কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

অহির বাস্তবতা বিশ্লেষণ (৭ম পর্ব)

[যে হাদীছের ব্যাখ্যা চলছে : ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু বুকায়র হাদীছ শুনিয়েছেন; তিনি বলেন, তাকে লায়ছ হাদীছ শুনিয়েছেন; তিনি বলেন, তাকে উকায়ল হাদীছ শুনিয়েছেন; তিনি ইবনু শিহাব থেকে, তিনি উরওয়া ইবনু যুবায়ের থেকে, তিনি আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে, তিনি বলেন, সর্বপ্রথম সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অহির আগমন শুরু হয়। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন না কেন সেই স্বপ্ন সকালের মতো তার সামনে সত্যরূপে প্রকাশিত হতো। অতঃপর তার কাছে একাকিত্ব ভালো লাগতে লাগল। তিনি হেরা গুহায় একাকী থাকতেন এবং রাত্রিকালীন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন- যতক্ষণ না পরিবারের কাছে ফিরে প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার প্রয়োজন না হতো। অতঃপর তিনি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট ফিরে আসতেন তিনি তার জন্য অনুরূপ পাথেয় প্রস্তুত করে দিতেন। এভাবেই তার নিকট একদিন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অহি চলে আসে এমতাবস্থায় তিনি হেরা গুহায় ছিলেন। ফেরেশতা তার নিকটে এসে তাকে বললেন, পডুন! তিনি বললেন, আমি পড়া জানি না। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ফেরেশতা আমাকে ধরলেন এবং চাপ দিলেন। পুনরায় বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি পড়া জানি না। ফেরেশতা আমাকে পুনরায় ধরলেন এবং চাপ দিলেন অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, পড়ুন! আমি বললাম, আমি পড়া জানি না। তিনি আমাকে আবারও সজোরে চাপ দিলেন অতঃপর তিনি বললেন, ‘পড়ুন! আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাটবাধা রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন। পড়ুন! আর আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত’।

এই আয়াতগুলো নিয়ে আল্লাহর রাসূল ফিরে আসলেন এমতাবস্থায় তার বুক ধড়ফড় করছিল। তিনি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকটে আসলেন এবং বললেন, আমাকে চাদর দাও! চাদর দিয়ে ঢেকে দাও! অতঃপর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর তার ভয় কেটে গেলে খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে তিনি পুরো ঘটনা জানালেন এবং বললেন, আমি আমার জীবনের ভয় পাচ্ছি। তখন খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আল্লাহর কসম! কখনোই নয়! মহান আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দুর্বলের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের সম্মান করেন, বিপদ-আপদে মানুষকে সাহায্য করেন। অতঃপর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে সাথে করে নিয়ে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেলের নিকট নিয়ে গেলেন। যিনি জাহেলী যুগে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি হিব্রু ভাষায় বই লিখতেন। তিনি ইঞ্জীল গ্রন্থকে হিব্রু ভাষায় যতদূর আল্লাহ তাওফীক্ব দিয়েছিলেন লিখেছিলেন। তিনি একজন বৃদ্ধ ও অন্ধ মানুষ ছিলেন। খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে বললেন, হে আমার চাচার ছেলে! আপনার ভাইয়ের ছেলে কী বলে শুনুন! তখন ওয়ারাক্বা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, আপনি কী দেখেছেন? রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখেছিলেন তাকে তা জানালেন। অতঃপর ওয়ারাক্বা বললেন, ইনিই সেই ‘নামূস’ যাকে মহান আল্লাহ মূসার নিকট পাঠিয়েছিলেন। হায়! আমি যদি সেদিন বেঁচে থাকতাম যেদিন তোমার জাতি তোমাকে বের করে দিবে! তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সত্যিই কি আমার জাতি আমাকে বের করে দিবে? হ্যাঁ, ইতোপূর্বে কোনো ব্যক্তির নিকটে এই লোক প্রেরিত হয়েছেন আর তাকে তার জাতি বের করে দেয়নি এমনটা হয়নি। তবে তোমার সাথে যেদিন এমন ঘটবে সেদিন যদি আমি বেঁচে থাকি আমি তোমাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাক্বা রযিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। আর অহি স্থগিত হয়ে যায়।

আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ ও আবূ ছালেহ রহিমাহুল্লাহ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হেলাল ইবনু রাদদাদ রহিমাহুল্লাহ যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইউনুস ও মামার রহিমাহুমাল্লাহفؤادهএর স্থলে بَوَادِرُهُশব্দ উল্লেখ করেছেন।]

হাদীছে বর্ণিত খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ রযিয়াল্লাহু আনহা-এর পরিচিতি :

জন্ম ও বেড়ে উঠা : খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা হিজরতের ৬৮ বছর পূর্বে মক্কায় সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা পূর্ব থেকেই জাহেলী যুগের নিকৃষ্ট কৃষ্টি-কালচার থেকে পবিত্র ছিলেন। এই জন্য তাকে ত্বহেরা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।

তার পূর্ববর্তী স্বামী-সন্তানগণের বর্ণনা : বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী তার প্রথম স্বামী ছিলেন আতীক্ব ইবনু আয়েয আল-মাখযূমী। এই মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন ইমাম যুহরী, ইমাম ইবনু কাছীর ও ইমাম নববী রহিমাহুমুল্লাহসহ প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ।[1]

প্রথম স্বামীর পক্ষ থেকে খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর গর্ভে একজন মেয়ে সন্তান হিন্দা বিনতে আতিক্ব জন্মগ্রহণ করে। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আবূ হালা ইবনু যুরারা আত-তামিমীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় স্বামীর নিকট থেকে তার দুটি সন্তানের জন্ম হয় হিন্দ ও হালা। ইবনু সা‘দের মতে, হালা ছোটতেই ইন্তেকাল করেন। অন্যদিকে কারও মতে, হালা বড় হয়ে ইসলাম পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ-এর মতে, এটা তাদের ভুল ধারণা। বরং ইসলাম গ্রহণ এবং ছাহাবী হওয়ার বিষয়ে যে হালার নাম পাওয়া যায় তিনি মূলত খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর বোন হালা বিনতে খুওয়ালিদ।[2]

যাহোক, হিন্দা বিনতে আতীক্ব এবং হিন্দ ইবনু আবূ হালা উভয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তথা বুঝা যায় হিন্দ নামটা ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্য ব্যবহার হয়। তন্মধ্যে হিন্দ ইবনু আবি হালা অনেক উঁচু মানের আরবী সাহিত্যিক ছিলেন। আরবী ভাষায় তার বালাগাত ও ফাছাহাতের প্রমাণ হিসেবে তার বলা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শারীরিক বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত প্রশংসা রচনা যথেষ্ট। যা ইমাম তিরমিযী তার শামায়েলে মুহাম্মাদীতে উল্লেখ করেছেন।[3] তিনি উষ্ট্রের যুদ্ধে নিহত হন। আর হিন্দা বিনতে আতীক্ব তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে তার থেকে কোনো হাদীছ বর্ণিত পাওয়া যায় না। তিনি তার চাচাতো ভাই সায়ফী ইবনু উমাইয়্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তার বিবাহ : তিনি মক্কার প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি সবসময় আমানতদার ব্যক্তিদেরকে তার ব্যবসার দায়িত্ব দিতেন। যখন তার নিকটে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সততার সংবাদ পৌঁছে তখন তিনি তাকে ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে সিরিয়া পাঠান। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক সফলতার সাথে এবং অনেক অতিরিক্তি লাভের সাথে সিরিয়া থেকে ফিরে আসেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমানতদারিতা, সততা এবং তার হাতের বরকত দেখে খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তাকে বিবাহের প্রস্তাব প্রদান করেন। তার সাথে যখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবাহ হয় তখন তার বয়স ৪০, আর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স ছিল ২৫। খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম স্ত্রী। তার বিপদে-আপদে সর্বদা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন, দিযেছেন উৎসাহ ও সাহস। আর্থিক ও মানসিক সকলভাবে তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর একজন উৎসর্গীকৃত সহযোগী ছিলেন। তার মৃত্যুর পরও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ভুলতে পারেননি। এই জন্য তিনি তার স্মৃতিচারণের জন্য তার বান্ধবীদের মধ্যে হাদিয়া পাঠাতেন। তার প্রতি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসার মাত্রা এত বেশি ছিল যে, আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা একমাত্র তার এই মৃত স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষা রাখতেন।

খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর মর্যাদা :

(১) ইবরাহীম ব্যতীত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল সন্তান তার গর্ভ থেকে এসেছে। তার গর্ভে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তানগণের নামসমূহ— কাসেম ইবনু মুহাম্মাদ, আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ, উম্মে কুলছূম, ফাতেমা, যায়নাব, রুকাইয়্যা।

(২) তার জীবদ্দশায় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে বিবাহ করেননি।

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ لَمْ يَتَزَوَّجِ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى خَدِيجَةَ حَتَّى مَاتَتْ.

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর মৃত্যুপর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি।[4]

(৩) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি প্রথম ঈমান আনয়নকারী তিনিই ছিলেন। যার প্রমাণ আমাদের আলোচিত হাদীছ।

(৪) তাকে মহান আল্লাহর সালাম।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ t قَالَ أَتَى جِبْرِيلُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذِهِ خَدِيجَةُ قَدْ أَتَتْ مَعَهَا إِنَاءٌ فِيهِ إِدَامٌ أَوْ طَعَامٌ أَوْ شَرَابٌ فَإِذَا هِيَ أَتَتْكَ فَاقْرَأْ عَلَيْهَا السَّلاَمَ مِنْ رَبِّهَا وَمِنِّي وَبَشِّرْهَا بِبَيْتٍ فِي الجَنَّةِ مِنْ قَصَبٍ لاَ صَخَبَ فِيهِ وَلاَ نَصَبَ.

আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা জিবরীল নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে আসলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই যে খাদীজা তার পাত্রে তরিতরকারী, পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসছে। যখন সে আপনার নিকটে পৌঁছে তখন আপনি তাকে তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছে দিবেন। আর তাকে সুসংবাদ দিবেন জান্নাতে এমন একটি ঘরের যেখানে কোনো হৈ চৈ থাকবে না।[5]

(৫) জান্নাতের শ্রেষ্ঠ মহিলা।

عَنْ عِكْرِمَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ خَطَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ خُطُوْطٍ قَالَ تَدْرُونَ مَا هَذَا؟ فَقَالُوا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ وَمَرْيَمُ ابْنَةُ عِمْرَانَ.

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটিতে চারটি দাগ কাটলেন। অতঃপর ছাহাবীগণকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো এই চারটি দাগ কী? তারা উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয় জান্নাতের সর্বোত্তম নারী হচ্ছে চার জন— খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, আসিয়া বিনতে মুযাহিম ফেরাউনের স্ত্রী এবং মারইয়াম বিনতে ইমরান।[6]

(৬) তার প্রতি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অগাধ ভালোবাসা।

عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ مَا غِرْتُ عَلَى نِسَاءِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا عَلَى خَدِيجَةَ وَإِنِّي لَمْ أُدْرِكْهَا قَالَتْ وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا ذَبَحَ الشَّاةَ، فَيَقُولُ أَرْسِلُوا بِهَا إِلَى أَصْدِقَاءِ خَدِيجَةَ قَالَتْ فَأَغْضَبْتُهُ يَوْمًا فَقُلْتُ خَدِيجَةَ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنِّي قَدْ رُزِقْتُ حُبَّهَا.

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো স্ত্রীর সাথে ঈর্ষা করতাম না, তবে খাদীজা ব্যতীত অথচ আমি তাকে তার জীবদ্দশায় পাইনি। তিনি বলেন, যখনই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ছাগল যবেহ করতেন তখনই তিনি বলতেন, কিছু গোশত খাদীজার বান্ধবীদের কাছে পাঠাও। একদিন আমি তাকে খাদীজার নাম নিয়ে রাগালাম। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয় তার ভালোবাসা আমার অন্তরে ঢেলে দেওয়া হয়েছে।[7]

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا ذَكَرَ خَدِيجَةَ أَثْنَى عَلَيْهَا فَأَحْسَنَ الثَّنَاءَ قَالَتْ فَغِرْتُ يَوْمًا فَقُلْتُ مَا أَكْثَرَ مَا تَذْكُرُهَا حَمْرَاءَ الشِّدْقِ قَدْ أَبْدَلَكَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ بِهَا خَيْرًا مِنْهَا قَالَ مَا أَبْدَلَنِي اللهُ عَزَّ وَجَلَّ خَيْرًا مِنْهَا قَدْ آمَنَتْ بِي إِذْ كَفَرَ بِي النَّاسُ وَصَدَّقَتْنِي إِذْ كَذَّبَنِي النَّاسُ وَوَاسَتْنِي بِمَالِهَا إِذْ حَرَمَنِي النَّاسُ وَرَزَقَنِي اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَلَدَهَا إِذْ حَرَمَنِي أَوْلَادَ النِّسَاءِ.

আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখনই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার কথা বলতেন তখনই তার অনেক প্রশংসা করতেন। এই রকম একদিন প্রশংসা করলে আমি বললাম, আপনি একজন প্রৌঢ় মহিলার কথা কেন এত বেশি বলেন অথচ মহান আল্লাহ আপনাকে তার চেয়ে উত্তম (কুমারী) দান করেছেন। উত্তরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহান আল্লাহ আমাকে তার চেয়ে উত্তম কাউকে প্রদান করেননি। তিনি তখন আমাকে বিশ্বাস করেছেন যখন মানুষ কুফরী করেছে। তিনি তখন আমাকে সত্যায়ন করেছেন যখন মানুষ মিথ্যারোপ করেছে। তিনি তখন আমাকে তার ধনসম্পদ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন যখন মানুষ আমাকে বঞ্চিত করেছে। আর মহান আল্লাহ আমাকে সন্তান তার গর্ভেই দান করেছেন যখন অন্য স্ত্রীদের থেকে তিনি বঞ্চিত রেখেছেন।[8] শুআইব আল-আরনাউত হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।[9]

উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী পরিমাণ খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে স্মরণ করতেন যে তার অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তার বিষয়ে আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর ঈর্ষা হতো।

খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর প্রতি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসার প্রমাণস্বরূপ আরও একটি ঘটনা উল্লেখ্য। বদরের যুদ্ধে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেয়ে যায়নাবের জামাই আবুল ‘আস এর মুক্তিপণস্বরূপ একটি হার রাখা হয়। হারটি খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা তার মেয়ে যায়নাবের বিয়েতে তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর ব্যবহৃত হার দেখে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটা আবেগে-আপ্লুত হয়ে পড়েন যে, তার চোখে পানি চলে আসে। তখন তিনি ছাহাবীদের অনুমতিক্রমে বিনা মুক্তিপণে তার জামাইকে মুক্তি দেন। যাতে করে খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা-এর ব্যবহৃত হারটি তার মেয়ে যায়নাবের নিকট থেকে যায়।[10]

মৃত্যু : নবুঅতের দশম বছরে চাচা আবূ তালেবের মৃত্যুর কিছু দিন পর খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা মৃত্যুবরণ করেন। মাথার উপর থেকে একসাথে একই বছরে চাচা ও স্ত্রীর ছায়া সরে যাওয়াতে যে পরিমাণ কষ্ট রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেয়েছিলেন তা আর কখনো পাননি। এই জন্য এই বছরকে আমুল হুযন বা কষ্টের বছর বলা হয়।

হাদীছে বর্ণিত ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেলের পরিচিতি : জাহেলী যুগে চার জন ব্যক্তি ছিল যারা মূর্তিপূজা করতে অস্বীকার করেছিলেন। তারা হলেন— ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল, ওবাইদুল্লাহ ইবনু জাহশ, উছমান ইবনু হুয়াইরিছ, যায়েদ ইবনু আমর ইবনু নুফায়েল।[11]

আসাদ ইবনু আব্দুল উযযার দুই সন্তান নওফেল ও খুওয়াইলেদ। খুওয়াইলেদের মেয়ে হচ্ছে খাদীজা আর নওফেলের সন্তান হচ্ছে ওয়ারাক্বা। তথা খাদীজা রযিয়াল্লাহু আনহা ও ওয়ারাক্বা নিজ চাচাতো ভাই। কুসাইয়ের স্তরে গিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাদের বংশনামা মিলে যায়। কুসাইয়ের দুই সন্তান একজন আব্দুল উযযা আরেকজন আবদে মানাফ। ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল ইবনু আসাদ ইবনু আবদিল উযযা ইবনু কুসাই। অন্যদিকে মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব ইবনু হাশেম ইবনু আবদে মানাফ ইবনু কুসাই। সেই সূত্রে ওয়ারাক্বা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা হচ্ছেন। ওয়ারাক্বার বিষয়ে হাদীছে যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তাতে বুঝা যায় তিনি জাহেলী যুগে মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত হয়ে নাছারা তথা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর দ্বীন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইঞ্জীলের ভাষা ইবরানী জানতেন এবং ইবরানী থেকে ইঞ্জীলকে আরবীতে অনুবাদ করে জনগণের মাঝে প্রচার করতেন।

কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর :

ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল কি ছাহাবী?

ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল ছাহাবী হওয়া নিয়ে মুহাদ্দিছগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম ত্ববারী, বাগাভী, ইবনু কানি, ইবনুস সাকান প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ তাকে ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেন।[12]

অন্যদিকে হাফেয ইবনু কাছীর, ইমাম যাহাবী ও হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ মুহাদ্দিছগণ তাকে ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেননি।[13]

ছাহাবী না হওয়ার দলীল : যাদের মতে তিনি ছাহাবী নন তাদের দলীল হচ্ছে, ওয়ারাক্বা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুঅতের প্রকাশ্য ঘোষণার পূর্বেই মারা গেছেন। ফলত তাকে নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ তিনি পাননি।

ছাহাবী হওয়ার দলীল : যারা তাকে ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেছেন। তাদের দলীল— রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لاتسبوا ورقة فاني رأيت له جنة أو جنتين ‘তোমরা ওয়ারাক্বার বিষয়ে কোনো খারাপ মন্তব্য করো না; আমি তাকে জান্নাতে দেখেছি’।[14] আর মুরসাল সূত্রে একটি হাদীছ পাওয়া যায় যা দলীল হিসেবে নয়, তবে এই ছহীহ হাদীছের ব্যাখ্যা হিসেবে পেশ করা যায়।

عن عروة بن الزبير سئل رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عن ورقة بن نوفل كما بلغنا فقال قد رأيته في المنام عليه ثياب بيض فقد أظن أن لو كان من أهل النار لم أر عليه البياض.

উরওয়া ইবনু যুবায়ের রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি তার গায়ে সাদা কাপড় ছিল। আর আমার ধারণা হচ্ছে যদি সে জাহান্নামী হতো তাহলে তার গায়ে সাদা কাপড় দেখা যেত না’।[15]

আমার মন্তব্য : আমার কাছে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয়েছে, ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল ছাহাবী ছিলেন কিনা তা জানা আমাদের জন্য অত বেশি জরুরী নয়। আর তার থেকে কোনো হাদীছও আমাদের নিকট বর্ণিত হয়নি। সুতরাং এতটুকু জানাই আমাদের জন্য যথেষ্ট যে, তিনি জান্নাতী। তার এই জান্নাতে ঈসায়ী ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার কারণেও হতে পারে আবার ছাহাবী হওয়ার কারণেও হতে পারে। ওয়াল্লাহু আ‘লাম বিছ ছওয়াব।

ওয়ারাক্বা নাছারা হওয়ার পরও কেন ঈসা আলাইহিস সালাম-এর নাম নিলেন না?

ওয়ারাক্বা নামূস ফেরেশতা তথা জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর বর্ণনা দিয়ে বললেন যে, ইনিই তিনি যাকে মহান আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট পাঠিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু তিনি ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের অনুসারী ছিলেন সেহেতু স্বভাবতই তার বলার কথা যে, ইনিই তিনি যাকে মহান আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালাম-এর নিকটে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ঈসা আলাইহিস সালাম-এর নাম না নিয়ে কেন মূসা আলাইহিস সালাম-এর নাম নিলেন। তার উত্তরে মুহাদ্দিছগণ বলেছেন, বানূ ইসরাঈলের মূল ও প্রধান নবী হচ্ছেন মূসা আলাইহিস সালাম। পরবর্তীতে যারা প্রেরিত হয়েছেন তারা নতুন কোনো দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হননি বরং তাওরাতের কিছু সামান্য বিধি-বিধানের পরিবর্তন-পরিবর্ধন নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। ঠিক তেমনি ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ইঞ্জীল মৌলিক কোনো গ্রন্থ ছিল না। বরং তাওরাতের পূর্ণতাদানকারী গ্রন্থ ছিল। তথা বানূ ইসরঈলের প্রথম নবী মূসা আলাইহিস সালাম ও শেষ নবী ঈসা আলাইহিস সালাম। এইজন্য প্রথম বা মূল নবীর নাম নিয়েছেন ওয়ারাক্বা ইবনু নওফেল।[16]

সীরাত ইবনু হিশামের ব্যাখ্যাকার আর-রওযুল আনফের লেখক সুহাইলি বলেন, যেহেতু নাছারাগণ ঈসা আলাইহিস সালাম-কে মহান আল্লাহর সন্তান মনে করত (নাঊযুবিল্লাহ) সেহেতু তার নিকটে অহি আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কেননা সন্তানের সাথে পিতার কথা বলতে কোনো মাধ্যম লাগে না। এই জন্য ওয়ারাক্বা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর নাম নেননি বরং মূসা আলাইহিস সালাম-এর নাম নিয়েছেন।[17] হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী রহিমাহুল্লাহ প্রথম ব্যাখ্যাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।[18]

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

(মিন্নাতুল বারী- ১৪তম পর্ব)

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; এম. এ. (অধ্যয়নরত), উলূমুল হাদীছ বিভাগ,
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।



[1]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/২০৫-২০৬।

[2]. ফাতহুল বারী, ৭/১৪০।

[3]. শামায়েলে তিরমিযী, হা/৮, ২২৬, ৩১৯।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৬।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮২০।

[6]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৬৮।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮২০।

[8]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৮৬৪।

[9]. প্রাগুক্ত।

[10]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৩৬২।

[11]. আর-রওযুল আনফ, ২/৩৪৭।

[12]. আল-ইসাবা, ৬/৬০৭; আল-আলাম, যিরিকলী, ৮/১১৫।

[13]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/২৫; সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১/১২৯।

[14]. সিলসিলা ছহীহা, হা/৪০৫।

[15]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/৯৭১৯।

[16]. ফাতহুল বারী, ১/৭।

[17]. প্রাগুক্ত।

[18]. প্রাগুক্ত।

Magazine