে যে অম্ল উত্‍পন্ন হয়, তাতে মূত্রে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিস্তার হ্রাস পায়। বিশেষ করে লেবু, টমেটো, কমলালেবু, ব্রকোলি, আমলকি ইত্যাদি খেলে তা সহজেই মোকাবেলা করা যায়। আমলকি একটি অসাধারণ পুষ্টিগুণে ভরপুর ভেষজ ফল। একটি আমলকিতে প্রায় ২০টি কমলার সমান ভিটামিন সি থাকে। ১০০ গ্রাম তাজা আমলকিতে থাকে প্রায় ৪৭০-৬৮০ মিলিগ্রাম খাঁটি ভিটামিন সি। বিজ্ঞানে এ ফলকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে।

(ঘ) সহবাসের আগে ও পরে প্রস্রাব করা : মিলনের আগে ও পরে মূত্রত্যাগ করা ইউরিনারি ইনফেকশন রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে এটা বেশি কার্যকর।

(ঙ) গরম পানিতে গোসল করা : ইউরিনারি ইনফেকশনের ফলে সৃষ্ট ব্যথা উপশমে কুসুম গরম পানিতে গোসল অনেকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

(চ) স্বাস্থ্যবিধি পালন করা : ঢিলেঢালা পোশাক পরা, সুতি কাপড়ের অন্তর্বাস ব্যবহার করা, নিয়মিত গোসল করা, সঠিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা, সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি খুবই জরুরী।

(ছ) সোডা-পানি পান করা : এক গ্লাস পানিতে এক চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে সপ্তাহে এক দিন সকাল বেলা পান করলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমবে ।

(জ) শসা খাওয়া : শসাতে প্রচুর পানি আছে। প্রতিদিন কমপক্ষে একটি শসা স্লাইস করে খেতে পারেন।

(ঝ) গরম সেঁক নেওয়া : হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি নিয়ে আপনার তলপেটের উপর রাখুন, এতে খুব দ্রুত প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া ও ব্যথা দূর হবে।

(ঞ) প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া : প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবার খেলে এটার উপশম হয়। যেমন— টকদই, কিমচি, আচার ইত্যাদি।

(ট) মধুমিশ্রিত লেবুপানি পান করা : কুসুম গরম পানিতে একটা লেবুর রস ও এক চা চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে পারেন। মধুমিশ্রিত লেবুপানি প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমাতে একটি জনপ্রিয় ঘরোয়া চিকিৎসা।

পরিশেষে বলা যায়, এই রোগ এখন অনেকের হচ্ছে। আমরা একটু সচেতন হলেই এসব অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা পেতে পারি। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার মাধ্যমে আমরা অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারি, সেজন্য চাই শুধু একটু সদিচ্ছার প্রয়োজন।

উম্মে মুহাম্মাদ

আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।

[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১২; মিশকাত, হা/৫১৫৫।

Magazine