কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈমানের আলো ও মুনাফেক্বীর আন্ধকার

লেখকের ভূমিকা

إن الحمد لله، نحمده، ونستعينه، ونستغفره، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا، ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يُضلل فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمداً عبده ورسوله، صلّى الله عليه وعلى آله وأصحابه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، وسلم تسليماً كثيراً. أما بعد:

সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। তাঁর কাছে স্বীয় কু-প্রবৃত্তি ও অসৎকর্মের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই। তিনি যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত দান করতে পারে না।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ছালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর উপর, তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবায়ে কেরাম এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর সকল অনুসারীর উপর।

আমি ‘‘نور الإيمان وظلمات النفاق” ‘নূরুল ঈমান ওয়া যুলুমাতুন নিফাক্ব’ অর্থাৎ “ঈমানের আলো ও মুনাফিক্বীর অন্ধকার” নামক সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে ঈমানের মর্মার্থ, তা অর্জনের পন্থাসমূহ, তাঁর ফলাফল ও উপকারসমূহ, তাঁর শাখা-প্রশাখা ও মুমিনদের গুণাবলি এবং নিফাক্বের মর্মার্থ, তার প্রকারসমূহ, ক্ষতিসমূহ ও মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেছি।

নিঃসন্দেহে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা মুমিনদের সাহায্যকারী, তিনি নিজ সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে তাদের দেখাশুনা করেন এবং কুফর, নিফাক্ব, ভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞতার অন্ধকারসমূহ হতে তাদেরকে জ্ঞান, ঈমান ও হেদায়াতের আলোতে বের করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿اللهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ﴾ ‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৭)। আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করেছেন যে, যারা কুফরী করেছে, তাদের সাহায্যকারী কেবল তারাই, যাদেরকে তারা বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে (অর্থাৎ ত্বাগূতসমূহ)। ত্বাগূত হলো, অংশীদারগণ ও মূর্তিসমূহ এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যা কিছুর ইবাদত করা হয় এবং সেও সন্তুষ্ট থাকে, তাও ত্বাগূত। আর এসব ত্বাগূতের যারা ইবাদত করে, তাদেরকে তারা ঈমানের আলো থেকে অজ্ঞতা, কুফর, নিফাক্ব ও উদাসীনতার অন্ধকারসমূহে বের করে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾ ‘আর যারা কুফরী করে, তাদের অভিভাবক ত্বাগূত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারা জাহান্নামের আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (আল-বাক্বারাহ ২/২৫৭)

আমি উল্লিখিত শিরোনামের বিষয়টি দুটি অধ্যায়ে ভাগ করেছি এবং প্রত্যেকটি অধ্যায়ের অধীনে কয়েকটি করে অনুচ্ছেদ রয়েছে। যা নিম্নরূপ:—

প্রথম অধ্যায় : ঈমানের আলো; প্রথম পরিচ্ছেদ : ঈমানের মর্মার্থ; দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : ঈমান অর্জন ও তা বৃদ্ধি করার পন্থাসমূহ; তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ঈমানের ফলাফল ও উপকারসমূহ; চতুর্থ পরিচ্ছেদ : ঈমানের শাখা-প্রশাখা; পঞ্চম পরিচ্ছেদ : মুমিনদের গুণাবলি।

দ্বিতীয় অধ্যায় : নিফাক্বের (মুনাফিক্বীর) অন্ধকারসমূহ; প্রথম পরিচ্ছেদ : নিফাক্বের মর্মার্থ; দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : নিফাক্বের প্রকারসমূহ; তৃতীয় পরিচ্ছেদ : মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্যসমূহ; চতুর্থ পরিচ্ছেদ : নিফাক্বের ক্ষতি ও পরিণামসমূহ।

আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন এই ক্ষুদ্র কাজকে বরকতময় ও তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ করেন। আর আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর এর মাধ্যমে আমাকে এবং যার কাছে এটি পৌঁছাবে তাদেরকে উপকৃত করেন। কারণ তিনিই হলেন সর্বোত্তম মাসঊল (যার কাছে প্রার্থনা করা হয়) এবং অতীব সম্মানিত মা‘মূল (যার কাছে প্রত্যাশা করা হয়)। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি কতই না উৎকৃষ্ট উত্তম কর্মবিধায়ক। আর তাঁর কাছে চাই, তিনি যেন বিশ্বস্ত নবী, সর্বশেষ নবী ও রাসূল, আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজন, ছাহাবীগণ ও ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত একনিষ্ঠতার সাথে যারা তাঁর অনুসরণ করেন তাদের উপর রহমত ও শান্তি বর্ষণ করেন।

-লেখক

১৬/১০/১৪১৯ হিজরীর

মঙ্গলবার বিকালে লেখা হয়।

প্রথম অধ্যায় : ঈমানের আলো

১. ঈমানের তাৎপর্য :

(ক) ঈমানের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ :

ঈমানের শাব্দিক অর্থ : সত্যায়ন করা। ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ভাইয়েরা তাদের পিতাকে বলেছিল, ﴿وَمَا أَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَنَا﴾ ‘কিন্তু আপনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না’ (ইউসুফ, ১২/১৭)। অর্থাৎ আমাদেরকে সত্যায়নকারী নন।

ঈমানের (হাক্বীক্বত) প্রকৃত অর্থ : ঈমান কথা ও কাজ দিয়ে গঠিত। অন্তর ও জিহ্বার কথা এবং অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গসমূহের কাজ। সুতরাং এই চারটি বিষয় দ্বীন ইসলামের যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।

(১) অন্তরের কথা : তা হলো, অন্তরের সত্যায়ন, নিশ্চিতরূপে জানা ও বিশ্বাস পোষণ করা।

(২) জিহ্বার কথা : তা হলো, শাহাদাতাইন উচ্চারণ করা। সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। আর এই সাক্ষ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো স্বীকার করা।

(৩) অন্তরের কাজ : তা হলো, নিয়্যত করা, একমাত্র আল্লাহর জন্য কাজ করা, ভালোবাসা, অনুগত হওয়া, আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া, তাঁর প্রতি ভরসা রাখা এবং এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি বাস্তবায়ন করা।

(৪) জিহ্বা ও অন্তরসমূহের কাজ : জিহ্বার কাজ হলো, জিহ্বা ছাড়া যা সম্পন্ন করা যায় না। যেমন- কুরআন তেলাওয়াত, সমস্ত যিকির-আযকার, দু‘আ, ইস্তিগফার ইত্যাদি।

অঙ্গসমূহের কাজ হলো, অঙ্গ ছাড়া যা সম্পন্ন করা যায় না। যেমন- ছালাতে দণ্ডায়মান করা, রুকূ করা, সিজদা করা, আল্লাহর জন্য পায়ে চলা— যেমন: মসজিদে, হজ্জে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের ক্ষেত্রে পায়ের ধাপ ফেলা। এছাড়াও শুআবুল ঈমানের হাদীছটি যা কিছু অন্তর্ভুক্ত করে, সেগুলোও’।[1]

আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ঈমান হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা কিছুর প্রতি ঈমান আনার আদেশ দিয়েছেন, তার সবগুলোকে দৃঢ়ভাবে সত্যায়ন করা, পূর্ণরূপে মেনে নেওয়া এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অনুগত হওয়া। এটাই হচ্ছে অন্তরের সত্যায়ন ও বিশ্বাস, যা অন্তর ও শরীরের কাজসমূহকে শামিল করে। সুতরাং এটি দ্বীনের সকল বিষয় সম্পাদন করাকে শামিল করে। এজন্যই ইমামগণ ও সালাফগণ বলতেন, ঈমান হলো,قول القلب واللسان، وعمل القلب واللسان والجوارح. وهو قول وعمل واعتقاد يزيد بالطاعة، وينقص بالمعصية. فهو يشمل عقائد الإيمان، وأخلاقه، وأعماله ‘ঈমান হলো, অন্তর ও জিহ্বার কথা এবং অন্তর, জিহ্বা ও দেহের অঙ্গসমূহের কাজ। তা হলো, কথা, কাজ ও বিশ্বাস। আনুগত্যের মাধ্যমে বাড়ে ও পাপের কারণে কমে। সুতরাং তা বিশ্বাস, আখলাক, কর্ম সবকিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে’।[2]

(খ) ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য :

শরীআতে ঈমানের দু’টি অবস্থা রয়েছে-

প্রথম অবস্থা : ঈমানের পাশাপাশি ইসলামের বর্ণনা না করে পৃথকভাবে ঈমান শব্দের ব্যবহার করা। তখন ঈমান দ্বারা উদ্দেশ্য হবে পুরো দ্বীন। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী, ﴿اللهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ﴾ ‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৫৭)। এ অর্থটিই সালাফগণ তাদের বক্তব্যে উদ্দেশ্য করেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘ঈমান হলো, বিশ্বাস, কথা, ও কাজ এবং সকল আমল ঈমানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত’।

দ্বিতীয় অবস্থা : ঈমানের পাশাপাশি ইসলামের ব্যবহার। তখন ঈমানের ব্যাখ্যা করা হয় অন্তরের বিশ্বাসসমূহ। যেমন- আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, শেষ দিবস এবং ভালো ও মন্দ তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী, ﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ﴾ ‘আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে’ (আন-নিসা, ৪/৫৭)

আর ইসলামের ব্যাখ্যা করা হয়, অঙ্গসমূহের প্রকাশ্য আমলসমূহ। যেমন- দুই শাহাদাতের (সাক্ষ্যের) উচ্চারণ, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ ও অন্যান্য আমল’।[3] যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী,﴿إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ﴾ ‘নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী’ (আল-আহযাব ৩৩/৩৫)। সুতরাং ঈমান ও ইসলাম যখন পৃথকভাবে আসবে, তখন একই অর্থে হবে। আর যখন একসঙ্গে আসবে, তখন ভিন্ন ভিন্ন অর্থে হবে। এটি ফক্বীর ও মিসকীন শব্দদ্বয়ের ন্যায়। যখন দুটির একটিকে পৃথক করা হবে, তখন অপরটিকে অন্তর্ভুক্ত করবে। আর যখন একসঙ্গে আসবে, তখন দুটির প্রত্যেকটির জন্য নির্দিষ্ট নাম থাকবে’।[4]

২. ঈমান অর্জন ও তা বৃদ্ধির উপায়সমূহ :

ঈমান বান্দার পূর্ণাঙ্গতা। এর মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে তার মর্যাদা উঁচু হয়। সেটাই ইহকালীন জীবন ও পরকালীন জীবনে সমস্ত কল্যাণের মাধ্যম ও পথ। আর তা অর্জিত হয়, মযবূত ও পরিপূর্ণ হয় কেবল সেসব বিষয় জানার মাধ্যমে, যা থেকে ঈমান পাওয়া যায়। ঈমান অর্জন, মযবূত ও বৃদ্ধি পায় অনেকগুলো বিষয়ের মাধ্যমে। তন্মধ্যে-

(১) আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামসমূহ জানা, যেগুলো কুরআন ও সুন্নায় বর্ণিত হয়েছে। আর এগুলোর অর্থ অনুধাবন করা ও এগুলোকে অসীলা করে আল্লাহর ইবাদত করার প্রতি যত্নশীল হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَلِلهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾ ‘আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকো। আর তাদেরকে বর্জন করো, যারা তাঁর নামে বিকৃতি ঘটায়। তারা যা করত, অচিরেই তাদেরকে তার প্রতিফল দেওয়া হবে’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৮০)। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِنَّ لِلهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘আল্লাহর ৯৯ অর্থাৎ এক কম ১০০টি নাম রয়েছে, যে ব্যক্তি তা মনে রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[5]

অর্থাৎ যে এগুলো মুখস্থ করবে, এগুলোর অর্থ অনুধাবন করবে, বিশ্বাস করবে এবং এগুলোকে মাধ্যম করে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং জানা গেলো, এটি হচ্ছে ঈমানের সবচেয়ে বড় উৎস এবং তা অর্জন, মযবূত ও স্থির হওয়ার মাধ্যম।

আর আল্লাহর নামসমূহ জানা ঈমানের মূল। তা তাওহীদের তিনটি প্রকারকে অন্তর্ভুক্ত করে। (ক) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ, (খ) তাহীদুল উলূহিয়্যাহ এবং (গ) তাওহীদুল আসমা ওয়া ছিফাত। এই প্রকারগুলোই ঈমানের প্রাণ। ঈমানের মূল ও চূড়ান্ত। সুতরাং আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে বান্দার জ্ঞান যত বৃদ্ধি পাবে, ততই তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে ও নিশ্চিত বিশ্বাস মযবূত হবে। সুতরাং মুমিনের উচিত, তার সাধ্য ও সক্ষমতা আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলিকে জানার ক্ষেত্রে ব্যয় করা- সাদৃশ্য প্রদান, আল্লাহর গুণ অস্বীকার করা, ধরন বর্ণনা করা ও বিকৃতি করা ছাড়াই’।[6]

(২) ব্যাপক পরিসরে কুরআন গবেষণা করা। কারণ কুরআনের গবেষক সর্বদায় কুরআনের জ্ঞান থেকে উপকৃত হয় এবং এর মাধ্যমে তার ঈমান বৃদ্ধি করে। অনুরূপ যখন সে কুরআনের বিন্যাস ও তার বিধিবিধানসমূহের প্রতি দৃষ্টি দেয়, যখন সে আরো দেখবে যে, কুরআনের একাংশ অন্য অংশকে সত্যায়ন করে, এর একাংশ অন্য অংশের সাথে মিলে যায়, এখানে কোনো বৈপরীত্য ও মতভেদ নেই, তখন নিশ্চিতরূপে জানবে যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আর এটি ঈমানকে সবচেয়ে বেশি দৃঢ় করে’।[7]

(৩) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছগুলো জানা এবং ঈমানের যে সমস্ত জ্ঞান ও আমলের দিকে আহ্বান করে সেগুলো জানা। এর প্রত্যেকটি ঈমানকে মযবূত করে। সুতরাং কুরআন ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ সম্পর্কে বান্দার জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই তাঁর ঈমান ও নিশ্চিত বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে।

(৪) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানা এবং নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সুউচ্চ চরিত্র ও পূর্ণাঙ্গ গুণাবলির অধিকারী, তা জানা। কারণ যে তাঁকে সঠিকভাবে চিনবে-জানবে, সে তাঁর সত্যতা এবং তিনি যে কিতাব ও সঠিক দ্বীন নিয়ে এসেছেন তার সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে না।

(৫) বিশ্বজগত নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। আসমানসমূহ, যমীন ও এগুলোর মধ্যে যে বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টি আছে, সেগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং স্বয়ং মানুষকে নিয়ে এবং তাঁর মধ্যে যেসব গুণ আছে সেগুলো নিয়ে চিন্তা করা। কেননা এটি ঈমান আনায়নের শক্তিশালীকরণ। কারণ এই সৃষ্টি জগতের মধ্যে আছে সুনিপুণ সৃষ্টিশৈলী, যা স্রষ্টার ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। আর এই সৃষ্টিগুলোর মধ্যে আছে সৌন্দর্য, সুবিন্যাস ও পরিপাটি ব্যবস্থাপনা, যা বিবেকসমূহকে হতবাক করে দেয়।

অনুরূপভাবে লক্ষ্য করা যে, সমস্ত সৃষ্টি সকল দিক থেকে তার রবের মুখাপেক্ষী। এক পলকের জন্যও তারা তাঁর থেকে অমুখাপেক্ষী নয়। এটি বান্দার জন্য পরিপূর্ণ অনুগত হওয়া, অধিক দু‘আ করা, আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী হওয়া এবং দ্বীন ও দুনিয়ার যেসমস্ত উপকারের প্রয়োজন হয় তা অর্জনে এবং যা ক্ষতিকর তা দূরকরণে আল্লাহর কাছে বিনম্র হওয়া অপরিহার্য করে এবং তার জন্য অপরিহার্য করে, তার রবের উপর দৃঢ় ভরসা করা, তার ওয়াদার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা এবং ছওয়াব ও তার অনুগ্রহ পাওয়ার অধিক আকাঙ্ক্ষা করাকে। এর মাধ্যমে ঈমান বাস্তবায়িত হবে এবং দৃঢ় হবে।

অনুরূপভাবে আল্লাহর ব্যাপক ও বিশেষ নেয়ামতরাজি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, যেগুলো থেকে এক পলকের জন্যও কোনো মাখলূক্ব অমুখাপেক্ষী নয়।

(৬) বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা এবং বেশি বেশি দু‘আ করা, যা হলো ইবাদত। কেননা যিকির অন্তরে ঈমানের বৃক্ষ রোপণ করে এবং তার খোরাক যোগান দেয় ও তাকে শক্ত করে। বান্দা যত বেশি আল্লাহর যিকির করে ততই তাঁর ঈমান দৃঢ় হয় এবং যিকির সর্বাবস্থায় যবান, অন্তর, আমল ও অবস্থার মাধ্যমে হয়ে থাকে। ফলে একজন বান্দার ঈমানের ততটুকু অংশ রয়েছে, যতটুকু মধ্যে যিকির রয়েছে।

(৭) ইসলামের সৌন্দর্যসমূহ জানা। কেননা দ্বীন ইসলামের পুরোটাই সৌন্দর্য। তার আক্বীদাসম্পর্কিত বিষয়গুলো সর্বাধিক বিশুদ্ধ আক্বীদা, সর্বাধিক সত্য ও সবচেয়ে বেশি উপকারী। ইসলামের নৈতিকতা অধিকতর সুন্দর নৈতিকতা। ইসলামের আমলসমূহ ও বিধানসমূহ সর্বাধিক সুন্দর ও ন্যায়নিষ্ঠ বিধান। এই দৃষ্টিতেই আল্লাহ বান্দার ঈমানকে সুসজ্জিত করেন এবং তাঁর নিকট প্রিয় করেন। ফলে সে ইসলামের মিষ্টতা পায়। ঈমানের মূলনীতি ও প্রকৃত অবস্থার মাধ্যমে অন্তর সুন্দর হয় এবং ঈমানের আমলসমূহের মাধ্যমে বাহ্যিক রূপ সুন্দর হয়।

(৮) আল্লাহর ইবাদত সুন্দরভাবে সম্পাদন করা ও তাঁর সৃষ্টিকুলের সাথে সদাচরণের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালানো। সুতরাং মানুষ আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে এমনভাবে প্রচেষ্টা করবে যে, সে যেন আল্লাহকে দেখছে। আর যদি দেখতে সক্ষম না হয় তাহলে মনে করবে, আল্লাহ তাকে দেখছেন। সুতরাং সে আমল পূর্ণাঙ্গ ও সুনিপুণভাবে করতে প্রচেষ্টা করবে। অনুরূপভাবে মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করবে কথা, কাজ, সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিভিন্ন প্রকার উপকার দিয়ে। যখন সে স্রষ্টার ইবাদত সুন্দরভাবে সম্পাদন করবে, বান্দার সাথে সুন্দর আচরণ করবে এবং এর উপর বহাল থাকবে, তাঁর ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাস মযবূত হবে এবং এর মাধ্যমে তার ঈমান প্রমাণিত সত্য ও সুনিশ্চিত বিশ্বাসে পৌঁছাবে। যা দৃঢ় বিশ্বাসের সর্বোচ্চ স্তর। তাই সে আনুগত্যমূলক কাজের মিষ্টতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের সুফল পাবে। এটাই হলো পূর্ণাঙ্গ ঈমান।

(৯) মুমিনদের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়া। যেমন- ছালাতে বিনম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতি থাকা, যাকাত দেওয়া, অনর্থক কথা ও কাজ হতে বিরত থাকা। অনর্থক কথা হলো, প্রত্যেক কথা যাতে কোনো কল্যাণ নেই, প্রত্যেক কাজ যাতে কোনো কল্যাণ নেই। বরং মুসলিম ভালো কথা বলবে ও ভালো কাজ করবে এবং মন্দ কথা ও কাজ পরিহার করবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এগুলোর প্রত্যেকটিই ঈমান বৃদ্ধি ও দৃঢ় করে। অনুরূপভাবে অশ্লীল কাজ হতে পবিত্র থাকা, আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করা ঈমানের আলামত বা চিহ্ন।

(১০) আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের দিকে আহ্বান করা। পরস্পর পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেওয়ার আহ্বান করা। দ্বীনের মূলনীতি (তাওহীদ) এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে বাধা প্রদানের মাধ্যমে শারঈ বিধান পালনের দিকে আহ্বান করা। আর এর মাধ্যমে বান্দা নিজেকে ও অন্যকে পূর্ণাঙ্গ করবে।

(১১) কুফর, নিফাক্ব, পাপাচার ও অবাদ্ধতার শাখা-প্রশাখা হতে দূরে থাকা। সুতরাং ঈমানের ক্ষেত্রে অনিবার্য হলো, সমস্ত উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা যা ঈমানকে দৃঢ় ও বৃদ্ধি করে। এর সাথে সাথে আরো অনিবার্য হলো, বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা। আর তা হলো পাপ ছেড়ে দেওয়া। আর যা হয়ে গেছে তা থেকে তওবা করা। দেহের সমস্ত অঙ্গকে হারাম কাজ হতে রক্ষা করা। ঈমানের জ্ঞানসমূহ নিন্দিত সংশয় যা ঈমানকে দুর্বল করে দেয় এবং প্রবৃত্তিসমূহ যা ঈমানের ইচ্ছা-বাসনাকে দুর্বল করে দেয় তার ফেতনা প্রতিরোধ করা।

(১২) ফরয ইবাদতের পর নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। খেয়াল-খুশির আধিক্যের সময় আল্লাহ যা ভালোবাসে তা অন্য সবকিছুর পূর্বে রাখা।

(১৩) আল্লাহ দুনিয়ার (প্রথম) আসমানে নেমে আসার সময় তাঁর সাথে গোপনে কথা বলা, কুরআন তেলাওয়াত করা, অন্তর দিয়ে অনুধাবন করা, তাঁর সামনে ইবাদতের শিষ্টাচার অনুসরণ করার জন্য তাঁর সাথে নির্জনে হওয়া। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তওবার মাধ্যমে শেষ করা।

(১৪) সত্যবাদী, নিবেদিতপ্রাণ আলেম-উলামার সাথে উঠাবসা করা এবং তাদের ভালো কথাগুলো গ্রহণ করা, যেমনিভাবে আমরা ভালো ফলগুলো বেছে বেছে গ্রহণ করি’।[8]

(চলবে)

মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী p

অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।


[1]. ইবনু আবীল ঈয, আক্বীদাতুত ত্বাহাবীয়া, পৃ. ৩৭৩; শায়খ হাফেয আল-হাকামী, মাআরিযুল কুবূল শরহু সুল্লামিল উছূল ইলা ইলমিল উছূল ফীত তাওহীদ, ২/৫৮৭-৫৯১; আল্লামা আব্দুল লতীফ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু হাসান আলে শায়খ, উছূলু ওয়া যাওয়াবিতু ফীত তাকফীর, পৃ. ৩৪; ইবনু মানদা, কিতাবুল ঈমান, ১/৩০০, ৩৪১।

[2]. আত-তাওযীহু ওয়াল বায়ান লি শাজারাতিল ঈমান, পৃ. ৪১-৪২; আরও দেখুন : ইবনু মানদা, কিতাবুল ঈমান, ১/৩৪১; ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়া, ৭/৫০৫।

[3]. ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়া, ৭/১৩-১৫, ৫৫১-৫৫৫; শায়খ হাফেয আল-হাকামী, মাআরিযুল কুবূল, ২/৫৯৭-৬০৮।

[4]. ফাতাওয়া ইবনু তায়মিয়া, ৭/৫৫১, ৫৭৫-৬২৩; ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/১০৪।

[5]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, আবূ হুরায়রা আলাইহিস সালাম হতে, ছহীহ বুখারী, ‘শর্তাবলি’ অধ্যায়, ‘শর্তারোপ করা ও স্বীকারোক্তির মধ্য থেকে কিছু বাদ দেওয়ার বৈধতা এবং লোকদের মধ্যে প্রচলিত শর্তাবলি প্রসঙ্গে যখন কেউ বলে যে, এক বা দুই ব্যতীত একশ? (তবে হুকুম কী হবে)’ অনুচ্ছেদ, হা/২৭৩৬; ছহীহ মুসলিম, ‘যিকির ও দু‘আ’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর নামসমূহের বর্ণনা এবং যারা এগুলো সংরক্ষণ করে তার মর্যাদা প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ, ৪/২০৬৩, হা/২৬৭৭, শব্দ বিন্নাস তাঁরই।

[6]. আল্লামা সা‘দী, আত-তাওযীহু ওয়াল বায়ান লি শাজারাতিল ঈমান, পৃ. ৪০।

[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ২/২৮; আল্লামা সা‘দী, আত-তাওযীহু ওয়াল বায়ান লি শাজারাতিল ঈমান, পৃ. ৪০।

[8]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ৩/১৭; আল্লামা সা‘দী, আত-তাওযীহু ওয়াল বায়ান লি শাজারাতিল ঈমান, পৃ. ৪০-৬২।

Magazine