কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসরা ও মি‘রাজ : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

post title will place here

ইসরা (الإسراء) অর্থ নৈশভ্রমণ। মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাত্রিকালীন ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে,سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ ‘পবিত্র ও মহামহিম সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমরা তাকে আমাদের নিদর্শনগুলো দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/১)

আর মি‘রাজ (المعراج) শব্দটি ‘উরূজ (عروج) শব্দ থেকে উদ্গত। এর অর্থ: সিঁড়ি বা সোপান, আরোহণ করা, ওপরে চড়া বা ঊর্ধ্বগমন করা। মাসজিদুল আক্বছা থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত ভ্রমণকে মি‘রাজ বলা হয়। মি‘রাজ একাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, যা অনেকের মতে মুতাওয়াতির কিংবা মাশহূরের পর্যায়ভুক্ত। 

মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা : হাদীছ থেকে সংগৃহীত সংক্ষিপ্ত রূপ এই যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বাঘরের নিকট শুয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় জিবরীল আলাইহিস সালাম কয়েকজন ফেরেশতাসহ তথায় আগমন করেন। তাঁরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষের উপরিভাগ থেকে পেট পর্যন্ত কেটে তাঁর হৃৎপিণ্ড বের করে তা ধৌত করেন এবং বক্ষকে ঈমান, হিকমত ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিপূর্ণ করেন। অতঃপর তাঁর হৃৎপিণ্ডকে পুনরায় বক্ষের মধ্যে স্থাপন করেন। এরপর ‘বুরাক’ নামক একটি বাহন তাঁর নিকট আনয়ন করা হয়। তিনি এ বাহনে বায়তুল মাক্বদিস বা জেরুযালেমে গমন করেন। মহান আল্লাহ তথায় পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম-কে সমবেত করেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইমামতিতে তাঁরা তথায় দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। এরপর তিনি একে একে সাত আসমান অতিক্রম করেন। বিভিন্ন আসমানে কয়েক জন নবী-রাসূলের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ, সালাম ও দু‘আ বিনিময় হয়। এরপর তিনি সৃষ্টিজগতের শেষ প্রান্ত ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ গমন করেন। সেখান থেকে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম ও মহান আল্লাহর অন্যান্য মহান সৃষ্টি পরিদর্শন করেন। মহান আল্লাহ তাঁর উম্মতের জন্য দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত ছালাতের বিধান প্রদান করেন। পরে তা সংক্ষিপ্ত করে পাঁচ ওয়াক্তের বিধান দেন।[1] এরপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। মি‘রাজে গমন ও প্রত্যাবর্তনের সময় এবং জান্নাত-জাহান্নামে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিভিন্ন পাপ ও পুণ্যের বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ও পুরস্কার দেখানো হয়।

ইসরা ও মি‘রাজের সময়কাল : ইসরা ও মি‘রাজ যাত্রার সময় সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল এবং এখনো রয়েছে। ইমাম যুহরী বলেছেন, এটি মদীনায় হিজরতের এক বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল রজব মাসের ২৭ তারিখের রাত। অন্যদিকে আর-রাহীকুল মাখতূমে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- (ক) নবুঅত প্রাপ্তির বছর, (খ) ৫ম নববী বর্ষে, (গ) ১০ম নববী বর্ষের ২৭শে রজব রাতে, (ঘ) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে, (ঙ) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৪ মাস পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে, (চ) কেউ বলেছেন, হিজরতের এক বছর পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে। অতঃপর মুবারকপুরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, প্রথম তিনটি মত গ্রহণযোগ্য নয় একারণে যে, খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা ১০ম নববী বর্ষের রামাযান মাসে মারা গেছেন। আর তখনো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয়নি। আর এ বিষয়ে সকলে একমত যে, ছালাত ফরয হয়েছে মি‘রাজের রাত্রিতে। বাকী তিনটি মত সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলোর কোনটিকে আমি অগ্রাধিকার দেব, তা ভেবে পাই না। তবে সূরা বানী ইসরাঈলে বর্ণিত আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ‘ইসরা’-এর ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের একেবারে শেষের দিকে হয়েছিল।[2]

ইসরা বা মি‘রাজের কারণ : ইসরা বা মি‘রাজের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়, তন্মধ্যে কয়েকটা কারণ তুলে ধরা হলো: 

১. এটি ছিল রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য বেদনা ও দুঃখের উপশমস্বরূপ। কারণ তিনি তার ক্বওমের লোকদের কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছিলেন।

২. নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদা এবং সম্মান বাড়ানোর জন্য ইসরা বা মি‘রাজ হয়েছিল। 

৩. এটি ছিল নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সান্ত্বনা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে তাঁর মর্যাদা ও মূল্য সম্পর্কে অবহিতকরণ। কারণ এর পরেই তিনি তাঁর দাওয়াতের একটি নতুন পর্যায় শুরু করেছিলেন ইত্যাদি।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মি‘রাজ : মু‘তাযিলা ও অন্যান্য কতিপয় দল এবং বিজ্ঞানও ‘মি‘রাজ’ অস্বীকার করেছে। বিজ্ঞানের দিকটা দেখে নেওয়া যাক। পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দোহাই দিয়ে অনেকে আমাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মি‘রাজকে অস্বীকার করেন। তারা গতিবিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চান মানুষ জড়পদার্থ পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ তাকে তীব্রভাবে টেনে রাখে। সুতরাং মি‘রাজের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা গতিবিজ্ঞানের সূত্র ধরেই বলেছেন, ‘মহাকাশে প্রতিটি গ্রহেরই নিজস্ব আকর্ষণ শক্তি আছে, যারা প্রত্যকেই নিজের দিকে বস্তুকে টানতে থাকে। এ টানাটানির ফলে সূর্য এবং পৃথিবীর মাঝখানে একটি ‘জিরো স্পেস’ আছে, যেখানে কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। অতএব, কোনো বস্তু যদি জিরো স্পেসে পৌঁছে তার আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই’।

অনলাইন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গতিবিজ্ঞানের মতে পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে যদি প্রতি সেকেন্ডে মোটামুটি সাত মাইল বেগে ঊর্ধ্বে নিক্ষেপ করা যায়, তা আর ফিরে আসবে না। আবার পৃথিবী থেকে যত ওপরে বস্তু যাবে, তার ওজন তত কমতে থাকবে। পৃথিবীর ১ পাউন্ড ওজন ১২ হাজার মাইল ঊর্ধ্বে ১ আউন্স হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগে ঊর্ধ্বে ছুটতে পারলে পৃথিবীর গতি থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। বিজ্ঞানীরা একে ‘মুক্তগতি’ বলেন। এ মুক্তগতির ফলেই মানুষের চাঁদে যাওয়া সম্ভব হয়েছে; মঙ্গলে যাই যাই করছে। এসবই প্রমাণ করছে, মি‘রাজ অবাস্তব কোনো যাত্রা ছিল না। উল্লেখ্য, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি হলো, কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত সকল বিষয় সরল ও স্বাভাবিক অর্থে বিশ্বাস করা। এগুলোকে অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা বিভ্রান্তি। যেহেতু ইসরা বা নৈশভ্রমণের কথা কুরআনুল কারীমে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সেহেতু তা অস্বীকার করা কুফর বলে গণ্য। আর মি‘রাজ বা ঊর্ধ্বভ্রমণের বিষয়টি হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর আক্বীদা ব্যাখ্যায় পড়েছি সেখানে ইমাম ত্বহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,وَالْمِعْرَاجُ حَقٌّ وَقَدْ أُسْرِيَ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعُرِجَ بِشَخْصِهِ فِي الْيَقَظَةِ إِلَى السَّمَاءِ ثُمَّ إِلَى حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الْعُلا وَأَكْرَمَهُ اللَّهُ بِمَا شَاءَ وَأَوْحَى إِلَيْهِ مَا أَوْحَى مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى ‘মি‘রাজের ঘটনা সত্য। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রাত্রে ভ্রমণ করানো হয়েছে। তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে প্রথমে আকাশে উঠানো হয়, পরে ঊর্ধ্ব জগতের যেখানে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল, সেখানে নেওয়া হয়। তথায় মহান আল্লাহর যা ইচ্ছা ছিল, তা দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন এবং তাঁর প্রতি যে বার্তা দেওয়ার ছিল, তা প্রদান করেন। যা তিনি দেখেছেন, সে বিষয়ে অন্তর মিথ্যা বলেনি’।[3]

আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ছিদ্দীক্ব উপাধি লাভ : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মি‘রাজের কথা শোনামাত্র বিশ্বাস স্থাপন করার কারণে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ‘ছিদ্দীক্ব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনসহচর ও ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। নেতৃস্থানীয় ও বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মি‘রাজ গমনের কথা শোনামাত্র নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেন। এজন্যই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ বা অধিক বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেন।[4]

করণীয় ও বর্জনীয় : আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ শিরক, বিদআতসহ বহু কুসংস্কারে ভরপুর। যাদের অনেকেই কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ থেকে অনেক দূরে। মি‘রাজের রাতে বিশেষ কোনো আমল শরীআতসম্মত নয়। ২৭ রজব ছিয়াম রাখা, ছালাতে রাগায়েব নামে বিশেষ ছালাত আদায়— এ সংক্রান্ত কোনো হাদীছের গ্রহণযোগ্যতা নেই। ফলে শবে মি‘রাজের নামে নফল ছালাত আদায় করা মানে ইসলামী শরীআতে নিজের পক্ষ থেকে কিছু সংযোজন করা, যা মোটেও কাম্য নয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতের ছালাতের ব্যাপারে উলামায়ে ইসলাম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, এটি প্রমাণযোগ্য নয়। আল্লাহ আমাদের সমস্ত শিরক, বিদআত, কুসংস্কার থেকে দূরে রেখে ছহীহ সুন্নাহর উপর আমল করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

এ. এস. এম. মাহবুবুর রহমান

দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা মুহাম্মদীয়া আরাবীয়া, ঢাকা; উপ-দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬২।

[2]. আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ. ১৮৪।

[3]. আক্বীদা ত্বহাবী, পৃ. ১৬৮।

[4]. আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ. ১৮৫।

Magazine