দীর্ঘ অপেক্ষার পরে হাঁটিহাঁটি পা পা করে একসময় আমাদের ঘরে এসেছিল মাহে রামাযান। আমাদেরকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল রহমত, বরকত ও মাগফিরাত দিয়ে। কিন্তু হায়! দেখতে দেখতে চোখের পলকে আমাদেরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। রামাযান তো এসেছিল আমাদের মুত্তাক্বী বানানোর জন্য। কিন্তু আমরা কি মুত্তাক্বী হতে পেরেছি? আমরা মুত্তাক্বী হতে পারলাম কি না, সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদন করার সবক গ্রহণ পারলাম কি না তার একটি বাস্তব পরীক্ষা হলো এ কুরবানী।
আর উম্মাতে মুহাম্মাদীর এ কুরবানীর প্রচলন শুরু হয়েছে আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর যুগ থেকে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসেবে এ কুরবানী চালু হয়েছে। যা মুক্বীম ও মুসাফির সর্বাবস্থায় পালনীয়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদানী জীবনে ১০ বছর নিয়মিত কুরবানী করেছেন।
কুরবানী পরিচিতি:
আভিধানিক অর্থ: কুরবানী শব্দট উর্দূ বা ফার্সি শব্দ। এটি আরবী (قربان) শব্দের সমার্থবোধক, যার অর্থ নৈকট্য। আরবীতে কুরবানীর ক্ষেত্রে ‘উযহিয়্যাহ’ (أضحية) শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
পারিভাষিক অর্থ:
هِي مَا يُذْبَحُ مِنَ الْإِبِلِ أَوِ الْبَقَرِ أَوِ الْغَنَمِ أَوِ الْمَعْزِ تَقَرُّبًا إِلَى اللهِ تَعَالَى يَوْمَ الْعِيْدِ‘আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের অভিপ্রায়ে ঈদের দিন যে উট, গরু, ছাগল বা ভেড়া যবেহ করা হয়, তাকে উযহিয়্যাহ বা কুরবানী বলা হয়’।[1]
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ ‘আর আদমের দু’ছেলের কাহিনী আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনান। যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল। অতঃপর একজন থেকে কবুল করা হলো এবং অন্যজনের কবুল করা হলো না’ (আল-মায়েদা, ৫/২৭)।
কুরআনে কুরবানীর ইতিকথা:
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে বলেন,فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ - فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ - وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ - قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ - إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ - وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ - وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ - سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ ‘যখন তিনি (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলেন, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি। অতএব বলো, তোমার মতামত কী? তিনি (ছেলে) বললেন, হে আব্বা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশা-আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পণ করলেন এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালেন, তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম- হে ইবরাহীম! নিশ্চয়ই আপনি আপনার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছেন। আমরা এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আর আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম। ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১০২-১০৯)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ ‘আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য (কুরবানীর) নিয়ম করে দিয়েছি। যাতে তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেসবের উপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ, কাজেই তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো এবং সুসংবাদ দিন বিনীতদেরকে’ (আল-হজ্জ, ২২/৩৪)।
উল্লেখ্য, কুরবানী দেওয়ার রীতি আদম আলাইহিস সালাম-এর ছেলে হাবীল-কাবীলের যুগ থেকেই চালু আছে। তবে আমাদের উম্মাতে মুহাম্মদীর মাঝে যে কুরবানী চালু আছে, তা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানী; হাবীল-কাবীলের কুরবানী নয়।
কুরবানীর গুরুত্ব ও ফযীলত:
(১) কুরবানী হলো ইসলামের একটি শি‘আর বা নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ ‘এটাই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে এ তো তার হৃদয়ের তাক্বওয়াপ্রসূত’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩২)।
(২) কুরবানী হলো তাক্বওয়ার পরিচায়ক। আল্লাহ তাআলা বলেন,لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না পশুর গোশত এবং রক্ত; বরং তার কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাক্বওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৭)।
(৩) কুরবানী করা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর সুন্নাহ। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুসরণের মাঝেই রয়েছে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী দিতে সক্ষম অথচ কুরবানী দেয় না এমন ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন,مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করে না, সে অবশ্যই যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’।[2]
(৪) কুরবানী ‘ত্যাগের’ এক মহান পরীক্ষা। একজন মানুষ কতদিন থেকে একটি পশুকে নিজ সন্তানের মতো আদর-যত্নে বড় করে তোলে, কত কষ্ট করে লালনপালন করে! কিন্তু কুরবানীর দিন সব মায়া ত্যাগ করে নিজ হাতে যবেহ করে। খুব কষ্ট হয় তারপরও একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য এ মহান ত্যাগ স্বীকার করে। এ তো আল্লাহ তাআলার মহান পরীক্ষা।
কুরবানীর হুকুম:
কুরবানী করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (আল-কাউছার, ১০৮/২)। হাদীছে এসেছে,
عن أَنس أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَانَ يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ وَيَضَعُ رِجْلَه عَلٰى صَفْحَتِهِمَا وَيَذْبَحُهُمَا بِيَدِهِ.
আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি শিংওয়ালা সাদা-কালো রঙের ভেড়া কুরবানী করতেন। তিনি পশুগুলোর পার্শ্ব তাঁর পায়ে চেপে ধরে সেগুলোকে নিজ হাতে যবেহ করতেন।[3]
যবেহ করার দু‘আ:
নিজ হাতে কুরবানী করা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর সুন্নাহ। সুতরাং কেউ যদি নিজ হাতে কুরবানী করতে সক্ষম হয়, তাহলে সে নিজ হাতে কুরবানী করবে এবং যবেহ করার সময় বলবে,
بِسْمِ اللّٰهِ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ اَللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ اَللّٰهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّيْ.
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা, আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বাল মিন্নী। অনুবাদ: আল্লাহর নামে, আর আল্লাহ সবচেয়ে বড়। হে আল্লাহ! এটা আপনার নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং আপনার জন্যই। হে আল্লাহ! আপনি আমার তরফ থেকে তা কবুল করুন।[4]
অথবা বলবে- ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা তক্বাব্বাল মিন্নী ওয়া মিন আহলি বায়তি’। অনুবাদ: আল্লাহর নামে যবেহ করছি, আর আল্লাহ সবচেয়ে বড়। হে আল্লাহ! আপনি আমার ও আমার পরিবারের তরফ থেকে তা কবুল করুন। অথবা কেউ যদি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলেও যবেহ করে, তাহলেও যথেষ্ট হবে।
আর যদি নিজ হাতে যবেহ করতে না পারে, তাহলে অন্তত যবেহ করতে সাহায্য করবে বা সেখানে উপস্থিত থাকবে।
যেমন প্রাণী কুরবানী করতে হবে:
কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়—
(১) পশুর বয়স। সুতরাং উটের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হতে হবে, গরুর বয়স দুই বছর পূর্ণ হতে হবে এবং ছাগলের বয়স এক বছর পূর্ণ হতে হবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لاَ تَذْبَحُوا إِلاَّ مُسِنَّةً إِلاَّ أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضَّأْنِ ‘তোমরা মুসিন্না ছাড়া কুরবানী করবে না। তবে এটা তোমাদের জন্য কষ্টকর মনে হলে তোমরা ৬ মাস বয়সী মেষ কুরবানী করতে পারো’।[5]
(২) দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,أَرْبَعَةٌ لَا يُجْزِينَ فِي الْأَضَاحِيِّ: الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا، وَالْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ ظَلْعُهَا، وَالْكَسِيرَةُ الَّتِي لَا تُنْقِي ‘চার প্রকারের পশু কুরবানীতে চলে না— ১. চোখে ত্রুটিপূর্ণ পশু, যার চোখের ত্রুটি স্পষ্ট। ২. রোগা পশু, যার রোগ প্রকাশ্য। ৩. খোঁড়া পশু, যার খোঁড়া হওয়া প্রকাশ্য। ৪. এমন দুর্বল পশু, যার হাড়ে মজ্জা নেই’।[6]
শেষ কথা:
হে দ্বীনী ভাই! কুরবানী হলো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আমরা মুত্তাক্বী হতে পারলাম কি না তার পরীক্ষা। তাই সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চাইলে অবশ্যই সবচেয়ে প্রিয় প্রাণীটি আল্লাহর রাহে কুরবানী করতে হবে, যেমন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম করেছিলেন। এজন্য আলেমগণ বলেছেন, নিজে লালনপালন করে কুরবানী দেওয়া বেশি উত্তম। কারণ সে প্রাণীটি ব্যক্তির কাছে বেশি প্রিয় থাকে। সে প্রাণীটির উপর তার বেশি মায়া থাকে। কিন্তু ভাই, আমরা যদি কুরবানী করি গোশত খাওয়ার জন্য, তাহলে কোনো ছওয়াব হবে না, বরং এত টাকা খরচ করার পরও পাপের ভাগিদার হতে হবে। তাই পরিশেষে আল্লাহ তাআলার নিকট বিশেষভাবে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী করার তাওফীক্ব দান করো- আমীন!
মাহফুজুর রহমান বিন আব্দুস সাত্তার
কুল্লিয়া ১ম বর্ষ, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. আল-ফিক্বহুল মুয়াসসার, পৃ. ১৬৫।
[2]. মুসনাদ আহমাদ, হা/৮২৭৩; ইবনু মাজাহ, হা/৩১২৩।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৬৪।
[4]. হিসনুল মুসলিম, দু‘আ নং ১২৭; তিরমিযী, হা/২৭৪১, ৫/৮২; আহমাদ, হা/ ১৯৫৮৬, ৪/৪০০; আবূ দাঊদ, হা/৫০৪০, ৪/৩০৮।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৯৭৬।
[6]. নাসাঈ, হা/৪৩৭০।