কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বিদ্যুৎ: আল্লাহর একটি মহান দান

post title will place here

ভূমিকা: বিদ্যুৎ আল্লাহর অসীম দয়া ও জ্ঞানের এক মহৎ নিদর্শন, যা আধুনিক সভ্যতাকে গতিশীল রাখে। এটি আমাদের জীবনকে সহজতর করে। বিদ্যুৎ যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদ্যুৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও কার্যকর এবং টেকসই করে তোলে। অতএব, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(১) আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন: আল্লাহ পৃথিবীকে একটি সুসংগঠিত নিয়মে সৃষ্টি করেছেন, যেখানে শক্তি ও পদার্থের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। বিদ্যুৎও এই সৃষ্টির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কুরআনে আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে,وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ ‘তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছেন এবং তারাগুলো তাঁর আদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে’ (আন-নাহল, ১৬/১২)

এই আয়াত থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীতে বিদ্যুৎসহ সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তি আল্লাহর কুদরতের ফলস্বরূপ এবং মানবজাতির জন্য একটি মহান উপহার।

(২) বিদ্যুৎ উৎপাদন আল্লাহর দেওয়া প্রাকৃতিক নিয়ম: ফ্যারাডে’স ল অব ইন্ডাকশনের মৌলিক নীতি হলো, যখন একটি কুণ্ডলী বা তার চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে চলতে থাকে অথবা সেই চুম্বকীয় ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়, তখন কুণ্ডলী বা তারের মধ্যে ইলেক্ট্রো-মোটিভ ফোর্স (EMF) তৈরি হয়। এই ইলেক্ট্রো-মোটিভ ফোর্স (EMF) পরবর্তীতে বিদ্যুৎ বা কারেন্টে পরিণত হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়মের অংশ।

আল্লাহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ দিয়েছেন। প্রতিটি শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর অসীম জ্ঞানের পরিচায়ক।

পানি ও বাষ্পের শক্তি: পানি বা বাষ্পের শক্তি ব্যবহার করে টারবাইন চালানো হয় এবং সেই শক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি সাধারণ এবং কার্যকর উপায়। যেমন- হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট বা থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টে পানি থেকে বাষ্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। কুরআনে বলা হয়েছে,وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ فَأَسْكَنَّاهُ فِي الْأَرْضِ ‘আর আমরা আকাশ থেকে পানি নির্দিষ্ট পরিমাণে বর্ষণ করি এবং তা মাটিতে সংরক্ষণ করি...’ (আল-মুমিনূন, ২৩/১৮)

সৌরশক্তি: সূর্যের আলোকে সোলার প্যানেল দ্বারা বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হয়। এটি একটি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূর্য আল্লাহর সৃষ্টি, যা কুরআনে বলা হয়েছে, وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا‘আর আমরা সৃষ্টি করেছি এক উজ্জ্বল প্রদীপ (সূর্য)’ (আন-নাবা, ৭৮/১৩)

বায়ুশক্তি: বাতাসের গতির শক্তি টারবাইন দ্বারা বিদ্যুতে রূপান্তরিত হয়। বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় এবং পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস। কুরআনে বলা হয়েছে, وَأَرْسَلْنَا الرِّيَاحَ لَوَاقِحَ ‘আর আমরা বৃষ্টি-গর্ভ বায়ু প্রেরণ করি..’ (আল-হিজর, ১৫/২২)

জ্বালানি শক্তি: কয়লা, তেল বা গ্যাস পোড়ানো হয় এবং এর থেকে উত্তপ্ত বাষ্প তৈরি হয়ে টারবাইন চালানো হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। এটি একটি প্রচলিত শক্তি উৎপাদন পদ্ধতি, যা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কুরআনে বলা হয়েছে, أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي ‘আপনি কি দেখেননি যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে দিয়েছেন...?’ (আল-হজ্জ, ২২/৬৫)

পারমাণবিক শক্তি: পারমাণবিক শক্তি পরমাণুর শক্তি থেকে আসে। পরমাণু বিভাজন বা ফিউশন প্রক্রিয়ায় বিশাল শক্তি উৎপন্ন হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দক্ষ শক্তি উৎপাদন পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

এই সমস্ত পদ্ধতি আল্লাহর অসীম দয়া ও জ্ঞানের প্রতিফলন, যা আমাদের জীবনকে আরও সহজ, উন্নত এবং টেকসই করে তোলে।

(৩) কুরআন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক: কুরআন আমাদের প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং তার মধ্যে গোপন রহস্য খুঁজে বের করার জন্য উৎসাহিত করে। কুরআনের মাধ্যমে আমাদের জীবনের সকল পদক্ষেপ এবং প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং অনুসরণ করতে সাহায্য করে। কুরআনে বলা হয়েছে,هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ ‘তিনি (আল্লাহ), যিনি পৃথিবীকে তোমাদের অধীন করেছেন, তাই তার পথসমূহে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রিযিক্ব থেকে আহার করো...’ (আল-মুলক, ৬৭/১৫)

এটি আমাদের প্রকৃতির সঠিক ব্যবহার এবং কুরআনের জ্ঞান অনুসরণ করার জন্য আহ্বান জানায়।

(৪) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন: বিদ্যুৎ এবং এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিমরা যদি তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষতা অর্জন করে, তবে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

এই জ্ঞান শুধু ব্যক্তি বা সমাজের উপকারে আসবে না, বরং তা পুরো মানবতার কল্যাণে কাজ করবে।

(৫) বিদ্যুতের গুরুত্ব: বিদ্যুৎ বর্তমানে আমাদের আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর গুরুত্ব নিম্নরূপ—

আধুনিক জীবন: বিদ্যুৎ আমাদের ঘর, অফিস, শিল্প ও প্রযুক্তিকে শক্তি দেয়।

শিক্ষা: বিদ্যুৎ শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনকে সহজ এবং কার্যকর করে তোলে।

স্বাস্থ্যসেবা: হাসপাতালের জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।

উদ্ভাবন: বিদ্যুৎ আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি, যা নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারগুলোর জন্য অপরিহার্য।

(৬) কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব: আল্লাহ আমাদের সম্পদ অপচয় করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ‘...আর অপচয় করো না। নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানদের ভাই’ (আল-ইসরা, ১৭/২৬-২৭)

আমাদের উচিত বিদ্যুৎ সঠিকভাবে ব্যবহার করা, এর অপচয় থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। এটি আমাদের দায়িত্ব এবং আল্লাহর দেওয়া এই অনুগ্রহের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহার: বিদ্যুৎ আল্লাহর অসীম দয়া ও জ্ঞানের একটি মহান নিদর্শন, যা আমাদের জীবনকে সহজ, উন্নত এবং টেকসই করে তোলে। এটি আল্লাহর সৃষ্টির নিয়মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং মুসলিমদের জন্য একটি অমূল্য উপহার। কুরআনের জ্ঞান অনুসরণ করে মুসলিমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আমাদের উচিত বিদ্যুৎ সঠিকভাবে ব্যবহার করা, এর জন্য কৃতজ্ঞ থাকা এবং সমাজের উন্নতিতে এর জ্ঞান কাজে লাগানো। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!

নাফিউল হাসান

 প্রভাষক, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বাংলাদেশ।

Magazine