কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

হজ্জ ও উমরা (পর্ব-১৮)

মুযদালিফায় রাত্রিযাপন : সূর্য ভালোভাবে অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে হবে। অতঃপর ধীরস্থির, শান্ত ও নম্রভাবে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা দিতে হবে। মুযদালিফায় পৌঁছে এক আযান ও দুই ইক্বামতে মাগরিব ও এশার ছালাত জামাআতবদ্ধভাবে ক্বছর করতে হবে। মাগরিব ও এশায় কোনো সুন্নাত ছালাত আদায় করতে হবে না। ৯ই যিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান হতে তালবিয়া পাঠ, তাকবীর পাঠ এবং তওবা ও ইস্তিগফার করতে করতে ধীরে ধীরে প্রায় ৯ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সূর্যাস্তের পূর্বে আরাফা ত্যাগ করা যাবে না। যদি ফিরে না আসে তাহলে কাফফারা দম (পশু জবেহ) ওয়াজিব হবে। তারপর মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার ছালাত একসাথে আদায় করতে হবে। মাগরিব তিন রাকআত এবং এশা দুই রাকআত ক্বছর করতে হবে। দুই ছালাতের মাঝে এবং এশার ছালাতের পর আর কোনো ছালাত নেই। এরপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলেন। এতে বুঝা যায়, তিনি এ রাতে বিতর বা তাহাজ্জুদ পড়েননি। কোনো কারণে মাগরিব ও এশার মাঝে ব্যবধান ঘটলে কোনো সমস্যা নেই। মুযদালিফায় ঘুম থেকে উঠে আওয়াল ওয়াক্তে ফজরের ছালাত আদায় করে দীর্ঘ সময় কিবলামুখী হয়ে দু‘আ ও ইস্তিগফার করতে হবে। সম্ভব হলে মাশআরুল হারাম মসজিদে ছালাত আদায় করতে হবে। তারপর ভালোভাবে আকাশ ফর্সা হলে সূর্যোদয়ের আগেই মিনার দিকে রওয়ানা দিতে হবে। তবে দুর্বলদের এবং মহিলাদের নিয়ে অর্ধরাত্রিতেই মিনা যাওয়া যায়। অর্ধরাত্রির পূর্বে মুযদালিফা ত্যাগ করা যাবে না। অর্ধরাত্রির আগে মুযদালিফা ত্যাগ করলে কাফফারা দম ওয়াজিব হবে। মুযদালিফা হতে মিনায় যাওয়ার সময় সাতটি ছোট পাথর কুড়িয়ে নিতে হবে। সকালে মিনায় গিয়ে বড় জামরায় মারতে হবে। এ সময় বিশেষ ধরনের কঙ্কর কুড়ানোর জন্য টর্চ লাইট জ্বালিয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়া বিদআতী আক্বীদা মাত্র।

মিনায় ফিরে যাওয়া : ১০ই যিলহজ্জ ফজরের ছালাত আদায়ের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে মুযদালিফা থেকে তালবিয়া পাঠ করা অবস্থায় রওয়ানা হয়ে মুযদালিফার শেষপ্রান্ত ও মিনার সীমান্ত এলাকায় মুহাসসির উপত্যকায় একটু জোরে চলতে হবে। তারপর প্রায় ৫ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে মিনায় পৌঁছে সূর্যোদয়ের পর প্রথমে ‘জামরাতুল আকাবা’ যা প্রথম দুটি জামরার পরে রয়েছে এবং মক্কার দিকে রয়েছে, সেই বড় জামরাকে লক্ষ্য করে মক্কাকে বাম দিকে এবং মিনাকে ডান দিকে রেখে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। এ সময় তালবিয়া পাঠ বন্ধ করবে এবং ইহরাম খুলে ফেলবে। যদিও মাথা মুণ্ডন এবং কুরবানী বাকি থাকে। কোনো কারণে সকালে পাথর নিক্ষেপ করতে না পারলে বিকালে নিক্ষেপ করবে। আর যখন বিকালে ত্বাওয়াফ শেষ হবে, তখন হবে পূর্ণ হালাল। প্রথম হালালের পর স্ত্রী মিলন বৈধ হবে না। তবে দ্বিতীয় হালালের পর স্ত্রী মিলন বৈধ হবে।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما أَنَّ أُسَامَةَ رضي الله عنه كَانَ رِدْفَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ عَرَفَةَ إِلَى الْمُزْدَلِفَةِ ثُمَّ أَرْدَفَ الْفَضْلَ مِنَ الْمُزْدَلِفَةِ إِلَى مِنًى قَالَ فَكِلاَهُمَا قَالَ لَمْ يَزَلِ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُلَبِّى حَتَّى رَمَى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ.

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, উসামা ইবনু যায়েদ রযিয়াল্লাহু আনহু আরাফার ময়দান হতে মুযদালিফা পর্যন্ত ফিরে আসার সময় নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে বসেছিলেন। তারপর তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফা হতে মিনায় আসা পর্যন্ত (আমার বড় ভাই) ফযল ইবনু আব্বাসকেও তার পেছনে বসিয়েছিলেন। তারা উভয়ে বলেছেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামারাতুল আক্বাবায় কঙ্কর মারা পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করেছিলেন।[1]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ جَمَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ بِجَمْعٍ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا بِإِقَامَةٍ وَلَمْ يُسَبِّحْ بَيْنَهُمَا وَلَا عَلَى إِثْرِ كُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا.

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিব ও এশার ছালাত মুযদালিফায় একত্রে আদায় করেছেন। প্রত্যেক ছালাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ইক্বামত দিয়েছেন এবং এই দুই ছালাতের মাঝে কোনো নফল ছালাত আদায় করেননি এবং পরেও আদায় করেননি।[2]

عَنْ عَبْدُ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى صَلَاةً إِلَّا لِمِيقَاتِهَا إِلَّا صَلَاتَيْنِ صَلَاةَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ بِجَمْعٍ وَصَلَّى الْفَجْرَ يومئِذٍ قبلَ ميقاتها.

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কখনো মুযদালিফায় মাগরিব ও এশার ছালাত একত্রে আদায় করা ছাড়া আর অন্য কোনো ছালাত একত্রে আদায় করতে দেখিনি। আর সেদিনই তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের ছালাতও (কিছু সময়) আগে আদায় করেছিলেন।[3]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ أَنَا مِمَّنْ قَدَّمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ المُزْدَلِفَةِ فِي ضَعَفَةِ أَهْلِهِ.

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পরিবারের যে দুর্বলদের (শিশু ও মহিলা) মুযদালিফার রাতে সময়ের আগেই (মিনায়) পাঠিয়েছিলেন আমিও তাদের মধ্যে ছিলাম।[4]

عَن الفضلِ بن عبَّاسٍ وَكَانَ رَدِيفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ فِي عَشِيَّةِ عَرَفَةَ وَغَدَاةِ جَمْعٍ لِلنَّاسِ حِينَ دَفَعُوا عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَهُوَ كَافٌّ نَاقَتَهُ حَتَّى دَخَلَ مُحَسِّرًا وَهُوَ مِنْ مِنًى قَالَ عَلَيْكُمْ بِحَصَى الْخَذْفِ الَّذِي يُرْمَى بِهِ الْجَمْرَةَ وَقَالَ لَمْ يَزَلْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُلَبِّي حَتَّى رَمَى الْجَمْرَةَ.

ফযল ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উটের পেছনে বসা ছিলেন। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার সন্ধ্যায় ও মুযদালিফায় ভোর বেলায় লোকেদের উদ্দেশে বলেছেন, তোমরা (অবশ্যই) প্রশান্তির সাথে চলবে। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও নিজের উষ্ট্রীকে মিনার অন্তর্গত মুহাসসির নামক স্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত সংযত রেখেছিলেন। এখানে তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা আঙুল দিয়ে ধরা যায় এমন ছোট পাথর জামরাতে নিক্ষেপের জন্য নাও’। ফযল বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামরায় পাথর মারা পর্যন্ত সব সময় তালবিয়া পড়ছিলেন।[5]

عَنْ جَابِرٍ قَالَ أَفَاضَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ جَمْعٍ وَعَلَيْهِ السَّكِينَةُ وَأَمَرَهُمْ بِالسَّكِينَةِ وَأَوْضَعَ فِي وَادِي مُحَسِّرٍ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يَرْمُوا بِمِثْلِ حَصَى الْخَذْفِ وَقَالَ لَعَلِّي لَا أَرَاكُمْ بَعْدَ عَامِي هَذَا.

জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফা হতে প্রশান্তির সাথে ধীরস্থিরভাবে রওয়ানা হলেন, লোকজনকেও শান্তশিষ্টভাবে রওয়ানা হওয়ার জন্য আদেশ করলেন। তবে মুহাসসির উপত্যকায় পৌঁছার পর উটকে কিছুটা দৌড়ালেন এবং তাদের জামরায় আঙুল দিয়ে নিক্ষেপ করার মতো পাথর মারতে নির্দেশ দিলেন। এমন সময় তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সম্ভবত এ বছরের পর আমি আর তোমাদের দেখতে পাব না।[6]

প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সময় ডান হাত উঁচু করে বলতে হবে ‘আল্লাহু আকবার’। এভাবে সাত বার তাকবীর দিয়ে সাতটি কঙ্কর মারতে হবে। এ তাকবীরধ্বনি শয়তানের বিরুদ্ধে মুমিনের পক্ষ থেকে আল্লাহ যে সবচেয়ে বড়, তার ঘোষণা। কঙ্কর হাউজের মধ্যে পড়লেই হবে। পিলারের গায়ে লাগতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। অতএব সারকথা হলো, মিনায় পৌঁছে দুপুরের আগেই কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। তারপর কুরবানী করতে হবে। অতঃপর পুরুষেরা মাথা ন্যাড়া করবে অথবা মাথার চুল ছোট করবে। আর মহিলারা চুলের অগ্রভাগ সামান্য কেটে ফেলবে। তারপর ইহরাম খুলে স্ত্রী মিলন ছাড়া অন্য সবকিছু হালাল হয়ে যাবে, যা ইহরামের পূর্বে হালাল ছিল। তবে ত্বাওয়াফে ইফাযা করা হলে স্ত্রী মিলনও হালাল হয়ে যাবে। ‘ত্বাওয়াফে ইফাযা’-কে ‘ত্বাওয়াফে যিয়ারা’-ও বলা হয়। ত্বাওয়াফে ইফাযা একটি রুকন। যিলহজ্জের ১০ তারিখেই করতে হবে। না হলে আইয়ামে তাশরীকের মধ্যে করতে হবে। সম্ভব না হলে দম দিতে হবে।

মিনায় পাঁচটি কাজ : ১০ই যিলহজ্জ সকালে মুযদালিফা থেকে মিনায় পৌঁছে মোট পাঁচটি কাজ ধারাবাহিকভাবে করতে হবে। সেগুলো হলো : (১) বড় জামরায় কঙ্কর মারা, (২) কুরবানী করা, (৩) মাথা ন্যাড়া করা অথবা চুল ছোট করা, (৪) মক্কায় গিয়ে ত্বাওয়াফে ইফাযা করা ও (৫) সাঈ করা।

তবে এ কাজগুলোর কোনোটা আগে-পিছে হয়ে গেলে তাতে কোনো দোষ নেই। জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন চাশতের সময় বড় জামরায় পাথর নিক্ষেপ করেন। পরের দিনগুলোতে সূর্য ঢলার পর কঙ্কর নিক্ষেপ করেন।[7]

 (চলবে)


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫৪৪; মিশকাত, হা/২৬০৬।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৭৩; নাসাঈ, হা/৩০২৮; মিশকাত, হা/২৬০৭।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১৩৭; মিশকাত, হা/২৬০৮।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১৬৭৮; মিশকাত, হা/২৬০৯।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৮২; মিশকাত, হা/২৬১০।

[6]. তিরমিযী, হা/৮৮৬, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/২৬১১।

[7]. ছহীহ বুখারী, ৬/৪১৮, ‘পাথর নিক্ষেপ’ পরিচ্ছদ; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৯৯; মিশকাত, হা/২৬২০।

Magazine