(৬) আল্লাহর স্মরণে মানসিক প্রশান্তি লাভ: আল্লাহ স্মরণ ব্যতীত মানুষের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে না। মানুষের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা সীমাহীন। তথাপি কোনোকিছুর আধিক্য তাদের মধ্যে একঘেয়েমির সৃষ্টি করে। তারা প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। বিপরীত দিকে মহান আল্লাহর চিরন্তন সত্তার সাথে সাক্ষাতের পথে তারা যত এগিয়ে যায়, তাদের ব্যগ্রতা আরো বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর স্মরণ মানুষকে এসব ক্ষেত্রে একমাত্র প্রশান্তির পায়রা হয়ে আবর্তিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জেনে রেখো! আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৮)। অতএব, মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের এবং মানুষের প্রশান্তির অন্যতম উপায় হলো আল্লাহর যিকির।
(৭) আল্লাহর ইবাদত পালনকারী: আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁর আনুগত্য প্রদর্শন করার নিমিত্তে। এটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِي ‘কেবল আমার ইবাদতের জন্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষ এবং জিনকে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)। কিন্তু মানুষ যদি আল্লাহর ইবাদত না করে এবং তাঁর সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা না করে, তাহলে তারা নিজেদের চিনতে পারবে না। আল্লাহর ব্যাপারে গাফেল হলে তারা নিজেদেরও ভুলে যাবে। এ পরিস্থিতিতে তারা বুঝতে পারবে না তাদের নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে; তাদের সৃষ্টি ও অস্তিত্বের পেছনে কী উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তাও ভুলে যাবে। এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে ধমকের সুরে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُوْلَئِكَ هُمْ الْفَاسِقُونَ ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। তারাই তো পাপাচারী’ (আল-হাশর, ৫৯/১৯)।
(৮) পরকালীন সফলতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান: মানুষ জাগতিক প্রেরণা বা উদ্দেশ্য নিয়েই বাঁচে না। অর্থাৎ বন্তুগত চাহিদা বা প্রয়োজনই মানুষের সকল কর্মের পেছনে একমাত্র প্রেরণা নয় বরং তারা মহৎ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। আর তা হলো পরকালীন সফলতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান। অতএব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে তাদের সামনে আর কোনো লক্ষ্যই থাকে না। এদিকে ইঙ্গিত করেই কুরআনুল কারীমে ঘোষিত হয়েছে, يَاأَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ - ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً - فَادْخُلِي فِي عِبَادِي- وَادْخُلِي جَنَّتِي ‘হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও আর আমার জান্নাতে প্রবেশ করো’ (আল-ফজর, ৮৯/২৭-৩০)।
(৯) মযবূত ঈমান: ঈমান মানে বিশ্বাস, প্রত্যয়, ধর্মীয় বিশ্বাস,[1] অন্তরের বিশ্বাস।[2] এক কথায় বলতে গেলে ঈমান হচ্ছে স্বীকৃতি প্রদান করা। পরিভাষায় বলা হয়, ইসলামের মূল বিষয়গুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মুখে স্বীকার করা এবং সে অনুযায়ী আমল করার নাম ঈমান। মানুষের মধ্যে এমন কতক মানুষ আছে যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল, ফেরেশতা, আসমানী গ্রন্থাবলিসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখে। কোনো অত্যাচারী শাসকের রক্তচক্ষুও তাদের বিন্দুমাত্র টলাতে পারে না। এমন ঈমানের এক জীবন্ত মডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে সমাদৃত রয়েছেন, মুসলিম জাহানের প্রথম খলীফা আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রযিয়াল্লাহু আনহু। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তার এত বেশি অগাধ আস্থা ছিল যে, মি‘রাজের ঘটনার বিবরণ শোনামাত্রই তিনি তা বিশ্বাস করে ফেলেন। পবিত্র কুরআন মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করেছে— ১. ঈমানদার ও ২. যারা ঈমান আনেনি এমন। তবে যারা ঈমান আনে তাদের অধিকাংশই মযবূত ঈমানের অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথা তারা বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত হতে বাধ্য। তাই তো ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ; অতঃপর অবিচল থাকে তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতাগণ এবং তারা বলেন, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার সুসংবাদ গ্রহণ করো’ (হা-মীম আস-সাজদা, ৪১/৩০)। যারা এ ধরনের ঈমানের অধিকারী তারাই সফলকাম ও বিজয়ী হবে। তাদের জন্যই মহান আল্লাহ পরকালে মহাপুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمْ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না; তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৯)।
(১০) দরিদ্র অথচ অল্পে তুষ্ট: সমাজে দুই শ্রেণির মানুষ বাস করে— ১. ধনী এবং ২. দরিদ্র। ধনী-দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণার্থে ইসলামে যাকাতের বিধান রয়েছে। যা ধনীদের সম্পদ থেকে উত্তোলন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ করতে হয়। কেননা ইসলাম সুসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। এতে যাকাতের বিধান রাখা হয়েছে যেন সম্পদ এক শ্রেণির মাঝে পুঞ্জীভূত না হয়ে যায়। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ ‘যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই সম্পদ পুঞ্জীভূত না হয়ে যায়’ (আল-হাশর, ৫৯/৭)। এতৎসত্ত্বেও এমন কতিপয় মানুষ রয়েছে যারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও সন্তুষ্ট চিত্তে জীবনযাপন করে। তথাপিও মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা বানায় না। পবিত্র কুরআনে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,لِلفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمْ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنْ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا ‘দান-ছাদাক্বা তো ঐসব গরীব লোকদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যারা পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারে না, লোকেরা হাত না পাতার কারণে তাদেরকে ধনী মনে করে; তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট নাছোড় হয়ে ভিক্ষা করে না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৭৩)। মূলত অল্পে তুষ্টিই শান্তির নিয়ামক। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ ‘অন্তরের প্রাচুর্যই প্রকৃত প্রাচুর্য’।[3]
(১১) তাক্বওয়াসম্পন্ন: তাক্বওয়া আরবী শব্দ। অর্থ হলো
আল্লাহর ভয়, পরহেযগারিতা, দ্বীনদারিতা, ধার্মিকতা।[4] যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে তাদেরকেই মুত্তাক্বী বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন কেবল মুত্তাক্বীদের জন্যই পথপ্রদর্শক। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষকে লক্ষ্য করে পরিপূর্ণ তাক্বওয়াবান হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০২)। এ তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য মানুষের উচিত অধিক পরিমাণে তাঁকে স্মরণ করা এবং সকল কাজ তাঁর দেওয়া বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা। এসব লোকদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آياتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‘নিশ্চয় প্রকৃত মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে’ (আল-আনফাল, ৮/২)। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় যারা জীবন অতিবাহিত করে এবং তাঁর নিষিদ্ধ বিষয় ও কাজসমূহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে তারাই মুত্তাক্বী। এসব লোকদের জন্যই মহান আল্লাহ চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন।
(১২) বিনয়ী ও ভদ্র: বিনয় ও নম্রতা মানুষের অন্যতম চারিত্রিক ভূষণ। বিনয় মানুষকে উচ্চ আসনে সমাসীন করতে এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সহায়তা করে। বিনয়ী ব্যক্তিকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمْ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا ‘রহমানের বান্দা, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে সালাম’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৬৩)। শুধু তাই নয়, একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা লুক্বমানও তাঁর পুত্রকে একই আদেশ দিয়েছেন, ‘(প্রিয় বৎস) পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না’ (লুক্বমান, ৩১/১৮)।
(১৩) দানশীল ও উদার: এ দুটি উত্তম চারিত্রিক গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ আর মানুষ হচ্ছে তার ব্যবহারকারী বা ভোক্তা মাত্র। অতএব, সম্পদকে পুঞ্জীভূত করে না রেখে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া কতক মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীন ও ছাহাবায়ে কেরাম এক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ। দানের ক্ষেত্রে তারা আমাদের জন্য ক্বিয়ামত অবধি মডেল হয়ে থাকবে। দানশীল লোকদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দিকে আহার্য দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি। আমরা তোমাদের নিকট হতে চাই না কোনো প্রতিদান এবং কৃতজ্ঞতা’ (আদ-দাহর, ৭৬/৮-৯)।
(১৪) ধৈর্যশীল: ধৈর্য একটি মহৎ গুণ। ধৈর্যশীলকে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন। মানুষ এ পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি ও কষ্টের সম্মুখীন হয় যা দ্বারা মূলত, তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়। আর তা হলো ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ধ্বংস, জীবনহানি, সম্মানহানি প্রভৃতি। এক্ষেত্রে ধৈর্যশীলগণ খুব সহজেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنْ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ - الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফলাদির ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে। যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫-১৫৬)।
(১৫) অপরকে অগ্রাধিকার দান: মানুষের স্বভাব হলো অন্যের উপর নিজের প্রাধান্য বিস্তার করা। তথাপিও আল্লাহর একান্ত অনুগত কতক বান্দা রয়েছে, যারা নিজেদের আমিত্বকে ভুলে গিয়ে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দানে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে থাকে। ছাহাবায়ে কেরাম ছিলেন এ দৃষ্টান্তের মূর্ত প্রতীক। বিশেষত আনছারগণ সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক্ষেত্রে নিজেদেরকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ ‘মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এ নগরীতে বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদের ভালোবাসা এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য হতে রক্ষা করা হয়, তারাই সফলকাম’ (আল-হাশর, ৫৯/৯)।
(১৬) ক্রোধ সংবরণকারী: ক্রোধ মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি করে দেয়। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মানুষের পরস্পরের প্রতি ঘৃণাবোধ জন্ম নেয়। এমনকি অন্যায় পথে পা বাড়াতেও এ ক্রোধ মানুষকে সাহায্য করে। অতএব, ক্রোধ হলো বিভ্রান্তিকর একটি মানবিক দুর্বলতার নাম। মুমিনগণ এ ক্রোধকে দমন করে স্বীয় কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ গুণটির কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা নিজেদের ক্রোধকে সংবরণ করে’ (আলে ইমরান, ৩/১৪৩)। এরকম মনের অধিকারী ব্যক্তিগণই হলেন সৎকর্মপরায়ণ।
(১৭) ক্ষমাশীল: ক্ষমা অন্যতম একটি মানবিক গুণ, যা মানুষকে বড় মনের অধিকারী বানাতে সাহায্য করে এবং ক্রোধ সংবরণে সহায়তা করে। ক্রোধের সাথে ক্ষমা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রোধের সাথেই ক্ষমাশীলতার উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালোবাসেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৪)।
এসব গুণাবলির অধিকারী যে-সব মানুষ রয়েছে, মূলত তাদের জন্যই মহান আল্লাহ স্বীয় গুণে গুণান্বিত হয়ে ক্ষমা ও চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। উপর্যুক্ত আয়াতের পূর্বোক্ত আয়াতে সে বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ ‘তোমরা ধাবমান হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়। যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাক্বীদের জন্য’ (আলে ইমরান, ৩/১৩৩)।
(চলবে ইনশা-আল্লাহ)
সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস, সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।
[1]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, (রিয়াদ প্রকাশনী: ঢাকা, চতুর্থ সংস্করণ-২০০২ খ্রি.), পৃ. ১৪৩।
[2]. মুফতী আমীমুল ইহসান, ক্বাওয়ায়েদুল ফিক্বহ, পৃ. ২০০।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫১।
[4]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, (রিয়াদ প্রকাশনী: ঢাকা, চতুর্থ সংস্করণ-২০০২ খ্রি.), পৃ. ২১৯।