কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বিদআতী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে দান-ছাদাক্বা করা প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে?

post title will place here

‘ছাদাক্বা’ শব্দটি আরবী, মূল শব্দ ‘ছিদক্ব’ (صدق) থেকে এসেছে, যার অর্থ আন্তরিকতা; এটি আন্তরিক বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শব্দটি তিন অক্ষরের মূল (ص د ق) থেকে এসেছে, যার অর্থ সত্য কথা বলা, আন্তরিক হওয়া এবং কারো প্রতিশ্রুতি পালন করা। ছাদাক্বার আক্ষরিক অর্থ ন্যায়পরায়ণতা এবং এটি দান বা স্বেচ্ছাসেবী দানকে বুঝায়। তবে ইসলামী পরিভাষায় ছাদাক্বাকে বিনিময়ে কোনো কিছু না চেয়ে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে কাউকে কিছু দেওয়া বুঝানো হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,تَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা নেকী ও কল্যাণের কাজে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করো, গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না’ (আল-মায়েদা, ৫/২)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করবে বা কোনো নবাবিষ্কারকারীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিবে অর্থাৎ কেউ যদি বিদআত করে, কোনো বিদআতীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, বিদআতের প্রচার-প্রসারে সহযোগিতা করে, তাহলে তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের লা‘নত। তার ফরয ইবাদত বা তওবা, নফল ইবাদত বা ফিদইয়া কোনো কিছুই কবুল করা হবে না...’।[1] এ প্রসঙ্গে ইমাম আওযাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আলেম বলেছেন, বিদআতীর ছালাত, ছিয়াম, ছাদাক্বা, জিহাদ, হজ্জ, উমরা, কোনো ফরয ইবাদত বা তওবা, নফল ইবাদত বা ফিদইয়া গ্রহণযোগ্য হবে না। অনুরূপ কথা হিশাম ইবনু হাসসান রহিমাহুল্লাহও বলেছেন।

সুতরাং কোনো প্রকার বিদআতী কাজে সহযোগিতা করা যাবে না। বিদআতীকে আশ্রয় দেওয়াও বড় অপরাধ। ফলে যেখানে কোনো গুনাহ হয়, সেখানে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা যাবে না। আর শিরক-বিদআত যেহেতু সবচেয়ে বড় অপরাধ, সেহেতু এজন্য কোনো সহযোগিতা করাও বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

মহান আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা ইসলামের মহান একটি মূলনীতি। এটা ছাড়া কারো ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। মুআয ইবনু আনাস আল-জুহানী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে দান-খায়রাত করে, আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে দান করা হতে নিবৃত্ত থাকে, আল্লাহ তাআলার জন্য ভালোবাসে, আল্লাহ তাআলার জন্যই ঘৃণা করে এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিয়ে প্রদান করে, সে তাঁর ঈমান সুসম্পন্ন করেছে’।[2] এই হাদীছটি প্রমাণ করে যে, দান-ছাদাক্বা হবে একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং তার নির্দেশিত পথে। এর ব্যতিক্রম হলে নেকীর পরিবর্তে গুনাহ হবে।

অপরদিকে আমাদের সকলের জানা অপরিহার্য যে, ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে বড় পাপ, শিরকের পর সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক গুনাহের নাম বিদআত। তাই সব ধরনের বিদআতী আমল বা কার্যক্রম এবং বিদআতী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে সাহায্য ও সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে আক্বীদাগত বিদআতীদের। কারণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদআত, বিদআতী এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে তাঁর উম্মতকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। এমনকি বিদআতীকে আশ্রয় দিতেও নিষেধ করেছেন।

(১) বিদআত করলে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ ‘আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য বল না যে, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে, তারা সফলকাম হবে না’ (আন-নাহল, ১৬/১১৬)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, যারা বিদআত করে, যার কোনো ভিত্তি ইসলামী শরীআতে নেই, তারা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা নিজেদের মনমতো আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হালাল সাব্যস্ত করে এবং আল্লাহর হালালকৃত বস্তুকে হারাম সাব্যস্ত করে।[3] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ সম্পর্কে বিনা ইলমে কথা বলা হারাম কাজসমূহের অন্যতম এবং সবচেয়ে বড় পাপ। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্যারোপ করা হয় এবং এমন কিছুকে তাঁর উপর সাব্যস্ত করা হয়; যা তাঁর জন্য শোভা পায় না, শরীআতে যা সিদ্ধ তা অমান্য করা হয় এবং যা নিষিদ্ধ তা পালন করা হয়, বাতিলকে হক্ব বলা হয় এবং হক্বকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়।[4]

(২) বিদআত করলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর খিয়ানতের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাতেই দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’ (আল-মায়েদা, ৫/৩)

অতএব ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়া সত্ত্বেও যারা ভালো কাজের দোহাই দিয়ে ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন ইবাদতের জন্ম দিয়েছে ও তাকে লালন করছে তাদের ভাবখানা এমন যেন ইসলাম অপূর্ণাঙ্গ। আর এরূপ বিশ্বাস আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর মিথ্যারোপ করার শামিল। ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে বিদআত সৃষ্টি করল এবং তাকে উত্তম মনে করল, সে যেন ধারণা করল যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিসালাতে খিয়ানত করেছেন। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (ইসলাম) পূর্ণাঙ্গ করলাম’ (আল-মায়েদা, ৫/৩)। সুতরাং সে যুগে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে যা দ্বীন হিসেবে গণ্য ছিল না, বর্তমানেও তা দ্বীন হিসেবে পরিগণিত হবে না।[5]

(৩) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ আমাদের এই দ্বীনের অংশ নয় এমন কিছু উদ্ভাবন করলে তা পরিত্যাজ্য-প্রত্যাখ্যাত’। অন্য বর্ণনায় তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনী কাজের মধ্যে এমন বিষয় উদ্ভাবন করে, যা তাতে নেই, তা অগ্রহণযোগ্য’।[6]

(৪) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামদ ও ছালাতের পর আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হলো মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হলো দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হলো ভ্রষ্টতা। এই ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[7]

(৫) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘যে কেউ দ্বীনের ব্যাপারে বিদআত করে কিংবা কোনো বিদআতীকে আশ্রয় দেয় কিংবা সাহায্য করে তার উপর আল্লাহ তাআলার, ফেরেশতাগণের ও সকল মানব জাতির অভিশাপ। তার কোনো ফরয কিংবা নফল ইবাদত গৃহীত হবে না’।[8] তাই বিদআতী কাজে সহযোগিতা করা মহা অন্যায়। আল্লাহ মুমিন ব্যক্তিদেরকে ভালো কাজে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন এবং অন্যায়, অসৎ, হারাম ও বিদআতী কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন।[9]

(৬) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে আরো বলেছেন, ‘আমার পরে তোমাদের যে ব্যক্তি বেঁচে থাকবে সে অনেক মতভেদ দেখবে। এমতাবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে, আমার সুন্নাতকে ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং এ পথ ও পন্থার উপর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে বিদআত সৃষ্টি করা হতে বিরত থাক। কেননা প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা’।[10]

(৭) আনাস রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ اللهَ حَجَرَ التَّوْبَةَ عَنْ كُلِّ صَاحِبِ بِدْعَةٍ ‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বিদআতীকে তওবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন’।[11] সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবলীসের কাছে অন্য যে কোনো পাপের চেয়ে বিদআত অতি প্রিয়। কেননা যে কোনো পাপ থেকে তওবার সুযোগ থাকে। কিন্তু বিদআত থেকে তওবার সুযোগ থাকে না।[12]

(৮) ফুযাইল ইবনু ‘ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি বিদআতীকে সম্মান করল, সে যেন ইসলামকে ধ্বংস করতে সহযোগিতা করল। আর যে ব্যক্তি বিদআতীর সম্মুখে মুচকি হাসল, সে যেন আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যা অবতীর্ণ করেছেন তা অবজ্ঞা করল।[13] আসাদ ইবনু মূসা রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক আসাদ ইবনু ফুরাত রহিমাহুল্লাহ-এর নিকট প্রেরিত একটি পত্রে বলেন, বিদআতীর উপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। সুতরাং তাদের আসরগুলো ভেঙে দাও, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা যেভাবে পরিত্যাগ ও লাঞ্ছিত করেছেন; সেভাবে পরিত্যাগ ও লাঞ্ছিত করো এবং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হেদায়াতপ্রাপ্ত উলামায়ে কেরাম তাদেরকে যেরূপ লাঞ্ছিত করেছেন, তাদেরকেও অনুরূপ লাঞ্ছিত করো।[14] আবূ ক্বিলাবা রহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণিত, একদা তিনি আহলে সুন্নাতের এক ব্যক্তিকে এক বিদআতী লোকের সাথে দেখে তাকে বলেন, তোমার কী হলো, এটা তো ঠাট্টা-বিদ্রুপ এর শামিল।[15]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত যে, কোনো অবস্থাতেই বিদআতীকে বা বিদআতী কার্যক্রমে সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে না। এখন বিদআতী প্রতিষ্ঠানে দান-ছাদাক্বার ক্ষেত্রে করণীয় হলো, যে সকল মসজিদ ও মাদরাসায় বিদআতী কর্মকাণ্ড হয় দেখতে হবে তাদের বিদআত কোন পর্যায়ের। যদি সাধারণ বিদআত অর্থাৎ আমলগত বিদআত হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে তাদেরকে দান-ছাদাক্বা করা নাজায়েয হলেও তাদের একান্ত প্রয়োজন হলে মুসলিম ভাই-বোন হিসেবে উত্তম নছীহার মাধ্যমে দান-ছাদাক্বা করা যেতে পারে। কারণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ এবং এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরের ক্ষতি করা হতে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে’।[16]

এই হাদীছে ‘তিনি তাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন’-একথার ব্যাপারে ইমাম ইবনু কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, একজন মানুষের ক্ষতি হস্তশিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ইত্যাদির ক্ষেত্রে হতে পারে। তাই তার সহবিশ্বাসী তাকে সমর্থন করে এবং তাকে জীবিকা অর্জনে সাহায্য করার চেষ্টা করে। আর যখন সে অনুপস্থিত থাকে তখন তাকে রক্ষা করে।[17]

কিন্তু বিদআত যদি আক্বীদাগত অর্থাৎ শিরক, কুফরী পর্যায়ের হয়, তাহলে সেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসায় কোনো অবস্থাতেই দান-ছাদাক্বা করা যাবে না। কারণ এতে বিদআতের সহযোগিতা করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘন কাজে সহযোগিতা করো না’ (আল-মায়েদা, ৫/২)। জেনে-শুনে বিদআতী আমল করলে সেই আমল কবুল হয় না, যতক্ষণ না সে তওবা করে বিদআত থেকে ফিরে আসে। আলী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, কুরআন এবং এই কাগজে যা আছে তা ব্যতীত আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট হতে আর কিছু লিখে নেইনি। তিনি বলেন, এতে আছে- রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মদীনা হারাম (সম্মানার্থে) আইর হতে ছওর পর্যন্ত। যে তাতে কোনো বিদআত সৃষ্টি করবে অথবা বিদআত সৃষ্টিকারীকে আশ্রয় দিবে, তার উপর আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ এবং মানুষ সকলেরই অভিসম্পাত। তার ফরয বা নফল কিছুই কবুল করা হবে না। সকল মুসলিমের প্রতিশ্রুতি এক, তাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিও তার চেষ্টা করতে পারে। অতএব যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, তার উপর আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ এবং সকল মানুষের লা‘নত; তার ফরয বা নফল কোনোটাই গ্রহণ করা হবে না। আর যে ব্যক্তি নিজের মালিকের অনুমতি ব্যতীত অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে, তার উপর আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ এবং সকল মানুষের লা‘নত; তার ফরয বা নফল কোনোটাই গ্রহণ করা হবে না।[18]

সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ, মুহাদ্দিছ, মুফাসসির ও উছূলবিদ, আশ-শায়খুল আল্লাম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু : ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.) বলেছেন, কিছু বিদআত আছে যার জন্য একজন ব্যক্তিকে মাফ করা যেতে পারে, কিছু বিদআত আছে যা ফিসক্ব (পাপ কাজ) পর্যন্ত পৌঁছে এবং কিছু বিদআত আছে যা কুফর পর্যায়ে পৌঁছে। যারা কুফর বিদআতের অনুসারী তাদের ব্যাপারে, তাদের সাহায্য করা মোটেও জায়েয নয়, যদিও তারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে। কারণ তার কুফরী প্রমাণিত হওয়ার পরেও বিদআতের উপর অটল থাকা মানে হলো তারা মুনাফিক্বদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ বলেন,إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ ‘যখন মুনাফিক্বরা তোমার নিকট আসে, তখন তারা বলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল। আর আল্লাহ জানেন যে, আপনি নিশ্চয় তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিক্বরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (আল-মুনাফিকূন, ৬৩/১)

...তাদের বিদআত প্রতিষ্ঠা বা প্রচারে দান-ছাদাক্বা করা থেকে বিরত রাখতে হবে। যদি এটা জানা যায় বা মনে করা হয় যে, তারা সেই দানের অর্থ তাদের বিদআতকে সমর্থন করার জন্য ব্যবহার করবে এবং তাদের তা করা থেকে বিরত রাখা যাবে না তাহলে তাদের দান করা উচিত নয়। কারণ এটি তাদের পাপের কাজে তাদেরকে সাহায্য করা হবে। আল্লাহ মুমিন ব্যক্তিদেরকে ভালো কাজে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন এবং অন্যায়, অসৎ, হারাম ও বিদআতী কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন।[19]

এখন কেউ যদি না জেনে কোনো আক্বীদাগত বিদআতী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে দান করে তাহলে তার জন্য করণীয় হলো আল্লাহর কাছে উক্ত ভুলের জন্য তওবা করা। এই মর্মে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু : ৭২৮ হি.) ও ইমাম শাত্বেবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, না জেনে বিদআতী প্রতিষ্ঠানে দান করলে এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলার নিকট কঠোরভাবে তওবা করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা খালেছ তওবার মাধ্যমে শিরকের মতো ধ্বংসাত্মক, হত্যার মতো মারাত্মক ও ব্যভিচারের মতো জঘন্য গুনাহকেও ক্ষমা করার ঘোষণা করেছেন। যে ব্যক্তি স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তরে একনিষ্ঠ ও একাগ্রতার সাথে খালেছ তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।[20]

হে আল্লাহ! আমাদেরকে ছহীহ সঠিক বুঝ দান করুন আর আমরা যেন সকল প্রকার বিদআতী আমল, বিদআতী কর্ম আর বিদআতের প্রসারে দান-ছাদাক্বা করা থেকে বিরত থাকতে পারি সে তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

অধ্যাপক ওবায়দুল বারী বিন সিরাজউদ্দিন

পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৭২, ৩১৭৯।

[2]. তিরমিযী, হা/২৫২১, হাসান।

[3]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ২/৫৯১।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ১/৩৭২।

[5]. আশরাফ ইবরাহীম কাতকাত, আল-বুরহানুল মুবীন ফীত তাছাদ্দী লিল বিদঈ ওয়াল আবাতীল, ১/৪২।

[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।

[7]. নাসাঈ হা/১৫৭৮, হাদীছ ছহীহ।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৭০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৭১।

[9]. আল-মায়েদা, ৫/২; তাফসীর ইবনু কাছীর, ২/১২; তাফসীরে কুরতুবী, ৬/৪৬-৪৭।

[10]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৬৯৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; মিশকাত, হা/১৬৫, হাদীছ ছহীহ।

[11]. আহমাদ ইবনুল হুসাইন ইবনু আলী ইবনু মূসা আবী বকর আল-বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, (রিয়াদ : মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), ১২/৫৪, হা/৯০১০।

[12]. আলী ইবনুল জা‘দ ইবনু উবাইদ আবুল হাসান আল-জাওহারী আল-বাগদাদী, মুসনাদু ইবনি জা‘দ, (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতু নাদির, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হি./১৯৯০ খ্রি.), হা/১৮০৯, পৃ. ২৭২।

[13]. কিতাবু শারহিস সুন্নাহ, পৃ. ৬০, আছার নং ১৩০।

[14]. মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াযযাহ আল-কুরতুবী, আল-বিদাঊ ওয়ান নাহিউ আনহা, (কায়রো : দারুস সাফা, ১ম সংস্করণ, ১৪১১ হি./১৯৯০ খ্রি.), পৃ. ১৪।

[15]. আল-ইবানাতু আন শারআতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াতি ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাজমূমাহ, ২/৮৯১।

[16]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯১৮, হাসান।

[17]. আউনুল মা‘বূদ এবং ইসলামী সওয়াল-জবাব, ফতওয়া নং ২১৯৪৪।

[18]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৭২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৭০; মিশকাত, হা/২৭২৮।

[19]. আল-মায়েদা, ৫/২; উছমীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ১/৬৬।

[20]. গিযাউল আলবাব, ২/৫৮১; আল-ই‘তিছাম, ২/২৮১; মাজাল্লাতুল বুহূছিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪/১৮৩-১৮৫।

Magazine