কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বিপথগামী যুবসমাজ: হুমকির মুখে বিশ্ব মানবসভ্যতা!

post title will place here

যুগে যুগে সকল ধর্ম, বর্ণ, মতবাদ বা জাতি সর্বাবস্থায় যুবসমাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। কারণ যুবসমাজ একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি। যুবসমাজের শিরদাঁড়ার উপর ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় একটি আদর্শ সমাজ। একটি সমাজ, সভ্যতা বা রাষ্ট্রের পরিবর্তন-পরিবর্ধন এবং ভাঙা-গড়ার কারিগর যুবসমাজ। যুবক মানে অদম্য শক্তি, অপ্রতিরোধ্য ঝড়। যুবক মানে একটি দৃপ্ত শপথ, এগিয়ে যাওয়ার দুরন্ত বাসনা। অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর সৃষ্টির উন্মাদনাই তাদের গৌরব। চেতনাদৃপ্ত যুবকরা যখন জেগে উঠে, তখন প্রতিবন্ধকতার সকল প্রকার বদ্ধ দুয়ার চূর্ণ করে বিজয়কে ছিনিয়ে আনে। বিজয়ের পুষ্পমালা তাদের পদচুম্বন করে। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে যুবসমাজের ভূমিকা অতুলনীয়। যে জাতির যুবসমাজ যতটা সচেতন, সে জাতি ততটা উন্নত। এরাই পারে জাতিকে একটি সোনালী সমাজ উপহার দিতে। যুবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে জাতির ললাটে নেমে আসবে ঘোর অমানিশা, পরাভূত হবে স্বাধীনতা, বিনষ্ট হবে সার্বভৌমত্ব।

আগামী বিশ্ব ভয়ানক এক প্রজন্মের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। যাদের হিতাহিত জ্ঞান বলতে কিছু নেই। অধিকাংশই মাতাল, নেশাগ্রস্ত, পাগল, লাগামহীন, বিকারগ্রস্ত ও উন্মাদ। যাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, সমাজ তো অনেক দূরের কথা। নাচ-গান, খেলাধুলা, টিভি-সিনেমা, বিপরীত লিঙ্গের সাথে অবাধ মেলামেশা আর বিজাতীয় সংস্কৃতির স্রোতধারায় শরীর এলিয়ে দেওয়াই যাদের নিত্যদিনের কাজ। বর্তমান যুবসমাজের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তার কিছুটা নমুনা উল্লেখ করা হলো—

মাদকতা:

বিশ্বব্যাপী মাদকের দিকে মানুষ যেভাবে ঝুঁকছে, তা চিন্তাতীত। ফলে সামাজিকতা নষ্ট হচ্ছে, ফাটল ধরছে পারিবারিক বন্ধনে। ভারত, মিয়ানমার-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে বন্যার পানির মতো এসব নেশাদার দ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দেশের সীমান্তে এক ডজনের বেশি মাদক ও ফেন্সিডিলের কারখানা রয়েছে। এর উৎপাদিত প্রায় সবটুকুই বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উদ্দেশ্য হলো এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিকারগ্রস্ত করে দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোন মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, ‘যুদ্ধ, মহামারি ও দুর্ভিক্ষে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয় মাদকতায়’।

বাংলাদেশ সরকারের মাদক অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এদেশে মাদকাসক্তের ৯০ ভাগই হলো কিশোর, যুবক ও শিক্ষার্থী। যাদের ৫৮ ভাগ ধূমপায়ী এবং ৪৪ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। মাদকাসক্তদের গড় বয়স এখন ১৩ বছরে এসে ঠেকেছে। আসক্তদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৭ বছরের মাঝে। অবাক করা তথ্য হলো মাদকসেবীর অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত। মাদকসেবীরা সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ। কারণ মাদকাসক্তি এবং সন্ত্রাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্তমান বিশ্বে মাদকসেবীদের ১০০ ভাগের মাঝে শতকরা ২০ ভাগই হলো নারী।

নারী নির্যাতন:

সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা বাঁধভাঙা বন্যার পানির ন্যায় বেড়েই চলেছে। রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সর্বত্রই নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। হায়েনার দল তাদেরকে দেখলেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। দেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাশ করা হয়। ২০১৩ সালে এ আইনকে সংশোধন করে শাস্তি আরও কঠিন করা হয়। এরপরও নারী নির্যাতনের গতি বিন্দুমাত্র স্তিমিত করা সম্ভব হয়নি। গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রতিনিয়ত পত্রিকাগুলোতে এরূপ কোনো না কোনো সহিংসতার ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১৮ সালে সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণসংক্রান্ত ১৭ হাজার ২৮৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ভিকটিমের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৯ জন। যাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬১ জন নারী ও ৩ হাজার ৫২৮ জন শিশু।

দেশজুড়ে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার ৫১.৬২ ভাগই ধর্ষণের দখলে। ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি মাসে ৫৯৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। মামলার হিসাবে মাসে শুধু গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৪১টি। তবে ধর্ষণের সঠিক সংখ্যা আরও বেশি। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মানসম্মানের ভয়ে মামলা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাধর অভিযুক্ত অপরাধীরা চাপ সৃষ্টি করে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেয়। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের সাজার হারও অনেক কম। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মাত্র ১১.২৬ শতাংশ ঘটনায় সাজা পেয়েছে অপরাধীরা।

পরিসংখ্যান মতে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭৯৯টি। একই সময় গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১২৫টি। ধর্ষণের ঘটনায় ছেলেশিশুর সংখ্যা ছিল ৩৮, কন্যাশিশু ৫৫৮ ও প্রাপ্তবয়স্ক নারী ১ হাজার ৩১৮ জন। মামলায় এজাহারনামীয় অভিযুক্তের মধ্যে ছেলেশিশু ৮৫ জন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দুই হাজার ৯৯৮ জন। পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনায় ১.৯৯ শতাংশ ছেলেশিশু, মেয়েশিশু ২৯.১৫ শতাংশ ও প্রাপ্তবয়স্ক নারী ৬৮.৮৬ শতাংশ।

পর্নোগ্রাফি:

ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টসের এক জরিপে দেখা যায় যে, স্কুল-কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে শতকরা ৬০ জন পর্নো ভিডিও দেখছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণির কিছু ছাত্র-ছাত্রীর ওপর চালানো একটি জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৭৬ জন শিক্ষার্থীর ফোন আছে। বাকিরা বাবা-মার ফোন ব্যবহার করে। এর মাঝে ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্নো দেখে। শুধু ক্লাসে বসেই পর্নো দেখে ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এটা ছিল ২০১৭ সালের কথা আর এখন ২০২৫ সাল। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় দিন দিন পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০২৩ সালে শিশু সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এতে বলা হয়েছে, দেশের ৩৪ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি দেখে। আসক্ত ২৬ শতাংশ মেয়েশিশু তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে এসব দেখে এবং ১৪.৪ শতাংশ আত্মীয় বা পরিবারের বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখে। পর্নোগ্রাফি দেখা শিশুদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৯.৪ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফি দেখে বন্ধু অথবা আত্মীয়স্বজনের বাসায় এবং ৩২.৩ শতাংশ দেখে নিজেদের বাসায়। ৫৯.২ শতাংশ শিশু তাদের বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে পর্নো ভিডিও দেখে। বাকিরা আত্মীয়স্বজন, অপরিচিত ব্যক্তিবর্গ এবং নিজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে পর্নোগ্রাফি দেখে।

সাইবার ক্রাইম বিষয়ক সচেতনতাধর্মী প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, গত ছয় বছর যাবৎ শিশুদের সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার হার ব্যাপক হারে বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪.৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০.৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে ফেসবুক-সহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে।

অপরাজনীতি:

অপরাজনীতি বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। যা ক্রমশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। অপরাজনীতির আগ্রাসী থাবার শিকারে পরিণত হচ্ছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, স্কুল-কলেজের স্বপ্নচারী মেধাবী শিক্ষার্থীরা। শত শত পরিবার তাদের একক কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে আজ পথের ভিখারী। বাচ্চারা এখনও তাদের বাবার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করে। অনেক ব্যক্তির ব্যাপারে শুনেছি, অপরাজনীতির বলি হয়ে বাবা মারা গেছেন বা জেলখানায় বন্দি আছেন আর এদিকে বাচ্চারা বাবাকে ছাড়া খাবার খেতে চায় না, স্ত্রী একা ঘুমাতে পারেন না। কী দোষ এই অবুঝ বাচ্চাগুলোর? কেন রাজাদের অপরাজনীতির শিকার হয়ে প্রজারা পথেঘাটে জীবন বিলাবে? পরিবাবের সযত্নে বেড়ে ওঠা সন্তানটি কেন পাইক-পেয়াদাদের হাতে গুলি খেয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে মর্গে পঁচবে? রুটি-রূযীর উদ্দেশ্যে বের হওয়া নিরপরাধ ব্যক্তিটি কেন পঙ্গুত্ব বরণ করবে? এটাই যদি রাজনীতি হয়, তবে এমন রাজনীতি জনসাধারণ চায় না।

এছাড়াও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অশ্লীল গান-বাজনা, নগ্ন নাটক, সিনেমা যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংস করে জাতিকে একেবারে পঙ্গু করে দিচ্ছে। স্কুল-কলেজগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং যৌনাচারের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। যুবসমাজ যেমন তাদের নিজেদের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, জাতির ভবিষ্যৎও নষ্ট করছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজ বিধ্বংসী অমুসলিমদের এসব নীল নকশা আমরা বুঝতে যতটা দেরি করব, পরিণাম ততটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

তাই আসুন! আমাদের সন্তানদের প্রতি আমরা আরও যত্নবান হই। এক্ষেত্রে ইসলামের সুমহান ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত চরিত্র গঠনের সকল গুণ যেমন— তাক্বওয়া, শালীনতা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা পালন, আমানতদারিতা, ছবর, ইহসান, বিনয়, উদারতা, দানশীলতা ইত্যাদি আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেই, তাহলে কখনোই তারা বিপথগামী হবে না। ফলে সুন্দর হবে আমাদের সমাজ। সমৃদ্ধ হবে আমাদের দেশ। পরম সুখ-শান্তির মৃদু হাওয়ায় আন্দোলিত হবে আমাদের জীবন। আমরা পাব একটি আল্লাহভীরু, মেধাবী ও সত্যবাদী প্রজন্ম। আল্লাহ আমাদের যুবসমাজকে তার পথে কবুল করুন এবং তাঁর রহমতের ছায়া দিয়ে আগলে রাখুন- আমীন!

* শিক্ষার্থী, শরীআহ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

Magazine