কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মুসলিমদের প্রযুক্তিগত পুনর্জাগরণ: সময়ের অপরিহার্য দাবি

post title will place here

ভূমিকা: মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকা শক্তি হলো প্রযুক্তি। আজকের বিশ্বে যে জাতি প্রযুক্তিতে এগিয়ে, সেই জাতিই বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একসময় মুসলিমরা ছিল প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎ। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে, যা অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে আমাদের দুর্বল করে তুলেছে।

এই প্রবন্ধে আমরা মুসলিম বিশ্বের প্রযুক্তিগত অবস্থার বিশ্লেষণ করব, পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজে দেখব এবং কীভাবে আমরা আবারও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারি, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা তুলে ধরব।

মুসলিমদের স্বর্ণযুগ- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়:

ইসলাম বরাবরই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। কুরআনের প্রথম নাযিল হওয়া আয়াতেই বলা হয়েছে—

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

‘পড়ুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আল-আলাক্ব, ৯৬/১)। এই আয়াতটি শুধু ধর্মীয় জ্ঞানের কথা বলে না; বরং এর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

খলীফা হারুন অর-রশিদ ও আল-মামুনের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত ‘বায়তুল হিকমা’ ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গবেষণা কেন্দ্র। এখানে গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৌশলসহ বিভিন্ন শাখার গবেষণা চলত।

মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন[1]:

ইবনে সিনা (Avicenna): আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক। তার লেখা ‘আল কানূন ফিত তিব্ব’ (The Canon of Medicine) শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের মেডিকেল স্কুলে পড়ানো হতো।

আল-খাওয়ারিজমি: ‘অ্যালগরিদম’ শব্দটি এসেছে তার নাম থেকে। তিনি আধুনিক গণিতের ভিত্তি স্থাপন করেছেন।

ইবনে হাইছাম: আলোকবিজ্ঞান (Optics) এবং ক্যামেরার মূল ধারণা তার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।

আল-বিরুনী: ভূবিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যায় অসাধারণ অবদান রেখেছেন।

এসব মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি সম্ভব হতো না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আজ আমরা কোথায়?

মুসলিম বিশ্ব কেনো প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়েছে?

(১) গবেষণায় বিনিয়োগের অভাব: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের জন্য গবেষণা (R&D) অপরিহার্য। পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে তাদের GDP-এর ২-৪% গবেষণায় ব্যয় করে, সেখানে মুসলিম দেশগুলোর বেশিরভাগই ১%-এর নিচে বিনিয়োগ করে।

(২) প্রযুক্তি আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা: আমরা কম্পিউটার, স্মার্টফোন, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম সবকিছুই বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে আমাদের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে।

(৩) শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা: STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) শিক্ষার প্রতি মুসলিম দেশগুলোতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না।

(৪) রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট: অনেক মুসলিম দেশ রাজনৈতিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ব্যস্ত, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পরিকল্পনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রযুক্তিতে অগ্রসর হওয়া কেনো জরুরী?

(১) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন: বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি-ভিত্তিক। যেমন- গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, টেসলা। যদি মুসলিম বিশ্ব প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে পারে, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারবে।

(২) প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: ড্রোন প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামI), সাইবার সিকিউরিটি এবং মহাকাশ গবেষণায় পিছিয়ে থাকলে মুসলিম বিশ্ব সবসময় নিরাপত্তাহীন থাকবে।

(৩) তথ্য ও মিডিয়া দখলে রাখা: গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া তথ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। মুসলিমদের নিজেদের মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে পারে।

(৪) আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া: বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। মুসলিম দেশগুলোকে উন্নত গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

মুসলিমদের প্রযুক্তিগত পুনর্জাগরণ কীভাবে সম্ভব?

(১) প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার: স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার পাঠ্যক্রমে কম্পিউটার বিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ব্লকচেইন, রোবোটিক্স, কোডিং অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অনলাইন ও অফলাইনে প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে।

(২) গবেষণা ও উদ্ভাবনে তহবিল বৃদ্ধি: প্রতিটি মুসলিম দেশকে GDP-এর কমপক্ষে ২-৫% গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে এবং মুসলিম বিশ্বে যৌথ গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

(৩) নিজস্ব প্রযুক্তি কোম্পানি গড়ে তোলা: গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনের বিকল্প মুসলিম কোম্পানি গড়ে তুলতে হবে এবং সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং সাইবার সিকিউরিটিতে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

(৪) মুসলিম দেশগুলোর প্রযুক্তিগত সংযোগ বৃদ্ধি: ওআইসি (OIC) ভুক্ত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং মুসলিম উদ্যোক্তাদের জন্য ফান্ডিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার তৈরি করতে হবে।

উপসংহার: প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ছাড়া মুসলিম বিশ্ব কখনোই প্রকৃত অর্থে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে না। এটি কেবল অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তির বিষয় নয়, বরং এটি জাতির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। আমরা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই এবং গবেষণায় বিনিয়োগ করি, তাহলে আবারও মুসলিমরা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের শীর্ষস্থান দখল করতে পারবে ইনশা-আল্লাহ। সময় এসেছে নিজেদের পরিবর্তন করার, প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং মুসলিম বিশ্বকে আত্মনির্ভরশীল করার।

আমরা কি আবারও বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত? সিদ্ধান্ত আমাদের হাতেই।

আবু হিসান নাঈম

শিক্ষক, মাদরাসা মিনওয়ালিল অহী, চৌধুরীপাড়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. এখানে সবার আক্বীদা-বিশ্বাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি।

Magazine