(আগস্ট’২১ সংখ্যায় প্রকাশিতের পর)
শুফাই আল-আছবাহী রাহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণিত।*তিনি বলেন, কোনো একদিন তিনি মদীনায় পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোককে ঘিরে জনতার ভিড় লেগে আছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, ইনি কে? উপস্থিত লোকেরা তাকে বলল, ইনি আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু। (শুফাই বলেন) আমি কাছে গিয়ে তার সামনে বসলাম। তখন লোকদের তিনি হাদীছ শুনাচ্ছিলেন। তারপর তিনি যখন নীরব ও একাকী হলেন, আমি তাকে বললাম, আমি সত্যিকারভাবে আপনার নিকট এই আবেদন করছি যে, আপনি আমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাবেন, যা আপনি সরাসরি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট শুনেছেন, ভালোভাবে বুঝেছেন এবং জেনেছেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি তাই করব। আমি এমন একটি হাদীছ তোমার কাছে বর্ণনা করব, যা সরাসরি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট বর্ণনা করেছেন এবং আমি তা বুঝেছি ও জেনেছি। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু একথা বলার পর বেহুঁশ হয়ে গেলেন। অল্প সময় পর হুঁশ ফিরলে তিনি বললেন, আমি এমন একটি হাদীছ তোমার কাছে বর্ণনা করব, যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘরের মধ্যে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। তখন আমি ও তিনি ব্যতীত আমাদের সাথে আর কেউ ছিল না। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু একথা বলে আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তিনি চেতনা ফিরে পেয়ে মুখমণ্ডল মুছলেন, তারপর বললেন, আমি তোমার নিকট অবশ্যই এরূপ হাদীছ বর্ণনা করব, যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। তখন এই ঘরে তিনি ও আমি ব্যতীত আমাদের সাথে আর কেউ ছিল না। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তিনি পুনরায় হুঁশ ফিরে পেলে মুখমণ্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি তা করব। আমি অবশ্যই তোমার নিকট এরূপ হাদীছ বর্ণনা করব, যা তিনি আমাকে বর্ণনা করেছেন। আমি তখন তার সাথে এ ঘরে ছিলাম। আমি আর তিনি ব্যতীত তখন আর কেউ এখানে ছিল না। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু আবারো গভীরভাবে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। এমনকি উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেন। আমি অনেকক্ষণ তাকে ঠেস দিয়ে ধরে রাখলাম। তারপর হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বান্দাদের মাঝে ফয়সালা করার জন্য কিয়ামত দিবসে তাদের সামনে হাযির হবেন। সকল উম্মতই তখন নতজানু অবস্থায় থাকবে। তারপর হিসাব-নিকাশের জন্য সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিদের ডাকা হবে, তারা হলো কুরআনের হাফেয, আল্লাহ তাআলার পথের শহীদ এবং প্রচুর ধনসম্পদের মালিক। সেই ক্বারী (হাফেয/কুরআন পাঠকারী)-কে আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন করবেন, আমি আমার রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যা প্রেরণ করেছি, তা কি তোমাকে শিখাইনি? সে বলবে, হে রব! হ্যাঁ, শিখিয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি যা শিখেছ, সে অনুযায়ী কোনো আমল করেছ কি? সে বলবে, আমি রাত-দিন তা তেলাওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তখন ফেরেশতাগণও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ তাআলা তাকে আরো বললেন, বরং তুমি ইচ্ছাপোষণ করেছিলে যে, তোমাকে বড় ক্বারী (হাফেয) ডাকা হোক। আর তা তো ডাকা হয়েছে। তারপর সম্পদশালী ব্যক্তিকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে সম্পদশালী বানাইনি? এমনকি তুমি কারো মুখাপেক্ষী ছিলে না। সে বলবে, হে বর! হ্যাঁ, তা বানিয়েছেন। তিনি বলবেন, আমার দেওয়া সম্পদ হতে তুমি কোন কোন (সৎ) আমল করেছ? সে বলবে, আমি এর দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রেখেছি এবং দান-ছাদাক্বা করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ; ফেরেশতাগণও বলবে, তুমি মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তাআলা আরো বলবেন, তুমি ইচ্ছাপোষণ করেছিলে যে, মানুষের নিকট তোমার দানশীল-দানবীর নামের প্রচার-প্রসার হোক। আর এরূপ তো হয়েছেই। তারপর যে লোক আল্লাহ তাআলার রাস্তায় শাহাদাত বরণ করেছে তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাকে প্রশ্ন করবেন, তুমি কীভাবে নিহত হয়েছে? সে বলবে, আমি তো আপনার পথে জিহাদ করতে আদিষ্ট ছিলাম। কাজেই আমি জিহাদ করতে করতে শাহাদাত বরণ করেছি। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, আর ফেরেশতাগণও বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তাআলা আরো বলবেন, তুমি ইচ্ছাপোষণ করেছিলে লোকমুখে একথা প্রচার হোক যে, অমুক ব্যক্তি খুবই সাহসী বীর। আর তা তো বলাই হয়েছে। তারপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাঁটুতে হাত মেরে বললেন, হে আবূ হুরায়রা! কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মধ্য হতে এই তিন জন দ্বারাই প্রথমে জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে।[1]
উক্ত ঘটনা যখন মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলা হলো, তখন তিনি বললেন, যদি তাদের সাথে এমনটি করা হয়, তাহলে (সেদিন) অন্যসব লোকের কী অবস্থা হবে? তারপর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু খুব বেশি কাঁদলেন (এমনকি বেহুঁশ হয়ে গেলেন)। এমনকি আমরা ধারণা করলাম যে, তিনি কাঁদতে কাঁদতে মারা যাবেন। আমরা বলাবলি করতে লাগলাম, এই লোকটি আমাদের এখানে অনিষ্ট নিয়ে এসেছে (সে এরূপ হাদীছ বর্ণনা না করলে এমন দুর্ঘটনা ঘটত না)। ইতোমধ্যে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঁশ ফিরে পেলেন এবং তার চেহারা মুছলেন। তারপর বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন। (এই বলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেন) ,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لاَ يُبْخَسُونَ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِى الآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও এর সৌন্দর্য কামনা করে, আমি দুনিয়াতে তাদের কর্মের পূর্ণ ফল প্রদান করে থাকি এবং সেখানে তাদের কম প্রদান করা হবে না। তাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছু নেই এবং তারা যা করে আখিরাতে তা নিষ্ফল হবে এবং তারা যা করে থাকে তা বিফলে যাবে’ (হূদ, ১১/১৫-১৬)।[2] এই হাদীছের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এই হাদীছটি রিয়া হারাম হওয়া এবং তার কঠোর শাস্তির ব্যাপারে ও আমলের ক্ষেত্রে ইখলাছ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে অন্যতম দলীল বা প্রমাণ’।[3]
উত্ববা ইবনু আবদ আস-সুলামী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জিহাদে যে সমস্ত লোক মৃত্যুবরণ করে তারা তিন প্রকার: (১) খাঁটি মুমিন যে স্বীয় জানমাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। শত্রুর সাথে যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন প্রাণপণে লড়াই করে। অবশেষে শহীদ হয়। এ জাতীয় শহীদের ব্যাপারে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই শহীদ আল্লাহর পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়েছে। সুতরাং এমন শহীদ আরশের নিচে আল্লাহর তাঁবুতে অবস্থান করবে। ঐ সমস্ত শহীদদের চেয়ে নবী-রাসূলগণের মর্যাদা কেবল নবুঅতের মর্যাদা ব্যতীত আর কোনো দিক দিয়ে বেশি হবে না। (২) যে মুমিন তার আমলকে ভালো ও মন্দের সাথে মিশ্রিত করে। অতঃপর নিজের জানমাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণ করে এবং যখন শত্রুর সম্মুখীন হয়, তখন প্রাণপণ লড়াই করে। অবশেষে শহীদ হয়। এ জাতীয় শহীদ সম্পর্কে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ ধরনের শাহাদত হলো পবিত্রকারী, যা গুনাহ-খাতাকে মুছে দেয়। বস্তুত তলোয়ার হলো গুনাহখাতা মোচনকারী। ফলে এ ধরনের শহীদ জান্নাতের যে কোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। (৩) আর তৃতীয় প্রকার শহীদ হলো মুনাফিক্ব, যে নিজের জানমাল দিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করে। অতঃপর যখন শত্রুর সম্মুখীন হয়, তখন লড়াই করে নিহত হয়। অর্থাৎ শত্রুর মোকাবিলা না করে নিজেই নিহত হয়। মৃত্যুর পর এরূপ ব্যক্তির ঠিকানা হলো জাহান্নাম। কেননা তলোয়ার নিফাক্বকে মিটায় না’।[4] কা‘ব ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أوْ يُصَرِّفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إلَيْهِ أدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘যে ব্যক্তি আলেমদের সাথে বিতর্কে জয়লাভের জন্য কিংবা অজ্ঞ-মূর্খদের সাথে বাক-বিতণ্ডা করার অথবা সাধারণ মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য বিদ্যা অর্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[5] আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إلاَّ لِيُصِيْبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এমন ইলম কোনো ব্যক্তি শধু এ উদ্দেশ্যে অর্জন যে, এর বিনিময়ে দুনিয়া লাভ করবে, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের গন্ধও পাবে না’।[6]
(চলবে)
ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. তিরমিযী, হা/২৩৮২, ২৫৫৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪০৮; ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/২৪৮২; মুসতাদরাকে হাকেম, হা/১৫২৭; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/১৫২৮৮; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২২, সনদ ছহীহ।
[2]. তিরমিযী, হা/২৩৮২, ২৫৫৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪০৮; ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/২৪৮২; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/১৫২৮৮; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২২, সনদ ছহীহ।
[3]. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুর রহীম আল-মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী বিশারহি জামেঈত তিরমিযী (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, তা.বি.), ৭ম খণ্ড, পৃ. ৪৮।
[4]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৬৬৩; দারেমী, হা/২৪১১; বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, হা/৪২৬১; ত্বাবারানী কাবীর, হা/৩১০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হা/৯৫১১; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১৩৭০; মিশকাত, হা/৩৮৫৯, সনদ হাসান।
[5]. তিরমিযী, হা/২৬৫৪; ত্বাবারানী আওসাত্ব, হা/৫৭০৮; ছহীহুল জামে‘, হা/৬১৫৮; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১০৬; মিশকাত, হা/২২৫, হাদীছ হাসান।
[6]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/২৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪৩৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭৮; মুসতাদরাকে হাকেম, হা/২৮৮; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১০৫; মিশকাত, হা/২২৭, সনদ ছহীহ।