আল্লাহ তাআলা বলেন, وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ - وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ ‘বিশ্বাসকারীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শনাবলি রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি দেখতে পাও না?’ (আয-যারিয়াত, ৫১/২০-২১)।
মানবদেহের কী কী নিদর্শন সমগ্র দেহকে সুগঠিত করেছে তা সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো :
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল মানবদেহেরে জন্য উপকারী অথবা সম্ভাব্য উপকারী হিসেবে ৬১টি উপাদান তালিকাভুক্ত করেছেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দুনিয়াতে বিদ্যমান ১১৮টি উপাদানের মধ্যে মানবদেহে ৯৪টি উপাদান রয়েছে, তন্মধ্যে ৬১টি উপাদানের মাত্রা জানা যায়। বাকী ৩৩টি উপাদান মানবদেহে কী পরিমাণে বা কী মাত্রায় রয়েছে, তা জানা যায় না।[1] এসব উপাদানের মধ্যে ছয়টি উপাদান মানবদেহের ৯৯% ভর দখল করে আছে। অক্সিজেন ৬৫%, কার্বন ১৮.৫%, হাইড্রোজেন ১০%, নাইট্রোজেন ৩.২%, ক্যালসিয়াম ১.৫% ও ফসফরাস ১.০%। পটাসিয়াম, সালফার, সোডিয়াম, ক্লোরিন এবং ম্যাগনেসিয়াম— এই পাঁচ উপাদান মাত্র ০.৮৫% ভর ধারণ করে। এই মোট ১১টি উপাদানকে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়াও এক ডজনের বেশি উপাদানকে প্রয়োজনীয় বিবেচনা করা হয়। এগুলোকে ট্রেস উপাদান বলা হয়। মানবদেহে এদের মোট ওযন ১০ গ্রামেরও কম।[2]
বিস্ময়কর মানুষ সৃষ্টির উপাদান : প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ তাআলা সরাসরি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কুরআনে এ মাটিকে কাদামাটি, পোড়ানো শুকনো মাটি, মাটির নির্যাস ইত্যাদি অভিধায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এগুলো ছিল মাটি থেকে আদম আলাইহিস সালাম-এর দেহ সৃষ্টি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়। আদম আলাইহিস সালাম-এর দেহ সৃষ্টির পর আল্লাহ সে দেহ থেকে হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। এরপর পুরুষ ও নারীর মিলনে উদ্ভূত শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণে মানুষের জন্মলাভের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। কেননা মানবদেহে যেসব উপাদান পাওয়া যায়, তার সবগুলো উপাদান মাটির মধ্যে বিদ্যমান। আমরা দেখেছি যে, পৃথিবীতে ১১৮টি উপাদান রয়েছে, তন্মধ্যে ২৬টি উপাদান দিয়ে মানবদেহ মৌলিকভাবে গঠিত। কুরআন বলছে, মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ মাটির সব উপাদান দিয়ে নয়, বরং মাটির উৎকৃষ্ট কিছু উপাদান দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্টি তা সন্দেহাতীতভাবেই সত্য। অনুরূপভাবে কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা জানি যে, পানি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত হয়। আমাদের দেহেও এই দুটি উপাদানের উপস্থিতি ৬৫% + ১০% = ৭৫%।
সুতরাং মানুষকে যুগপুৎভাবে মাটি ও পানি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।[3] কুরআনেও বলা হয়েছে মানুষকে কাদামাটি তথা মাটি ও পানির সংমিশ্রনে সৃষ্টি করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে মানুষের সৃষ্টির এ উপাদানসমূহ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। যেমন—
(ক) মানুষকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ‘তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি মৃত্তিকা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’ (আর-রূম, ৩০/২০)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেন,الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ ‘যিনি তাঁর সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন’ (আস-সাজদাহ, ৩২/৭)।
(খ) মানুষকে পোড়ামাটির মতো শুকনো মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল্লাহ তাআলা বলেছেন,خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ ‘আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে’ (আর-রহমান, ৫৫/১৪)।
(গ) মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ ‘আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি’ (আল-মুমিনূন, ২৩/১২)।
(ঘ) মানুষকে শুকনো কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল্লাহ তাআলা বলেছেন,وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ ‘আমি মানবকে পচা কর্দম থেকে তৈরি শুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি’ (আল-হিজর, ১৫/২৬)।
(ঙ) মানুষকে আঠালো মাটিতে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল্লাহ তাআলা মানুষকে আঠালো মাটিতে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন, إِنَّا خَلَقْنَاهُمْ مِنْ طِينٍ لَازِبٍ ‘আমিই তাদেরকে আঠালো মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি’ (আছ-ছাফফাত, ৩৭/১১)।
(চ) মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا ‘তিনিই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানবকে’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৫৪)।
পুরুষের বীর্য এবং নারীর ডিম্বাণু গঠিত হওয়ার উপাদান মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝখান থেকে আসে। মোট কথা, পুরুষের বীর্য এবং নারীর ডিম্বাণু গঠিত ও বিকশিত হয় এমন কিছু কোষের মাধ্যমে, যা মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝে উদগত। সুতরাং এই আয়াতটি সম্পূর্ণরূপে একটি অলৌকিক বিষয়, যখন এটি বলছে যে, বীর্য মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝখান থেকে উদগত হয়’।[4] অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিন মাসের মধ্যে ভ্রুণের অণ্ডকোষের বীচি অণ্ডকোষের থলে নেমে আসে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অণ্ডকোষের বীচি নিচে নেমে আসে না, তখন এটাকে (Undescended testes)-কে orchiopexy নামক সার্জিক্যাল পক্রিয়ায় নিচে নামিয়ে আনা হয়।[5]
(ছ) মেরুদণ্ড ও পাঁজরের মধ্য থেকে নির্গত তরল থেকে মানুষের সৃষ্টি : আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ - خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ - يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ ‘অতএব, মানুষ যেন লক্ষ্য করে, কী থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে, যা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষপাঁজরের মধ্য থেকে’ (আত্ব-ত্বারেক, ৮৬/৫-৭)।
অনেকেই ভাবতে পারেন যে, মানুষের বীর্য তো অণ্ডকোষের বীচি থেকে উৎগত হয়, তাহলে কুরআনে কীভাবে বলা হলো যে, তা মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝখান থেকে বীর্য উৎগত হয়?
এই প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মাদ আলী আল-বার্র বলেন, ‘অণ্ডকোষের বীচি ও ডিম্বাশয় ঠিক এই অঞ্চল অর্থাৎ মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝখানে গঠিত। তারপর অণ্ডকোষের বীচি ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে আসে, এমনকি গর্ভধারণের সপ্তম মাসের শেষের দিকে শেষ পর্যন্ত তা তলপেটের বাইরে অণ্ডকোষের থলেতে এসে পৌঁছে। আর মেয়েদের ডিম্বাশয় নিম্ন ঔদরিক খাঁজে নেমে আসে।...
যাহোক, এদের পুষ্টি সঞ্চরণশীল, স্নায়ুবিক ও লসিকানালীর সিস্টেমে, যেখানে এদের উৎপত্তি হয়েছে অর্থাৎ মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝখান থেকে অণ্ডকোষের বীচি ও ডিম্বাশয়ে আসা অব্যাহত থাকে। অণ্ডকোষের বীচি ও ডিম্বাশয়ের ধমনি মহাধমনি থেকে উদগত যা মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝে বিদ্যমান। অণ্ডকোষের বীচির শিরাগুলোও ঐ একই এলাকা তথা মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝে গিয়ে শেষ হয়েছে। অণ্ডকোষের বীচি ও ডিম্বাশয়ের নার্ভগুলো একদল নার্ভ থেকে উদগত, যেগুলো মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝে পাকস্থলিতে অবস্থিত। রসবাহী ভেসেলগুলো ঐ একই এলাকা তথা মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝে গিয়ে শেষ হয়েছে।
এসবের পরও কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে যে, মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের মাঝখান থেকে অণ্ডকোষের বীচি ও ডিম্বাশয় পুষ্টি ও রক্ত গ্রহণ করে, এগুলো এমন কিছু নার্ভ থেকে গঠিত, যা ঐ স্থান থেকে উদগত?
(জ) মানুষকে নুতফাহ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একবার বীর্যপাতে গড়ে ৩.৭ মিলিলিটার বীর্য নির্গত হয়। আর প্রতি মিলিলিটার বীর্যে গড়ে ১০০ মিলিয়ন তথা ১০ কোটি শুক্রাণু থাকে। সুতরাং ৩.৭ মিলিলিটার বীর্যে ৩০ কোটি ৭০ লক্ষ শুক্রাণু থাকে। আর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার জন্য একটি শুক্রাণুই যথেষ্ট।
আল-কুরআনে মানুষ সৃষ্টির এ অতি অল্প পরিমাণ শুক্রাণুর প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য নুতফাহ তথা অতি সামান্য পরিমাণ তরল বীর্যের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ ‘তিনি মানবকে এক ফোঁটা বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন’ (আন-নাহল, ১৬/৪)। এছাড়া আল-কুরআনের বিভিন্ন সূরাতে একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। বিষয়টি আরও আলোচিত হয়েছে আল-কাহফ, ১৮/৩৭; আল-হজ্জ, ২২/৫; আল-মুমিনূন, ২৩/১৩; ফাত্বির, ৩৫/১১; ইয়াসীন, ৩৬/৭৭; হা-মীম আস-সাজদাহ, ৪০/৬৭; আন-নাজম, ৫৩/৪৬; আদ-দাহর, ৭৬/২; আবাসা, ৮০/১৯ প্রভৃতি আয়াতে।
(ঝ) মানুষকে ‘নুতফাতুন আমশাজ’থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে : আল-কুরআনে মানুষের সৃষ্টিশৈলী বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে’ (আদ-দাহর, ৭৬/২)। এই আয়াতের نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ অর্থ হলো, মিশ্রিত তরল পদার্থ। আল-কুরআনের তাফসীরকারকদের মতে, এখানে মিশ্রিত তরল পদার্থ বলতে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ থেকে নিঃসৃত তরলের মিশ্রণকে বোঝানো হয়েছে। নারী ও পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিশ্রিত হওয়ার পরও ভ্রূণ নুতফাহ আকারে অবস্থান করে। মিশ্রিত তরল পদার্থ দ্বারা শুক্রাণু জাতীয় তরল পদার্থকেও বোঝানো হতে পারে, যা বিভিন্ন লালাগ্রন্থির নিঃসরিত রস থেকে তৈরি হয়ে থাকে। এ হিসেবে نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ দ্বারা বুঝায় নারী ও পুরুষের ডিম্বাণু, শুক্রাণু এবং এগুলোর চারপাশের তরল পদার্থের কিছু অংশ।
(ঞ) মানুষকে ‘সুলালাহ’ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে : মানুষের জন্মপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ ‘অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে’ (আস-সাজদাহ, ৩২/৮)।
আরবী শব্দ ‘সুলালা’র তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ রয়েছে। এর অর্থ- তরলের সাধারণ নির্যাস, স্বল্প পরিমাণ তরল ও একটি মৎস্যসদৃশ কাঠামো। উল্লেখ্য, মানুষের শুক্রাণু একটি লম্বা আকৃতির মাছের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। অধিকন্তু প্রত্যেক বীর্যপাতের সময় ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন শুক্রাণু নির্গত হয়, যা থেকে কেবল ২০০টি শুক্রাণু ৫ মিনিটের মধ্যে নিষিক্তকরণ অঞ্চলে পৌঁছে যায়। সেসব থেকে কেবল একটি শুক্রাণুকেই ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্তকরণের জন্য নিংড়ে নেওয়া হয়। অধিকন্তু শুক্রাণুগুলো সামান্য পরিমাণ তরলের রূপ ধারণ করে, যা ৩.৫ থেকে ৫ মিলিমিটারের বেশি নয়। অতএব, এই কারণে কুরআনের ‘সুলালা’ শব্দটি কেবল যথার্থ বর্ণনাই প্রদান করে না, বরং এই উপধাপের অঙ্গসংস্থান এবং শরীরতাত্ত্বিক গঠনকেও নির্দেশ করে। আরো উল্লেখ্য, কুরআন মাজীদ এই ধাপে কেবল পুরুষের বীর্য সম্পর্কে নির্দেশ করে। আর সেটা ভ্রূণবিদ্যার সাম্প্রতিক জ্ঞানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
বিস্ময়কর মানবদেহের উপাদান : মানব শরীর সত্যি বিস্ময়কর। এটি একটি অভূতপূর্ব মেশিন। এই আশ্চর্য মেশিনটাকে ঢেকে রাখা হয়েছে একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পোশাক দিয়ে, যার নাম চামড়া। এর উপরিভাগে আবার রয়েছে ১ কোটি লোমকূপ।
প্রতিদিন মানুষের দেহের চামড়া থেকে ঝরে পড়ে অসংখ্য মৃত ত্বক-কোষ। হিসেব করে দেখা গেছে, মানুষের শরীর থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬ লক্ষ ত্বক-কোষ ঝরে পড়ে। এক বছরে এই ঝরে পড়া ত্বক কোষের ওযন দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ পাউন্ড।[6]
মানবদেহকে সচল রাখার জন্য যে পরিমাণ ফসফরাস আল্লাহ দিয়েছেন তা দিয়ে ২২০০ দিয়াশলাই বানানো যাবে। শরীরে পানি আছে ১০ গ্যালন। যে পরিমাণ কার্বন আছে (দেহের মোট ওযনের ১৮.৫%) তা দিয়ে ৯০০০টি পেন্সিলের নিব তৈরি করা যাবে। যে পরিমাণ লোহা (২-৬ গ্রাম) আছে তা দিয়ে বড় ধরনের ২ ইঞ্চি পেরেক তৈরি করা যাবে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ (১০০ ওয়াট) আছে তা দিয়ে ২৫ ওয়াটের একটি বাল্বকে অন্তত পাঁচ (৪ মিনিট) মিনিট সময় জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব। এই মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যে পরিমাণ বাতাস (মিনিটে ৮ লিটার, দিনে ১১ হাজার লিটার এবং সারা জীবন ৩০ কোটি লিটার বাতাস) ব্যবহার করে, তা দিয়ে ৩৫ লক্ষ বেলুন ফোলানো যাবে। একজন ৭০ কেজি ওযনের মানুষের শরীরে ১৪০ গ্রাম সালফার বা গন্ধক থাকে। মানুষের শরীরে লবণ আছে প্রায় ২৫০ গ্রাম, রক্ত আছে প্রায় ১.৫ গ্যালন বা ৫ কেজি আর হাড় আছে শিশু বয়সে ৩০০টি, কিন্তু বয়স বাড়লে তা কমে দাঁড়ায় ২০৬ টিতে।
প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কে ৮৬ বিলিয়ন নার্ভ সেল আছে। প্রতিটি আদম সন্তানকে ৩৬০ গিরা বা জোড়ের উপর সৃষ্টি করা হয়েছে।[7] এ গিরা না থাকলে কোনো দিকে বাঁকানো যেত না। একজন মানুষের দেহে চামড়া রয়েছে ২ বর্গমিটার বা ২২ বর্গফুট।[8] আমাদের শরীরে মোট ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষ আছে। শিশুদের যে পরিমাণ কোষ আছে, তা পাশাপাশি জোড়া লাগালে ৬০ হাজার মাইল হবে, আর প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কোষ পাশাপাশি জোড়া লাগালে তা ১ লাখ মাইল হবে।[9] একজন মানুষের শরীরে রক্ত চলাচলের জন্য যে শিরা আছে, তার সবগুলোকে পাশাপাশি সাজালে দেড় একর জমির প্রয়োজন হবে। মানবদেহে প্রতিদিন ২০০ বিলিয়ন নতুন রক্তকণিকা উৎপন্ন হচ্ছে।
একটি কম্পিউটার খুললে আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য ক্যাবল সংযোজন করে কার্য সম্পাদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তেমনি মানবদেহের মস্তিষ্কের সাথে সংযোজিত রয়েছে, শিরা, উপশিরা, ধমনি, স্নায়ু ইত্যাদির বহুরূপী অসংখ্য ক্যাবল। যার ফলে আমরা যাবতীয় কার্য সম্পাদন করতে পারি। এখন প্রশ্ন হলো, মানবদেহের এই অসংখ্য শিরা, উপশিরা, ধমনি, স্নায়ু ইত্যাদি এত সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও সুনিপুণভাবে সংযোজন করলেন কে? একটি কম্পিউটারের যদি একজন আবিষ্কারক থেকে থাকেন, তবে মানবদেহের মতো এত নিখুঁত, নির্ভুল ও নিপুণ কম্পিউটারের কোনোই কি সৃষ্টিকর্তা নেই, এটি কোন যুক্তিতে টেকে?
মানুষের চোয়াল এতই শক্তিশালী যে, প্রতিবারে ২৭৯ পাউন্ড বা ১২৫ কেজি ওযন বলপ্রয়োগ করতে পারে। হাড়গুলো স্টিলের চেয়েও শক্ত। আমাদের রুচিবোধের জন্য অর্থাৎ কোনটা আমরা পছন্দ করি, কোনটা আমরা অপছন্দ করি এটি বলে দেওয়ার জন্য রয়েছে ৯০০০ ছোট সেল, যেগুলোকে যথারীতি সাহায্য করার জন্য রয়েছে আরও ১ কোটি ৩০ লক্ষ নার্ভ সেল। মানুষের মস্তিষ্ক ১০ ওয়াটের বাল্ব এর সমান শক্তি প্রয়োগ করে। মানুষের ফুসফুস থেকে বের হওয়া বায়ুর তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং হাতের ছালের তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মানবদেহে আল্লাহ তাআলা যে কত কিছু দান করেছেন, সে সম্পর্কে বর্ণনা করতে গেলে বিশালাকৃতির গ্রন্থ রচিত হবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ ‘যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন’ (আল-ইনফিত্বার, ৮২/৭)।
যিনি দয়া করে, অনুগ্রহ করে মানুষকে এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করেছেন, এই পৃথিবীতে সে যেন জীবন ধারণ করতে পারে সে ব্যবস্থা করেছেন, যাবতীয় ব্যবস্থা যিনি করে যাচ্ছেন, তাঁর দাসত্ব না করে মানুষ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করছে। আল্লাহর বিধানের বিপরীত পন্থায় যাবতীয় কাজকর্ম করে যাচ্ছে। একটি বারের জন্যও চিন্তা করছে না যিনি তাকে শূন্য থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন, প্রতি মুহূর্তে তাঁর রহমতের বারিধারায় সিক্ত করছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি যে, কোন সে বিজ্ঞানী যিনি মায়ের গর্ভে গভীর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে শুক্রাণু থেকে এরূপ বিস্ময়কর শিল্পনৈপুণ্যে ভরা মানুষ সৃষ্টি করলেন? কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনিই হচ্ছেন সুমহান আল্লাহ।
মো. হারুনুর রশীদ
ফরক্কাবাদ, বিরল, দিনাজপুর।
[1]. Dietary Reference Intakes: The Essential Guide to Nutrient Requirements, P. 313-319, 415-422.
[2]. The essential metals for humans: a brief overview, P. 120-129.
[3]. Experimental Models of Primitive Cellular Compartments: Encapsulation, Growth, and Divition, P. 618-622.
[4]. খালকুল ইনসান বায়না আত-তিব্বী ওয়াল কুরআন, পৃ. ১১৪-১২৪।
[5]. Robins Basic Pathology, P. 692-694.
[6]. Vitalrecord ওয়েবসাইট থেকে গৃহীত।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০০৭।
[8]. Live Science ও National Geographic ওয়েবসাইট থেকে গৃহীত।
[9]. টাইমস অব ইন্ডিয়া।