সময়ানুবর্তিতা : একজন প্রধান শিক্ষককে অবশ্যই সময়মতো সব কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। তিনি স্কুলটাইমের আগেই স্কুলে আসবেন। তিনি যদি দেরি করেন, তবে অন্যরা তাকে গুরুত্ব দিবে না। সময় মেনে চলা খুবই দরকারি। মিটিংয়ে তিনি আগেই আসবেন। ক্লাসে তিনি আগে যাবেন। এমনকি অ্যাসেম্বলিতে তাকে সময়মতো হাযির থাকতে হবে। প্রধান শিক্ষক এই সমস্ত কাজে প্রথমে আসলে বা সময় মেনে চললে সেটা অন্যদের অন্য অনুপ্রেরণার হয়। অন্যদের জন্য একটা অলিখিত কিন্তু খুবই কার্যকর মানসিক প্রেরণা দেয়। নিজের নিকটও সৎ থাকা যায়।
প্রতিদিন সকালে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করা : স্কুলে এসে ক্লাস শুরু করার আগে প্রধান শিক্ষক সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারিদের নিয়ে কোনো না কোনো দলগত কাজ করবেন। এ সমস্ত কাজের মাধ্যমে ‘একটা টিম’ এর মানসিকতা তৈরি হয় সবার ভিতর। এতে প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। একজন প্রধান শিক্ষককে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপরও পাঁচ মিনিট সময় বের করা যায়।
ছুটির দিনেও কাজ করা : শুধু স্কুলের অফিসিয়াল নিয়ম মেনে স্কুল চালালে তাতে উৎকর্ষ আসে না। প্রত্যেক সফল মানুষ গদবাধা নিয়মের বাইরেও কাজ করেই তবে সফল হয়েছে। স্কুলটাইমের আগে বা পরে এমনকি ছুটির দিনেও স্কুলের নানা রকম কাজ করা যায়। শিক্ষার্থীদের ক্লাবগুলোর কাজ দেওয়া যায়। সহপাঠক্রমিক কাজের অগ্রগতি জানার জন্য ছুটির দিন বা স্কুলটাইমের আগে বা পরে কাজ করা যেতে পারে। বিশেষ করে করোনা পরিরস্থিতি আমাদের শিক্ষাপরিবারের যে ক্ষতি করেছে তা পুষিয়ে নিতে ছুটির দিনেও কাজ করা প্রয়োজন।
ন্যায় বিচারের সংস্কৃতি তৈরি : প্রধান শিক্ষক হবেন দরদি। তাকে সাহসীও হতে হবে। তিনি অবশ্যই সৎ থাকবেন। স্কুলে সততার নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সহকারী শিক্ষকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে যথাযথ। কাউকে বেশি গুরুত্ব দিবেন আর কাউকে অবহেলা করবেন তা হতে পারে না। কাউকে পকেটের লোক বানিয়ে রাখবেন আর কাউকে পাত্তা দিবেন না তা হতে পারে না। মানসম্মত শিক্ষাবিস্তারে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ফ্রাইডে বক্স চালু : এটা চমৎকার একটি ধারণা। মূলত এটা ছিল ‘সানডে বক্স’। অথবা এটিকে ‘ট্যালেন্ট শো বক্স’ নাম দেওয়া যেতে পারে। যে সমস্ত শিক্ষার্থী শুক্রবারে স্কুলে আসবে তারা কেবল এই সুযোগ পাবে। শিক্ষার্থীরা যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়ে কাগজে লিখে বক্সের ভিতর ফেলবে। প্রধানশিক্ষক বক্স থেকে কাগজ উঠাবেন। এক একজনকে পারফর্মেন্স করতে বলবেন। শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মদক্ষতা উপস্থাপন করবে। স্কুলে একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি হবে। এতে করে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হবে। প্রধান শিক্ষক এই ধারণা বাস্তবায়ন করবেন। তিনি সহকারী শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ, শিক্ষার্থী, সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস এবং অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করে এই ধরনের অনেক কিছুই উদ্ভাবন করতে পারেন। এতে করে কমিউনিটি বুঝতে পারবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা স্কুলটিম মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে সক্রিয়।
অভিভাবক শিক্ষক সভা/সম্পৃক্ততা : গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাবা-মায়েরা সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রায়শই তাদের ভূমিকা, দায়িত্ব এবং শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন। অভিভাবক-শিক্ষকদের সভায় সচেতনতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে আলোচনা করতে হবে। প্রধান শিক্ষক স্কুলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অভিভাবক, কমিউনিটির নেতা, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত রাখবেন। অবিভাবকরা যেন অনুভব করেন, তাদের সন্তান স্কুলে নিরাপদ। এই অনুভূতি আসবে যখন শিক্ষক এবং স্কুলটিম স্কুলে একটা আন্তরিক পরিবেশ তৈরি করতে পারবে। উন্নত স্কুলে অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের আন্তরিক সম্পর্ক থাকে। বছরে অন্তত দুইবার অভিভাবকদের স্কুলে ডাকতে হবে। তাদের সাথে সন্তানদের আচার-আচরণ, পরীক্ষার ফলাফল ইত্যাদি বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করতে হবে। অভিভাবককে নিয়ম করে, মাসে একবার স্কুলে আসতে উৎসাহ দিতে হবে। অভিভাবক স্কুলে আসলে শিক্ষকদের উপর একটা লিখিত দায়ভার তৈরি হয়। একটা জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি হয়। সন্তানরাও মনে করে তার অভিভাবক স্কুলে আসবে অতএব তাকে সবকিছুতেই ভালো করতে হবে। এই কাজগুলো প্রধান শিক্ষক নেতৃত্ব দিয়ে করবেন।
ইউনিফর্ম : স্কুলে অবশ্যই ইউনিফর্ম থাকবে। এটা একটা পরিচিতি। স্কুলের সবাই যে একই প্রতিষ্ঠানের এবং একই নীতি নিয়ে চলে তার একটা বাহ্যিক প্রমাণ হলো ইউনিফর্ম।
স্কুলের উন্নয়নে কমিউনিটির সহায়তা দাবি : স্কুল প্রায়শই কমিউনিটির নিকট স্কুলের উন্নয়নে সহযোগিতা চাইতে এগিয়ে যায় না। অথচ কমিউনিটিই অধিকাংশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে থাকে। সুতরাং প্রধান শিক্ষক কমিউনিটির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে সচেষ্ট হবেন।
শিক্ষার্থী অ্যালামনাই : প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অ্যালামনাই গঠন করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। একটি অ্যালামনাই স্কুলে অনেক রকম কাজে সহযোগিতা করতে পারে। অর্থ দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, পরিকল্পনা করে অ্যালামনাই স্কুলের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
স্কুলের পরিছন্নতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উদ্যোগ : শুধু স্কুলের কর্মচারিরা নয়; শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি হাতে নিতে পারেন। মাসে একবার এই অভিযান চালালে স্কুলের পরিবেশ সুন্দর থাকবে। একইভাবে স্কুলে ফুলের বাগান করা, স্কুলের আশেপাশে সমাজ সচেতনতামূলক র্যালি বের করতে পারে। এক এক র্যালিতে এক এক রকম স্লোগান যুক্ত করা যায়। প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে এই দায়িত্ব বণ্টন করবেন।
প্রধান শিক্ষক/সহকারী শিক্ষকদের ক্লাসপর্যক্ষেণ : ক্লাস পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। একজন সহকারী শিক্ষকের ক্লাস অন্য একজন সহকারী শিক্ষক সময় পেলে পিছনে বসে দেখবেন। কীভাবে তিনি ক্লাস নিচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা কেমন উপভোগ করছেন তা দেখবেন। ক্লাস শেষে কোনো পরামর্শ থাকলে শিক্ষকদের অফিসে বসে সে বিষয়ে আলোচনা করবেন। প্রধান শিক্ষকও এই কাজটি করবেন। ক্লাস পর্যবেক্ষণের যাবতীয় বিষয় প্রধান শিক্ষক দেখভাল করবেন।
ইংরেজি ক্লাস ইংরেজিতেই : মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ইংরেজি ক্লাস ইংরেজিতে পরিচালনার বিকল্প নেই। ইংরেজিকে সাবজেক্ট হিসাবে না দেখে একটা ভাষা হিসাবে ক্লাসে উপস্থাপন করতে হবে। বাংলা যেমন ভাষা, ইংরেজিও তেমন ভাষা। অনুশীলনের পরিবেশ পেলে শিক্ষার্থীরা স্বংক্রিয়ভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে। ইংরেজি লিখতে পারবে। পরীক্ষায়ও ভালো করবে। মোটকথা ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠাভ্যাস, বারবার প্রশিক্ষণ : একজন শিক্ষক কি বছরে একবারই প্রশিক্ষণ নিবেন? কয়েক বছর পর একটা প্রশিক্ষণ কি যথেষ্ট? আপনারা কী মনে করেন? একটি প্রশিক্ষণের ১০%ও কি আমরা মনে রাখতে পারি? পৃথিবীর সব ভালো প্রতিষ্ঠানের আছে প্রশিক্ষণ নীতি। বারবার প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষকরা হালনাগাদ শিক্ষাবিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারবেন না। প্রশিক্ষণ আমাদের গুণগত মান বাড়াতে সহায়ক। শিক্ষকরা বই পড়বেন। শিক্ষার্থীদেরকে পাঠক্রমের বাইরের বিভিন্ন বই পড়তে উৎসাহ দিবেন। যে শিক্ষক যত বেশি পড়বেন, তিনি তত জানবেন। যত বেশি জানবেন, তার আত্মবিশ্বাস তত বাড়বে। আত্মবিশ্বাস বাড়লে তার কর্মদক্ষতা বাড়বে।
বিষয়ভিত্তিক, শিক্ষাবিজ্ঞান এবং সমসাময়িক ও ইতিহাসবিষয়ক জ্ঞান : প্রধান শিক্ষক অবশ্যই বিষয়ভিত্তিক, শিক্ষাবিজ্ঞান এবং সমসাময়িক ও ইতিহাসবিষয়ক জ্ঞান রাখবেন। সহকারী শিক্ষকদেরকেও এই বিষয়ে উৎসাহ দিবেন।
সব শিক্ষার্থীকে ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে দেখবেন : শুধু প্রধানশিক্ষকই নন; সকল শিক্ষক মেধাবী শিক্ষার্থী এবং ব্যাকবেঞ্চারদের একই দৃষ্টিতে দেখবেন। কাউকে গুরুত্ব দিবেন আর কাউকে দিবেন না তা হতে পারে না। ভালো শিক্ষার্থীর নিকট বা প্রথম বেঞ্চের সবার নিকট প্রশ্ন করবেন আর কাউকে করবেন না তা চলবে না। প্রয়োজন হলে আজ পিছনের বেঞ্চ, কাল তার সামনের বেঞ্চ এমনভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে। শিক্ষকই ভালো জানবেন কীভাবে তিনি এটা করবেন।
প্রধান শিক্ষক হবেন পথপ্রদর্শক ও মেন্টর : প্রয়োজনে তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবেন। সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের ডাকবেন। অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীকে আপন করে নিতে হবে। মানুষ একটা খারাপ ঘটনা ১০ জনের সাথে বললে ভালোটা বলে এক থেকে দুই জনের সাথে। সুনাম অর্জন করা খুবই কঠিন। তাই প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নিকট হয়ে উঠবেন পথপ্রদর্শক।
বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব : প্রধান শিক্ষক তার দায়িত্বের বোঝা ভাগ করে দিবেন। আমরা প্রায়শই দেখি, প্রধান শিক্ষক কাজের চাপ ভাগাভাগি করেন না। দায়িত্ব হস্তান্তর করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। সকল চাপ নিয়ে তিনি শিক্ষক এবং প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে এটি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া যায়। প্রয়োজনে দায়িত্ব বদল করা যেতে পারে।
এছাড়াও আরও কিছু গুণ প্রধানশিক্ষক অনুশীলন করবেন। প্রধান শিক্ষক কর্তৃক পরীক্ষার হল পর্যবেক্ষণ, ক্লাসে বিনোদনের মাধ্যমে পাঠদান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন, স্কুলটিমকে নিয়ে পরিকল্পনা করা, নিয়মিত শিক্ষক সভা/প্রতিক্রিয়া সভা আহ্বান করা এবং সেখানে সকল খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করা। আমাদের মনে রাখা জরুরী এই কাজ শুধু প্রধান শিক্ষকের নয়; স্কুলের সকলেই তাকে সহযোগিতা করবেন।
মো. আরিফুর রহমান
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ এবং সাবেক ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।