এ গ্রন্থে ইমাম আশআরীর উৎসগ্রন্থ:
ইমাম আবুল হাসান আশআরীর ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি গ্রন্থ সংকলন করার ক্ষেত্রে খুব কম গ্রন্থ থেকে তথ্য নিয়েছেন। এর কারণ হতে পারে, তিনি নষ্ট ও বাতিল বিবেকবাদী মু‘তাযিলা, জাহমিয়া ও অন্যান্য বিদআতীদের এ গ্রন্থে খণ্ডন করেছেন। আর তিনি এক সময়ে মু‘তাযিলাদের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি তাদের পদ্ধতিতেই তাদের খণ্ডন করেছেন। ফলে অন্যান্য উৎসের তেমন প্রয়োজন পড়েনি। ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থে উৎসগ্রন্থসমূহ হলো—
১. আল-কুরআনুল কারীম। তিনি এ গ্রন্থে কুরআনের শত শত আয়াতের ওপর নির্ভর করেছেন এবং বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন।
২. আস-সুন্নাহ। তিনি সুন্নাহ ও হাদীছের ওপর নির্ভর করেছেন এবং অনেক হাদীছ দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। তবে ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম-সহ প্রসিদ্ধ গ্রন্থ থেকে হাদীছ উদ্ধৃত করেননি। তিনি যে-সব হাদীছগ্রন্থ থেকে হাদীছ উল্লেখ করেছেন, তা হলো—
(ক) মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালেক। মুওয়াত্ত্বা মালেক থেকে তিনি একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন।
(খ) মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা গ্রন্থের কথা উল্লেখ না করলেও ইমাম ইবনে আবী শায়বার সনদের একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন।
(গ) মুআবিয়া ইবনে উমার, মূসা ইবনে উমার ও আফফান ইবনে মুসলিম থেকে অনেক হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। তবে তাদের প্রসিদ্ধ কোনো গ্রন্থ নেই।
তিনি অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ থেকে হাদীছ উদ্ধৃত করেননি। সম্ভবত হাদীছের গ্রন্থের ব্যাপারে তার গভীর জ্ঞান ছিল না।
৩. তিনি মাত্র একটি তাফসীরগ্রন্থ উদ্ধৃত করেছেন। আর তা হলো, তাফসীর সুনাইদ ইবনে দাঊদ আল-মাসসীসী।
৪. আক্বল-বিবেক। তিনি এ গ্রন্থে বিবেকগত অনেক দলীল পেশ করেছেন। তবে তার বিবেকগত দলীলসমূহ নিরাপদ ও কুরআন-সুন্নাহর সাথে সংগতিপূর্ণ।
৫. দিওয়ান ইমরুল ক্বায়েস। তিনি এ গ্রন্থ থেকে কবিতার একটি পঙতি উল্লেখ করেছেন।
৬. দিওয়ান খানসা। তিনি এ গ্রন্থ থেকে কবিতার একটি পঙতি উল্লেখ করেছেন।
‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ প্রণয়নে ইমাম আশআরীর গৃহীত পদ্ধতি:
১. তিনি প্রধান উৎস হিসেবে কুরআনের ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি আয়াত থেকে দলীল সাব্যস্ত করেছেন এবং আয়াতের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে খণ্ডন করেছেন। তিনি বিবেকগত দলীল দ্বারা কোনো আয়াতের বিরোধিতা করেননি।
২. দ্বিতীয় উৎস হিসেবে তিনি হাদীছের ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি হাদীছ থেকে দলীল সাব্যস্ত করেছেন এবং হাদীছের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে খণ্ডন করেছেন। তিনি বিবেকগত দলীল দ্বারা কোনো হাদীছের বিরোধিতা করেননি।
৩. কুরআন ও হাদীছ বোঝার ক্ষেত্রে তিনি মুহাদ্দিছ ইমামদের বুঝের ও মানহাজের ওপর নির্ভর করেছেন। যেমন ইমাম আহমাদ ও ইবনুল মুবারক। গুণাবলি সাব্যস্তকরণ ও তাতীল[1] নাকচকরণ-সহ অন্যান্য মাসআলা সাব্যস্তকরণে তিনি তৃতীয় উৎস হিসেবে তিনি তাদের ইজমাকে গ্রহণ করেছেন।
৪. ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থে তার অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইজমার ওপর নির্ভর করেছেন এবং এসব মাসআলা উদ্ধৃতকরণে সূক্ষ্মতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এমন কোনো ইজমার দাবি করেননি, যে ইজমা প্রমাণিত নয় বা উক্ত ইজমার বিরোধিতা করেছেন আহলুস সুন্নাহর কোনো আলেম।
৫. ইমাম আশআরী বিরোধীপক্ষের পর্যালোচনা, খণ্ডন ও তাদের সাথে মুনাযারা করার ক্ষেত্রে বিবেকগত এমন দলীল ব্যবহার করেছেন, যা কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী নয়; বরং কুরআন ও সুন্নাহকে শক্তিশালী করে। বিবেকগত দলীল উপস্থাপনে তার ছিল বিশেষ পাণ্ডিত্য। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, তিনি যাদের খণ্ডন করেছেন বিশেষ করে মু‘তাযিলাদের, দীর্ঘসময় ধরে তিনি সেই মু‘তাযিলা মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
৬. তিনি এ গ্রন্থে ছাহাবী ও তাবেঈনের আছারের ওপর নির্ভর করেছেন এবং নিজের মত শক্তিশালী করার সময় ও বিরোধীপক্ষের খণ্ডনের সময় তাদের আছার উল্লেখ করেছেন।
৭. তিনি এ গ্রন্থে কালামপন্থিদের পদ্ধতি ও মানতেক্বী শব্দ থেকে দূরে থেকেছেন। খুব অল্প শব্দ ছাড়া এ কিতাবে মানতেক্বী শব্দ পাওয়া যায় না।
৮. তিনি বিরোধীপক্ষকে খণ্ডনের সময় ‘মুনাযারা-বিতর্ক করা’ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
৯. তিনি এ গ্রন্থে আক্বীদাগত বিষয়ে সালাফ ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মানহাজ ও বিশ্বাস আলোচনা করেছেন।
১০. তিনি এ গ্রন্থে আক্বীদার অধিকাংশ মৌলিক বিশ্বাস আলোচনা করেছেন এবং সালাফ ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মানহাজ ও বিশ্বাস তুলে ধরেছেন আর বিরোধীপক্ষের বিস্তারিত ব্যবচ্ছেদ করেছেন।
যারা এ গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন:
১. ইমাম ইসমাঈল ইবনে আব্দুর রহমান ছাবূনী। ইবনে আসাকির বলেন, তিনি যখনই তার দারসের উদ্দেশ্যে বের হতেন, তখন তার হাতে আবুল হাসান আশআরীর ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ থাকত। তিনি এ গ্রন্থের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন এবং বলতেন, এই গ্রন্থটি যার, তার ওপর কী আপত্তি করা হতে পারে?[2]
২. হাফেয ইবনুত ত্বব্বাখ। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া বলেন, তিনি ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থের ওপর নির্ভর করতেন এবং বলতেন, এটাই আমার মাযহাব। আমি এই মাযহাবে বিশ্বাসী।[3]
৩. হাফেয আবূ বকর আস-সামআনী। তিনি এ গ্রন্থের ওপর নির্ভর করতেন এবং তার ‘আল-ই‘তিকাদ’ গ্রন্থের অনেক স্থানে এ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করেছেন।[4]
৪. নাছরুদ্দীন মাক্বদেসী। তিনি আক্বীদা বিষয়ে একটি গ্রন্থ লিখেন এবং তাতে ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ থেকে একটি অধ্যায় উদ্ধৃত করেন।[5]
৫. আবুল আব্বাস আত-তরক্বী। তার ব্যাপারে শায়খুল ইসলাম বলেন, তিনি আল্লাহর আরশের ওপর উঠার ও জাহমিয়াদের খণ্ডনের ক্ষেত্রে ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ থেকে উপকার গ্রহণ করেছেন।[6]
৬. ইমাম নববী। তিনি নিজ হাতে এ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি লিখেন।[7]
৭. শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া। তিনি তার অনেক গ্রন্থে এ কিতাবের আলোচনা উদ্ধৃত করেছেন এমনকি দশাধিক পৃষ্ঠা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি কোনো স্থানে এই গ্রন্থের সমালোচনা করেননি বা বিরোধিতা করেননি।
৮. ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম। তিনি তার অনেক গ্রন্থে এ কিতাবের আলোচনা একাধিক পৃষ্ঠা উদ্ধৃত করেছেন।[8]
৯. ইমাম যাহাবী। তিনি বলেন, ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থটি আবুল হাসানের প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের একটি। আমাদের কালামপন্থি সাথীরা যদি আবুল হাসানের এই নীতিতে পৌঁছাত এবং আঁকড়ে ধরত, তাহলে তারা ভালো করত।[9] তিনি এ গ্রন্থ থেকে আলোচনাও উল্লেখ করেছেন।[10]
১০. ড. শায়খ ছালেহ ইবনে ফাওযান আল-ফাওযান। তিনি বলেন, এটি চমৎকার উৎস। এটি সালাফী আক্বীদার মৌলনীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছে। এর ওপর ইমাম আবুল হাসান আশআরী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন। তা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর আক্বীদা।[11]
১১. ড. জালাল মূসা। তিনি বলেন, আশআরী কার্যত সুপ্রশস্ত দিগন্ত ও সূক্ষ্মদর্শী ছিলেন। ভালো লিখতে পারতেন। এর প্রমাণ ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থ।[12]
১২. শায়খ ড. আব্দুর রহমান আল-মাহমূদ। তিনি বলেন, এটি আশআরীর অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের একটি। এটি অধিক তর্ককে জাগ্রত করেছে। কেননা এ গ্রন্থে এমন আক্বীদার বিষয় রয়েছে, যা পরবর্তী আশআরীদের বিরোধিতা করে; বিশেষ করে খাবারিয়া (কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত) আল্লাহর গুণাবলিসংক্রান্ত মাসআলা, যেমন আল্লাহর ঊর্ধ্ব ও আরশের ওপর উঠা।[13]
(চলবেইনশা-আল্লাহ)
আব্দুল্লাহ মাহমুদ
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. তাতীল অর্থ নিষ্ক্রিয় করা, খালি করা ও মুক্ত করা। এ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহকে তাঁর গুণাবলি থেকে মুক্ত করা এবং গুণাবলিকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হওয়া অস্বীকার করা। কুরআনে একে ‘ইলহাদ’ বলা হয়েছে। –অনুবাদক
[2]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ৩৮৯।
[3]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪২।
[4]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৩৬।
[5]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪১।
[6]. বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়া, ১/১৪০।
[7]. আল-উলূ, ২/১২৪৮।
[8]. যেমন- ইজতিমাউল জুয়ূশ, ১৬৮-১৭৪।
[9]. আল-উলূ, ২/১২৪৮, ১২৫৫।
[10]. কিতাবুল আরশ, ২/২৯৪।
[11]. ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থের ভূমিকা, পৃ. ৩।
[12]. নাশআতুল আশাঈরা, পৃ. ১৭০।
[13]. মাওকিফু ইবনে তায়মিয়া মিনাল আশাঈরা, ১/৩৪৮।