কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

পাশ্চাত্য চশমায় ইসলাম!

post title will place here

বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কিত টকশোগুলো দেখে আমার একটা কথাই শুধু মনে হয়— এসব বক্তা বা আলোচক ইসলামকে জানেনই না। যতটুকু জানেন, তা ইসলাম বুঝার জন্য কোনোক্রমেই যথেষ্ট নয়। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর পূর্বে আরজ আলী মাতুব্বর পড়ার সময়ও একই কথা মনে হয়েছিল। অবস্থা এতটুকুও পাল্টায়নি।

যারা ইসলামের বিপক্ষে নানা প্রশ্ন তুলছেন, তাদের সিংহভাগকেই জ্ঞানী বলতে আমার বাঁধছে। কারণ জ্ঞানীর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— ভালোভাবে জেনে-বুঝে কিছু বলা। সেটা কোনো মতবাদ সম্পর্কে যেমন সত্য, তেমনই সত্য কোনো বই বা শাস্ত্র সম্পর্কেও। হ্যাঁ, যদি কিছুটা পড়াশুনা করে কিছু বলা হয়, তবে সেক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে— যখন মূল সত্য ও ব্যাখ্যা কোনো জ্ঞানীর মাধ্যমে উপস্থাপিত হবে, তখন তা মেনে নেওয়া। এটাই জ্ঞানীর লক্ষণ।

অথচ আমাদের এসব পণ্ডিতদের অবস্থা উল্টো। ক্ষমতা আর মিডিয়ার জোরে তারা যা বলছেন, তা-ই সঠিক। অন্যরাই বরং পড়াশুনা করে ভুল বুঝছে— এটাই তাদের মূলমন্ত্র। এটা মূলত পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ব্যতীত কিছুই নয়। আমি পাশ্চাত্যের জ্ঞান-গবেষণা খারাপ সেটা বলছি না। বরং তাদের গবেষণার মাপকাঠিতেও আমরা এখন পর্যন্ত কিছুই না। আমি বলছি ইসলাম নিয়ে তাদের ধারণা প্রসঙ্গে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের ধারণা মোটাদাগে কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।

প্রথমত, তারা ইসলামকে অধ্যয়ন করেন শাস্ত্র হিসেবে। যেমন করেন অর্থনীতি, রাজনীতি, পদার্থ, রসায়ন। পাশাপাশি ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে ইসলামকে অন্য ধর্মের মতোই মনে করেন। ফলে ইসলামের যে প্রায়োগিক দিক আছে, তা তারা অলমোস্ট ভুলেই যান। প্রায়োগিক দিকের যে ইসলামকে তাঁরা দেখেন তা হচ্ছে, পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচারিত তথাকথিত মৌলবাদী ইসলাম।

বাংলাদেশের অবস্থাও তেমন। এখানে যারা ইসলামের সমালোচনা করছেন, তাদের কাছেও ইসলাম একটা ধর্ম মাত্র; যেমন হিন্দু, খ্রিষ্টান ও ইয়াহূদী ধর্ম। অথচ এর বাস্তবতা যে নিতান্তই আলাদা তা তাদের জ্ঞানে আসে না বা আসতে দেন না।

দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্যের কাছে ইসলামের মূল্যায়ন হয় বস্তুবাদিতার মাপকাঠিতে। পার্থিব লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে তারা ইসলাম ও মুসলিমদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করেন। যেমন রিদ্দার যুদ্ধের কারণ হিসেবে যেখানে আমরা মুসলিমরা দ্বীন ত্যাগের কথাই বেশি অনুভব করি, সেখানে তাঁরা এটাকে একেবারেই গৌণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণই তাদের কাছে মুখ্য। কারণ তাদের হিসেবে পার্থিব কোনো স্বার্থ না থাকলে কীভাবে এসব করা হয়।

এজন্যই ছাহাবায়ে কেরামের আত্মত্যাগ, অনাড়ম্বর জীবনযাপন তাদের অধ্যয়নের মূল বিষয় নয়। কারণ এগুলো বস্তুবাদিতার মূলে কুঠারাঘাত হানে। অথচ ছাহাবা, তাবেঈন ও সালাফ ছালেহীনের আখেরাতমুখী জীবনযাপন ইসলামের মূল চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদেরও একই রোগ। তাদের কাছেও সবই লাভ-লোকসানের নিক্তিতে পরিমাপযোগ্য। অথচ ইসলাম দুনিয়াবিমুখতা ইত্যাদির শিক্ষাই বেশি দিয়ে থাকে। ফলে ইসলামের মূল চেতনা তাদের কাছে অধরাই থেকে যায়। দ্বীনের জন্য একজন মানুষ কীভাবে জানমাল পরিত্যাগ করে, নিজের স্বার্থ পরিত্যাগ করে উল্টো কথা বলে তা তাদের বুঝে বা ব্যাখ্যায় আসে না।

বস্তুবাদিতার ফলেই তারা খেলাফাতের উদাহরণ খুঁজেন। ইসলাম প্রসঙ্গে মুসলিমদের যে-কোনো কথাকেই তারা রাজনৈতিক ফ্লেভার দিয়ে দেন। অথচ ক্ষমতা দখল নয়, নেতৃত্ব নয়; ইসলামের মূল চেতনা হচ্ছে সবাই মুসলিম হয়ে যাওয়া, আল্লাহর অনুগত হয়ে যাওয়া। তা ক্ষমতা যার হাতেই থাকুক সে যদি আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পরিচালনা করে, তবে কোনো মুসলিমেরই আপত্তি থাকে না। বস্তুবাদিতা ইসলামের এ চেতনা ধারণ করতে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ।

তৃতীয়ত, ইসলামকে খণ্ডিত আকারে দেখা। অথচ ইসলাম সার্বিক জীবনব্যবস্থা। পাশ্চাত্য রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব কিছুকে আলাদা করে নিয়ে অধ্যয়ন করছে।

সুধী পাঠক! এটা গাড়ি নয় যে ইঞ্জিন নষ্ট হলে তা খুলে নিয়ে ঠিক করে নিলাম; বাকী পার্টগুলো আর ঠিক করতে হবে না। ইসলামে সবকিছু একটার সাথে অন্যটা জড়িত। একটা নষ্ট হলে অন্যটাও নষ্ট হয়ে যায়। তেমনই একটি কাজের সাথে অন্যগুলোও জড়িত থাকে। ইসলামের এই সার্বিক রূপরেখাও তাদের ধারণার বাইরে।

আরও অনেক কিছুই বলা যাবে। কিন্তু মোটাদাগে এসবই পাশ্চাত্যের ইসলাম অধ্যয়ন (থিওলজিক্যাল বিষয় বাদ দিয়ে)। এর প্রমাণ হিসেবে, ইসলামের অধ্যয়নে তাদের ফোকাসড বিষয়গুলো দেখেন। ইসলামকে জানার জন্য, বুঝার জন্য, অনুভব করার জন্য যেখানে ছাহাবীগণের, তাবেঈনের, সালাফদের আখলাক, চরিত্র, ধর্মভীরুতা, মানবিকতা, মানহাজ ইত্যাদি বেশি অধ্যয়ন করা দরকার, তারা এর ধারেকাছেও নেই। যেসব বিষয় বস্তুবাদিতার সাথে সম্পর্কিত (যেমন, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, আইন ইত্যাদি) সেসবই তাদের পাঠ্য। ফলে আমাদের আর তাদের মধ্যে ইসলাম জানার পার্থক্য রয়েই যাবে, তা বুঝা এমন আর কি কঠিন বিষয়।

আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও পাশ্চাত্যের আলোকেই ইসলাম ও মুসলিমকে বিচার করেন। এমনকি অনেকে শুধু উপরিউক্ত একটি বা দুইটি ধারণা নিয়েই ইসলামকে মূল্যায়ন করতে লেগে যান। তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই, কিন্তু সমস্যা হয়ে যায়, যখন তারা ইসলামের মূল ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হলেও মেনে নিতে অস্বীকার করেন। শুধু আলিফ-বা-তা পড়ে যদি নিজেদের ইসলামী পণ্ডিত ভাবেন, তাহলে তাদের নিকট থেকে ভালো কিছু আশা করাই বোকামি।

যেমনভাবে রঙিন চশমা পরা কারো নিকট থেকে বাস্তব দৃশ্যের সঠিক বর্ণনা আশা করা বৃথা। তা সে যত ভালো সাহিত্যিকই হোন। কেননা বাস্তবতাই তিনি দেখতে পান না। আর যিনি বিনা চশমায় প্রকৃতি দেখেন, তার বর্ণনাশৈলী যতই খারাপ হোক, তা নিশ্চিতরূপেই চশমাধারীর চাইতে সত্যের বেশি কাছাকাছি হবে।

হ্যাঁ, যদি সত্যিই কেউ ইসলামের সৌন্দর্য অবলোকন করতে চান, তাহলে ডুব দেন ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলিতে। নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে সত্য অনুসন্ধান করলে আপনার সামনে ইসলাম তাঁর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়েই হাজির হবে। যুগে যুগে এমনটা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। শুধু দরকার চশমাটা খুলে ফেলে দেওয়া। তারপর দেখেন পৃথিবীর বাস্তবতা। সত্য তখন নিজেই আপনাকে তার কাছে টেনে নেবে।

মুস্তফা মনজুর

সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Magazine