(মার্চ’২৪ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)
নারী-পুরুষের পরস্পরের মাঝে পর্দার সীমা কতটুকু?
সম্মানিত পাঠক! উপর্যুক্ত আলোচনায় মাহরাম ও গায়ের মাহরাম তথা বেগানা ও এগানা নারী-পুরুষ সম্পর্কে আমরা একটা সম্যক ধারণা পেয়েছি আল-হামদুলিল্লাহ। এখন আমাদের জানতে হবে, কোন শ্রেণির সাথে পর্দার বিধান কেমন হবে। নিচে এ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হলো—
ইসলামে পর্দার হুকুম: প্রতিটি প্রাপ্ত বয়ষ্কা মুসলিম নারীর উপর পর্দার বিধান মেনে চলা ওয়াজিব।[1] মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ﴾ ‘আর যখন তোমরা তাদের (নবীপত্নীগণের) নিকট কোনো সামগ্রী চাইবে, তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্র’ (আল-আহযাব, ৩৩/৫৩)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,﴿وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى﴾ ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করো এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৩)।
ইফকের ঘটনায় আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ছফওয়ান ইবনুল মু‘আত্তাল রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বলেন,فَرَأَى سَوَادَ إِنْسَانٍ نَائِمٍ فَعَرَفَنِي حِينَ رَآنِي، وَكَانَ رَآنِي قَبْلَ الحِجَابِ، فَاسْتَيْقَظْتُ بِاسْتِرْجَاعِهِ حِينَ عَرَفَنِي، فَخَمَّرْتُ وَجْهِي بِجِلْبَابِي ‘তিনি একজন মানুষের আকৃতি নিদ্রাবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি আমাকে দেখে চিনে ফেললেন। কেননা, পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে তিনি যখন চিনে ফেললেন, তখন তার উচ্চকণ্ঠে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়ার আওয়াজে আমি জেগে গেলাম এবং আমি আমার চাদর দিয়ে চেহারা ঢেকে নিলাম’।[2]
অন্য একটি হাদীছে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,يَرْحَمُ اللَّهُ نِسَاءَ المُهَاجِرَاتِ الأُوَلَ، لَمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ: ﴿وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ﴾ [النور: 31] شَقَقْنَ مُرُوطَهُنَّ فَاخْتَمَرْنَ بِهَا ‘মহান আল্লাহ প্রাথমিক যুগের মুহাজির নারীগণের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যখন আল্লাহ এ আয়াত ‘তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন ওড়না দ্বারা আবৃত করে’ (আন-নূর, ২৪/৩১) নাযিল করলেন, তখন তারা চাদর ছিড়ে তা দিয়ে ওড়না তৈরি করে নিলেন’।[3]
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা আরো বলেন,كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي الفَجْرَ، فَيَشْهَدُ مَعَهُ نِسَاءٌ مِنَ المُؤْمِنَاتِ مُتَلَفِّعَاتٍ فِي مُرُوطِهِنَّ، ثُمَّ يَرْجِعْنَ إِلَى بُيُوتِهِنَّ مَا يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের ছালাত আদায় করতেন। তখন মুমিন নারীগণ তাঁদের চাদরে সারা শরীর আচ্ছাদিত করে তাঁর সাথে জামাআতে শরীক হতেন। অতঃপর তাঁরা তাঁদের বাড়িতে ফিরতেন, কিন্তু কেউ তাঁদেরকে চিনতে পারতেন না’।[4]
আসমা বিনতে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,كُنَّا نُغَطِّيَ وُجُوهَنَا مِنَ الرِّجَالِ ‘বেগানা পুরুষ থেকে আমরা আমাদের মুখমণ্ডল ঢেকে নিতাম’।[5] কুরআন মাজীদ ও হাদীছে এরকম আরো বহু দলীল রয়েছে।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,وَكَشْفُ النِّسَاءِ وُجُوهَهُنَّ بِحَيْثُ يَرَاهُنَّ الْأَجَانِبُ غَيْرُ جَائِزٍ وَعَلَى وَلِيِّ الْأَمْرِ الْأَمْرُ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيُ عَنْ هَذَا الْمُنْكَرِ وَغَيْرِهِ وَمَنْ لَمْ يَرْتَدِعْ فَإِنَّهُ يُعَاقَبُ عَلَى ذَلِكَ بِمَا يَزْجُرُهُ ‘মেয়েদের মুখমণ্ডল এমন জায়গায় খোলা নাজায়েয, যেখানে বেগানা পুরুষ তাদেরকে দেখে ফেলবে। অভিভাবক ও রাষ্ট্রনেতার উচিত, ভালো কাজের আদেশ করা এবং এই মন্দ কাজ ও অন্যান্য মন্দ কাজে নিষেধ করা। এরপরও যে ব্যক্তি নিষেধ শুনবে না, তাকে এমন শাস্তি দিতে হবে, যে শাস্তি তাকে বিরত রাখতে পারে’।[6]
গায়ের মাহরাম বা বেগানা নারী-পুরুষের পরস্পরের মাঝে পর্দার সীমা:
পর্দার মূল জায়গাটাই আসলে গায়ের মাহরাম নারী-পুরুষ। পর্দা সম্পর্কিত কুরআন-হাদীছের বক্তব্যগুলোর সিংহভাগ এ শ্রেণির জন্যই প্রযোজ্য। সেজন্য, গায়ের মাহরাম বা বেগানা নারী-পুরুষকে পরস্পর সম্পূর্ণ পর্দা বজায় রেখে চলতে হবে। নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো বজায় থাকলে তাকে পরিপূর্ণ পর্দা বলা যাবে:
(১) সম্পূর্ণ শরীর আবৃত থাকতে হবে: একজন নারীকে গায়ের মাহরাম বা বেগানা কোনো পুরুষের সামনে আপাদমস্তক সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,﴿يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا﴾ ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলুন, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আল-আহযাব, ৩৩/৫৯)। উল্লেখ্য, জিলবাব হচ্ছে এমন পোশাক, যা পুরো শরীরকে আচ্ছাদিত করে। উক্ত আয়াতের তাফসীরে হাফেয ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন,أَيْ: لَا يُظهرْنَ شَيْئًا مِنَ الزِّينَةِ لِلْأَجَانِبِ، إِلَّا مَا لَا يُمْكِنُ إِخْفَاؤُهُ. ‘অর্থাৎ যা লুকানো যায় না, তা ছাড়া সৌন্দর্যের কোনো কিছুই তারা বেগানা পুরুষের সামনে প্রকাশ করতে পারবে না’।[7]
(২) পোশাক এমন সৌন্দর্যপূর্ণ হওয়া যাবে না, যা পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে: মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ﴾ ‘তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে’ (আন-নূর, ২৪/৩১)। আয়াতাংশটি এমন ডিজাইনের পোশাককেও অন্তর্ভুক্ত করে, যা পুরুষের নজর কাড়ে। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, সৌন্দর্য ঢাকার জন্যই যে পোশাক, তা নিজেই যদি দৃষ্টি আকর্ষণকারী সৌন্দর্যপূর্ণ হয়, তাহলে তা দিয়ে পর্দা হবে কীভাবে?!
(৩) পোশাক পুরু হতে হবে, যা শরীরের রং প্রকাশ করবে না: কারণ পাতলা পোশাকে পর্দা হয় না; বরং ফেতনা আরো বাড়িয়ে দেয়। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,سَيَكُونُ فِي آخِرِ أُمَّتِي نِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ، عَلَى رُءُوسِهِنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ، الْعَنُوهُنَّ؛ فَإِنَّهُنَّ مَلْعُونَاتٌ ‘আমার উম্মতের শেষ যামানায় এমন নারীদের আবির্ভাব ঘটবে, যারা বস্ত্র পরিহিতা হওয়া সত্ত্বেও উলঙ্গ। তাদের মাথার উপর বুখতী উটের উঁচু কুঁজের ন্যায় খোঁপা থাকবে। তাদেরকে অভিশাপ দাও।[8] কারণ তারা অভিশপ্ত’।[9] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ رِيحَهَا لَتُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا ‘তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ এত এত দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে’।[10]
ইবনু আব্দিল বার রাহিমাহুল্লাহ উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এর দ্বারা) সেসব নারীকে উদ্দেশ্য করেছেন, যারা এমন পাতলা পোশাক পরে, যা (দেহের) বিবরণ তুলে ধরে, আবৃত করে না। তারাই নামে পোশাক পরিহিতা, কিন্তু বাস্তবে উলঙ্গ’।[11]
(৪) পোশাক ঢিলেঢালা হতে হবে: কারণ পোশাকের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ফেতনা দূর করা। আর ঢিলেঢালা পোশাক ছাড়া ফেতনা দূর করা সম্ভব নয়। টাইট পোশাক শরীরের রং ঢাকলেও শরীরের আকার প্রকাশ করে দেয়, যা ফেতনার বড় কারণ এবং পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট। সেজন্য, পোশাক ঢিলেঢালা হওয়া আবশ্যক। পূর্বের পয়েন্টে উল্লিখিত হাদীছ দু’টি এখানেও প্রযোজ্য।
(৫) পোশাক সুগন্ধিযুক্ত হওয়া যাবে না: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েদের সুগন্ধি মেখে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,أَيُّمَا امْرَأَةٍ اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلَى قَوْمٍ لِيَجِدُوا مِنْ رِيحِهَا فَهِيَ زَانِيَةٌ ‘যে কোনো মহিলা সুগন্ধি মেখে মানুষের পাশ দিয়ে গমন করে এই উদ্দেশ্যে যে, তারা তার সুগন্ধির ঘ্রাণ পাবে, সে ব্যভিচারিণী’।[12] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أَيَّتُكُنَّ خَرَجَتْ إِلَى الْمَسْجِدِ، فَلَا تَقْرَبَنَّ طِيبًا ‘তোমাদের মহিলাদের যে কেউ মসজিদে গেলে সে যেন সুগন্ধির ধারেকাছেও না যায়’।[13]
এর মূল কারণ হচ্ছে, যে কোনো পুরুষ সুগন্ধির সূত্র ধরে নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং যে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যেতে পারে।[14]
(৬) নারীর পোশাক পুরুষের পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া যাবে না: নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষ পরস্পরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাক পরলে তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ، وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই পুরুষকে অভিশাপ করেছেন, যে নারীর পোশাক পরে এবং সেই নারীকে অভিশাপ করেছেন, যে পুরুষের পোশাক পরে’।[15] অপর হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِالرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ، وَلَا مَنْ تَشَبَّهَ بِالنِّسَاءِ مِنَ الرِّجَالِ ‘যে নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং যে পুরুষ নারীর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[16]
(৭) কাফের নারীদের পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া যাবে না: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে চলে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’।[17] তাছাড়া ইসলামী শরীআতের একটি সুবিদিত মূলনীতি হচ্ছে, নারী-পুরুষ কোনো মুসলিমের জন্য কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা যাবে না।
(৮) প্রসিদ্ধি ও খ্যাতি অর্জনের পোশাক হওয়া যাবে না: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِي الدُّنْيَا، أَلْبَسَهُ اللَّهُ ثَوْبَ مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ أَلْهَبَ فِيهِ نَارًا ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে খ্যাতি অর্জনের পোশাক পরবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোশাক পরাবেন, অতঃপর তাতে অগ্নিসংযোগ করবেন’।[18]+[19]
পরিপূর্ণ পর্দার জন্য আরো যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে—
(৯) বেগানা পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলা পরিহার করতে হবে: মেয়েদের কণ্ঠ নিচু হতে হবে। প্রয়োজনে পুরুষের সাথে কথা বলা যাবে, তবে কোমল কণ্ঠে বলা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,﴿يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا﴾ ‘হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও। যদি তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করো, তবে (বেগানা পুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, সে প্রলুব্ধ হবে। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩২)।
(১০)দৃষ্টি নিচু রাখতে হবে: মহান আল্লাহ মুমিন পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলেন,﴿قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ﴾ ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। তারা যা করে, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (আন-নূর, ২৪/৩০)। পরের আয়াতে তিনি মুমিন নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন,﴿وَقُلْ لِلْمُؤْمِناتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ﴾ ‘মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে’ (আন-নূর, ২৪/৩১)।
(১১)এমন অঙ্গভঙ্গি করে চলা যাবে না, যাতে বেগানা পুরুষের নজর কাড়ে: মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ﴾ ‘আর তারা যেন নিজেদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে’ (আন-নূর, ২৪/৩১)।
(১২) গায়ের মাহরাম নারী-পুরুষের নির্জনে একত্রিত হওয়া যাবে না এবং গায়ের মাহরাম পুরুষের সাথে কোথাও সফর করা যাবে না: এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ: انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ ‘অবশ্যই কোনো পুরুষ যেন কোনো মহিলার সঙ্গে নির্জনে একত্রিত না হয় এবং কোনো মহিলা যেন কোনো মাহরাম পুরুষসঙ্গী ছাড়া সফর না করে। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক যুদ্ধের জন্য আমার নাম লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী হাজ্জযাত্রী। তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে যাও, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ্জ করো’।[20]
অস্থায়ী ও স্থায়ী মাহরামের মাঝে পার্থক্য পার্থক্য করা জরুরী: মূলত অস্থায়ী মাহরাম প্রকৃত মাহরাম নয় এবং তাদের সাথে প্রকৃত মাহরামদের মতো চলাফেরা বৈধ নয়। স্থায়ী মাহরাম নারীদের সাথে যা যা বৈধ, তার কোনোটাই অস্থায়ী মাহরাম নারীদের সাথে বৈধ নয়। কিন্তু এখানেই অনেকেই ভুল করে থাকে। অস্থায়ী মাহরাম নারীদেরকে স্থায়ী মাহরাম নারীদের মতো গণ্য করে তাদের সাথে নির্জনে মিলিত হয়, দেখাদেখি করে, একসাথে ভ্রমণে বের হয়, ঘোরাঘুরি করে ইত্যাদি। অথচ এগুলোর কোনোটাই অস্থায়ী মাহরামদের ক্ষেত্রে বৈধ নয়।
মাহরাম নারী-পুরুষের পরস্পরের মাঝে পর্দার সীমা:
মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ ‘আর যা সাধারণত প্রকাশ পায়, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ… ছাড়া কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে’ (আন-নূর, ২৪/৩১)।
উক্ত আয়াতের তাফসীরে আবূ বকর আল-জাছ্ছাছ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আয়াতটির স্পষ্ট দাবি হচ্ছে, স্বামীর সামনে এবং স্বামীর সাথে পিতাসহ যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবে। আর সুবিদিত যে, এখানে সৌন্দর্যের জায়গা হচ্ছে, চেহারা, হাত, বাহু। ফলে আয়াতটির দাবি হচ্ছে, এতে উল্লিখিত পুরুষদের জন্য উপর্যুক্ত জায়গাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া বৈধ’।[21]
এখানেআমিসঊদী আরবের গবেষণা ও ফতওয়া বোর্ডের স্থায়ী কমিটির ফতওয়া উল্লেখ করতে চাই, যার মাধ্যমে নারীদের পরস্পরের মাঝে এবং নারী ও তাদের মাহরাম পুরুষদের মাঝে পর্দার সীমারেখা স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। সঊদী আরবের গবেষণা ও ফতওয়া বোর্ডের স্থায়ী কমিটি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইসলামের সূচনালগ্নে মুমিন নারীগণ চারিত্রিক পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা এবং লজ্জাশীলতা ও শালীনতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এর মূল কারণ ছিল মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর প্রতি ঈমান এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ। সে সময় নারীগণ গোটা দেহ আবৃতকারী পোশাক পরতেন। তারা পরস্পর মিলিত হলে বা তাদের মাহরাম পুরুষদের সাথে মিলিত হলে খোলামেলা পোশাক পরা তাদের অভ্যাস ছিল না। অতি নিকট অতীত পর্যন্ত যুগের পর যুগ নারীগণ এই সঠিক ও যথার্থ নিয়মের উপরেই ছিলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-আচরণে অনেক নোংরামি ঢুকে পড়েছে।
নারীদের একে অপরের দিকে তাকানোর এবং নিজেদের মাঝে পোশাক-পরিচ্ছদের সীমারেখা কী হবে, সে বিষয়ে ফতওয়া বোর্ডের কাছে প্রচুর প্রশ্ন আসে। সেকারণে ফতওয়া বোর্ড স্পষ্ট বলতে চায়, নারীদের লজ্জাশীলতা অর্জন করতে হবে, যেটিকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের অন্যতম শাখা হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর শরীআত নির্দেশিত ও সামাজিকভাবে প্রচলিত সেই লজ্জাশীলতার অংশ হচ্ছে, নারীর নিজেকে আবৃত রাখা ও শালীনতা বজায় রেখে চলা এবং এমন চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া, যা তাকে ফেতনা ও সংশয়ের জায়গা থেকে দূরে রাখবে।
কুরআন মাজীদের স্পষ্ট বক্তব্য প্রমাণ করে, একজন নারী অপর নারীর সামনে কেবল ততটুকু উন্মুক্ত করতে পারে, যতটুকু তার মাহরাম পুরুষের সামনে উন্মুক্ত করতে পারে। আর তা হচ্ছে, বাসা-বাড়িতে এবং কাজ করতে যেয়ে সাধারণত যতটুকু উন্মুক্ত হয়, ততটুকু। মহান আল্লাহ বলেন,﴿وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنّ ‘আর যা সাধারণত প্রকাশ পায়, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ… ছাড়া কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে’ (আন-নূর, ২৪/৩১)।
যেহেতু কুরআনের এই বক্তব্যই হাদীছেরও বক্তব্য, তাই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর স্ত্রীগণ, ছাহাবীগণের স্ত্রীগণ এবং তাদের উত্তম অনুসারী নারীগণ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীগণ এই আমলের উপরেই ছিলেন। উপর্যুক্ত শ্রেণির পুরুষগণের সামনে সাধারণত যা উন্মুক্ত রাখা যায়, তা হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাসা-বাড়িতে ও কাজ করতে গেলে যা প্রকাশ পায় এবং যেখান থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কঠিন। যেমন— মাথা, দুই হাত, গলা, দুই পায়ের পাতা।এর বাইরে অন্য কোনো অঙ্গ বের করার বৈধতার পক্ষে কুরআন বা হাদীছ থেকে কোনো দলীল পাওয়া যায় না। তাছাড়া এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ফেতনার পথ খুলে যায়, অন্যদিকে তেমনি এটি অন্য নারীদের জন্য মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
তদুপরি এর মাধ্যমে কাফের, ব্যভিচারিণী ও পোশাক-পরিচ্ছদে নির্লজ্জ নারীদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে চলে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’।[22] আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরনে দু’টি বিশেষ কুসুম রঙের কাপড় দেখে বলেন, إِنَّ هَذِهِ مِنْ ثِيَابِ الْكُفَّارِ فَلَا تَلْبَسْهَا ‘এগুলো কাফেরদের পোশাকের মধ্যে গণ্য। সুতরাং তুমি তা পরো না’।[23] অপর হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ رِيحَهَا لَتُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا ‘দুই শ্রেণির জাহান্নামী, যাদেরকে আমি দেখিনি। এক শ্রেণির ঐ সমস্ত মানুষ, যাদের নিকট গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে। তারা এর দ্বারা লোকদের প্রহার করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণির ঐ সমস্ত মহিলা, যারা বস্ত্র পরিহিতা হওয়া সত্ত্বেও উলঙ্গ, আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা। যাদের মাথার খোঁপা বুখতী উটের উঁচু কুঁজের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ এত এত দূরত্বে থেকে পাওয়া যাবে’।[24]
‘বস্ত্র পরিহিতা হওয়া সত্ত্বেও উলঙ্গ’— এ বাক্যের অর্থ হচ্ছে, নারী এমন পোশাক পরে, যা তাকে আবৃত করতে পারে না। সেজন্য সে পোশাক পরিহিতা হলেও বাস্তবে সে উলঙ্গ। যেমন- এমন পাতলা পোশাক, যা দেহের রং প্রকাশ করে দেয় বা এমন সংকুচিত পোশাক, যা দেহের উঁচু-নিচু জায়গা প্রকাশ করে দেয় অথবা এমন খাটো পোশাক, যা দেহের কোনো কোনো অঙ্গ অনাবৃত রাখে।
অতএব, মুসলিম নারীদের জন্য আবশ্যক হচ্ছে, সেই হেদায়াতের পথ আঁকড়ে ধরে থাকা, যার উপর নবীপত্নীগণ, ছাহাবাপত্নীগণ এবং তাদের যথার্থ অনুসারী নারীগণ অটল ছিলেন। তাদের উচিত, নিজেদের আবৃত রাখা এবং শালীনতা বজায় রেখে চলা। তবেই তারা ফেতনার ফাঁকফোকড় থেকে অধিকতর দূরে থাকতে পারবে এবং প্রবৃত্তির তাড়না উদ্দীপক ও অশ্লীলতার প্রণোদনাদায়ক বিষয়াবলি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে।
অনুরূপভাবে মুসলিম নারীদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর আনুগত্যের স্বার্থে এবং মহান আল্লাহর প্রতিদানের আশায় ও শাস্তির ভয়ে সেসব পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে সতর্ক থাকা, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম করে দিয়েছেন; যেসব পোশাকে কাফের ও পতিতাশ্রেণির নারীর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন হয়।
অতএব, প্রতিটি মুসলিম অভিভাবকের উপর আবশ্যক হচ্ছে, তাদের অধীনস্থ নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা। তারা যেন তাদের অধীনস্থ নারীদেরকে এমন পোশাক পরতে না দেন, যা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম করে দিয়েছেন; যেসব পোশাক নগ্নতা ও ফেতনার দিকে আহ্বান করে। প্রত্যেক অভিভাবকের জেনে রাখা উচিত, তিনি একজন দায়িত্বশীল এবং ক্বিয়ামতের দিন তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।[25]
অতএব, নারীর বক্ষদেশ, পেট, পিঠ, ঊরু ইত্যাদি মাহরাম পুরুষের সামনে উন্মুক্ত করা এবং সেদিকে তাকানো জায়েয নেই।[26]
মাহরাম নারী-পুরুষের নির্জনে অবস্থান করা, সফর করা, একসাথে খাওয়া-দাওয়া করা ইত্যাদি জায়েয। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ: انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ ‘অবশ্যই কোনো পুরুষ যেন কোনো মহিলার সঙ্গে নির্জনে একত্রিত না হয় এবং কোনো মহিলা যেন কোনো মাহরাম পুরুষসঙ্গী ছাড়া সফর না করে। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক যুদ্ধের জন্য আমার নাম লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী হাজ্জযাত্রী। তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে যাও, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ্জ করো’।[27]
উল্লেখ্য, মাহরাম পুরুষগণ সবাই এক ধরনের নয়। বরং ঘনিষ্টতা ও ফেতনামুক্ত থাকার দিক থেকে তাদের মধ্যে স্তরভেদ রয়েছে। সেকারণে একজন নারী তার পিতার সামনে যতটুকু প্রকাশ করতে পারে, তার স্বামীর অন্য স্ত্রীর সামনে ততটুকু প্রকাশ করতে পারে না। ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ যথার্থই বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ প্রথমে স্বামীদের কথা বলেছেন, অতঃপর অন্যান্য মাহরাম পুরুষের কথা বলেছেন আর সৌন্দর্য প্রকাশের দিক থেকে তিনি সবাইকে সমান গণ্য করেছেন। তবে মানুষের হৃদয় গহীনে যা লুক্কায়িত থাকে, তা বিবেচনায় মাহরাম পুরুষদের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। অতএব, কোনো সন্দেহ নেই যে, একজন নারীকে তার পিতা ও ভাইয়ের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশের চেয়ে অন্য স্বামীর সন্তানের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। সেকারণে মাহরাম পুরুষদের সামনে কতটুকু সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবে, তার স্তরও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ফলে পিতার সামনে যা প্রকাশ করা যাবে, স্বামীর অন্য স্ত্রীর সন্তানের সামনে তা প্রকাশ করা যাবে না’।[28]
তবে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে সহবাসের অঙ্গ ও সময় সম্পর্কিত কিছু বিধিনিষেধ ছাড়া তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,احْفَظْ عَوْرَتَكَ إِلَّا مِنْ زَوْجَتِكَ أَوْ مَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ ‘তোমার লজ্জাস্থান আপন স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া অন্যদের থেকে হেফাযত করবে’।[29]
মহান রব্বুল আলামীন আমাদেরকে মাহরাম-গায়ের মাহরাম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে এ সম্পর্কিত বিধিবিধান বাস্তবায়নের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী
বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আত-তুওয়াইজিরী, মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিল ইসলামী, ৪/১০৮।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৪১৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৭০।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭৫৮।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭২।
[5]. ছহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৬৯০।
[6]. মাজমূ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, ২৪/৩৮২।
[7]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৬/৪৫।
[8]. তবে নির্দিষ্টভাবে কাউকে অভিশাপ দেওয়া যাবে না।
[9]. আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৯৩৩১, ‘সনদ হাসান’।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১২৮।
[11]. সুয়ূত্বী, তানবীরুল হাওয়ালেক, ৩/১০৩।
[12]. সুনানে নাসাঈ, হা/৫১২৬, ‘হাসান’।
[13]. সুনানে নাসাঈ, হা/৫২৬২, ‘ছহীহ’।
[14]. দ্রষ্টব্য: ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী, ২/৩৪৯।
[15]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪০৯৮, ‘ছহীহ’।
[16]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৮৭৫, ‘ছহীহ’।
[17]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১, ‘হাসান-ছহীহ’।
[18]. সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/৩৬০৭, ‘হাসান’।
[19]. উপর্যুক্ত ৮টি শর্ত আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: আলবানী, হিজাবুল মারআতিল মুসলিমাহ, পৃ. ৫৪-৬৭।
[20]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪১।
[21]. আহকামুল কুরআন, ৫/১৭৪।
[22]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১, ‘হাসান-ছহীহ’।
[23]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৭৭।
[24]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১২৮।
[25]. ফাতাওয়াল লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ১৭/২৯০-২৯৪।
[26]. দ্রষ্টব্য: ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, ৭/৯৮।
[27]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪১।
[28]. তাফসীর কুরতুবী, ১২/২৩২।
[29]. সুনানে তিরমিযী, হা/২৭৬৯; সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪০১৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/১৯২০, ‘হাসান’।