দলীল : ৪
আল্লাহ তাআলা বলেন,لَقَدْ صَدَقَ اللَّهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ آمِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ لَا تَخَافُونَ فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا فَجَعَلَ مِنْ دُونِ ذَلِكَ فَتْحًا قَرِيبًا ‘অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলের স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছেন। আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই তোমরা মাসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে, মস্তকমুণ্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়, (এসময়) তোমরা (কাউকে) ভয় করবে না। তিনি জানেন যা তোমরা জানো না। এছাড়াও তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এক আসন্ন বিজয়’ (আল-ফাতহ, ৪৮/২৭)।
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় থাকা অবস্থায় একবার ছাহাবীগণকে তার স্বপ্নের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন, তিনি বায়তুল্লাহতে প্রবেশ করেছেন এবং তাওয়াফ করেছেন। পরবর্তীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে যখন তিনি মক্কা না গিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন, তখন কিছু ছাহাবীর অন্তরে আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত স্বপ্ন নিয়ে কিছুটা দ্বিধা-সংশয় কাজ করে। এমনকি উমার রযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি আমাদের এই সংবাদ দেননি যে, আমরা বায়তুল্লাহয় প্রবেশ করব এবং তাওয়াফ করব?’ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি কি বলেছি যে, তা এ বছরেই হবে?’ উমার রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘না, সেটা তো বলেননি’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই মক্কায় প্রবেশ করবে এবং তাওয়াফ করবে’। মহান আল্লাহ উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য সত্যায়ন করেন। যা প্রমাণ করে পবিত্র কুরআনের বাহিরেও আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে অহী আসত। সেটি স্বপ্নের মাধ্যমেও হতে পারে। সুতরাং কুরআনের বাহিরেও অহী আসার স্বীকৃতি পবিত্র কুরআন থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।
দলীল : ৫
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
هُوَ الَّذِي أَخْرَجَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ دِيَارِهِمْ لِأَوَّلِ الْحَشْرِ مَا ظَنَنْتُمْ أَنْ يَخْرُجُوا وَظَنُّوا أَنَّهُمْ مَانِعَتُهُمْ حُصُونُهُمْ مِنَ اللَّهِ فَأَتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ حَيْثُ لَمْ يَحْتَسِبُوا وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُمْ بِأَيْدِيهِمْ وَأَيْدِي الْمُؤْمِنِينَ فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ - وَلَوْلَا أَنْ كَتَبَ اللَّهُ عَلَيْهِمُ الْجَلَاءَ لَعَذَّبَهُمْ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابُ النَّارِ - ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ شَاقُّوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَمَنْ يُشَاقِّ اللَّهَ فَإِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ - مَا قَطَعْتُمْ مِنْ لِينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَائِمَةً عَلَى أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيُخْزِيَ الْفَاسِقِينَ
‘তিনিই কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে প্রথম জমায়েতে তাদের বাড়িঘর থেকে বহিষ্কার করেছেন। তোমরা ধারণা করনি যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমন জায়গা থেকে আসলো, যার আশা তারা করেনি। আল্লাহ তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিলেন। তারা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে নিজ হাতে এবং মুসলিমদের হাতে। অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহ যদি তাদের জন্যে নির্বাসন নির্ধারণ না করতেন, তবে তাদেরকে অবশ্যই দুনিয়াতে শাস্তি দিতেন। আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব। এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে (তার জানা উচিত যে,) আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। তোমরা যেসব খেজুরগাছ কর্তন করেছ আর যেসব গাছ সমূলে রেখে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমেই করেছ এবং যাতে তিনি ফাসেক্বদের লাঞ্ছিত করতে পারেন’ (আল-হাশর, ৫৯/২-৫)।
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করেন, তখন মদীনায় চির প্রতিদ্বন্দী আউস ও খাযরাজ গোত্র বসবাস করত। তাদের পাশাপাশি তিনটি ইয়াহূদী গোত্র বসবাস করত— বানূ নাযীর, বানূ কায়নুকা, বানূ কুরায়যা। আউস ও খাযরাজ গোত্রের প্রভাবশালী কিছু নেতা ইসলাম গ্রহণ করলে এবং তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নেতা হিসেবে মেনে নিলে মদীনার ইয়াহূদীরাও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নেতা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সংবিধান তৈরি করেন মদীনা পরিচালনার জন্য। যার নাম ‘মদীনা সনদ’। উক্ত সংবিধানের মাধ্যমে মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নেতা হন মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। উক্ত সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল মদীনা নামক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং মদীনার নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু বানূ নাযীর গোত্র উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা মদীনা রাষ্ট্র ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ করে বসে। যদিও ইয়াহূদীশাস্ত্র মতে, বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে গুরু অপরাধে লঘুদণ্ড প্রদান করেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অবরোধ করেন, কিন্তু তাদের দূর্গের পাশে খেজুর গাছের কারণে দূর্গ ভেদ করা যাচ্ছিল না। এজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গাছ কর্তন করার নির্দেশ দেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই কাজের জন্য মদীনায় অবস্থানরত অন্যান্য ইয়াহূদী গোত্র এবং কিছু মুনাফেক্ব সমালোচনা করা শুরু করে। মহান আল্লাহ উক্ত আয়াতে তাদের উত্তরে অবতীর্ণ করেন। উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বানূ নাযীরের যে খেজুরগাছ কেটে দিয়েছেন, তা তিনি নিজে থেকে করেননি; বরং আল্লাহর আদেশে করেছেন।
দলীলের যৌক্তিকতা : উক্ত আয়াত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বানূ নাযীরের সাথে যা করেছেন, তা পবিত্র কুরআনে কোথাও আদেশ করা হয়নি। বরং কুরআনের বাহিরে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অহী করা হয়েছিল। সেই অহীর আদেশ অনুযায়ী তিনি সকল কিছু করেছেন। পরবর্তীতে মানুষ অভিযোগ উত্থাপন করলে আলাদাভাবে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তিনি যা করেছেন তা আল্লাহর আদেশেই করেছেন। উক্ত আয়াতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে কুরআনের বাহিরেও অহী আসত। যার স্পষ্ট স্বীকৃতি উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ দিয়েছেন।
যে সমস্ত নবীরউপরকিতাবআসেনি এবং যারা শাসক ছিলেন না,তাঁদের উম্মতগণ হাদীছ অনুসরণ করতেন :
একদল মুনকিরে হাদীছ বলার চেষ্টা করে, আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাসক ছিলেন, তাই ছাহাবীগণ শাসক হিসেবে তাঁর কথা অনুসরণ করতেন; তাঁর হাদীছের নয়। আমরা উত্তরে বলতে চাই, পৃথিবীতে বহু নবী এমন এসেছেন, যারা শাসন ক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি; এমনকি তারা কিতাবও পাননি, তাহলে তাদের উম্মাতগণ কীসের অনুসরণ করতেন? তারা মূলত পূর্ববর্তী নবীর কিতাব ও হাদীছ অনুসরণ করতেন। সেক্ষেত্রে সেই উম্মতের বিভিন্ন জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্ন, সমস্যা প্রভৃতির সমাধান আল্লাহ কর্তৃক অহীর মাধ্যমে দিতেন। মূসা আলাইহিস সালাম-এর পরে বানূ ইসরাঈলের নবীদেরকে আলাদা কোনো কিতাব দেওয়া হয়নি। বরং পরবর্তী সকল নবীই উক্ত তাওরাতের ব্যাখ্যাকার হিসেবে প্রেরিত হতেন। আর কিতাবের বাহিরে নবীদের নিকট যা অহী করা হয়, তাকেই হাদীছ বলা হয়। মহান আল্লাহও পবিত্র কুরআনে হাদীছ বলে সম্বোধন করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ مُوسَى - إِذْ نَادَاهُ رَبُّهُ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى ‘আপনার নিকট কি মূসার হাদীছ (বৃত্তান্ত) পৌঁছেছে? যখন তাকে তাঁর প্রতিপালক পবিত্র ‘তুওয়া’ উপত্যকায় ডাক দিয়েছিলেন’ (আন-নাযিআত, ৭৯/১৫-১৬)।
দলীলের যৌক্তিকতা : মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে পবিত্র উপত্যকায় যা ঘটেছে তা তাঁর উপর কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার আগেই ঘটেছে। সুতরাং তার স্বাভাবিক জীবনের এই ঘটনা অবশ্যই হাদীছ। তাই মহান আল্লাহ এই ঘটনাকে হাদীছ হিসেবে সম্বোধন করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ - إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ سَلَامٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ ‘আপনার নিকট কি ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানদের হাদীছ (বৃত্তান্ত) পৌঁছেছে? যখন তাঁরা তাঁর কাছে প্রবেশ করেন অতঃপর বলেন, ‘সালাম’ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)! আর তিনিও উত্তরে বললেন, ‘সালাম’ (আপনাদের উপরও শান্তি বর্ষিত হোক)। (আপনারা তো) অপরিচিত লোক (অর্থাৎ আমি তো আপনাদের চিনতে পারছি না)!’ (আয-যারিয়াত, ৫১/২৪-২৫)।
দলীলের যৌক্তিকতা : উক্ত ঘটনাটি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর উপর অবতীর্ণ ছহীফার অংশ নয়, বরং তার স্বাভাবিক জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। যা অবশ্যই হাদীছ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَوْحَيْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَعِيسَى وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهَارُونَ وَسُلَيْمَانَ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا - وَرُسُلًا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا ‘নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি অহী করেছি, যেভাবে আমি অহী করেছিলাম নূহের প্রতি এবং তার পরবর্তী নবীগণের প্রতি। আর আমি আরো অহী করেছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, তাঁর বংশধরগণ, ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারূন ও সুলায়মানের প্রতি। আর আমি দাঊদকে দিয়েছি যাবূর। (আর আমি পাঠিয়েছি) এমন অনেক রাসূল, যাদের বৃত্তান্ত আমি ইতোপূর্বে আপনার কাছে বর্ণনা করেছি, এবং (আমি আরো পাঠিয়েছি) এমন অনেক রাসূল, যাদের বৃত্তান্ত আমি আপনার কাছে বর্ণনা করিনি। আর আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন’ (আন-নিসা, ৪/১৬৩-১৬৪)।
দলীলের যৌক্তিকতা : উক্ত আয়াতে উল্লিখিত অধিকাংশ নবীকেই মহান আল্লাহ রাষ্ট্রক্ষমতা এবং কিতাব প্রদান করেননি। যেমন ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, ইউনুস ও হারূন। তাহলে তাঁদের কাছে আল্লাহ তাআলা কিতাব ছাড়াই অহী প্রেরণ করতেন। আর এই অহীকেই হাদীছ বলা হয়।
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর আদর্শ মূলত তার হাদীছ :
আল্লাহ তাআলা বলেন,قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ ‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তাঁরা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের প্রত্যাখ্যান করছি। আর তোমাদের ও আমাদের মাঝে চিরদিনের জন্য শত্রুতা ও ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছো, তবে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বাবার উদ্দেশ্যে তাঁর এই কথা ব্যতীত, (তিনি বলেছিলেন), ‘আমি অবশ্যই আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তবে আপনার জন্য আল্লাহর কাছে আমি কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখি না। হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমারই অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করেছি এবং তোমারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল’ (আল-মুমতাহিনা, ৬০/৪)।
দলীলের যৌক্তিকতা : মহান আল্লাহ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর মাঝে আদর্শ থাকার কথা বলেছেন আর তাঁর আদর্শের কথা তিনি পবিত্র কুরআনে বহু জায়গায় বর্ণনা করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর যে আদর্শগুলো মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন, তা মূলত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর স্বাভাবিক জীবনী যা তাঁর জীবনে ঘটেছে; যা তার স্ত্রীর সাথে ঘটেছে; যা তাঁর সন্তানদের সাথে ঘটেছে; সেটাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। তথা একজন নবীর স্বাভাবিক জীবনীও মানুষের জন্য আদর্শ। তাঁরা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে যা কিছু করেন সেটাও অহীর নির্দেশনা মাফিক হয়ে থাকে, যা অনেক সময় কিতাবের অন্তর্ভুক্ত হয় না।
আমরা উদাহরণ হিসেবে পেশ করলে দেখতে পাব, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ছোটবেলার ঘটনাগুলো অবশ্যই তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাব ছিল না, বরং তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। তেমনি মূসা আলাইহিস সালাম-এর ছোটবেলার ঘটনাগুলো তাঁর উপর প্রেরিত কিতাব ছিল না; তিনি কিতাব পেয়েছেন অনেক পরে। এভাবে আমাদের নবী পর্যন্ত সকল নবীর স্বাভাবিক জীবনী আমাদের জন্য আদর্শ ও অনুসরণীয় হিসেবেই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। কেননা এগুলো সবই মহান আল্লাহ তাঁদের অন্তরে ইলহাম, স্বপ্ন ও সরাসরি ফেরেশতা পাঠানোর মাধ্যমে অহী করে থাকেন। আর এই অহীকেই হাদীছ বলা হয়। সুতরাং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর আদর্শ মানে তাঁর হাদীছের অনুসরণ। তাঁর স্বাভাবিক জীবনের ঘটনাবলির অনুসরণ। তেমনি আমাদের নবীর আদর্শ অনুসরণ মানে তার স্বাভাবিক জীবনের ঘটনাবলির অনুসরণ যা পবিত্র কুরআনে অহী আকারে অবতীর্ণ হয়নি। আর অনুসরণীয় আদর্শ কখনো বইয়ের পাতা থেকে পাওয়া যায় না; বাস্তব চরিত্র থেকে অনুসরণীয় আদর্শ পাওয়া যায়। মহান আল্লাহর নির্দেশাবলি কিতাবে সন্নিবেশিত থাকে আর বাস্তব চরিত্র হিসেবে তিনি নবীদের প্রেরণ করে থাকেন, যারা সেই কিতাবের আলোকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া অহীর মাধ্যমে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করে থাকেন।
(চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।