চোখের যত্নে ওযূর ভূমিকা : আল্লাহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসেন। কদর্যতা-মলিনতাকে তিনি পছন্দ করেন না। অপরিষ্কার দেহ সুস্থ থাকতে পারে না। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিষ্কার রাখলে রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ দৃষ্টিকোণে ওযূর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বলা হয়ে থাকে, পানি সর্বরোগের মহৌষধ। আগুনকে যেমন পানি দ্বারা নির্বাপিত করা যায়, তেমনি রোগজীবাণুকেও পানি দ্বারা অপসারিত করা যায়। চোখে ময়লা ঢুকলে কোনো পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন পুশ করে ময়লা দূরীভূত করা যায় না। কোনো দেশি বা বিদেশি নামকরা টনিক সেবন করেও এসব পরিষ্কার করা চলে না। পরিষ্কারের জন্য পানিরই প্রয়োজন। এই পানিই ওযূর উপকরণ।
হাকেম মুহাম্মাদ তারেক মাহমূদ চাগহাঈর মতে, ওযূ করার পর যে অঙ্গগুলো ভিজে যায়, মেডিকেল সায়েন্স অনুযায়ী যদি এ অঙ্গগুলো আর্দ্র থাকে, তাহলে চোখের রোগ হতে মানুষ বেঁচে যায়। অন্যথা চোখের আর্দ্রতা কমে যাওয়ার ফলে রোগী ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। দিনের মধ্যে বারবার ওযূর জন্য চেহারা ধৌত করার কারণে এর সৌন্দর্য বেড়ে যায়। ওযূর মাধ্যমে ভ্রুতে পানি লেগে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, ভ্রু ভেজা থাকলে চোখের এমন মারাত্মক রোগ হতে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে, যেসব রোগের কারণে চোখের দৃষ্টিশক্তি পর্যায়ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। আমাদের মধ্যে অনেকের চোখে ব্যথা হলে চোখে পানির ছিটা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি এটা একটা ভালো ব্যবস্থা। অথচ এ ব্যবস্থা প্রত্যেক মুসলিমের ওযূর মধ্যে নিহিত আছে। এর মাধ্যমে চোখের অসুখ কমে যায়। ধুলাবালি দূর হয়ে যায়।
ইউরোপের একজন ডাক্তার ‘চোখ, পানি ও স্বাস্থ্য’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে সেখানে তিনি প্রতিদিন কয়েকবার পানি দিয়ে চোখ ধোয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তোমরা প্রতিদিন একাধিকবার মুখ ধৌত করো। অন্যথা তোমরা মারাত্মক চোখের রোগে আক্রান্ত হবে। অথচ এটা মুসলিমরা ওযূর মাধ্যমে দিনে কমপক্ষে পাঁচ বার করছেন। আল-হামদুলিল্লাহ!
একজন নিয়মিত ছালাত আদায়কারী বৃদ্ধই এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যিনি ছালাতের জন্য দৈনিক পাঁচ বার ওযূ করেন। ৫০ বছরের বৃদ্ধ ব্যক্তি যেখানে ভালো করে দেখতে পারে না, সেখানে ১০০ বছরের বৃদ্ধ সুন্দর চেহারা, অটুট স্বাস্থ্য ও ভালো দৃষ্টিশক্তি নিয়ে অবলীলায় চলাফেরা করেন। এটাই ওযূর ইহকালীন নগদ পুরস্কার।[1]
কুদৃষ্টির ক্ষতি ও চিকিৎসা বিজ্ঞান : কুদৃষ্টির কারণে নানারকম রোগ দেখা দেয়। এক সেকেন্ডের কুদৃষ্টি হলেও সে দৃষ্টি মনকে দুর্বল করে দেয়। মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব জাগে। কেউ দেখে ফেলল কি-না এ চিন্তাও মনে আসে। মন দুর্বল হয়ে যায়। নানা কুচিন্তা মনকে আচ্ছন্ন করে। ঘনঘন পেশাবের বেগ হয়। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। মনের মধ্যে ভূমিকম্পের ন্যায় পরিস্থিতি তৈরি হয়।
হঠাৎ দৃষ্টি পড়ার পর চোখ ফিরিয়ে নেওয়া হলেও মনে কাঁপন জাগে। কিন্তু এতে পাপ করার চিন্তা থাকে না।
গভীর দৃষ্টিতে দেখা চোখের জন্য ক্ষতিকর : কোনো জিনিসের প্রতি অপলক তাকিয়ে থাকাকে বলা হয় গভীর দৃষ্টিতে তাকানো। যারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অভ্যাসের দাস হয়ে যায়, তাদের চোখের দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কাজেই কোনো জিনিসের প্রতি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা আমাদের উচিত নয়। এ অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ গভীর দৃষ্টিতে কারো প্রতি তাকিয়ে থাকার অভ্যাস ভালো নয়। এতে আমাদের চোখের দৃষ্টি দুর্বল হয়ে যাবে।
পুরুষ ও নারীদের উচিত দৃষ্টি নিচু করা : পুরুষ ও নারীদের কর্তব্য হচ্ছে তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি নিচু রাখে। বর্তমান সমাজে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, দৃষ্টির হেফাযত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কুরআনে বর্ণিত দৃষ্টি নিচু রাখার যে আদেশ রয়েছে তার উপর আমল করতে হবে, তাতে মনের ভিতর মহান আল্লাহর ভয় জাগ্রত করতে হবে। চিন্তা করতে হবে যে, মহান আল্লাহ আমাকে দেখছেন। মহান আল্লাহর ভয় মনে যত বেশি জাগ্রত হবে, পাপ ও অন্যায় থেকে আত্মরক্ষা করা তত সহজ হবে। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘চোখ ব্যভিচার করে। চোখের ব্যভিচার হচ্ছে দেখা’।[2]
কুদৃষ্টি ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি : মনে রাখতে হবে কুদৃষ্টি হচ্ছে ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি। কুদৃষ্টির মাধ্যমে বড় রকমের অশ্লীলতার দ্বার খুলে যায়। কুদৃষ্টির পাপ বন্ধ করার জন্য কুরআন গাইডলাইন দিয়েছে।
মহান আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের আদেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে। তাদের কামনা যেন নিয়ন্ত্রণ করে। একবার যদি হঠাৎ করে চোখ পড়ে যায়, তবে যেন চোখ ফিরিয়ে নেয়। পুনরায় যেন না তাকায়। কারণ দ্বিতীয়বার দেখা হবে তার নিজের ইচ্ছায়। তাকে এক্ষেত্রে নির্দোষ বলা যাবে না।
মানুষ যদি তার দৃষ্টিকে চলার পথে সংযত করতে পারে, তাহলে তার আত্মিক পরিশুদ্ধির পথ উন্মোচিত হবে। হাদীছে প্রথমবারের অনিচ্ছাবশত দৃষ্টিকে ক্ষমা করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার দেখার পাপ ক্ষমা করা হয়নি।
কুদৃষ্টি সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা : আধুনিক ফিরিঙ্গি সভ্যতার চিন্তাধারা হচ্ছে দেখলে কী ক্ষতি? শুধু তো দেখাই হলো। এতে দোষের কী আছে? প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে ,হঠাৎ যদি সামনে বাঘ এসে পড়ে এক নযর তার প্রতি তাকালে কেমন লাগবে? সবুজ গাছপালা, তরুলতা, সুন্দর ফুল একবার দেখেই কেমন মনে হয়? মন কি আনন্দে, শিহরণে ভরে যায় না? রক্তাক্ত আহত কোনো মানুষকে দেখামাত্র অনুভূতি কেমন হয়? মন কি বিপদে, দুঃখে পূর্ণ হয়ে যায় না? কেউ কেউ কিছু দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে যায় না? কিন্তু কেন এমন হয়?
দৃষ্টি যেখানেই পতিত হয়, এর একটা ভালো বা মন্দ প্রভাব রয়েছে। সে প্রভাব মন-মগজে রেখাপাত করে। কামনার দৃষ্টিতে কারো প্রতি তাকালে হরমোনারি সিস্টেমে খারাপ কিছুই দেখা দেয়। কারণ সে দৃষ্টির প্রভাবে বিষ রয়েছে। এতে মানুষের দেহ অভ্যন্তরে তোলপাড় হয়ে যায়। ফলে নানা রোগের আক্রমণ ঘটে। অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ যদি তার দৃষ্টি সংযত না করে, তবে অবসাদ, অস্থিরতা এবং হতাশার শিকার হয়। এর চিকিৎসা অসম্ভব। কারণ দৃষ্টি মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং আবেগকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। এরকম বিপজ্জনক অবস্থা থেকে মানুষ ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
কুদৃষ্টিরকারণে ইবাদতের মধ্যে কোনো স্বাদ পাওয়া যায় না : কুদৃষ্টির একটি ক্ষতি হচ্ছে, এতে ইবাদত-বন্দেগীর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। ইবাদতের মধ্যে কোনো প্রকার স্বাদ পাওয়া যায় না।
কুদৃষ্টির পর চোখের নূর অবশিষ্ট থাকে না : কুদৃষ্টির একটি ক্ষতি হচ্ছে এ কুদৃষ্টির পর চোখে অন্ধকার ঘিরে থাকে, চোখের নূর অবশিষ্ট থাকে না। মনে অস্থিরতা ছেয়ে যায়। আর একটি ক্ষতি হচ্ছে, এ পাপ যত বেশি করা হয়, ততই করতে মন চায়। যারা কুদৃষ্টি দিয়ে থাকে তাদের প্রতি মহান আল্লাহর অভিশাপ। তারা মহান আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়। হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘চোখের ব্যভিচার হচ্ছে দেখা, কানের ব্যভিচার হচ্ছে শোনা, জিহ্বার ব্যভিচার হচ্ছে কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হচ্ছে স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হচ্ছে হেঁটে যাওয়া, মনের ব্যভিচার হচ্ছে মনে মনে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা, তারপর লজ্জাস্থান সে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করে অথবা সে ঘটনা মিথ্যা করে দেয়’।[3]
কুদৃষ্টি ও আধুনিক বিজ্ঞান : মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে সংযত রাখা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ‘আপনি মুমিনদের বলুন! তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে’ (আন-নূর, ২৪/৩০)। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ‘নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (আল-ইসরা, ১৭/৩৬)। জারীর রযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হঠাৎ পড়ে যাওয়া দৃষ্টি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, ‘তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে’।[4]
চোখ সম্পর্কে অজানা তথ্য : নিম্নে চোখ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য দেওয়া হলো :
(১) পরিপূর্ণ একটি চোখের ওযন হয় ৭.৫ গ্রাম।
(২) একটি অক্ষিগোলকের ওযন হয় প্রায় ১ আউন্স।
(৩) চোখ খোলা রেখে মানুষ কখনোই হাঁচি দিতে পারে না। (৪) মানুষের চোখ ১০ হাজারটি আলাদা আলাদা রং চিনতে পারে।
(৫) মানুষ গড়ে প্রতি ২ সেকেন্ড পরপর চোখের পলক ফেলে।
(৬) গড়ে প্রতিটি চোখের পলকের স্থায়িত্ব হয় ১ সেকেন্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগ সময় পর্যন্ত।
(৭) মানুষ এক দিনে গড়ে ২০ হাজার বার চোখের পলক ফেলে।
(৮) পুরুষের চেয়ে মহিলারা প্রায় দ্বিগুণ চোখের পলক ফেলে।
(৯) শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে অনেক কম চোখের পলক ফেলে।
(১০) অক্ষিগোলকের শতকরা ৩ ভাগ জুড়েই রয়েছে লবণ।
(১১) মানুষের চোখ বা অক্ষিগোলকের ৬ ভাগের ৫ ভাগ থাকে ভেতরে, বাকি অংশ থাকে উন্মুক্ত।
(১২) আনন্দময় কোনো কিছু চোখে পড়লে আমাদের চোখের মণি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
(১৩) মানবদেহের সবচেয়ে সক্রিয় পেশিগুলোর অবস্থান চোখে।
(১৪) মানুষ খালি চোখে ১ মাইল দূর থেকে অন্ধকারে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি দেখতে পায়।
(১৫) আমাদের প্রতিটি চোখে ১২ কোটি রড আছে।
মো. হারুনুর রশিদ
[1]. পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে মুহাম্মদ (সাঃ), পৃ. ১২০।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৫৬।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৭; আবূ দাঊদ, হা/২১৫৩।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/২১৪৮, হাদীছ ছহীহ।