মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মহান চরিত্রের অধিকারী আদর্শের জীবন্ত প্রতীক। আল-কুরআনই হলো তাঁর জীবনাদর্শ। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ ‘তিনি ছিলেন আল-কুরআনের মূর্ত প্রতীক’।[1] তিনি তাঁর জীবনে আল-কুরআনের প্রতিটি অনুশাসনের রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। এজন্য তাঁকে ‘জীবন্ত কুরআন’ও বলা হয়।
জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর মাঝে বিরাজ করছিল সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরী, সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। বাল্যকাল থেকেই তাঁর স্বভাব ছিল কলুষতা, কঠিনতা ও কর্কশমুক্ত। নম্রতা ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার। তিনি ছিলেন দয়াশীল, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল এবং সর্বমহলে বিশ্বস্ত। ওয়াদা পূরণ বা অঙ্গীকার পালন করা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার পালন না করাকে তিনি জঘন্যতম পাপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন, لَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ ‘যে অঙ্গীকার পালন করে না তার ধর্ম নেই’।[2] তাই তিনি নির্দেশ দেন, ‘তোমরা যখন অঙ্গীকার করবে, তখন তা পালন করবে’।[3]
ব্যক্তিগতভাবে ওয়াদা বা অঙ্গীকার পালনে তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল। তাই তো অতি অল্প বয়সেই তিনি ‘আল-আমীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। ছাহাবী কবি হাসসান ইবনে ছাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আবৃত্তি করে বলেন,
وَأَحسَنُ مِنكَ لَم تَرَ قَطُّ عَيني.... وَأَجمَلُ مِنكَ لَم تَلِدِ النِساءُ
خُلِقتَ مُبَرَّءً مِن كُلِّ عَيبٍ.... كَأَنَّكَ قَد خُلِقتَ كَما تَشاءُ
‘আপনার চেয়ে সুন্দর আমার দু’চোখ কাউকে কখনো দেখেনি,
আপনার চেয়ে সুন্দর সন্তান কোনো নারী কখনো জন্ম দেয়নি।
আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে।
হে আল্লাহ! আপনি যেমন চেয়েছেন ঠিক তেমন করেই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন’।[4]
কবির এই কবিতাই বলে দিচ্ছে কেমন ছিলেন তিনি। কেমন ছিল তাঁর অনুপম আদর্শের সৌন্দর্য। অনুভব করার বিষয়। এজন্য তাঁর উন্নত আদর্শের স্বীকৃতি দিয়েছেন মহান আল্লাহ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’ (আল-ক্বলম, ৬৮/৪)।
আল্লাহ তাআলা তাঁকে শুরু থেকেই সুন্দর ভূষণে নিরন্তর বিভূষিত করেছিলেন। অন্যায়ের প্রতিকার ও প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা বালা-মুছীবতে সহ্য ও স্থিরতা ছিল আখলাকে নববীর অনন্য ভূষণ। প্রত্যেক ধৈর্য ও সহনশীল লোকদের জীবন-বৃত্তান্ত খুঁজে দেখলে তাতে অব্যশই কোনো না কোনো বিকৃতি বা ফাঁকফোকর পাওয়া যাবে। কিন্তু এর বিপরীতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র মাধুরী ছিল এতটা নির্মল ও নির্ভেজাল যে, তাঁর ওপর শত্রুদের পক্ষ থেকে যুলম-অত্যাচারের মাত্রা যতটা বেড়ে গিয়েছিল ঠিক তাঁর সহিষ্ণুতা আর স্থিরতার চরম সীমাও ততটা বিরল ইতিহাসের জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল। আরবের মূর্খ মানুষগুলোর সীমালঙ্ঘনের পরিধি যতটা বেড়েছিল তাঁর সহনশীলতার পরিধিও ততটা বিস্তৃত হয়েছিল। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, যে কোনো ক্ষেত্রে যখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে দু’টি পথ খোলা থাকত, তখন তিনি বারবার সহজ পথটিই অবলম্বন করতেন যতক্ষণ না গুনাহের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। কারণ যে কোনো গুনাহের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরে। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থে তিনি কখনো কারও থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর কোনো বিধান লঙ্ঘন করা হলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ নিতে দ্বিধায় ভুগতেন না।[5]
রাগ আর ক্রোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সংযমী। আর রাযী ও সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। রাগ শয়তানের কুমন্ত্রণার অংশ বিশেষ বলে তিনি কখনো রাগ করতেন না। এজন্যই তিনি এক আগন্তুক ব্যক্তিকে উত্তম নছীহত হিসেবে বলেন, ‘রাগ করো না’। এমনটি তিনি তিন বার বলেছেন।[6]
তবে পূর্বে যে বিষয়টি বলা হয়েছে, নিজের স্বার্থে তিনি কখনো কারও থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করেননি। কিন্তু আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা হলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ নিতে দ্বিধায় ভুগতেন না। তা আপন জায়গায় বহাল থাকবে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কাউকে মেরেছেন এমনটি হয়নি। নিজের স্ত্রীদের বেলায়ও না; এমনকি কোনো সেবক, কর্মচারীর ক্ষেত্রেও না। তবে জিহাদের ময়দানে আল্লাহর জন্য বেঈমানদের উপর আক্রমণ করেছেন। কেউ তাকে কষ্ট দিলে তিনি তার থেকে প্রতিশোধ নিতেন না। তবে শরীআতের কোনো হুকুম লঙ্ঘন করলে দোষী হিসেবে তাকে শাস্তি দিতেন।[7]
নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বদান্যতা ছিল তাঁর অন্যতম জীবনাদর্শ।
দয়া ও দানশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। নিজের কাছে কিছু থাকলে তিনি কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না।
মূসা ইবনু আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কখনো এমন হয়নি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে আর তা তিনি দেননি। তিনি বলেন, একবার এক ব্যক্তি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একটি বকরি চাইলে তিনি তাকে এত বেশি পরিমাণ দান করলেন, যা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থান পূর্ণ করে দেবে। অতঃপর লোকটি নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এসে বললেন, হে সম্প্রদায়! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কেননা, মুহাম্মাদ এত বেশি দান করেছেন যে, তিনি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ভয় করেন না।[8]
কথাবার্তা, মতপ্রকাশ ও কোনো কাজ করতে যাওয়ায় সাহসিকতা প্রদর্শন একটি চমৎকার গুণ। যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় তিনি ছিলেন সকল মানুষের চেয়ে বেশি সাহসী। বীর সিপাহী আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন যুদ্ধ শুরু হতো তখন আমরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আড়াল নিয়ে আত্মরক্ষা করতাম। তিনি থাকতেন আমাদের মধ্য থেকে শত্রুদের সবচেয়ে নিকটবর্তী। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে উহুদ ও হুনাইনের যুদ্ধে।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বোত্তম আদর্শের অন্যতম ছিল তাঁর লজ্জাশীলতা। লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের এক মহান ভূষণ। লজ্জাশীলতা সম্পর্কে তিনি বলেন,الْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيمَانِ ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’।[9] বস্তুত মহানবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি বাণী, কাজকর্ম, কথাবার্তা, আচরণ এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনাও তৎপরবর্তী বিশ্ববাসীর জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, উৎকর্ষতম, অনুসরণীয় আদর্শ। একটি অনুপম আদর্শ ও চরিত্রের যতগুলো মহৎ গুণ প্রয়োজন, মানব হিতৈষী বিশ্বনেতা মহানবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্রে তার সবগুলোরই অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি তাঁর উৎকর্ষতম আদর্শের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর অনুপম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের শান্তির পতাকাতলে সমবেত হয়ে তাঁর আদর্শে নিজেদের জীবনকে উজ্জ্বল করে গড়ে তুলেছিল। মানব জীবনের প্রতিটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠতম ও অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন, যা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারী হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
উপরিউক্ত আলোচনায় বর্ণিত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। যার পক্ষে পবিত্র কুরআনুল কারীমও একই কথা বলেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা তার অনুসরণ করবে অবশ্যই তারা হেদায়াত পাবে। আর ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করবে।
নাজমুল হাসান সাকিব
দাওরায়ে হাদীছ (মাস্টার্স), ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা; অধ্যয়নরত (ইফতা), আল-মারকাজুল ইসলামী কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
[1]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩৪১; জামেউছ ছাগীর, হা/৮৯৪২।
[2]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৪০৬; ইবনু হিব্বান, হা/১৯৪; মিশকাত, হা/৩৫।
[3]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১৪৭০; জামেউছ ছাগীর, হা/১৮৯৮।
[4]. দিওয়ানু হাসসান ইবনে ছাবিত, পৃ. ২১।
[5]. ছহীহ বুখারী, ১/৫০৩।
[6]. ছহীহ বুখারী, ১/৯০৩।
[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩২৮; ইবনু মাজাহ, হা/১৯৮৫।
[8]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৭৩০।
[9]. ইবনু মাজাহ, হা/৫৮; নাসাঈ, হা/৫০০৬।