আরবী ক্যালেন্ডার অনুসারে দশম মাস হলো ‘শাওয়াল’ মাস। রামাযানের পরপরই আগমন ঘটে শাওয়াল মাসের। এ মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে শাওয়াল মাস ও শাওয়ালের ছয়টি ছিয়াম নিয়ে আলোচনা করা হলো।
‘শাওয়াল’ নামকরণের কারণ ও এ মাসেরবৈশিষ্ট্য :
তাফসীর ইবনু কাছীরে এসেছে, শাওয়াল অর্থ উঠানো। আরবরা এ মাসে শিকার করার উদ্দেশ্যে কাঁধে অস্ত্র উঠাত। এজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে ‘শাওয়াল’। এ মাসটি কিছু বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার দাবি রাখে। তা হলো শাওয়াল মাসেই মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিত্বর পালিত হয়। শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ এ তিনটি মাস জুড়ে হজ্জের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আর হজ্জ সম্পাদনের তিনটি মাসের প্রথম মাসই হলো শাওয়াল মাস। এ মাসে অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ছয়টি নফল ছিয়াম রয়েছে।
শাওয়াল মাসে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা :
শাওয়াল মাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। যেমন হিজরতের প্রথম বছরে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর সাথে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল, বনূ কাইনুকার যুদ্ধ, আবূ আফাককে হত্যা করার জন্য সালেম ইবনু উমাইরের অভিযান, উহুদের যুদ্ধ, হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের শাহাদাত এবং হিজরতের তৃতীয় বছরে হামরা আল-আসাদের যুদ্ধ।
শাওয়াল মাসের ছিয়ামের ফযীলত :
শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ফযীলতপূর্ণ। নিচে কিছু ফযীলত তুলে ধরা হলো।
(১) মহান আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করা যায়। হাদীছে এসেছে, আবূ আইয়ূব আল-আনছারী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ ‘রামাযানের ছিয়াম পালন করে শাওয়াল মাসে ছয় দিন ছিয়াম পালন করলে সারা বছর ছিয়াম পালন করার সমতুল্য হবে’।[1] আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا﴾ ‘যে কেউ কোনো নেক আমল করবে তাকে তার ১০ গুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে’ (আল-আনআম, ৩/১৬০)।
অতএব, রামাযান মাসের ছিয়ামের ১০ গুণ ছওয়াব দেওয়া হলে তা হবে ৩০০ দিন আর শাওয়ালের ৬ ছিয়ামের ছওয়াব ১০ গুণ হলে তা হবে ৬০ দিন। আর মোট ৩৬০ দিনে আরবী বছর পূর্ণ হয়ে যায়।
(২) এই ছিয়ামের মাধ্যমে বান্দা তার রবের নৈকট্য লাভ ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَالَ «مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيْذَنَّهُ».
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সাথে শত্রুতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধের ঘোষণা রইল। আমার বান্দা যে সমস্ত জিনিস দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে, তার মধ্যে আমার নিকট প্রিয়তম জিনিস হলো তা, যা আমি তার উপর ফরয করেছি (অর্থাৎ ফরযের দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করা আমার নিকটে বেশি পছন্দনীয়)। আর আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, পরিশেষে আমি তাকে ভালোবাসি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যার দ্বারা সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই, যার দ্বারা সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে। আর সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তাহলে আমি তাকে দেই এবং সে যদি আমার আশ্রয় চায়, তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দেই’।[2]
(৩) ছিয়াম পরাক্রমশালী আল্লাহর জন্য এবং এর পুরস্কার তিনি নিজ হাতে দিবেন। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ لَهُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ سُبْحَانَهُ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِهِ ‘আদম-সন্তানের প্রতিটি কাজের ছওয়াব ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, তবে ছিয়াম ব্যতীত। কেননা তা শুধু আমার জন্য এবং আমিই তার পুরস্কার দিব’।[3]
(৪) একজন ছিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ছিয়াম ঢালস্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায় অথবা তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি ছিয়াম পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! অবশ্যই ছিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধির চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য পানাহার ও কামাচার পরিত্যাগ করে। ছিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় ১০ গুণ’।[4]
(৫) ছিয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে ঢালস্বরূপ।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «الصِّيَامُ جُنَّةٌ».
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ছিয়াম ঢালস্বরূপ’।[5]
শাওয়াল মাসে বিয়ে করার বিধান :
আজকাল অনেককে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায় শাওয়াল মাস আসলেই বিয়ে নিয়ে বেশ মাতামতি শুরু করে দেয়। তারা শাওয়াল মাসে বিবাহ করাকে সুন্নাত বলে প্রচার করে থাকে। অনেকে এই মাসে বিবাহ করবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। তাই আজ প্রকৃত বিষয়টি জানার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ কোনো মাস বা দিনে বিয়ে করতে উৎসাহিত করেননি বা এজন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়কে উত্তম বলেননি। তবে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে শাওয়াল মাসে বিয়ে করেছেন। যেমন উরওয়া রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,تَزَوَّجَنِى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِى شَوَّالٍ وَبَنَى بِى فِى شَوَّالٍ فَأَىُّ نِسَاءِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ أَحْظَى عِنْدَهُ مِنِّى قَالَ وَكَانَتْ عَائِشَةُ تَسْتَحِبُّ أَنْ تُدْخِلَ نِسَاءَهَا فِى شَوَّالٍ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে শাওয়াল মাসে বিবাহ করেন এবং শাওয়াল মাসে আমার সাথে প্রথম মিলিত হন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোন স্ত্রী তাঁর নিকট আমার চাইতে অধিক সম্ভোগ্য ছিলেন? আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা তাঁর বংশের মেয়েদের শাওয়াল মাসে বাসর ঘরে পাঠানো উত্তম মনে করতেন’।[6]
জেনে রাখা উচিত যে, জাহেলী যুগের মানুষের এই ধারণা ছিল যে, শাওয়াল মাসে বিবাহ-শাদির অনুষ্ঠান অশুভ ও অকল্যাণকর। তিনি বিবাহ করার মাধ্যমে জাহেলী যুগের এ ভিত্তিহীন ধারণাকে খণ্ডন করেছেন।[7] বাস্তবতা হলো প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে যেমন শাওয়াল মাসে বিয়ে করেছেন, তেমনি অন্যান্য মাসে অন্যান্য স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন। যদি শাওয়াল মাসে বিয়ে করা সুন্নাত হতো, তাহলে সবগুলো বিয়ে তিনি এ মাসে করার চেষ্টা করতেন বা উম্মতকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। আর ছাহাবীগণও এ মাসেই বিয়ে করার চেষ্টা করতেন, যেহেতু তারা ছিলেন সুন্নাহ পালনে সবচেয়ে অগ্রগামী। কিন্তু হাদীছে এমন কিছু সাব্যস্ত হয়নি। সুতরাং কেবল শাওয়াল মাসেই বিবাহ করা সুন্নাত এমনটি বলা উচিত না।
পরিশেষে বলতে চাই, শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে পালন করেছেন। তাই আমাদেরও উচিত এই ছয়টি ছিয়াম পালন করা। আর রামাযানের ৩০টি ছিয়াম পালনের পর এই ছয়টি ছিয়াম একদমই সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। তাই এই ছয়টি ছিয়াম পালনে আরও সচেষ্ট হওয়া দরকার। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শাওয়ালের ছয়টি ছিয়াম পালনের মাধ্যমে নেকীর পাল্লা ভারী করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
এ. এস. এম. মাহবুবুর রহমান
শিক্ষার্থী, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া;
দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, ঢাকা।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৪; মিশকাত, হা/২০৪৭।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫০২; মিশকাত, হা/২২৬৬।
[3]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৮২৩, হাদীছ ছহীহ।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২৩।
[7]. শরহে মুসলিম, ৯/২০৯।