১. মেয়ে সন্তান হলে মনঃক্ষুণ্ন হওয়া:
জাহেলী যুগে একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক উৎফুল্লতার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। আশার চেয়ে বেশি লাভ হওয়ায় রীতিমতো তার মনটা বেশ পুলকিত। বহুদিন পর ব্যবসায়ে লাভের মুখ দেখেছে। বেঁচে যাওয়া পণ্য নিয়ে প্রফুল্ল মন নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। আজ তার চলার ভঙ্গিই ভিন্ন রকম। তার মনে যে আনন্দের স্নিগ্ধ হাওয়া দোল খাচ্ছে, তা তার চালচলন দেখেই আঁচ করা যাচ্ছে। ওই তো তার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। একটু বাদেই দেখা মিলবে প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে। বলবে বলে মনের মাঝে অনেক কথাই লুকিয়ে রেখেছে। অনেক দিন পর বাড়িতে যাচ্ছে। বাড়ির অদূর থেকে এক লোক গলা ছেড়ে চিৎকার করে ডাকছে, ‘ওই ভাই, ওই ভাই’। আওয়াজটা বেশ চেনাচেনা লাগছে। লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুত আসছে। কাছে আসতেই চিনতে আর বাকি নেই। ‘কী রে, তোর কী হয়েছে?’ ‘ভাই, খুশির সংবাদ! আপনার স্ত্রী, মানে আমাদের ভাবি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছে!’ ‘যাহ! এটা কোনো খুশির সংবাদ হলো! দিলি তো তুই আমার মুডটা নষ্ট করে!’ মুহূর্তেই তার চেহারায় মলিনতা এসে ভিড় জমায়। এখন তার চেহারা ধারণ করেছে ধূসর বর্ণের রূপ। একটা বিদ্ঘুটে চেহারা ও বিরক্তি ভরা সুর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। স্ত্রীকে আর কী ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবে, তার মেজাজে যে আগুন লেগেছে! বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেই বলছে, ‘এই সংবাদ শুনার আগে আমার মৃত্যু হলো না কেন? আমি এখন মুখ লুকাব কোথায়? সবাই আমাকে অপয়া বলবে। আমার বংশ খাঁটো হবে। আমি যদি এখন মাটির নিচে চলে যেতে পারতাম! অথবা চলে যেতে পারতাম অজানা কোনো রাজ্যে, যেখানে আমাকে কেউ চিনতে পারবে না। বলবে না আমাকে কোনো কটু কথা। জাহেলী যুগে কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণ করলে এভাবেই কন্যার বাবা বিলাপ করত। কুরআন মাজীদ এই চিত্রটাই এভাবে তুলে ধরেছে,﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ - يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ﴾ ‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সুসংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানির কারণে সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে বেড়ায়। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও কি তাকে রেখে দিবে, না-কি মাটিতে পুঁতে ফেলবে!? সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট!’ (আন-নাহল, ১৬/৫৮-৫৯)।
সুধী পাঠক! এই চিত্রটাকে আপনি শুধু জাহেলী যুগের সাথে রেখে দিচ্ছেন? মনে মনে ভাবছেন জাহেলী যুগের মানুষ কত খারাপ ছিল! বিস্ময়বোধ করছেন আপনি? আপনার চোখ তো চড়কগাছ হবে, যদি আমি আঙুল উঁচিয়ে আপনাকে দেখিয়ে দেই আপনার পাশের বাড়িতে জাহেলী যুগের এই কাজ হচ্ছে! আপনার চাচাতো ভাই তার স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ করছে। প্রথম কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণের পর পরের সন্তানও কন্যা হওয়ার কারণে আপনার চাচাতো ভাই তার স্ত্রীকে মারধর করছে। এখনো আমাদের মাঝে জাহেলী যুগের কাজ বিদ্যমান আছে। কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণ করলে আমরা মনঃক্ষুণ্ন হই। আত্মপীড়ায় ভুগতে থাকি। নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে অপয়া, অশুভ মনে করি। অপরিচিত ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করি। শরীরের সবটুকু শক্তি ব্যয় করে তাকে বেদম প্রহার করি। তার আত্মীয়স্বজন, বংশ নিয়ে গালিগালাজ করি। ওই সময় আপনার স্ত্রী অঝোরে লোকচক্ষুর আড়ালে অশ্রু বৃষ্টি বর্ষণ করে। ভেতরের দহন যন্ত্রণার কথা কারো কাছে বলতে পারে না। শুধু নীরবে নিভৃতে একা একা কাঁদে। অনেক অযোগ্য, মূর্খ স্বামী একধাপ এগিয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়। সোজাসাপ্টা তালাক দিয়ে তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
শুনুন, আপনার মাঝে জাহেলী যুগের মানুষের বৈশিষ্ট্য আছে। আপনাকে বলি, আপনার স্ত্রী কি নিজ থেকে কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছে? সন্তান হওয়ার পেছনে কি তার কোনো হাত আছে? তার হাতে যদি ছেলে-মেয়ে হওয়ার ক্ষমতা থাকত, তাহলে সে কি কখনো মেয়েসন্তান জন্ম দিত? সন্তান ছেলে হবে, না-কি মেয়ে এটা তো আল্লাহর হাতে। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ - أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ﴾ ‘আসমানসমূহ ও জমিনের মালিকানা আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা রাখেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাবান’ (আশ-শূরা, ৪২/৪৯-৫০)।
আপনার মাঝে কি একটু দ্বীনের জ্ঞান নেই? কীভাবে আপনি নির্লজ্জের মতো আপনার স্ত্রীকে মারছেন? অনেক পুরুষকে দেখেছি, দেখেছে আমার চক্ষুদ্বয় তিনটা মেয়েসন্তান হওয়ার কারণে তাকে তালাক দিয়ে আরেক নারীকে বিয়ে করেছে। আমি আবারও বলছি আপনার মাঝে জাহেলী যুগের মানুষের বৈশিষ্ট্য আছে। এখনই স্ত্রীর কাছে মিনতি করে ক্ষমা চান। বলুন, আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে ক্ষমা করো। আমার উপর বিতাড়িত শয়তান জয়লাভ করেছিল। তাই আমি তোমাকে মেরেছি।
প্রিয় ভাই! আমি হলফ করে আপনাকে একটা কথা বলছি, এই কন্যাসন্তান আপনার ঘরের বরকতের কারণ হবে। আপনার রূযী-রোজগার বৃদ্ধি পাবে। আর অবশ্যই এটা হবেই। আল্লাহ তাআলা অবশ্যই আপনাকে অনেক টাকাপয়সা দান করবেন। কারণটা জানেন কী? নারীরা হচ্ছে দুর্বল। আপনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদের রিযিক্ব দিবেন। আপনার কি মনে আছে, বিয়ের আগে জানি আপনি মাসে কত টাকা উপার্জন করতেন? হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে। বিয়ের পর দেখুন তো আপনার এই বাড়তি টাকা কোত্থেকে আসছে? এখন আগের তুলনায় একটু বেশি উপার্জন হয়। কেন হয়, কীভাবে হয়, কার জন্য হয়, কোনোদিন কি একটু চিন্তা করেছেন? মধ্যরাতে কি ভেবেছেন, কীভাবে এখন বেশি টাকা উপার্জন হয়? আগে তো এত পরিশ্রম খাটুনি করেও এত টাকা উপার্জন করতে পারতাম না! আপনার স্ত্রী যখন তার বাবার কাছে ছিল, তখন আল্লাহ তাআলা তার রিযিক্বটা তার বাবার মাধ্যম দিয়েছেন। এখন সে আপনার স্ত্রী, তাই আল্লাহ তাআলা আপনার মাধ্যমে তার রিযিক্ব দিচ্ছেন। সেজন্যই এখন আপনি বেশি টাকা উপার্জন করতে পারেন। আপনার কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণ করেছে, তার রিযিক্ব আল্লাহ তাআলা আপনার মাধ্যমে দিবেন। তাই রিযিক্ব নিয়ে কখনো দুঃশ্চিন্তায় থাকবেন না।
একটা কথা মনের মাঝে গেঁথে রাখুন। নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালাম হচ্ছেন কন্যার বাবা। আমাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চারজন কন্যাসন্তান ছিল। আপনি কি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ভালো মানুষ? তাঁর যদি কন্যাসন্তান হয়, তাহলে আপনার হলে সমস্যা কী? নবী-রাসূলদের আলাইহিমুস সালাম মতো আপনিও কন্যাসন্তানের বাবা। এটা কি ভালো লাগার নয়?! কখনো চিন্তা করবেন না। দেখুন, আমাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে কত বড় বড় উপহার দিচ্ছেন,مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ وَأَطْعَمَهُنَّ وَسَقَاهُنَّ وَكَسَاهُنَّ مِنْ جِدَتِهِ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘কারো তিনটি কন্যাসন্তান থাকলে এবং সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করলে, যথাসাধ্য তাদের পানাহার করালে ও পোশাক-আশাক দিলে, তারা ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য জাহান্নাম থেকে অন্তরায় হবে’।[1] অপর আরেকটি হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَا مِنْ رَجُلٍ تُدْرِكُ لَهُ ابْنَتَانِ فَيُحْسِنُ إِلَيْهِمَا مَا صَحِبَتَاهُ أَوْ صَحِبَهُمَا إِلاَّ أَدْخَلَتَاهُ الْجَنَّةَ ‘কোনো ব্যক্তির দুটি কন্যাসন্তান থাকলে এবং তারা যতদিন তার সাথে থাকে, ততদিন সে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করলে, তবে তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে’।[2]
আরেকটি কথা বলি, বলুন তো সবার যদি শুধু ছেলেসন্তান হয়, তাহলে এই ছেলেরা বিয়ে করবে কাদের? মেয়ে পাবে কোথায়? এজন্যই আল্লাহর সৃষ্টি বড়ই নিখুঁত। তিনি কাউকে ছেলে আবার কাউকে মেয়ে আবার কাউকে দুটিই দান করেন।
আপনাকে আমি একটা ভরসার বাণী শুনাচ্ছি। আপনার চারজন কন্যাসন্তান আছে? কোনো টেনশন নেই। আপনি অন্তত নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না, লুটোপুটি খেতে হবে না বৃদ্ধ বয়সে মলমূত্রের সাথে। আপনার অসুখবিসুখ হলে এই কলিজার টুকরোরা দুর্বার গতিতে আপনার কাছে ছুটে আসবে। আপনার ক্ষীণকায় দেহের যত্ন নিবে, ময়লা কাপড় ধুয়ে দিবে, অপরিচ্ছন্ন অপরিপাটি ঘরদোর পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে দিবে। ছয় ছেলের বাবা-মা দেখবেন বৃদ্ধাশ্রমে আছে। কিন্তু ছয় মেয়ের বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে নেই। একজন না একজন আপনাকে ঠাঁই দিবেই। নয় কন্যাসন্তানের মাকে দেখেছি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে নাতিপুতি নিয়ে খুব ভালোভাবে দিন কাটাচ্ছেন। আবার এও দেখেছি চার ছেলের মা মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে চলছে। তাই আপনাকে বলছি, আপনি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণ করায় মনঃক্ষুণ্ন হবেন না। এটা জাহেলী যুগের মানুষের বৈশিষ্ট্য। আপনার মাঝে যেন এই বৈশিষ্ট্য না থাকে।
অনেক বাবা তো কন্যাসন্তানকে রাগ করে লেখাপড়াই করান না। বলেন, মেয়ে মানুষ এত লেখাপড়া করে কী হবে! যতই লেখাপড়া করুক, দিনশেষে পাতিল মাস্টার। মানেটা মনে হয় আপনি বুঝেননি। যত শিক্ষিত নারীই হোক তাকে কিন্তু রান্নাবান্না করতে হয় এটাই বুঝাতে চাচ্ছেন তিনি। ছেলেকে স্কুলে পড়ান, বিকেলে বাড়িতে শিক্ষক রেখে আলাদাভাবে পড়ান, তার জন্য আলাদা যত্ন, কিন্তু মেয়ের বেলায় একেবারে অনীহা প্রকাশ করেন।
আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন! প্রিয় ভাই! আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি যদি ছহীহ বুখারীর জগদ্বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্ৰন্থ ‘ফাতহুল বারী’ পড়েন, তাহলে সেখানে দেখতে পাবেন হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ তার কিতাবে প্রায় জায়গায় একটা বর্ণনা এভাবে নিয়ে এসেছেন, ‘কারীমার বর্ণনা অনুযায়ী এমন’। এর মানে হচ্ছে কয়েকজন মুহাদ্দিছ ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ-এর কিতাবের পাণ্ডুলিপি লিখেছেন। তাদের মাঝে একজন হচ্ছেন কারীমা। তিনিও পাণ্ডুলিপি লিখেছেন। তার পাণ্ডুলিপিতে বর্ণনাটা এভাবে এসেছে। সুবহানাল্লাহ! একজন মেয়ে মানুষ মুহাদ্দিছা! আপনি কি কল্পনা করতে পারেন? একজন মেয়ে কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করলে মুহাদ্দিছা হতে পারেন! আমি প্রায়ই কারীমা নাম্মী এই মুহাদ্দিছা মেয়েকে নিয়ে ঈর্ষা করি। ইশ! আমি যদি তার মতো হতে পারতাম! হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ-এর মতো এত বড় একজন বিদ্বান কত সম্মানের সাথে তার নাম উল্লেখ করতেন। আহ! আমার মেয়ে যদি এমন হতো! আপনার কি মন চায় না আপনার মেয়ে এমন হোক? আমার তো খুব মন চায়, আল্লাহ! আমার মেয়ে যদি এমন হতো! আপনার মেয়ে হয়েছে এজন্য তাকে অবহেলা করে রেখে দিয়েন না। তাকে পড়ালেখা করান। সেও যোগ্য হবে ইনশা-আল্লাহ। আমার মেয়েটা কারীমার মতো জগদ্বিখ্যাত বিদুষী হবে! আমার মেয়ে মানুষের অন্তরের চিকিৎসা করবে! আজ নারীদের মাঝে মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, মুফতী নেই বললেই চলে! কিন্তু অসংখ্য ডাক্তার আছে! আপনি আপনার মেয়েকে মুহাদ্দিছ বা মুফাসসির অথবা মুফতী বানান! নারীদের গোপন অনেক মাসআলা তারা চোখলজ্জায় অনেক সময় আলেমদের কাছে বলতে পারে না। আপনার মেয়েকে মুফতী বানান। বাড়িতে বসে বসে আপনার মেয়ে নারীদের মাসআলাগুলোর সমাধান দিবে! শুনুন, আমাদের মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা রাযিয়াল্লাহু আনহা কিন্তু নারী ছিলেন! তিনি কিন্তু অনেক জ্ঞানী ছিলেন। তাঁর সময়ে বড় বড় ছাহাবী, তাবেঈ কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তাদের কাছে ওই বিষয়ের জ্ঞান না থাকলে সরাসরি চলে যেতেন আম্মাজান আয়েশা ছিদ্দীক্বা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর কাছে। তিনি সুন্দর করে দলীলের আলোকে বুঝিয়ে দিতেন। আপনি আপনার মেয়েকে নারীদের জন্য একটা আদর্শ রেখে যান। প্রিয় পাঠক! মেয়ে দেখে আপনার কলিজার টুকরোকে অবহেলা করবেন না। নাক সিটকাবেন না। তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলুন। জাহেলী যুগের মানুষের মতো আপনি আচরণ করবেন না। আল্লাহ তাআলা আপনার সহায় হোন- আমীন!
২. মেয়েসন্তান জীবন্ত প্রোথিত করা:
জাহেলী যুগে কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণ করলে তাকে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। এই আলোচনাটা শুরু করার আগে কে সর্বপ্রথম জাহেলী যুগে কন্যাসন্তান জীবন্ত প্রোথিত করে ও কীভাবে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো এই ইতিহাস জানা সমীচীন মনে করছি।
জীবন্ত কন্যাসন্তান সর্বপ্রথম প্রোথিত করে ক্বায়েস ইবনু আছেম আত-তামীমী। এর কারণ হলো নু‘মান ইবনে মুনযির একবার বানূ তামীম গোত্রের উপর হামলা করে, তাদের অনেক নারী ও শিশুদের বন্দী করে নেয়। তারপর তার কাছে বন্দীদের চাওয়া হলে তিনি নারীদের ঐচ্ছিকতা প্রদান করে স্বামী, বাবা বা বন্দিকারী— যে কাউকে গ্রহণ করতে পারবে। অধিকাংশ নারী তাদের বাবা ও স্বামীকে গ্রহণ করলেও ক্বায়েসের স্ত্রী বন্দিকারীকে গ্ৰহণ করে। এতে ক্বায়েস যারপরনাই ক্রোধান্বিত হয়ে শপথ করে, ‘এরপর থেকে তার যত মেয়ে জন্মগ্ৰহণ করবে সবাইকে সে জীবন্ত প্রোথিত করবে’। তারপর থেকেই তামীম গোত্রের মাঝে এই রীতি ব্যাপকতা লাভ করে। সাসায়া ইবনু নাজিয়াহ আত-তামীমী সে ছিল আবার ক্বায়েসের সম্পূর্ণ উল্টো। সে মুক্তিপণ দিয়ে মেয়েদের রক্ষা করত। সে যদি শুনতে পেত কোথাও মেয়েসন্তান জীবন্ত প্রোথিত করা হবে, সে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে গিয়ে ওই লোককে বলত, তুমি তাকে জীবন্ত প্রোথিত করো না। তার বিনিময়ে আমি তোমাকে এত দিরহাম দিব। তারপর চুক্তি অনুযায়ী দিরহাম দিয়ে সে এভাবে মেয়েদের রক্ষা করত। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদুজই ইসলাম গ্ৰহণ করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য পেয়ে ধন্য হন। আল-হামদুলিল্লাহ।
জাহেলী যুগে মেয়েদের দুভাবে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। (ক) সন্তান প্রসবের পূর্বে স্বামী বলত, এই যে, কূপের সন্নিকটে সন্তান প্রসব করবে। মেয়ে হলে আর কথা নেই। সাথে সাথে কূপে ফেলে দিবে। আর ছেলে হলে সযত্নে নিয়ে আসবে।
(খ) স্বামী বলা নেই কওয়া নেই, একদিন হুট করে স্ত্রীকে এসে বলত। এই শুনছ, তোমার মেয়েকে দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে দাও! তাকে নিয়ে যে আমি নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাব। আমার মেয়ে বলে কথা। অপরিচ্ছন্ন থাকলে কি হয়! তারপর স্ত্রী মেয়েকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিত। মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে গভীর কূপের সন্নিকটে দাঁড় করাতো। তারপর বলত, মা! নিচের দিকে তাকাও তো। আর অমনি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত। একবারের জন্যও পেছনে তাকাত না। আহ! আহ![3]
জাহেলী যুগের মানুষ কন্যাসন্তান জীবন্ত প্রোথিত করত। তারা কত পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী ছিল, তাই না? আমার আপনার যুগের মানুষ জাহেলী যুগের মানুষের চেয়ে কম পাষাণ নয়। বরং তারাও তাদের মতো। আমার আপনার যুগের মানুষ শুনতে পেয়েছে হাসপাতালে তার কন্যাসন্তান হয়েছে। রাতের অন্ধকারে, প্রকৃতিতে যখন আঁধার ছেয়ে গেছে তখন মৃদু পায়ে হেঁটে আলগোছে পলিথিনের ভেতরে মুড়িয়ে বাচ্চাকে ডাস্টবিনে ফেলে এসেছে। পরে রাস্তার কুকুর যখন ওই শিশুকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে তখন মানুষ টের পেয়েছে। বিষয়টা কি আপনার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে? আমরা কোনো আজগুবি কথা বলছি না। আপনি পেপার-পত্রিকার পাতায় চোখ রাখুন, তাহলে দেখতে পাবেন।
সাত মাস হয়েছে। এরপর আল্ট্রাসনোগ্ৰাফি করার পর জানা গেছে মেয়ে বাচ্চা হবে। পেটের ভেতর রেখেই এই শিশুকে মেরে ফেলেছে। প্রিয় ভাই! এই শিশু যদি পরকালে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করেছেন, আপনি কি তার উত্তর দিতে পারবেন? আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ - بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ﴾ ‘সেদিন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাশিশুকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে’ (আত-তাকভীর, ৮১/৮-৯)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوقَ الأُمَّهَاتِ، وَوَأْدَ الْبَنَاتِ وَمَنَعَ وَهَاتِ، وَكَرِهَ لَكُمْ قِيلَ وَقَالَ، وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মায়ের নাফরমানী করা, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা, কারো প্রাপ্য না দেওয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেওয়া আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্য ব্যয়, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা এবং মাল বিনষ্ট করা’।[4]
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ঔষধ খেয়ে কত সন্তান যে বর্তমানে নষ্ট হচ্ছে তা আল্লাহ মা‘লূম। এর সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহ তাআলা জানেন। অনেক মানুষ দরিদ্রতার ভয়ে অথবা জায়গা-জমিন স্বল্প থাকার দরুন গর্ভেই সন্তান হত্যা করে! তারা কাবীরা গুনাহ করছে। এটা যে কত জঘন্য পাপ তারা যদি জানত! মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا ‘দরিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা করবে না। আমরা তাদের ও তোমাদের জীবিকা দিব। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ’ (বনী ইসরাঈল,১৭/৩১)।
আল্লাহ তাআলা এই পৃথিবীর বুকে যা কিছু আছে, সব আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রত্যেকটা সৃষ্টিজীবকে জীবিকা দান করেন। আমাদের কি তিনি দেবেন না?
আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا﴾ ‘পৃথিবীর বুকে যত প্রাণী আছে, সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর উপর ন্যস্ত’ (হূদ, ১১/৬)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَكَأَيِّنْ مِنْ دَابَّةٍ لَا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللَّهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾ ‘কত প্রাণী আছে তাদের জীবিকা বহন (জমা) করে না। আল্লাহ তাদের ও তোমাদের জীবিকা দিয়ে থাকেন। তিনি সর্বশ্রোতা, সবকিছু জানেন’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৬০)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا تُرْزَقُ الطَّيْرُ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا ‘তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভরশীল হতে, তাহলে পাখিদের যেভাবে রিযিক্ব দেওয়া হয়, সেভাবে তোমাদেরকেও রিযিক্ব দেওয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যাবেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে’।[5]
এই পৃথিবীতে আপনার যেমন বাঁচার অধিকার আছে, ওই শিশুটারও বাঁচার অধিকার আছে। আপনি কেন বলপ্রয়োগ করে তাকে হত্যা করছেন? এই মুখ নিয়ে কি আল্লাহর কাছে দাঁড়াতে পারবেন? আমি আপনি যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখনই আমরা পৃথিবীতে কতটুকু রিযিক্ব পাব তা লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। সেখানে যে পরিমাণ লেখা আছে, তার চেয়ে বিন্দু পরিমাণ কমও পাবেন না আবার বেশিও পাবেন না। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ثُمَّ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ يَبْعَثُ اللهُ مَلَكًا فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعٍ بِرِزْقِهِ وَأَجَلِهِ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ فَوَاللهِ إِنَّ أَحَدَكُمْ أَوْ الرَّجُلَ يَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا غَيْرُ بَاعٍ أَوْ ذِرَاعٍ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيَدْخُلُهَا وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا غَيْرُ ذِرَاعٍ أَوْ ذِرَاعَيْنِ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ فَيَدْخُلُهَا.
‘তোমাদের প্রত্যেকেই আপন আপন মাতৃগর্ভে ৪০ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা থাকে। তারপর ওই রকম ৪০ দিন রক্তপিণ্ড, তারপর ওই রকম ৪০ দিন গোশতপিণ্ডাকারে থাকে। তারপর আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিযিক্ব, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য— এ চারটি বিষয় লেখার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের মাঝে যে কেউ অথবা বলেছেন, কোনো ব্যক্তি জাহান্নামীদের আমল করতে থাকে। এমনকি তার ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক হাত বা এক গজের তফাত থাকে। এমন সময় তাক্বদীর তার ওপর প্রাধান্য লাভ করে আর তখন সে জান্নাতীদের আমল করা শুরু করে দেয়। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি জান্নাতীদের আমল করতে থাকে। এমন কি তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত বা দুহাত তফাত থাকে। এমন সময় তাক্বদীর তার উপর প্রাধান্য লাভ করে আর অমনি সে জাহান্নামীদের আমল শুরু করে দেয়। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে’।[6]
একটা লোক তিন দিন পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল। বিছানায় তার নিথর দেহটা পড়ে ছিল। তিন দিন পর দ্বিপহরের সময় হঠাৎ লোকটা বিছানা থেকে উঠে পড়ে। তারপর বাহিরে গিয়ে তিন চক্কর পায়চারি করে ঘরে প্রবেশ করে। টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি পান করে ধপাস করে বিছানায় পড়ে যায়। আর ওই মুহূর্তে সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনা থেকে আপনি কী বুঝতে পারলেন? মানে এখনো তার পৃথিবীতে তিন চক্কর পায়চারির বাকি ছিল ও এক গ্লাস পানি পান করার বাকি ছিল। তার এক গ্লাস পানি রিযিক্ব বাকি ছিল বিধায় তার মৃত্যু হয়নি। আপনার জন্য যে রিযিক্ব বরাদ্দ আছে তা না খেয়ে আপনারও মৃত্যু হবে না।
এক প্রতিবন্ধীকে দেখেছি তিন তলা বিল্ডিংয়ের মালিক। আশ্চর্যের বিষয়! সে কীভাবে তিন তলার মালিক হলো! তার ভাগ্যে তার রিযিক্বে আছে তাই সে এর মালিক হয়েছে। তাই রিযিক্ব নিয়ে কখনো টেনশন করবেন না। আপনি কি শয়তানের কাছে পরাভূত হবেন? তাহলে কোনো অবস্থাতেই রিযিক্বের চিন্তায় জাহেলী যুগের মানুষের ন্যায় কন্যাসন্তান হত্যা করবেন না। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
সাঈদুর রহমান
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৬৬৯, হাদীছ ছহীহ।
[2]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৬৭০, হাসান।
[3]. ফাতহুল বারী, হা/৫৯৭৫, ১৩/৪২১-৪২২।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪০৮।
[5]. তিরমিযী, হা/২৩৪৪, হাদীছ ছহীহ।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৩২।