আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে সকলেই মেনে নেয়: সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক নাস্তিক ছাড়া অধিকাংশ মানুষই এক সৃষ্টিকর্তাকে প্রতিপালক (রব) হিসেবে স্বীকার করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ - اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ - وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ نَزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ
‘আর যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, ‘কে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং চাঁদ ও সূর্যকে নিয়োজিত করেছেন?’ তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। তাহলে কোথায় তাদের ফিরানো হচ্ছে? আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা করেন, রিযিক্ব প্রশস্ত করে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছা, সীমিত করে দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। আর যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, ‘কে আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন?’ তবে তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। বলুন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বুঝে না’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬১–৬৩)।
শুধু ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানরাই নয়, বরং তৎকালীন জাহেলী যুগের মুশরিকরাও মহান আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক হিসেবে স্বীকার করত। এমনকি আবূ জাহল ও আবূ লাহাবও। যেমন- বদরের দিনে আবূ জাহল আল্লাহর কাছে দু‘আ করে বলেছিল, اللَّهُمَّ أَيُّنَا كَانَ أَحَبَّ إِلَيْكَ وَأَرْضَى لَكَ، فَانْصُرْهُ الْغَدَ ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে কে তোমার নিকট প্রিয় এবং তোমার সন্তোষভাজন, আগামীকাল তাকেই বিজয় দান করো’।
এমনকি বদরের দিন মক্কার মুশরিকরাও আল্লাহর কাছে এভাবে দু‘আ করেছিল,قالوا يعني المشركين في بدر: اللهم أقطعنا للرحم، وآتانا بما لا نعرف، فأحنه الغداة (أي: أَهلكه اليوم) ‘তারা বলেছিল, অর্থাৎ বদরের মুশরিকরা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! (মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং আমাদের এমন কিছু নিয়ে এসেছেন যা আমরা চিনতাম না। সুতরাং আজকের দিনে আপনি তাঁকে ধ্বংস করে দিন’।[1]
আনুগত্য পাওয়ার একমাত্র হক্বদার কে?
কে সেই মহাশক্তিধর সত্তা, যিনি এই পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টিজীবের প্রশ্নাতীত আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের একমাত্র যোগ্য?
অবশ্যই তিনি, যিনি এই মহাবিশ্বের প্রকৃত স্রষ্টা, প্রতিপালক ও নিয়ন্ত্রক। তিনিই সেই সর্বশক্তিমান সত্তা, যাঁর নিকট আমরা চাই বা না চাই, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়—অবশেষে ফিরে যেতে বাধ্য।
আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, আমাদের চারপাশের প্রকৃতি—সবই তাঁর সৃষ্টি এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন। আমরা তাঁর নির্ধারিত নিয়মের উপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করি।
সুতরাং আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তি ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য একমাত্র তাঁর জন্যই হওয়া উচিত। আর এটিই সবচেয়ে যৌক্তিক ও ন্যায্য।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ মানুষ যদিও এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু তাঁকে এককভাবে শ্রদ্ধা, ভক্তি ও পূর্ণ আনুগত্য প্রদান করে না।
প্রতি যুগে শয়তান মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করে তাদের আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। শয়তানের অন্যতম দুটি পদ্ধতি হলো—
প্রথমত, মানুষের মনে এই ভয় ঢোকানো—‘তুমি অনেক বড় গুনাহগার। আল্লাহ কখনোই তোমাকে ক্ষমা করবেন না’।
দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা—‘তুমি আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। আল্লাহর কাছে পৌঁছতে হলে তোমার বিশেষ প্রতিনিধির প্রয়োজন, যাদের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব’।
ফলে মানুষদের একাংশ যিশু খ্রিষ্ট ও তার মা মারইয়ামকে, কেউ মা দুর্গা বা কালীকে, আবার কেউ বিভিন্ন পীর-আউলিয়া ও কবরবাসীদের আল্লাহর প্রতিনিধি বা সুপারিশকারী মনে করে তাদের ইবাদত ও আনুগত্য শুরু করে। তারা তাদের সামনে মাথা নত করে, মানত করে, নজরানা পেশ করে এবং ইচ্ছাপূরণের আশায় তাদের প্রতি ভক্তি নিবেদন করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলে,
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনে থাকা এমন বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছ, যা তিনি অবগত নন?’ তিনি পবিত্র মহান এবং তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে’ (ইউনুস, ১০/১৮)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
‘আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে’। যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে, আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফের, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হেদায়াত দেন না’ (আয-যুমার, ৩৯/৩)।
উক্ত আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যায়— মক্কার মুশরিকরা তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোকে আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী বা সমতুল্য মনে করত না। বরং তারা বিশ্বাস করত—আল্লাহই সর্বশক্তিমান রব। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য পেতে হলে এই মূর্তিগুলোর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে—এই ছিল তাদের ভুল বিশ্বাস।
সুতরাং শিরক শুধু এটুকুই নয় যে, কেউ আল্লাহকে অস্বীকার করল বা অন্য কাউকে ইলাহ বা রব বলে মানল। বরং সবচেয়ে ভয়াবহ শিরক হলো—আল্লাহকে বিশ্বাস করেও তাঁর সাথে অন্য কাউকে সুপারিশকারী মনে করে ইবাদত করা, যেমন করত মক্কার মুশরিকরা।
এই ভ্রান্ত বিশ্বাসই যুগে যুগে বহু মানুষকে তাওহীদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে। সুতরাং একমাত্র উপাস্য, একমাত্র রব এবং একমাত্র আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী হলেন মহান আল্লাহ তাআলা—আর এটাই চিরন্তন সত্য।
আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তবে (ইবাদতে) শিরক করা অবস্থায়’ (ইউসুফ, ১২/১০৬)। আল্লাহ তাআলা বলেন,الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে যুলমের সাথে সংমিশ্রণ করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত’ (আল-আনআম, ৬/৮২)।
আমাদের পরিপূর্ণ আনুগত্য পাওয়ার একমাত্র যোগ্য হচ্ছেন সেই মহান সত্তা, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিপালন করে যাচ্ছেন। তিনি ব্যতীত আর কারও প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শন করা অত্যন্ত মারাত্মক অন্যায়। এটি এক ভয়াবহ গুনাহ, যা মানুষকে শিরকের গভীর অন্ধকারে নিপতিত করে।
নবীগণ আলাইহিমুস সালাম আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে এই ভুল ধারণা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তারা মানুষকে বোঝাতেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রত্যেকের কথা শুনতে পান, সকলকে দেখতে পান এবং কারও হৃদয়ের গভীরতম চিন্তাও তারা বুঝেন। সুতরাং তাঁর কাছে কিছু চাইতে কোনো মাধ্যম, কোনো বাহক কিংবা কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন নেই। বরং যেহেতু তিনিই সবকিছু জানেন, দেখেন এবং শোনেন, তাই আমাদের চাওয়ার জন্য সরাসরি তাঁর কাছেই ফিরে যাওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ করা যায়— ধরুন, যদি আমাদের সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়, তাহলে আমরা কি তার সাথে কথা বলার জন্য কোনো দালাল খুঁজব? কোনো মাধ্যমের দ্বারস্থ হব? নিশ্চয়ই না। আমরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথেই কথা বলব। একইভাবে, যখন আমাদের মহান প্রভুর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ রয়েছে, তখন তার বদলে অন্য কারও শরণাপন্ন হওয়া এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়।
নবীগণ আলাইহিমুস সালাম মানুষের সামনে এই সরল সত্যটি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন—আল্লাহ চাইলে সবরকম গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন। গুনাহ যত বড়ই হোক না কেন, আল্লাহর দরবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাঁর করুণার দরজা সর্বদা খোলা, আর তাঁর ক্ষমাশীলতা অতুলনীয়। সুতরাং গুনাহের ভয়াবহতায় ভীত হয়ে মানুষের তৈরি মূর্তি, পীর, ওলীর কাছে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা চরম পর্যায়ের দাসত্ব ও বোকামি।
মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করার জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বারবার মিথ্যা উপাস্যদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে প্রতিপালকত্বের পরীক্ষায় ডেকেছেন। কেননা, একজন প্রতিপালক হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার প্রধান শর্ত হলো, তাঁর সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকতে হবে। অথচ, এই মিথ্যা ইলাহদের কোনো সৃষ্টি করার ক্ষমতাই নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআনে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন—এরা যদি সত্যিই উপাস্য হতো, তবে একটি মাছিও সৃষ্টি করে দেখাক! অথচ তারা একটি মাছি তো দূরে থাক, একটি পাতাও সৃষ্টি করতে পারে না।
এই যুক্তির সারমর্ম হলো— যে সৃষ্টিকর্তা নয়, সে উপাস্য বা ইবাদতের যোগ্য নয়। যে জীবন-মৃত্যুর মালিক নয়, তার আনুগত্য করা যায় না। যে নিজেই খাবার, ঘুম, পেশাব-পায়খানা, স্ত্রী, পুত্র, পিতা-মাতার মুখাপেক্ষী—সে শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আত্মসমর্পণের অযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে একমাত্র তিনিই ইবাদতের যোগ্য, যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন, যিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সমস্ত দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যিনি সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণকারী, মালিক ও একচ্ছত্র প্রতিপালক—তিনিই একমাত্র প্রশ্নাতীত আনুগত্য পাওয়ার উপযুক্ত।
নিম্নে কুরআনুল কারীম থেকে এই সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত পেশ করা হলো—
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ - الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করো, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন কর। যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফলফলাদি তোমাদের জন্য রিযিক্বস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনেবুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না’ (আল-বাক্বারা, ২/২১-২২)। আল্লাহ বলেন,
يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِنْ قِطْمِيرٍ - إِنْ تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ - يَاأَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ - إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ - وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ
‘তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান আর তিনিই সূর্য ও চাঁদকে বশীভূত করে দিয়েছেন; প্রত্যেকে পরিভ্রমণ করছে একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব; সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁরই। আর আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকো, তারা খেজুরের আঁটির আবরণেরও মালিক নয়। যদি তোমরা তাদেরকে ডাক, তারা তোমাদের ডাক শুনবে না; আর শুনতে পেলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না এবং ক্বিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শরীক করাকে অস্বীকার করবে। আর সর্বজ্ঞ আল্লাহর ন্যায় কেউ তোমাকে অবহিত করবে না। হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত। যদি তিনি চান তোমাদেরকে সরিয়ে দেবেন এবং একটি নতুন সৃষ্টি নিয়ে আসবেন। আর তা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন নয়’ (ফাত্বির, ৩৫/১৩-১৭)। আল্লাহ তাআলা বলেন,أَيُشْرِكُونَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ - وَلَا يَسْتَطِيعُونَ لَهُمْ نَصْرًا وَلَا أَنْفُسَهُمْ يَنْصُرُونَ ‘তারা কি এমন কিছুকে শরীক করে, যারা কোনো কিছু সৃষ্টি করে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়? আর তারা তাদেরকে কোনো সাহায্য করতে পারে না এবং তারা নিজদেরকেও সাহায্য করতে পারে না’ (আল-আ‘রাফ, ৭/১৯১-১৯২)। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ ائْتُونِي بِكِتَابٍ مِنْ قَبْلِ هَذَا أَوْ أَثَارَةٍ مِنْ عِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ - وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ
‘বলুন, ‘তোমরা আমাকে সংবাদ দাও- তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো, আমাকে দেখাও তো তারা যমীনে কী সৃষ্টি করেছে? অথবা আসমানসমূহে তাদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে কি? এর পূর্ববর্তী কোনো কিতাব অথবা পরম্পরাগত কোনো জ্ঞান তোমরা আমার কাছে নিয়ে এসো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে, যে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাদের আহ্বান সম্পর্কে উদাসীন’ (আল-আহক্বাফ, ৪৬/৪-৫)। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ ‘আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। অতএব তুমি যদি কর, তাহলে নিশ্চয় তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (ইউনুস, ১০/১০৬)। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ - إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ - وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا كَذَلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ
‘আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় দৃঢ়তর। আর যদি যালেমগণ দেখে— যখন তারা আযাব দেখবে যে, নিশ্চয় সকল শক্তি আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আল্লাহ আযাব দানে কঠোর। যখন যাদেরকে অনুসরণ করা হয়েছে, তারা অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে এবং তারা আযাব দেখতে পাবে। আর তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যারা অনুসরণ করেছে, তারা বলবে, ‘যদি আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ হতো, তাহলে আমরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতাম, যেভাবে তারা আলাদা হয়ে গিয়েছে’। এভাবে আল্লাহ তাদেরকে তাদের আমলসমূহ দেখাবেন, তাদের জন্য আক্ষেপস্বরূপ। আর তারা আগুন থেকে বের হতে পারবে না’ (আল-বাক্বারা, ২/১৬৫-১৬৬)। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلَا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنْكُمْ وَلَا تَحْوِيلًا - أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
‘বলুন, ‘তাদেরকে ডাকো, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে (উপাস্য) মনে কর। তারা তো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না’। তারা যাদেরকে ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের রবের কাছে নৈকট্যের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে তাঁর নিকটতর? আর তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার রবের আযাব ভীতিকর’ (আল-ইসরা, ১৭/৫৬–৫৭)।
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
[1]. ইবন হিশাম, আস-সীরাতু আন-নাবাবিয়্যাহ, ১/৬২৪।