আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَكَادُ الْبَرْقُ يَخْطَفُ أَبْصَارَهُمْ كُلَّمَا أَضَاءَ لَهُمْ مَشَوْا فِيْهِ وَإِذَا أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُوا وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ﴾ ‘বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেওয়ার উপক্রম হয়। যখন তা তাদের আলো দেয়, তখন তাতে তারা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার করে দেয় তখন তারা দাঁড়িয়ে যায়। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দুই-ই নষ্ট করে দিতে পারেন। নিশ্চয় তিনি সকল বস্তুর উপর শক্তিমান’ (আল-বাক্বারা, ২/২০)।
আয়াতের মর্মার্থ : এ আয়াতের মর্মার্থ হলো— মানুষ আলোর উপস্থিতিতে সবকিছু দেখতে পায়; অন্ধকারে কিছুই দেখে না। আবার আলোর ঝলক তীব্র হলে চোখের আলোগ্রাহী (Photoreceptor) কোষগুলো অসংবেদনশীল হয়ে পড়ে, ফলে সে দেখে না। এছাড়াও মহান আল্লাহ যে কোনো সময় যে কোনোভাবে মানুষের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দুটোই ছিনিয়ে নিতে পারেন। তিনি ক্ষমতাশালী ও শক্তিমান।
আয়াতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা : আল-কুরআন বৈজ্ঞানিক কোনো গ্রন্থ নয়; এটা আল্লাহর সর্বশেষ নবীর উপর সর্বশেষ প্রত্যাদেশ, যা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য তিনি মানুষের সামনে পেশ করেছেন। তবে এখানে বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট ৭৫০টি আয়াতের মাঝে অনেক তথ্য চমৎকারভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। যা পবিত্র কুরআনের মু‘জেযাকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছে। নিম্নে উপরিউক্ত আয়াতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হলো।
চোখ, দৃষ্টিশক্তি ও আলো : আলোর মধ্য দিয়ে মানুষের চোখ দৃষ্টি সঞ্চার করে। দৃষ্টি সঞ্চারের সাথে অনেকগুলো আনুষঙ্গিক অঙ্গ জড়িত। যেমন কর্নিয়া, আইরিস, কোরয়েড, রেটিনা, লেন্স, পিউপিল, কনজাংটিভা, অ্যাকুয়াস হিউমার, ইত্যাদি। এসব অঙ্গের আচরণ ও কার্যপ্রণালী কিছু কিছু আবিষ্কৃত হলেও বেশির ভাগ অঙ্গের কার্যকারণ রহস্যময় রয়ে গেছে। চোখের গঠন এবং দেখার পদ্ধতি অনুকরণে আবিষ্কার হয়েছে ক্যামেরা। আমাদের চোখের সামনে আছে একটি লেন্স। এ লেন্স কিছু বিশেষ ধরনের কোষ দিয়ে তৈরি ক্যামেরাতেও এমনি একটি কাচের লেন্স থাকে। এই লেন্সের মধ্যে কোনো জিনিসের উপর থেকে প্রতিফলিত আলো ঢুকে ক্যামেরার ফিল্মে পড়ে। আর তার উপরে ঐ বস্তুর একটা উল্টা প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। চোখের মধ্যে ফিল্মের কাজ করে রেটিনা। রেটিনার চারপাশে কালো রঙের একটি স্তর থাকে। এর নাম কোরয়েড। চোখে আলো প্রবেশ করে পিউপিল দিয়ে। আলো বাড়া-কমা নিয়ন্ত্রণ করে আইরিস। আবার রেটিনার আছে আলো গ্রহণকারী কোষ। আলোর প্রতি মানুষের দৃষ্টি খুবই সংবেদনশীল। রেটিনা আলোক উদ্দীপনাবাহী জটিল সুসংঘবদ্ধ স্নায়ুকোষ এবং আলোক সংবেদীগ্রাহক কোষ সমন্বয়ে গঠিত। আলোক সংবেদীগ্রাহক কোষ দুই ধরনের। যথা :
১. কোন (Cones) Photochemical reaction Visual center) এবং ২. রড (Rods)।
১. কোন : সাধারণত দিনের আলোতে দেখতে সাহায্য করে এবং রং (Colors) সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করে।
২. রড : রাতের অন্ধকারে এবং ক্ষীণ আলোতে দেখার জন্য অভিযোজিত।
কোষগুলো আলোর অনুভূতি দ্রুত মস্তিষ্কের দর্শন কেন্দ্রে প্রেরণ করার সাথে সাথে আমরা দেখতে পাই। প্রত্যেক জিনিসের ছবি রেটিনায় গিয়ে একটি উল্টা প্রতিবিম্ব তৈরি করে। কিন্তু মস্তিষ্কের দর্শন কেন্দ্রের সাহায্যে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সোজা হয়ে যায়। মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের কপালের নিচে যে দুটি চোখ দিয়েছেন, তার প্রতি ইঙ্গিত করে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿أَلَمْ نَجْعَل لَّهُ عَيْنَيْنِ﴾ ‘আমি কি তাকে দেইনি চক্ষুদ্বয়’ (আল-বালাদ, ৯০/৮)। তিনি অন্যত্র বলেছেন,﴿قُلْ هُوَ الَّذِي أَنشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ﴾ ‘বলুন, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (আল-মুলক, ৬৭/২৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,﴿قُلْ مَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ أَمَّن يَمْلِكُ السَّمْعَ والأَبْصَارَ وَمَن يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللّهُ فَقُلْ أَفَلاَ تَتَّقُونَ﴾ ‘তুমি জিজ্ঞেস করো, কে রূযী দান করে তোমাদেরকে আসমান থেকে ও জমিন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেই-বা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন আপনি বলুন, তারপরও তাক্বওয়া অবলম্বন করছ না?’ (ইউনুস, ১০/৩১)।
উপরিউক্ত দর্শনশক্তি অতি সূক্ষ্ম ও জটিল কলাকৌশলের অঙ্গীভূত প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া সচল থাকে আল্লাহ পাকের নিয়মকানুনের ভিত্তিতে। এ অঙ্গটি বিকল হয়ে গেলে জগতে কেউ নেই নতুন করে তা সৃষ্টি করে দিতে পারে।
মানুষ কখন দেখতে পায় : কোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোক তরঙ্গ (Light waves) এসে কোন (Cones) এবং রড (Rods) কোষকে উদ্দীপিত করলে তবেই মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু সব ধরনের আলোক তরঙ্গ আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। যেসব তরঙ্গ ধরা পড়ে তাদের বলা হয় দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ। যার ব্যাপ্তি ৩৮০০ A0 থেকে ৭২০০ A0 তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে মধ্যে (1 Angstrom=10 -8 cm)। আলোক তরঙ্গ চোখে পড়লে কোন (Cones) এবং রড (Rods)-এর যে রাসায়নিক পদার্থ আছে তা আলো শোষণ করে নেয়। কোন-এর আছে আয়োডোপসীস এবং রড-এর আছে রোডপসীন। আলোর ছোঁয়ায় এ রাসায়নিক বস্তু দুটির মধ্যে ফটোক্যামিক্যল বিক্রিয়ার (Photochemical reaction) কারণে আবেগ দৃষ্টি হলে তা স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের দর্শন কেন্দ্রে (Visual Centre) পৌঁছে যায়। তখনই মানুষ দেখতে পায়। অন্ধকারে কোণ এবং রড আলো গ্রহণ করতে পারে না বলেই কিছুই দর্শন করা যায় না।
আলোর তীব্রতা দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয় : আলোর তীব্রতার প্রেক্ষাপটে দৃষ্টিশক্তি নিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, আলোর তীব্রতার প্রেক্ষাপটে কোন ও রড খুব তীব্র আলোতে অসংবেদী হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ চমক হঠাৎ জোরালো আলো উৎপন্ন করে ক্ষীপ্র গতিতে ছড়িয়ে দেয়। এ সময় কোন এবং রড-এর দিক থেকে কোনো সাড়া না আসার দরুন মানুষের দৃষ্টি সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের ফলে চলার পথে মানুষের দৃষ্টিশক্তির যে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হয় আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘ইয়াখতাফু’ শব্দ দ্বারা তা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যা একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে আজ থেকে ১৪শ’ বছর পূর্বের অবতীর্ণ আল-কুরআনের সাথে শতভাগ মিলে যায়।
উপর্যুক্ত আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা : আয়াতটি সূরা আল-বাক্বারা থেকে উৎকলিত। ২০ নং আয়াতের পূর্বে ১৪টি আয়াতই প্রথমে কাফের ও পরের ১৩টিতে মুনাফিক্বদের প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। তাদের মানসিকতার ধরন ও প্রকৃতির পাশাপাশি আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে কেমন মনোভাব পোষণ করেন ঐ সমস্ত আয়াতে তা ফুটে উঠেছে।
আয়াতটির প্রাসঙ্গিকতা : উপরিউক্ত আয়াতে মুনাফিক্বদের স্বার্থপরতা ও স্বভাবসুলভ প্রকৃতি সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। যখন ইসলাম তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে মসৃণ মনে হয় তখন তারা ইসলামের সাথে থাকে। পক্ষান্তরে যখন ইসলামের কারণে কণ্টকাকীর্ণ জীবন বরণ করতে হয়, সমকালীন স্বার্থান্বেষী মহলের নিকট থেকে সম্মুখীন হতে হয় নানা বাধা-বিপত্তির ও জীবনে নানা স্তরে ইসলামী অনুশাসনের প্রতিপালনের কারণে বিরোধিতার অন্ধকার নেমে আসে, তখন সঠিক ইসলাম পালনের পথ থেকে তারা সরে পড়ে, ইসলামের মৌলিক চেতনা, ধ্যানধারনা ও বিশ্বাস থেকে তারা দূরে সরে যায়। তাদের সমস্যা হবে বলে মনে করে তারা ইসলামের ছহীহ ত্বরীক্বা থেকে সরে পড়ে বা নিজেদের আড়াল করে রাখে। অথচ আল্লাহ সকল বস্তুর উপর শক্তিমান। তিনি চাইলে আড়াল করা অবস্থায়ও বিপদ দিতে পারেন। সমস্যা তৈরি হতে পারে। জীবন অতিষ্ঠ ও সংকটাপন্ন হতে পারে। এভাবে বেশি সুযোগ-সুবিধায় থেকেও মানুষ উপভোগের সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। যেমনিভাবে আলোর কারণে মানুষ দেখতে পেলেও বেশি আলোতে বিদ্যুৎ চমকে আবার কিন্তু দেখে না। আর আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দুই-ই যে কোনো সময়ে নষ্ট করে দিতে পারেন। সর্বোপরি মানুষের স্বার্থে ইসলামের নির্দেশনা পুরোপুরি গ্রহণ বা বর্জনের উপর কোনো কৃতিত্ব নেই; কৃতিত্ব সব আল্লাহরই। তাঁকে ঘিরেই যাবতীয় উপাসনা-আরাধনা হওয়া দরকার। তিনিই একমাত্র মহা পরক্রমশালী।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুযোগের প্রাচুর্যে বসবাস করেও বিভিন্ন কারণে জীবনে সীমাবদ্ধতার দেয়াল তৈরি হতে পারে। আবার কম সুযোগ ও অতি নগণ্য আয়োজন মানুষকে তৃপ্ত ও প্রশান্ত করে দিতে পারে। মানুষের যাপিত জীবনে অলৌকিক অদৃশ্য এক মহান শক্তির সাথে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ও তাঁরই প্রদর্শিত-নির্দেশিত পথে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ করা প্রত্যেক ঈমানদারের একান্ত কর্তব্য। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ঠিক রেখে ব্যক্তিগত তৎপরতা দিয়ে ইসলামের বিধানকে নিয়ন্ত্রণ বা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা নয়; বরং ইসলামের আলোকে নিজের জীবন পরিচালনা করা দরকার। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে সুবিধাবাদী ইসলাম থেকে বিরত থেকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন অতিবাহিত করে তাঁর রেযামন্দী হাছিলের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
ড. মোহাম্মদ হেদায়াত উল্লাহ
সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান মুফাসসির, সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।