অতএব, ‘এই নাম পরিবর্তন বৈধ নয়’।[1] কারণ নাম কোনো কিছুর বাস্তবতা বদলায় না। আর বাহ্যিক রূপ অভ্যন্তরীণ বিষয়ের প্রতিফলন। যে ব্যক্তি বিবর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে আপনার উদ্দেশ্যে প্রফুল্লতা প্রদর্শন করে, সে তা কেবল এজন্য করে যে, তার মধ্যে দলের সদস্যদের প্রতি ঘনিষ্ঠতা, ভালোবাসা ও পক্ষাবলম্বন গ্রোথিত রয়েছে। যেহেতু তার চোখ আপনার চোখে পড়েছে, তাই সে এমন হাসি দিতে বাধ্য হয়েছে। আপনি তাকে না দেখলে কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতো।
আর এই ব্যাপারটা কিন্তু অসত্য কিছু নয়। কারণ ‘এখন এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আবেগমূলক, উপলব্ধিমূলক ও চিন্তামূলক নানা উপাদান দ্বারা মানুষের অনুভূতি দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। এই উপাদানগুলো ব্যক্তির চালচলন ও আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। চরমপন্থী দলগুলোর প্রতি অন্ধভক্তদের ব্যাপারে অথবা বিশেষ ব্যক্তি বা দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার ক্ষেত্রে যাদের দল মরিয়া, তাদের ব্যাপারে যেসব গবেষণা চালানো হয়েছে, তা স্পষ্ট প্রমাণ করেছে যে, এসব ব্যক্তি কেবল সেসব বিষয় উপলব্ধি করে থাকে, যেগুলোর সাথে তাদের দলের সম্পর্ক রয়েছে। যেসব বিষয় তারা শোনে বা দেখে, সেগুলোর মধ্যে তারা কেবল সেটুকুই মনে রাখে, যেটুকু তাদের দলের পক্ষে যায়। কিন্তু যেসব বিষয় তাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, সেগুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়, অথবা সেগুলো দ্রুত ভুলে যায়, অথবা যে কোনো মূল্যে সেগুলোর বিকৃতি ঘটায়, যাতে সেগুলো তাদের চিন্তাচেতনার সাথে মিলে যায়’।[2]
নিঃসন্দেহে হিযবিয়্যাত বা দলাদলি উপর্যুক্ত মানসিক প্রভাব ও আচরণের নিকৃষ্টতম ক্ষেত্র।
‘অতএব, আক্বীদা ও মৌলিক বিষয়াবলিতে মতভেদ রাজনৈতিক দলাদলি সৃষ্টির পুঁজি হওয়া উচিত নয়[3]। কারণ এটা কখনই বিবেকের কথা হতে পারে না যে, এ ধরনের ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার জন্য পথ প্রশস্ত করা হবে এবং সেটা চালু রাখার অনুমোদন দেওয়া হবে। তা করা হলে এই ভ্রষ্টতা বড় হবে, বৃদ্ধি পাবে, ডিম দিবে এবং বাচ্চাও ফুটাবে; এমনকি একটি দল হয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করবে এবং সিঁড়ি বানিয়ে তা দিয়ে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির স্থানে পৌঁছে যাবে এবং এর ভিত্তিতে মুসলিমদের নেতৃত্ব দিবে!
আল্লাহর কসম! এটা একটা ভয়ানক ব্যাপার। এটা মুসলিমদের জন্য অকল্যাণ ও ক্ষতি ছাড়া কিছুই বয়ে আনতে পারে না।
বারবার মুসলিমরা এই মতভেদের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করেছে। এটা মুসলিম উম্মাহকে যৌবনেই অবক্ষয় ও অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ রক্ষা না করলে এবং এর স্থায়িত্ব[4] নির্ধারণ করে না দিলে আল্লাহর শত্রুদের ষড়যন্ত্র তাদেরকে ধ্বংস করে ছাড়ত এবং দৃশ্যমান হওয়ার পর তারা পুরাতত্ত্বে পরিণত হতো।
অতএব, কীভাবে এসব মতবিরোধকে দলাদলি তৈরির পুঁজি হিসেবে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে?!
নিশ্চয়ই এগুলো ইসলাম ও মুসলিমদের উপর কঠিন বিপদ এবং মুসলিম দেশগুলোর সোজা পথে চলার ক্ষেত্রে বিরাট বাঁধা। এগুলো মুসলিম উম্মাহর শক্তি সঞ্চার ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রেও বড় বাঁধা। এগুলো মারাত্মক অকল্যাণ, যার চেয়ে অকল্যাণ আর হতে পারে না। এগুলো কঠিন রোগ, যার চিকিৎসা নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলো থেকে মুক্ত’।[5]
এসব হিযবিয়্যাত বা দলাদলির আবার বহু বিধিনিষেধ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : দলাদলির বিধিনিষেধ
ইমাম আইয়ূব আস-সাখতিয়ানী রহিমাহুল্লাহ বলেন,إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تَعْرِفَ خَطَأَ مُعَلِّمِكَ، فَجَالِسْ غَيْرَهُ ‘তুমি যদি তোমার শিক্ষকের ভুল জানতে চাও, তাহলে অন্যের সাহচর্যে বসো’।[6]
একারণে দলবাজরা তাদের অনুসারীদেরকে অন্যদের সাহচর্যে যেতে নিষেধ করে, যারা তাদের সাথে নেই বা তাদের সমর্থক নয়!!
যদি (দলে) তাদের পদোন্নতি ঘটে, তাহলে বহু শর্ত ও বিধিনিষেধ সাপেক্ষে অন্যদের সাথে মেশার অনুমতি দেওয়া হয়। এসব শর্ত ও বিধিনিষেধের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের মগজে পর্দা টেনে দেওয়া, যাতে তা তাদের তরীক্বার বিপরীত এবং তাদের বিদ‘আত পরিপন্থী কথা শুনতে বাধা সৃষ্টি করে।
আর এর মাধ্যমে তারা আসলে বিভিন্ন ছূফী তরীক্বার অনুকরণ করছে; অনুসরণ করছে পীর-মুরীদীর কুসংস্কারের। ‘ইসলামী বায়‘আতের ক্ষেত্রে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক গৃহীত শর্ত কোথায় আর মুরীদের জন্য পীর কর্তৃক গৃহীত শর্ত কোথায়!’[7]
ইমাম সুয়ূত্বী[8] রহিমাহুল্লাহ-কে ছূফীদের কোনো এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যে ব্যক্তি কারো নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে, অতঃপর আরেকজন পীর ধরে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে। এক্ষণে, প্রথম অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা আবশ্যক, না-কি দ্বিতীয়টি?
জবাবে তিনি বলেন,لَا يَلْزَمُهُ الْعَهْدُ الْأَوَّلُ، وَلَا الثَّانِيْ، وَلَا أَصْلَ لِذَلِكَ ‘তার উপর প্রথম অঙ্গীকার[9] বাস্তবায়ন করাও আবশ্যক নয়, দ্বিতীয়টিও নয়। এর কোনো ভিত্তি নেই’।[10]
অতএব, এসব বিধিনিষেধ, শর্ত ও সীমাবদ্ধতা বাতিল। কুরআন ও সুন্নাহয় এসবের কোনো ভিত্তি নেই। আরكُلُّ شَرْطٍ لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَهُوَ بَاطِلٌ، وَإِنْ كَانَ مِائَةَ شَرْطٍ ‘আল্লাহর কিতাবে নেই এমন প্রত্যেকটি শর্তই বাতিল, যদিও তা একশ শর্ত হয়’।[11]
দলাদলির নিকৃষ্ট ও হতাশাব্যঞ্জক একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, শারঈ ইলমের গুরুত্ব কম দেওয়া। মনে রাখতে হবে, ইলম এক জিনিস, আর বক্তব্য আরেক জিনিস। সালাফে ছলেহীন বা পূর্বসূরীগণ ছিলেন উপকারী ইলমের অধিকারী। আর উত্তরসূরীগণ হচ্ছে প্রচারিত বক্তব্যের বক্তা। পূর্বসূরীগণের ইলম ছিল স্বল্পবাক্য, বরকতময় ও পর্যাপ্ত। আর উত্তরসূরীগণের ইলম হচ্ছে অধিকবাক্য ও অল্প উপকারী।
মুসলিম জাতি ইলম ও আমলের জাতি। তাদের ইলম হচ্ছে দলীল ও মূল। (মহান আল্লাহ বলেন,) ﴿وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا﴾ ‘আর বলুন, হে আমার রব! আপনি আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’ (ত্ব-হা, ২০/১১৪)। (তিনি আরো বলেন,)﴿وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ﴾ ‘কেবল আলেমগণই তা বোঝেন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪৩)। (তিনি আরো বলেন,) ﴿قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ﴾ ‘বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?’ (আয-যুমার, ৩৯/৯)। (মহান আল্লাহ আরো বলেন,)﴿يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ﴾ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন’ (আল-মুজাদিলাহ, ৫৮/১১)।
আপনি নিশ্চয় এমন কিছু উক্তিকারীকে পাবেন, যে পরিবেশ-পরিস্থিতি জানার নামে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া ও ময়দানে কাজ করার অজুহাতে ইলম অর্জনের বিষয়টি তুচ্ছ জ্ঞান করে…
কিন্তু তিনি কী দ্বারা বাস্তবতা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি জানবেন?! তিনি কী দিয়ে দাওয়াত দিবেন?! তিনি কীসের মাধ্যমে কাজ করবেন?!
চিন্তার একটা সীমাবদ্ধ জায়গা রয়েছে, কিন্তু তা ইলম নয়। অগ্নিঝরা বক্তব্য জাগ্রত করতে পারে, কিন্তু গঠন করতে পারে না। একগুঁয়ে কল্পনা মুগ্ধ করতে পারে, কিন্তু তা খুব শিগগিরই চলে যায়। (মহান আল্লাহ বলেন,)﴿فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ﴾ ‘অতঃপর ফেনাগুলো নিঃশেষ হয়ে যায় আর যা মানুষের উপকার করে, তা যমীনে থেকে যায়’ (আর-রা‘দ, ১৩/১৭)।[12]
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব বিধিনিষেধে কিন্তু তাদের সালাফ বা পূর্বসূরী রয়েছে। তবে সেই পূর্বসূরী কতই না নিকৃষ্ট! সেই পূর্বসূরী হচ্ছে ছূফী। ইবনুল জাওযী ‘তালবীসু ইবলীস’[13] গ্রন্থে আবু আব্দিল্লাহ ইবনে খফীফ থেকে বর্ণনা করেন, اِشْتَغِلُوْا بِتَعَلُّمِ الْعِلْمِ وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ كَلَامُ الصُّوْفِيَّةِ فَإِنِّيْ كُنْتُ أُخَبِّىءُ مَحْبَرَتِيْ فِيْ جَيْبِ مُرَقَّعَتِيْ وَالْكاَغَدَ فِيْ حِزَّةِ سَرَاوِيْلِيْ وَكُنْتُ أَذْهَبُ خِفْيَةً إِلَى أَهْلِ الْعِلْمِ فَإِذَا عَلِمُوْا بِيْ خَاصَمُوْنِيْ وَقَالُوْا لَا تُفْلِحُ ‘তোমরা ইলম অর্জনে ব্রতী হও। ছূফীদের বক্তব্য যেন তোমাদেরকে প্রতারিত করতে না পারে। আমি কিন্তু আমার দোয়াত আমার জোড়াতালিযুক্ত পোশাকের পকেটে এবং কাগজ আমার পাজামার খাঁজে লুকিয়ে রাখতাম। আমি সঙ্গোপনে আলেমগণের নিকট যেতাম। যখন তারা (ছূফীরা) আমার ব্যাপারে জানতে পারত, তখন তারা আমার সাথে বিবাদে লিপ্ত হতো[14] এবং বলত, তুমি সফল হবে না’।
এরপর এই বিধিনিষেধ আরো উন্নত হয়ে[15] বর্তমান যুগে এর নানা রূপ তৈরি হয়েছে, দলাদলিই যেগুলোর আবিষ্কারক।
দলাদলি ও দলবাজরা যেসব জিনিস আবিষ্কার করেছে, তন্মধ্যে ভয়ংকর একটি বিষয় হচ্ছে, নতুন নতুন পরিভাষা। যেমন- আন্দোলনের আলেম-উলামা, পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ আলেম-উলামা, চিন্তাবিদ, সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ইত্যাদি। এভাবে উম্মতকে তারা ধ্বংস করে ছাড়ে। তারা উম্মতকে শরী‘আতের প্রকৃত আলেম-উলামা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছাড়ে।
ছূফীদের পরিভাষার সাথে উপর্যুক্ত পরিভাষার মিল আছে। তারা বলে, হাক্বীক্বতে অভিজ্ঞ আলেম এবং শরী‘আতে অভিজ্ঞ আলেম। দলবাজ ও ছূফীদের পরিভাষার মধ্যে সাদৃশ্যের দিকটি হচ্ছে, শরী‘আতের প্রকৃত আলেম-উলামা ও জনগণের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা এবং এমন ইলমের দাবি করা, যেখানে শারঈ জ্ঞানে অভিজ্ঞ আলেমগণ পৌঁছতে পারেননি।
এগুলো আসলে আন্দোলনধর্মীদের ইলহাম ও অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলো কেবল তাদের মাথা থেকে নিঃসরিত ভবিষ্যতমুখী মতবাদ, কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে পৌঁছতে অনুসারীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সেজন্য আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।[16]
ছূফীরা মানুষদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ থেকে পৃথক করার জন্য এবং তাদের ব্রেইনকে শিকলবন্দী করতঃ তার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যেদিক ইচ্ছা সেদিক নেওয়ার জন্য এই পথ অনুসরণের বিকল্প কিছু খুঁজে পায়নি।
তারাই বলেছে, আন্দোলনে অভিজ্ঞ আলেম এবং শরী‘আতে অভিজ্ঞ আলেম। এই ভাগের কারণেই আন্দোলনের আলেম-উলামা দ্বীনী কাজে লম্ফঝম্ফ করছে। আর পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতার অজুহাত দেখিয়ে শরী‘আতের আলেমগণকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আরো নানা সংশয় সৃষ্টি করে যুবকদের কান ভারী করছে। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কারণ এর মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহক প্রকৃত আলেমগণ থেকে দাওয়াতী কার্যক্রমকে আলাদা করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। তারা ইলম ও শরী‘আতের দায়িত্বশীলগণের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা উঠিয়ে দিয়ে আন্দোলন ও আন্দোলনকর্মীদের ঘিরে এবং তাদের তুচ্ছ সম্বল ইলহাম, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘিরে বলয় তৈরি করছে। যেমন- আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনে বায, আমাদের এ যুগের শায়খুল হাদীছ নাছিরুদ্দীন আলবানী, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছলেহ আল-উছাইমীন, শায়খ মুক্ববিল ইবনে হাদি আল-ওয়াদেঈ সহ শরী‘আতের ইনছাফপরায়ণ সকল আলেম।
যখন আপনি বলবেন, আল্লামা ইবনে বায বলেছেন, তখন তারা বলবে, তিনি পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞ!![17]
আপনি যদি বলেন, শায়খ মুহাদ্দিছ নাছিরুদ্দীন আলবানী বলেছেন, তখন তারা বলবে, তিনি রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ!!
যদি শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহও এখন বের হতেন, তবুও তারা তাকে অজ্ঞতার অপবাদ লাগাতো!!
বিষয়টি এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আন্দোলনের আলেম ও আন্দোলনমুখীরা এখন দাওয়াতের কান্ডারি হয়ে গেছেন। আর শরী‘আতের আলেমগণ এবং শারঈ জ্ঞানের ছাত্রগণ হয়ে গেছেন অনুসারীদের মতো, যাদের কোনো কথা শোনা হবে না!![18]
প্রত্যেকটা দলেই আপনি দলীয় মানহাজ বা কর্মপদ্ধতি পাবেন। আক্বীদাগত বা আমলগত কোনো মাসআলাতেই একথা না বলা পর্যন্ত সে নিশ্চিত হতে পারে না যে, এই মাসআলায় দলীয় বিশেষ ব্যাপার রয়েছে। এই বিশেষ ব্যাপার সে ভবিষ্যত পরিকল্পনার চ্যানেলে আওড়াতে থাকে। ফলে তা ইলহাম, ধারণা, পরিকল্পনা ইত্যাদি দ্বারা সুসজ্জিত হয়ে বের হয়। আর অমনিই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দলবাজ লোক তা লুফে নেয়। অতঃপর খুব জোরেসোরে তা অনুসারীদের ব্রেইনে নিক্ষেপ করে।[19]
এ অবস্থায় সর্বনাশ হয়ে যাবে সে ব্যক্তির, যে সাহস করে দলীল চাইবে এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী আয়াত-হাদীছের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে সমালোচনা করবে। সে অচিরেই তার ভাইদের মাঝে রোগাক্রান্ত উটের মতো হয়ে যাবে!
ثمَّ من نَاظر أَو جادل أَو ... رام كشفا لقذى لم ينجل
قَدَحُوا في دينه وَاتَّخذُوا ... عرضه مرمى سِهَام المنصل
(কবিতার সারাংশ): অতঃপর যে ব্যক্তি বিতর্ক করে বা বিবাদ করে বা অপরিস্ফুটিত ময়লা দূর করতে চায়, তারা তার দ্বীনের ব্যাপারে নিন্দা করে এবং তার সম্মানকে তীর নিক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করে।[20]
বুঝা গেল, অনুসারীরা কিতাব ও সুন্নাতের প্রকাশ্য বক্তব্যের সাথে লেনদেন করতে ভয় পায় এবং আন্দোলন ও দলের আলেম ও ফক্বীহ-এর ইলহামী বক্তব্যের উপর নির্ভর করে। ঠিক যেমন ত্বরীক্বাপন্থী ছূফীরা কিতাব ও সুন্নাতের প্রকাশ্য বক্তব্য দেখে ঘাবড়ায় এবং তারা পদস্খলিত হওয়ার ভয়ে দ্বীন বুঝতে হাক্বীক্বতের আলেমদের উপর নির্ভর করে। এসব তাদের ধারণা মাত্র!!
সম্মানিত মুসলিমগণ! কিছু নবাবিষ্কৃত, সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল, বিদ‘আতী পদ্ধতি ও মাধ্যম দ্বারা কিতাব ও সুন্নাতের আলেমগণের সাথে যোগাযোগের মাঝে ও শরী‘আতের প্রকাশ্য বক্তব্যের সাথে জীবনাচারের মাঝে এবং মানুষের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে!
অতএব, আপনাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে, শরী‘আতের আলেম-উলামা ও শারঈ জ্ঞানের ছাত্রদের মেনে চলা, তাদের সঙ্গে থাকা এবং তাদের কথা শোনা, যারা কিতাব ও সুন্নাহ থেকে সব বিদ‘আত ও কালিমা দূর করতে ব্যস্ত। সাথে সাথে মহান আল্লাহর এই বাণীটি স্মরণ করুন,﴿وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا﴾ ‘আর তার চেয়ে বড় যালেম আর কে, যাকে স্বীয় রবের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হলে সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (আস-সাজদাহ, ৩২/২২)।[21]
এভাবে ‘নতুন নতুন পথ ও কাঠামোযুক্ত দলাদলি, যেগুলোর সাথে সালাফে ছালেহীন পরিচিত ছিলেন না, সেগুলো ইলমের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা এবং বিভক্তির ভয়ানক কারণ। এগুলো ইসলামী ঐক্যের রজ্জুকে কত-না দুর্বল করেছে এবং এর কারণে মুসলিমদের কত-না দুর্যোগ গ্রাস করেছে’।[22]
এগুলো সবই ‘দলাদলি ও অন্ধভক্তির অন্যতম বিপদ। অথচ বিভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জেনে সেগুলোর মধ্যে তুলনা করলে মানুষের উপদেশ গ্রহণ ও সংশোধনের সামর্থ্য অর্জনের কথা ছিল’।[23]
কিন্তু দলবাজদের নিকট সংশোধনের ব্যাপারটা রহিত বা বিকৃত হয়ে গেছে। তারা তাদের দ্বীনকে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত করে ফেলেছে!!
(চলবে)
মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী
অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
[1]. আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস মিন তালবীসি ইবলীস, পৃ. ৪৭০।
[2]. ইসলামী মনোবিদ্যার অগ্রদূত প্রফেসর ড. মালেক বাদরীর বক্তব্য থেকে গৃহীত। দ্র. মুহাম্মাদ মুছতফা আ‘যমী, মানহাজুন নাক্বদ ইনদাল মুহাদ্দিছীন, পৃ. ৪১।
[3]. অরাজনৈতিক দলাদলিও।
[4]. অন্যের বিপদে উল্লসিত মানুষ ও শত্রুরা থাকা সত্ত্বেও।
[5]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ২৫।
[6]. আদ-দারেমী, আস-সুনান, ১/১৫৩।
[7]. আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস মিন তালবীসি ইবলীস, পৃ. ২৫০। ওখানে আমি টীকায় বলেছি, ‘এই যুগের দলবাজরা যেসব শপথ, অঙ্গীকার ইত্যাদি গ্রহণ করছে, সেগুলোর রূপ ও নাম ভিন্ন হলেও নিশ্চিতভাবে সেগুলো বাতিল’।
[8]. আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া, ১/২৫৩।
[9]. এই ধরনের অঙ্গীকার বিদ‘আত ও বাতিল প্রমাণিত করে শায়খ শুক্বাইরীর লম্বা বক্তব্য আছে (দ্র. আল-মিনহা আল-মুহাম্মাদিয়্যাহ ফী বায়ানিল আক্বাইদিস সালাফিয়্যাহ, পৃ. ২৫৪-২৬৬)।
[10]. যা দলীয় ও সাংগঠনিকভাবে মানুষকে সংঘবদ্ধ করে, তাকে কেউ কেউ ‘অঙ্গীকার’ বা ‘বিশেষ বায়‘আত’ বা অনুরূপ কিছু বলে থাকে। আসলে এগুলোর কোনো ভিত্তিই নেই এবং এগুলো বিশুদ্ধ হওয়ার কোনো দিকও নেই। এক্ষেত্রে আমার পুস্তিকা ‘আল-বায়‘আতু বায়নাস সুন্নাতি ওয়াল বিদ‘আহ’ বইটি পড়া যেতে পারে। সেখানে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
আমার ‘আল-বায়‘আতু’ শীর্ষক বইটি আল-হামদুলিল্লাহ বহুল প্রচারিত একটি বই এবং আলেমসমাজের নিকটও গ্রহণযোগ্য একটি বই। এ বইটিকে স্বীকৃতি দিয়ে এর দ্বারা উপকৃত হয়ে অনেক আলেম এখান থেকে তথ্য নিয়েছেন। …কিন্তু হঠাৎ এক সম্মানিত ভাই এই বইটির প্রত্যুত্তরে কলম ধরেন। যেখানে তিনি ভালো-মন্দ একাকার করে ফেলেছেন এবং প্রত্যুত্তর ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আলেমগণের আদর্শের সীমালঙ্ঘন করেছেন। তিনি প্রবন্ধ আকারে সেটি ‘মাজাল্লাতুল বালাগ আল-কুয়েতিয়্যাহ’-তে প্রকাশ করেছেন (দ্র. সংখ্যা ৮৯১, বর্ষ: ১৪০৭ হি.)।
আমি তার প্রত্যুত্তরে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে যুক্ত করার জন্য বিস্তারিত লিখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু মহান আল্লাহ আমার জন্য শায়খ আল্লামা বাকর আবু যায়েদ-এর একটি সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপক অর্থবোধক বক্তব্যকে প্রত্যুত্তরের জন্য যথেষ্ট করে দিয়েছেন আল-হামদুলিল্লাহ। তিনি সেই ভদ্রলোকের সেই প্রত্যুত্তরের ব্যাপারে মন্তব্য করে লিখেছেন, كَلَامٌ مُتَهَافِتٌ ‘(এটি) স্ববিরোধী ও দুর্বল কথা’ (দ্র. হুকমুল ইনতিমা, পৃ. ১৬৪)।
[11]. ইমাম বুখারী ও মুসলিম আয়েশা g থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। শব্দচয়ন ইবনে মাজাহ-এর, হা/২৫২১।
[12]. আয়েয আল-ক্বরনী, আল-হারাকাত আল-ইসলামিয়্যাহ আল-মু‘আছেরাহ, পৃ. ১৬।
[13]. আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস, পৃ. ৪৪৩।
[14]. আমি ‘আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস’-এর এই জায়গায় টীকাতে লিখেছি, ‘গতকালের সাথে আজকের কী অপূর্ব মিল! বর্তমান যুগের দলবাজদের বহুসংখ্যক এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু করছে। অথচ তারা মনে করছে যে, তারা ভালো কাজই করছে!
[15]. উন্নত হয়ে নয়; বরং জটিল হয়ে!
[16]. ইবনে গানেম প্রণীত ‘তাফলীসু ইবলীস’ বইয়ের ২৭ পৃষ্ঠায় আমাদের সম্মানিত ভাই সালীম হেলালীর টীকার সাথে বিষয়টি মিলিয়ে দেখুন। সেখানে ঠিক এরকম বক্তব্যের দিকেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
[17]. তাদের কারো কারো পক্ষ থেকে এই ‘বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি’ (الواقع) শব্দটার মধ্যে সামগ্রিক ধোঁকা রয়েছে। এটা তখনই স্পষ্ট হয়ে যাবে, যখন আপনি এই ‘বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি’ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান তুলনা করে দেখবেন- যে ‘বর্তমান প্রেক্ষাপট’ ঘিরে তাদের জল্পনা-কল্পনা, যেদিকে তারা আহ্বান করে। আমার ‘ফিক্বহুল ওয়াক্বে‘ বায়নান নাযারিয়্যাতি ওয়াত-তাত্ববীক্ব’ বইটিতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।
[18]. সেজন্য দলে থাকলে হীন ব্যক্তিকেও অগ্রগামী করা হবে; কিন্তু দলের বিরোধী ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত হলেও তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে এবং তার কাছ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে!
[19]. ফলে তারা ‘দলীল ছাড়াই তাদের পীরের অনুসরণ করে। পীর-মাশায়েখ যা করতে বলেন বা মুরীদরা তাদেরকে যা করতে দেখে, তারা তা-ই করে’ (দ্র. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস, পৃ. ৪৯৫)।
[20]. আল-বাদরুত ত্বলে‘, ১/১৩৬।
[21]. উতাইবী, আত-ত্বলী‘আহ ফী বারাআতি আহলিস সুন্নাহ, পৃ. ৩০-৩৩ (ঈষৎ পরিমার্জনসহ)।
[22]. শায়খ বাকর আবু যায়েদ, হিলইয়াতু ত্বলিবিল ইলম, পৃ. ৬৫।
[23]. উমার উবাইদ হাসানাহ প্রণীত ‘ফিক্বহুদ দাওয়াহ’ কিতাবের ভূমিকা দ্রষ্টব্য, ১/৮।