কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

চলে যাওয়া মানে হারিয়ে যাওয়া নয়

post title will place here

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে চৌদ্দশ বছর গত হয়েছে। এখন অবধি তাঁর কথা, কাজগুলো আমাদের কাছে স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত; যেন আমরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছি।

সুধী পাঠক! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি ফুটফুটে ছেলেসন্তান জন্মগ্ৰহণ করে। তিনি তো এই শিশুকে পেয়ে যারপরনাই পুলকিত হন। শিশুর মোলায়েম হাতে-পায়ে মৃদু চুমু খাওয়া ও স্মিত চিমটি কাটার স্বাদ যে কেমন এই ধরণির বুকে তা শুধু মা-বাবাই বুঝে।

একদিন ঘটে গেল এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা! আকস্মিক নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছেলে এই নশ্বর ভূবন ছেড়ে রবের ডাকে সাড়া দেয়। বুঝতেই পারছেন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কেমন ব্যথা অনুভব হয়েছে! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই ‘কাটা গায়ে নুনের ছিটে’ দিতে পিছপা হলো না কাফেররা। তারা খুশিতে আত্মহারা! একে অপরের উপর লুটোপুটি খেতে লাগল। বাজে মন্তব্যের বাণ বইয়ে দিল। কেউ কেউ তো খুশির ঠেলায় ঠাসঠাস করে বলেই ফেলল, ‘মুহাম্মাদ তো লেজকাটা, নির্বংশ’। হা হা হা…!

তাদের এসকল মশকরাসূচক কথনে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মনটা দুমড়েমুচড়ে গেল। ব্যথায় তিনি কুঁকড়ে উঠেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যথা, আল্লাহ তাআলা কি কিছু করবেন না? এটা হতে পারে? সান্ত্বনার চাদরে তাঁকে আচ্ছাদিত করার মানসে পুরোদস্তুর একটা সূরাই অবতীর্ণ করলেন।

‘সূরাটা শুনবেন না?’ ‘হ্যাঁ, অবশ্যই’। ‘শুনুন তাহলে’।

إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ - فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ - إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ

‘আমরা তোমাকে কাউছার দান করেছি। অতএব, তোমার রবের জন্য ছালাত পড়ো ও কুরবানী করো। তোমার প্রতি বিদ্বেষপোষণকারীই তো আদতে লেজকাটা (নির্বংশ)’ (আল-কাউছা, ১০৮/১০৩)

সুবহানাল্লাহ! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তান বিরহের দহন যন্ত্রণা প্রশমিত করলেন মহান রব হাউযে কাউছার দান করে। কী আশ্চর্য একটা মিল!

কারো গায়ে বা বাড়িতে যদি আগুন লাগে, তাহলে পানি ঢেলে দিলে নিভে যায়। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হৃদয়ের আগুন আল্লাহ তাআলা নিভিয়ে দিলেন কাউছারের স্বচ্ছ পানি ঢেলে। কী অসাধারণ মিল! রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যারা নির্বংশ বলেছিল, আদতে তারাই নির্বংশ হয়েছে।

‘আপনি কি এমন কাউকে দেখেছেন যে, তার ছেলের নাম আবূ জাহল রেখেছে? এমনকি কোনো অমুসলিমকে দেখেছেন?’

না, দেখেননি।

অথচ আপনি দেখেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের কলিজার টুকরো ছেলের নাম রাখে ‘মুহাম্মাদ’। লক্ষ লক্ষ মানুষ মেয়ের নাম রাখে ফাতেমা, আয়েশা, খাদীজা, যায়নাব, হাফছা, জুয়াইরিয়া, উম্মু সালামা, উম্মু হাবীবা, সাওদা, মায়মূনা। আল্লাহর বাণী কত চমৎকার!

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

‘আর আমরা আপনার স্মৃতিকে উচ্চ মর্যাদায় তুলে ধরেছি’ (আল-ইনশিরাহ, ৯৪/৪)

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশ বিলীন হয়ে যায়নি। এখন অবধি আছে এবং তাঁর বংশ থেকেই জন্মগ্রহণ করবে ইমাম মাহদী, যে এসে কানা দাজ্জালকে হত্যা করবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীদের নামে কত মানুষ তাদের সন্তানদের নামকরণ করছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা বিদায় নিয়েছেন আমাদের থেকে; কিন্তু তারা মরেও অমর। প্রত্যেক দিন হাজারো মানুষের মুখে তাদের প্রশংসার রব রয়েছে। যারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা করেছে, তাদের নাম গন্ধ আছে? কেউ কি তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে কোনোদিন একটি বাক্য বলেছে? আল্লাহ ঠিকই বলেছেন,هَلْ تُحِسُّ مِنْهُمْ مِنْ أَحَدٍ أَوْ تَسْمَعُ لَهُمْ رِكْزًا ‘আপনি কি তাদের কারো অস্তিত্ব অনুভব করেন অথবা কোনো ক্ষীণ শব্দ পান?’ (মারইয়াম, ১৯/৯৮)

পৃথিবীতে জীবদ্দশায় তারা কত প্রতাপশালী, দাপুটে ছিল। অসহায়, দরিদ্র, গোলাম ছাহাবীগণ তাদের নাম শুনে শাস্তির বীভৎস চিত্র স্মরণ করে থরথর করে কাঁপতেন। আজ তারা কোথায় হারিয়ে গেল? কেউ তো তাদের স্মরণ করে না! সবাই নাক সিঁটকায়!

আল্লাহ তাআলা শুধু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্মৃতিকেই উন্নত করেননি; বরং যারা তাঁর সঙ্গ দিয়েছেন, তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তাদের নামও সোনালি অক্ষরে অঙ্কিত করেছেন। আবূ বকর, উমার, উছমান, আলী n তারা আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন; কিন্তু আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাদের স্থান অম্লান রয়েছে। যারাই মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীনের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, তাদেরই আল্লাহ সম্মানিত করেছেন।

দাহইয়া ক্বালবী রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্ৰহণ করার পূর্বে নিজ কন্যাকে জীবন্ত প্রোথিত করেছেন। একটা লোক কতটা নিষ্ঠুর, পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হলে এমন আচরণ করতে পারে পরম আত্মীয়ের সাথে! শুধু কী তাই! কবরস্থ করার সময় মেয়েটি কত কাকুতিমিনতি করেছে, কত ব্যর্থ নোনাজল ফেলেছে; কিন্তু সবই ভেস্তে গেছে। তার এই অশ্রুকালি পাষাণ পিতার হৃদয়ের ডায়েরিতে দাগ টানতে পারেনি। একবারের জন্যও মায়ার উদ্রেক হয়নি।

এই লোকটি যখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য লাভ করে ধন্য হলেন। তার সাহায্যে এগিয়ে আসলেন, হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে তাকে ভালোবাসলেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম তার আকৃতিতে পৃথিবীতে আগমন করতেন। আর কোনো ছাহাবীর আকৃতিতে তিনি আসতেন না। সুবহানাল্লাহ!

ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ রাহিমাহুমুল্লাহ তাঁরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কত পরে এসে কালজয়ী ইতিহাস রেখে গেছেন। তাদের নাম প্রতিটি হাদীছের ছাত্রের অন্তরে প্রোথিত, মোহরাঙ্কিত, খোদাই করে লিখিত। তাদের যুগে কত প্রতাপশালী, দাপুটে অত্যাচারী রাজা-বাদশাহ ছিল! আমরা কজন তাদের নাম জানি? কজন তাদের ইতিহাস জানি? আর এই সকল মহামতি ইমামদের ইতিহাস মোটামুটি সকলেই জানে। কমসে কম নাম সকলেই জানে। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাছের, ধর্মে সংশয় পোষণকারী তহা হোসাইন। আজ তারা কোথায়? কালের গর্ভে আজ তারা হারিয়ে গেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের প্রপাগাণ্ডা কয়দিন চলেছে? কেউ তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে? না, কেউ স্মরণ করে না।

তারা চলে গেছে; কিন্তু ইসলাম ঠিকই রয়ে গেছে। ইসলাম সুনির্দিষ্টক্ষণ পর্যন্ত থাকবেই। হয় আমাকে আপনাকে নিয়ে অথবা ছাড়া। ইসলামের বিজয় হবেই। হয় আমাকে আপনাকে নিয়ে অথবা ছাড়া, ইসলাম কিন্তু বিজয়ী হবেই। এই সবুজ-শ্যামল কোলাহলময় বসুন্ধরা বড়ই রগচটা, নিষ্ঠুর। হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে তাকে ভালোবাসলেও সে আপনাকে আল্লাহর হুকুমে নির্দিষ্ট সময়ে বহুদূরে কবরের জগতে ঠেলে দিবে। কেউ তার বুকে চিরকাল থাকতে পারেনি, আপনিও পারবেন না। তাই আসুন কিছু করি। পরকালের জন্য কিছু গচ্ছিত সম্পদ রেখে যাই। আমরা মরেও যেন অমর থাকি। আমাদের চলে যাওয়াটা যেন শেষ না হয়। আমরা এমন কিছু করে যাব, যেন পরবর্তীরা আমাদের জন্য হৃদয় থেকে দু‘আ করে। দ্বীনিজ্ঞান এমন একটি আলোকময় বাতি, যা যেই বক্ষেই জ্বলবে তাকে আলোকিত করে ছাড়বেই। দ্বীনিজ্ঞান এমন একটি সম্পদ যা নিঃস্ব হতদরিদ্রকে করে প্রাচুর্যের অধিকারী, যা সবার গলে মানায়। এই জ্ঞান অর্জন করলে একটা ভৃত্য পর্যন্ত সম্মানের পাত্রে পরিণত হয়। আমাদের সন্তানদের আধুনিক জ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি দ্বীনিজ্ঞানও শেখাতে হবে। আমরা যদি এই জ্ঞান শিক্ষা করতে অনীহা প্রকাশ করি, তাহলে আমরা হতচ্ছাড়া হব। এই জ্ঞান আল্লাহ অন্যদের দিয়ে শেখাবেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমাকে সতর্ক করে বলছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মাঝে কেউ বেদ্বীন হয়ে গেলে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায়কে নিয়ে আসবেন, তিনি যাদের ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর’ (আল-মায়েদা, ৫/৫৪)। তিনি আরও বলেন, وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ ‘তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে তিনি (আল্লাহ) তোমাদের পরিবর্তে অন্যদের নিয়ে আসবেন, যারা তোমাদের মতো হবে না’ (মুহাম্মদ, ৪৭/৩৮)

এই জ্ঞান যদি আমরা শিখি তাহলে আমাদের নিজের লাভ। না শিখলে আমাদেরই ক্ষতি। আল্লাহর কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। আমরা যদি আল্লাহর ইবাদত করি তাহলে আমাদের লাভ; না করলে আমাদেরই ক্ষতি। গোটা পৃথিবীর সবাই যদি আল্লাহর কথা না শোনে বা তাঁর ইবাদত না করে, তাহলে আল্লাহর যে সম্মান আছে তা থেকে বিন্দু পরিমাণ কমবে না। গোটা দুনিয়ার মানুষ যদি সিজদায় পড়ে থাকে, তাহলেও আল্লাহর যে সম্মান আছে, সেখান থেকে বিন্দু পরিমাণ উন্নীত হবে না।

শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

Magazine