সকল প্রশংসা সেই মহাজ্ঞানী আল্লাহর জন্য, যিনি নিজ জ্ঞান দ্বারা সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ নামক এক সৃষ্টির উদ্ভাবন করেছেন এবং তাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবী নামক এক গ্রহে প্রেরণ করেছেন। সেই সাথে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন। রবের দেওয়া নেয়ামতরাজির মধ্যে প্রধান এবং প্রথম ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান, যা চর্চার মাধ্যমে মানুষ তার নিজ স্রষ্টার পরিচয় লাভ করতে পারে। সবাই এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে, প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত জাতিসমূহের উত্থান ও পতন ঘটেছে জ্ঞানচর্চা করা অথবা তার প্রতি অবহেলার কারণে। কোনো ব্যক্তি, গোত্র বা জাতি ততদিন পর্যন্ত বিশ্বের বুকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে, যতদিন পর্যন্ত তারা জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত থাকবে। এরই চাক্ষুষ প্রমাণ আমরা হাজার বছরের ঊর্ধ্বে শাসন করা সেই মুসলিম জাতির দিকে নজর দিলেই দেখতে পাই। যখন থেকে তারা তাদের ধর্ম বা ধর্মীয় কিতাব আল-কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া শুরু করেছে, হাজার বছরের শাসন করা এক বিপ্লবী জাতি তখন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পানির উপরে স্রোতের গতিতে ভাসমান কচুরিপানার মতো মুমূর্ষু, দুর্বল, হিংসুটে, পরনিন্দাবাজ, অথর্ব, জাহেল, বর্বর, রুগ্ন এক গোলাম বা দাসত্বপূর্ণ জাতিতে পরিণত হয়েছে। যার মূল কারণ হচ্ছে জ্ঞানচর্চা এবং ধর্মচর্চা থেকে দূরে থাকা। এই দুইয়ের অপর প্রান্তে আরো দুটি জিনিসের অভাব রয়েছে, তা হলো ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতা। যুলুম বা অত্যাচার একটা জাতিকে শাসকের মসনদ থেকে পালিয়ে বেড়ানো গোলামে পরিণত করে। এই বিষয়গুলোর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় যদি সংশোধন করে নিতে পারে, তাহলে পুনরায় পৃথিবীর বুকে মুসলিম জাতি শির উঁচু করে শাসকের মসনদে আল্লাহর অনুগ্রহে বসতে সক্ষম হবে। আরেকটি বিষয় অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা আর তা হলো আমানতদারিতা। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই আর যে অঙ্গীকার পালন করে না, তার দ্বীন নেই’।[1]
প্রিয় পাঠক! আমরা কি পৃথিবীর বুকে হাজার বছরের ঊর্ধ্বে শাসক ছিলাম না? আমাদের এমন দশা কীভাবে হলো যে, গোটা মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে ফিলিস্তীনের বুকে ধারণ করে রাখা এক টুকরো গাযায় পরিণত হয়েছে? পৃথিবীর বুকে এতগুলো মুসলিম দেশ থেকে লাভ কী হলো? প্রায় ২০০ কোটি মুসলিম থাকা সত্ত্বেও গাযার মুসলিমদের উপর মধ্যপ্রাচ্যে ভিত্তিহীনভাবে জোরপূর্বক দখলদার সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাঈলের প্রধানমন্ত্রী মুসলিমদের রক্তচোষা, অত্যাচারী, বর্বর, গিরগিটির মতো রং পরিবর্তনকারী নেতানিয়াহুর আদেশে বোমা নিক্ষেপ করে। সেই বোমার শব্দে গাযার কোমলমতি শিশুদের যখন ঘুম ভাঙে, তখন মনে হয় পৃথিবীতে কেবল মুসলিম হিসেবে বেঁচে আছে গাযাবাসীরা। মুসলিম জাতি যখন চিত্তবিনোদনে ব্যস্ত, গাযাবাসী তখন বিষণ্ন ও চিন্তিত। মুসলিমরা যখন উদরপূর্তি করে রাত যাপন করে, গাযাবাসী তখন ক্ষুধার্ত ও সদা জাগ্রত। মুসলিম বিশ্ব যখন খাদ্য অপচয়ে ব্যস্ত, গাযাবাসী তখন এক টুকরো রুটির জন্য এবং এক ঢোক পানির জন্য উদ্ভ্রান্ত। ধিক্কার আমাদের জন্য! আমরা মুসলিম হিসেবে লজ্জিত! জাতি হিসেবে লাঞ্ছিত!
প্রিয় পাঠক! মুসলিম জাতির এত অধঃপতন নেমে আসল কীভাবে? এই জাতি কি নেতৃত্বে ও গুণাবলিতে শ্রেষ্ঠ শাসক ছিল না? তাহলে কি এই জাতির অবস্থা মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো হয়ে গেছে? যে মেরুদণ্ডের উপর ভর দিয়ে শির উঁচু করে রবের গযব নিপতিত হয়েছে এমন নিকৃষ্ট বর্বর ইয়াহূদী জাতির সম্মুখে দাঁড়ানো কি শুধু স্বপ্নঘোর হয়ে থাকবে? উছমানীয় খেলাফতের শত বছর গত হওয়ার পরও কি এই জাতির পুরুষ ও নারীরা উমার ইবনুল খাত্ত্বাব, খালেদ ইবনুল ওয়ালিদ, ছালাহউদ্দীন আইয়ূবীর উত্তরসূরি নির্ভীক কোনো সন্তান উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে? যদি ব্যর্থ না হয়ে থাকে, তাহলে এমন কোন বিশেষ কারণ আছে যার জন্য আমরা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের মুখোমুখি হয়ে শির উঁচু করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে জবাব দিতে ব্যর্থ হচ্ছি? তাদের কাছে এমন কী আছে, যা আমাদের কাছে নেই? অবশ্যই তাদের কাছে এমন কিছু আছে, যা বর্তমানে মুসলিম জাতির কাছে নিতান্তই স্বল্প। তা হলো গোমরাহী এবং পথভ্রষ্ট হওয়ার পরেও তারা তাদের ধর্মের ওপর অটুট পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে কাজ করে যাচ্ছে, বিশেষত ইয়াহূদীরা। অপরদিকে আমরা মুসলিমরা শতভাগ সত্য ধর্মের অনুসারী হওয়ার পরেও সন্দেহের কারণে বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ধর্মকে খেল-তামাশার পাত্রে পরিণত করেছি। কপাল তো আমাদের পুড়বেই!
জাতির উন্নতি ও অবনতির পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, এক বাক্যে জাতির মেরুদণ্ড যারা, তারাই হচ্ছে যুবক। দেড় হাজার বছর পূর্বে আরবের বুকে যখন বিপ্লবের প্রভাত প্রস্ফুটিত হয়েছিল, সেকাল থেকে ফিলিস্তীনীদের সাথে মুসলিম সংস্কৃতি পরিবর্তনকারী, বিশ্বাসঘাতক ব্রিটিশ বেনিয়াদের উত্থানের পূর্বে হাজার বছরের ঊর্ধ্বে পৃথিবী শাসনকারী মুসলিম জাতির মধ্যে অধিকাংশ অবদান ছিল যুবকদের। যুবকদের প্রধান শক্তি হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা, যা মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান মুসলিম বিশ্বে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত যুবক নিতান্তই কম। এ জাতির অধঃপতন ঠেকাবে কী দিয়ে? বর্তমান বিশ্বের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রযুক্তি এবং জ্ঞানচর্চায় উন্নতির শিখরে অবস্থান করছে এমন এক জাতি, যারা নিকট অতীতেও জানত না প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতি শব্দদ্বয় বলতে কী বুঝায়। ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে স্পষ্ট লিখিত আছে, জ্ঞানচর্চা এবং সংস্কৃতির পাঠদানকারী মুসলিমদের গৌরবময় শহর বাগদাদ যখন আধুনিকতা ও প্রযুক্তির আলোতে আলোকিত, তখন বর্তমান প্রযুক্তির পাঠদানকারী, মুসলিম জাতির অবদান অস্বীকারকারী, প্রযুক্তির আবিষ্কার আত্মসাৎকারী এবং পৃথিবীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ইউরোপের লোকেরা প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য রবের তৈরি নিখুঁত খুঁটিহীন আকাশের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করত। সেই মূর্খ ও বর্বর জাতি থেকে তারা কীভাবে শাসকে পরিণত হলো আর মুসলিম জাতি শাসক থেকে গোলামে কীভাবে পরিণত হলো?
প্রিয় পাঠক! এর মূল কারণ হচ্ছে আজ মুসলিম যুবকরা রবের দেওয়া মহান অনুগ্রহ জ্ঞানচর্চার পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে দাসত্বের প্রধান সরঞ্জাম, সময় অপচয়ের কারখানা, যুব সমাজের প্রোডাক্টিভিটি ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নামক বিষক্রিয়ায় জর্জরিত। যার অতিরঞ্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিম যুবারা নিজের সৃজনশীলতা হারিয়ে ভিন্ন জাতির অনুসরণ এবং অনুকরণে নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছে। এটাই যদি বর্তমান মুসলিম জাতির যুবকদের অবস্থা হয়, তাহলে কীভাবে সে জাতি গোলাম থেকে শাসকের মসনদে গৌরবমণ্ডিত অতীতের ন্যায় বসতে সক্ষম হবে?
প্রিয় পাঠক! বর্তমান বিশ্বে যারা নিজেদেরকে সুপার পাওয়ার বলে দাবি করে, তাদের দিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা দেখতে পাব যে, নিষ্ফল বিনোদন আর উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের দিকে না হেঁটে অবিরাম চেষ্টা আর নির্ঘুম রাত যাপনের মাধ্যমে মহাজ্ঞানী আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত সময়কে যতটুকু সম্ভব কাজে লাগানোর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনে তারা ব্যস্ত। বিশেষত আল্লাহর গযবপ্রাপ্ত ইয়াহূদী জাতি আর তারা গোটা বিশ্বের মুসলিম জাতিকে এটাই প্রচার করে যে, তোমরা বিনোদন, আড্ডা, মদ, জুয়া, দলে দলে বিভক্তি, ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে খ্যাত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযথা সময় নষ্ট করার মাধ্যমে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখো। এটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এটা যদি আরও স্পষ্ট করে বলতে যায়, তাহলে একটা উদাহরণের মাধ্যমে ইতি টানতে সক্ষম হব আর তা হলো ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের কাছে আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদের খনি মুসলিমদের চেয়ে নিতান্তই কম। তাহলে প্রশ্ন হলো, তারা শাসক হলো কীভাবে? এর স্পষ্ট সমাধান হলো তাদের কাছে আছে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, এমআইটির মতো বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ, যা বর্তমান মাকাল ফল সদৃশ জ্ঞানচর্চাহীন মুসলিম যুবকদের পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করে তারা তৈরি করেছিল। আর মুসলিম জাতির হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিনোদনের পণ্যসমগ্র। যার চাক্ষুষ প্রমাণ হিসেবে আমরা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত আকল (জ্ঞান) নামক বস্তুর কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে স্পষ্ট উত্তর পেয়ে যাব।
প্রিয় পাঠক! পরিশেষে এটাই ব্যক্ত করতে চাই, মহাজ্ঞানীর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ পথে চলার মাধ্যম, হেদায়াতের পথনির্দেশক আল-কুরআন এবং তার ঐ পথে আহ্বানকারী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ ও নিষেধ মান্য করে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত রাখলে হয়তো একবিংশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে শির উঁচু করে ফিলিস্তীনের বুকে অবস্থিত রক্তে রঞ্জিত এক টুকরো গাযাবাসীর ক্বিছাছ আদায়ে সক্ষমতা অর্জন করতে পারব, ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!
এহসান বিন কাশেম
* শিক্ষার্থী, আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
[1]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, হা/৩০০৪।