‘আল্লাহু আকবার’ অর্থ আল্লাহ মহান। ‘আল্লাহু আকবার’ পৃথিবীতে উচ্চারিত শ্রেষ্ঠতম তাসবীহ, পবিত্রতম যিকির এবং বরকতময় এক মহান কালেমা। এটি সর্বোৎকৃষ্ট ধ্বনি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ স্লোগান। এর সমতুল্য কোনো ধ্বনি কিংবা স্লোগান পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এ স্লোগানের ভেতর লুকিয়ে আছে স্রষ্টার পরিচয়, তাঁর বড়ত্ব এবং মহত্ত্ব। এ ধ্বনির জাদুস্পর্শে ভীরুরা পরিণত হয় বীরে, কাপুরুষেরা পরিণত হয় অকুতোভয় সৈনিকে। এ ধ্বনির পরশে বৃদ্ধরা পরিণত হয় টগবগে তরুণে, আর তরুণরা অগ্নিস্ফুলিঙ্গে।
আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ এবং মহান সত্তা। শক্তি, সামর্থ্য কিংবা সম্মান কোনো দিক থেকেই তাঁর চেয়ে বড়, মহৎ, শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। তাই একজন মুসলিমের কাছে ‘আল্লাহু আকবার’ এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধ্বনি, প্রিয় বাক্য এবং প্রিয় স্লোগান কোনো কিছুই হতে পারে না। ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবীর দেওয়া রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত, ছাহাবীগণের আমল। তাদের তাকবীর ধ্বনিতে কাফের-মুশরিকদের অন্তরাত্মা থরথর করে কেঁপে উঠত। হাদীছে এসেছে, আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি সকালে খায়বার প্রান্তরে প্রবেশ করেন। সে সময়ে ইয়াহূদীরা কাঁধে কোঁদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা যখন তাকে দেখতে পেল, তখন বলতে লাগল— মুহাম্মাদ সেনাদলসহ আগমন করেছেন, মুহাম্মাদ সেনাদলসহ আগমন করেছেন। ফলে তারা দুর্গে ঢুকে পড়ল। তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উভয় হাত তুলে বললেন, ‘আল্লাহু আকবার, খায়বার ধ্বংস হোক’।[1]
‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম এবং অফুরন্ত ছওয়াবের ভাণ্ডার। বিপদে-মুছীবতে, খুশি-আনন্দে, সফরে-সমরে সর্বাবস্থায় মুমিন ব্যক্তি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবেন। এটিই ঈমানের দাবি। এ ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি তার প্রভুর প্রতি বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটান এবং প্রভুর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যে মুমিনের অন্তরে তাকবীরের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব যত বেশি হবে, তার ঈমানের প্রভাব তত বেশি প্রতিফলিত হবে। তাই আল্লাহর নাম ব্যতীত কিংবা আল্লাহর নামের মোকাবেলায় অন্যের নামে ধ্বনি তোলা বা শ্লোগান দেওয়া স্পষ্টত আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার শামিল। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব ঘোষণার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ﴿وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ﴾ ‘আর আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন’ (আল-মুদ্দাছছির, ৭৪/৩)। তিনি আরো বলেন, ﴿وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا﴾ ‘আর সসম্ভ্রমে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন’ (বনু ইসরাঈল, ১৭/১১১)। উমার রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহু আকবার’ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বাক্য।[2]
‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিকে অবলম্বন করে কবিরা পেয়েছেন কবিতার ভাষা, বীরেরা পেয়েছেন শৌর্য-বীর্য, ভীরুরা পেয়েছেন সাহস-শক্তি। ইতিহাস সাক্ষী, এ ধ্বনির জাদুস্পর্শে ভীরু-কাপুরুষ, আত্মভোলা ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি সন্তান পরিণত হয়েছে নরশার্দূলে। এ ধ্বনিই যুগে যুগে মুসলিমদের বিশ্বজয়ের সাহস, শক্তি, প্রেরণা এবং মন্ত্রণা দিয়েছে। এ ধ্বনির কারণেই বিশ্বব্যাপী কালেমার পতাকা পতপত করে উড়েছিল। এ ধ্বনির কারণেই কালজয়ী জীবনাদর্শ ইসলামের জয়ধ্বনি করতে বাধ্য হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। বিশ্ববাসী আজও ভুলে যায়নি বদর, উহুদ, খন্দক, তাবূক, মুতা, ইয়ারমুক, কাদেসিয়া আর ইয়ামামার প্রান্তরের তাকবীর ধ্বনির কথা। কোটি কোটি হৃদয়ে আজও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় আবূ বকর, উমার, উছমান, আলী, জুবায়ের, খাব্বাব, খুবায়েব, খালেদ, খাল্লাদ, খাওলা, ছাফিয়্যা, হিন্দ রযিয়াল্লাহু আনহুম, তারেক ইবনে যিয়াদ, মূসা ইবনে নুছাইর, মুখতার ছাকাফী, ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী, তিতুমীর রহিমাহুমুল্লাহ-এর মতো বীর-বীরাঙ্গনাদের তাকবীর ধ্বনি।
‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শয়তান ও তার দোসরদের অন্তরে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে এবং তাদের পলায়নপরায়ণতাকে বৃদ্ধি করে। এক বর্ণনায় বসনিয়া যুদ্ধে মুজাহিদদের অবস্থানের কথা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘যখন মুজাহিদরা ময়দানে আসতেন এবং ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করতেন। আল্লাহর শপথ! তখন বিপুল পরিমাণে যুদ্ধাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও সে অঞ্চলে একটা মুশরিক পুরুষ পাওয়া যেত না’। ‘আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান শুনে শয়তান ও তার দোসরদের লেজ গুটিয়ে পলায়নের লক্ষ লক্ষ দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘শয়তান যখন ছালাতের আযান (আল্লাহু আকবার আওয়ায) শুনতে পায়, তখন পশ্চাত বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পালাতে থাকে, যেন আযানের শব্দ তার কানে পৌঁছতে না পারে। মুয়াজ্জিন যখন আযান শেষ করেন, তখন সে ফিরে এসে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। সে পুনরায় যখন ইক্বামত শুনতে পায়, আবার চলে যায় যেন এর শব্দ তার কানে না যেতে পারে। যখন ইক্বামত শেষ হয় তখন সে ফিরে এসে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে’।[3]
‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শয়তান এবং তার দোসরদের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিরোধের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে তা দেখার জন্য বেশি দূর যেতে হবে না। ভারতের কর্ণাটকের কলেজ ক্যাম্পাসে উগ্রবাদি হিন্দু সন্ত্রাসী হায়েনাদের সম্মুখে মুসকান খানের ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি আজ বিশ্বের সকল নিপীড়িত মযলূম মানবতার প্রতিবাদের ভাষায় পরিণত হয়েছে। মুসকানের ধ্বনি আজ বিশ্ববাসীকে শক্তি ও সাহস যোগাচ্ছে, নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত করছে, গোলামী জিঞ্জির ছিন্ন করে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। এদেশের মানুষের ঘুম ভাঙে মসজিদের সুউচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনির সুর মূর্ছনায়। তাদের সারাদিনের কর্মব্যস্ততার অবসান ঘটে এ ধ্বনির মাধ্যমে। এ ধ্বনির আহ্বানে সাড়া দিতেই লক্ষ-কোটি মুসলিম প্রতিদিন পাঁচ বার ছুটে যান মসজিদ পানে। এ দেশের আনাচেকানাচে প্রতি মুহূর্তে অযুত কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় এই পবিত্র ধ্বনি। এদেশের গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দর-নগরে প্রতি বছর হাজারো তাফসীর মাহফিল, ইসলামী জালসা, ওয়ায-মাহফিল, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যায়। মোটকথা, বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি, বোধ-বিশ্বাস, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে মিশে আছে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। এ ধ্বনি তাদের অস্তিত্বের অংশ। শুধু বাংলাদেশী মুসলিমই নয়; বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলিম ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনির সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এ ধ্বনি বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়। এ ধ্বনি বিশ্বমুসলিমের হৃদয়ের স্পন্দন। তাদের জাতিসত্তার পরিচয়। এ ধ্বনি মুসলিমদের আবেগ-অনুভূতির অপর নাম। তাদের চেতনার বাতিঘর এবং প্রেরণার উৎস। এ ধ্বনি মুসলিমদের প্রতিবাদী স্লোগান, প্রতিরোধের ভাষা, বিজয়ের মন্ত্রণা। এ ধ্বনি বিশ্ব মুসলিমের সংস্কৃতি, বোধ-বিশ্বাস, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের অংশ। এটি বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় স্লোগান। এ ধ্বনির মাধ্যমে মুসলিমহৃদয়ে জাগ্রত হয় বিশ্বাসের ফল্গুধারা, অমিততেজ, অসীম বিক্রম।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো— মুসলিম সন্তানদের অনেকেই আজ ইসলাম, ইসলামী আচার-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ এবং উদাসীন। তারা মুসলিমদের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে বিজাতীয়দের অন্ধ অনুকরণে মানবরচিত তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত। সে কারণে স্রষ্টার মহত্ত্ব ও বড়ত্বসম্বলিত ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনির পরিবর্তে তারা সৃষ্টির নামে ধ্বনি দিচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে। অনেকেই আল্লাহর নামের স্লোগানকে বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট করে ফেলছে। কেউ কেউ আল্লাহর নামের ধ্বনিতে বিব্রতবোধ করছে। কেউ কেউ আল্লাহর নামের ধ্বনি পরিত্যাগ করে কিংবা এড়িয়ে চলে কিংবা দূরত্ব বজায় রেখে বিজাতীয় প্রভুদের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করছে। কেউ আবার আল্লাহর নামের ধ্বনিকে নিজের বাপ-দাদার ধ্বনি বলে দাবি করছে। কেউ আবার ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’-এর মধ্যে বিশেষ জাতি গোষ্ঠীর গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করছে। এখানেই শেষ নয়; ইসলামবিদ্বেষীদের একাংশ ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিকে সমালোচনা, প্রতিরোধ, চ্যালেঞ্জ, মোকাবেলা এমনকি উৎখাত করার ঘোষণা দেওয়ার মতো স্পর্ধা দেখাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামবিদ্বেষীদের তাকবীরের বিরোধিতার ক্ষেত্রে দল, গোষ্ঠী, ভাষা কোনো সমস্যা নয়। তাদের কাছে সমস্যা হলো— ইসলাম, ইসলামী পুনর্জাগরণ ও বিজয়। ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগানের বিরোধিতাকারীরা আসলে ইসলামেরই বিরোধিতা করতে চায়। ইসলামের আওয়াজকে সংকুচিত কিংবা স্তব্ধ করতে চায়। কিন্তু কোটি মুসলিমের দেশে তাদের এ স্বপ্ন-সাধ কোনো দিনই পূরণ হবে না। কাফের-মুশরিক-মুনাফিক্ব এবং শয়তানের উত্তরাধিকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, আল্লাহ তাআলা তার দ্বীনকে বিজয়ী রাখবেনই। সম্প্রতি সময়ে চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক নেতার ‘নারায়ে তাকবীর’ শ্লোগান নিয়ে, আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের খবর সচেতন মহলের সবারই জানা। অথচ এসব অপরিণামদর্শীরা এ উপমহাদেশে ইসলামের প্রভাব, গভীরতা জানে না। জানে না তাকবীরের প্রভাব, তাকবীরের ইতিহাস। যারা অন্তরে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি বিশ্বাস, ধারণ ও লালন করেন, তাদের মোকাবিলা কিংবা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দুনিয়ার কারও নেই।
একজন প্রকৃত মুসলিম কখনো আল্লাহর মোকাবিলায় অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারে না। সুতরাং ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি নিয়ে সমালোচনা করা, প্রতিক্রিয়া দেখানো, গোসসা করা, ক্ষোভ দেখানো কোনো মুসলিমের পক্ষে শোভনীয় নয়। যদি কেউ আল্লাহকে মহান এবং শ্রেষ্ঠ বলে উচ্চারণ করতে, প্রচার করতে, স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা-সংকোচবোধ করে কিংবা হীনমন্যতার পরিচয় দেয়, তাহলে সে কখনোই ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী হতে পারে না। হতে পারে না ইসলামের মহান ব্যক্তিদের যোগ্যতম উত্তরসূরী।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সর্বাবস্থায় তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব ঘোষণার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মো. হাসিম আলী
সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮২৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৬৫।
[2]. তাফসীরে কুরতুবী, ১০/৩৪৫।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯১৬৯।