কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

অহির বাস্তবতা বিশ্লেষণ (১২তম পর্ব)

(মিন্নাতুল বারী- ১৯তম পর্ব)

[যে হাদীছের ব্যাখ্যা চলছে :

حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ أَبِي عَائِشَةَ، قَالَ: حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى: {لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ} [القيامة : 16] قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُعَالِجُ مِنَ التَّنْزِيلِ شِدَّةً، وَكَانَ مِمَّا يُحَرِّكُ شَفَتَيْهِ - فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: فَأَنَا أُحَرِّكُهُمَا لَكُمْ كَمَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُحَرِّكُهُمَا، وَقَالَ سَعِيدٌ: أَنَا أُحَرِّكُهُمَا كَمَا رَأَيْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ يُحَرِّكُهُمَا، فَحَرَّكَ شَفَتَيْهِ - فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى: {لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ}[القيامة : 17]قَالَ: جَمْعُهُ لَكَ فِي صَدْرِكَ وَتَقْرَأَهُ: {فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ}[القيامة : 18] قَالَ: فَاسْتَمِعْ لَهُ وَأَنْصِتْ: {ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ}[القيامة : 19]ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا أَنْ تَقْرَأَهُ، فَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بَعْدَ ذَلِكَ إِذَا أَتَاهُ جِبْرِيلُ اسْتَمَعَ فَإِذَا انْطَلَقَ جِبْرِيلُ قَرَأَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم كَمَا قَرَأَهُ.

অনুবাদ :

মহান আল্লাহর বাণী, ‘তাড়াতাড়ি অহি আয়ত্ত করার জন্য আপনার জিহ্বা দ্রুত নাড়াবেন না’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৬)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহি নাযিলের সময় তা আয়ত্ত করতে বেশ কষ্ট স্বীকার করতেন এবং এজন্য তিনি তাঁর ঠোঁট (দ্রুত) নাড়াতেন। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি তোমাদেরকে ঠিক সেভাবে ঠোঁট নেড়ে দেখাচ্ছি যেভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঠোঁট নাড়াতেন’।

সাঈদ রহিমাহুল্লাহতাঁর ছাত্রদের বললেন, আমি তোমাদেরকে ঠিক সেভাবে আমার ঠোঁট নেড়ে দেখাচ্ছি যেভাবে আমি ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে তাঁর ঠোঁট নাড়াতে দেখেছিঅতঃপর তিনি তাঁর ঠোঁট নেড়ে দেখান। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন, ‘তাড়াতাড়ি অহি আয়ত্ত করার জন্য আপনার জিহ্বা দ্রুত নাড়াবেন না’। এর সংগ্রহ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৬-১৮)।

ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এর অর্থ হলো আপনার অন্তরে তা সংরক্ষণ করা এবং আপনার দ্বারা তা পাঠ করানো। আল্লাহর বাণী, ‘সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৯)। ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং চুপ থাকুন। আল্লাহর বাণী, ‘এরপর আপনার কাছে তা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমারই’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/১৯)। অর্থাৎ অতঃপর আপনাকে পাঠ করানোর দায়িত্বও আমারই। এরপর যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল আলাইহিস সালাম আসতেন, তখন তিনি মনোযোগ সহকারে কেবল শুনতেন এবং জিবরীল আলাইহিস সালাম চলে গেলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠিক সেভাবে পড়তেন, যেভাবে জিবরীল আলাইহিস সালাম পড়েছিলেন।]

বুখারীর বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে হাদীছের ইবারতের ভিন্নতা :

(১) আবুল ওয়াকত থেকে সাম‘আনী যে বর্ণনা করেছেন, তাতে حـدثنا এর পরিবর্তে أخبَرَنا শব্দ আছে।

(২) আছীলী ও আবূ যারের বর্ণনাতে تَعالَىَ এর পরিবর্তেعَزَّ وَجَلَّ শব্দ আছে।

(৩) আছীলী, ইবনু আসাকিরের বর্ণনাতে এবং আবুল ওয়াকত থেকে সাম‘আনী যে বর্ণনা করেছেন তাতে لَكُمْ এর পরিবর্তে لك শব্দ আছে।

(৪) কারীমার বর্ণনাতে جمْعُه لك في صدرِك আছে। অর্থাৎ لَهُ এর বদলে لك আছে। আবূ যার ও ইবনু আসাকিরের একটি বর্ণনাতে এবং আবুল ওয়াকত থেকে সাম‘আনী যে বর্ণনা করেছেন সেই বর্ণনার একটিতে جمْعُه له صدرُك আছে। অর্থাৎ সেখানে في শব্দ নেই। আর আবূ যার, ইবনু আসাকির, আছীলীর আরেকটি বর্ণনাতে এবং আবুল ওয়াকত থেকে সাম‘আনী যে বর্ণনা করেছেন সেই বর্ণনার আরেকটিতেجمْعُه لك صدرُك আছে। অর্থাৎ সেখানে لَهُ এর বদলে لك আছে। আবার في শব্দও নেই।

(৫) আবুল ওয়াকত থেকে সাম‘আনী যে বর্ণনা করেছেন তাতে قال শব্দ নেই।

(৬) আবূ যার, আছীলী ও ইবনু আসাকিরের বর্ণনাতে كَما قَرَاهُ এর বদলে كما قرأ আছে। আর কুশমাইহানীর বর্ণনাতে এবং আবূ যারের আরেকটি বর্ণনাতে كما كان قرأ আছে।

হাদীছের তাখরীজ :

ইমাম আহমাদ হাদীছটি শুনেছেন আব্দুর রহমান ইবনু মাহদী থেকে। ইমাম বুখারী,[1] মুসলিম[2] ও নাসাঈ[3] হাদীছটি শুনেছেন কুতায়বা ইবনু সাঈদ থেকে। ইমাম বুখারী হাদীছটি আরো শুনেছেন মূসা ইবনু ইসমাঈল আত-তাবুযাকী থেকে। তারা সকলেই (ইবনু মাহদী, কুতায়বা, মূসা) এবং ইমাম আবূ দাঊদ তয়ালিসী (হা/২৭৫০) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন আবূ আওয়ানা অযযাহ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-ইয়াশকুরী থেকে। ইমাম বুখারী হাদীছটি আরো শুনেছেন হুমায়দী থেকে। ইমাম তিরমিযী[4] হাদীছটি শুনেছেন ইবনু আবী উমার আল-আদানী থেকে। তারা উভয়ে (হুমায়দী ও আদানী) এবং ইমাম আহমাদ[5] হাদীছটি শুনেছেন সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা থেকে। ইমাম মুসলিম হাদীছটি আরো শুনেছেন ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইহ ও ইবনু আবী শায়বা থেকে। তারা উভয়ে জারীর ইবনে আব্দুল হামিদ আয-যব্বী থেকে। ইমাম বুখারী হাদীছটি আরো শুনেছেন উবাইদুল্লাহ ইবনু মূসা থেকে, তিনি ইসরাঈল ইবনু ইউনুস ইবনু আবী ইসহাক্ব আস-সাবেঈ থেকে।

উপরে উল্লেখিত সকলেই (আবূ আওয়ানা, সুফিয়ান, জারীর, ইসরাঈল) সকলেই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন মূসা ইবনু আবী আয়েশা থেকে। ইমাম নাসাঈ ও ইমাম বাযযার[6] দুটি আলাদা সূত্রে হাদীছটি সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি আমর ইবনু দীনার আল-আছরাম থেকে। ইমাম নাসাঈ হাদীছটি আরো বর্ণনা করেছেন ইসরাঈল ইবনু ইউনুস ইবনে আবী ইসহাক্ব আস-সাবেঈর সূত্রে, তিনি তার দাদা আবূ ইসহাক্ব আস-সাবেঈ থেকে। তারা সকলেই (মূসা, আবূ ইসহাক্ব আস-সাবেঈ, আমর ইবনু দীনার) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন সাঈদ ইবনু জুবায়ের থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে।

শব্দ ও বাক্য বিশ্লেষণ :

يُعَالِجُ মূল অর্থ চিকিৎসা করা। তবে কষ্ট সহ্য করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। উক্ত হাদীছে কষ্ট সহ্য করা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। وَكَانَ مِمَّا يُحَرِّكُ شَفَتَيْهِ এই বাক্যে مِمَّا (মিম্মা) শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইমাম সারকুসতী বলেন, এখানে ‘মিম্মা’ দ্বারা উদ্দেশ্য كثيرا ما তথা তিনি অধিকাংশ সময় ঠোঁট নাড়াতেন। আর একদল বলেছেন, এখানে ‘মিম্মা’ দ্বারা ربما উদ্দেশ্য। যা স্বল্পতা ও অত্যধিক উভয়ের জন্যই আরবী ভাষাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্বল্পতা ধরলে অর্থ হবে তিনি অল্পই তার ঠোঁট নাড়াতেন। আরেক দল বলেছেন, كان এর গোপন সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্বের মু‘আলাজা আর ما মাছদারিয়া আর من সাবাবিয়া। তখন অর্থ দাঁড়াবে- كان علاجه ناشئا من تحريك شفتيه অর্থাৎ ‘তার এই কষ্টের কারণ হচ্ছে তার ঠোঁট নাড়ানো।

কুরআনে জিহ্বা, হাদীছে ঠোঁট কেন?

উক্ত হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো করে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা ঠোঁট নাড়িয়ে দেখিয়েছেন। হাদীছের সারর্মম হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই ঠোঁট নাড়ানো থেকে নিষেধ করেছেন। অথচ পবিত্র কুরআনের আয়াতে ঠোঁট নাড়ানোর কোনো কথা নেই। বরং মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে জিহ্বা নাড়াতে নিষেধ করেছেন। তাহলে কুরআনে জিহ্বা নাড়াতে নিষেধ করা হচ্ছে আর হাদীছে সেটা দেখানো হচ্ছে ঠোঁট নাড়ানোর মাধ্যমে। এই বৈপরীত্যের কারণ ও সমাধান মুহাদ্দিছগণ বিভিন্নভাবে করেছেন। নিম্নে দু’টি প্রাধান্যযোগ্য জবাব প্রদান করা হলো—

(১) হাদীছের অন্য রেওয়ায়েতে অন্য রাবীগণ যখন হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তখন তারা জিহ্বা ও ঠোঁট উভয়টির কথাই বলেছেন। মূসা ইবনু আবী আয়েশার দুই জন ছাত্র আবূ আওয়ানা ও ইসরায়েল শুধু ঠোঁট বর্ণনা করেছেন।[7] তার আরেকজন ছাত্র সুফিয়ান শুধু জিহ্বার কথা বর্ণনা করেছেন।[8] আরেকজন ছাত্র জারীর জিহ্বা ও ঠোঁট উভয়ের কথাই বর্ণনা করেছেন।[9]

(২) আরবীর সকল বর্ণ শুধু ঠোঁট বা শুধু জিহ্বা দ্বারা উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। তথা আরবী সকল বর্ণ উচ্চারণ করতে গেলে ঠোঁট ও জিহ্বা উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং একটা আরেকটার পরিপূরক। তাই একটা উল্লেখ করা মানে আরেকটা বাদ দেওয়া, তা নয়। বরং ওই একটার মাধ্যমে উচ্চারণ করতে যা যা লাগে তার সবকিছু বুঝানো উদ্দেশ্য। যেমন মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন,وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ ‘আর আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড়ে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের যা গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে তোমাদের যুদ্ধে। এভাবেই তিনি তোমাদের উপর তাঁর নেয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও’ (আন-নাহল, ১৬/৮১)

উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ শুধু গরমের কথা বলেছেন। ঠাণ্ডার কথা বলেননি। তার মানে ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কাপড় সাহায্য করবে না, তা নয়। কিন্তু একটা উল্লেখ করার মাধ্যমে ওই জাতীয় যে ধরনের প্রয়োজনে কাপড় কাজে আসে তার সবগুলোই উদ্দেশ্য।

আয়াতসমূহের তাফসীর :

উক্ত আয়াতের যে তাফসীর আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে উক্ত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে তার সারর্মম হচ্ছে—

إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ এই আয়াতে ‘কুরআনাহু’ দ্বারা পড়তে পারার সক্ষমতা প্রদানকে বুঝানো হয়েছে। إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ আবার এই আয়াতেও ‘বায়ানাহু’ দ্বারা পড়তে পারার সক্ষমতা প্রদানকে বুঝানো হয়েছে।

আয়াত ভিন্ন, শব্দ ভিন্ন কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা উক্ত হাদীছে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করলেন একই রকম। আর আমরা জানি যে, কুরআনে অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা নেই। মহান আল্লাহ একই কথা এভাবে দুইবার বলার কথা নয়। এই সমস্যার সমাধান বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছে।

(ক) প্রথমবার পড়ার সক্ষমতা দ্বারা উদ্দেশ্য নিজে পড়তে পারার সক্ষমতা। আর পরেরবার পড়ার সক্ষমতা দ্বারা উদ্দেশ্য জনগণের সামনে পড়তে পারার সক্ষমতা।

(খ) প্রথমবার পড়ার সক্ষমতা দ্বারা উদ্দেশ্য প্রথমবারের মতো পড়তে পারার সক্ষমতা। আর পরেরবার পড়ার সক্ষমতা দ্বারা উদ্দেশ্য পরবর্তীতে বারবার পড়তে পারার সক্ষমতা।

(গ) সবচেয়ে সঠিক উত্তর হচ্ছে— আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, উপরিউক্ত তাফসীরটির অন্যান্য সনদে যেভাবে ব্যাখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে সেই বর্ণনাটিই বেশি প্রণিধানযোগ্য। যেমন— ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার কিতাবুত তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, {إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ} [القيامة: ১৭] وَقُرْآنَهُ، أَنْ نَجْمَعَهُ فِي صَدْرِكَ وَقُرْآنَهُ، أَنْ تَقْرَأَهُ {فَإِذَا قَرَأْنَاهُ} [القيامة: ১৮] يَقُولُ: أُنْزِلَ عَلَيْهِ: {فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ} [القيامة: ১৯] أَنْ نُبَيِّنَهُ عَلَى لِسَانِكَ.

সারমর্ম : প্রথম ‘কুরআনাহু’ দ্বারা উদ্দেশ্য পড়তে পারার সক্ষমতা আর পরবর্তীতে ‘বায়ানাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য তাফসীর বা ব্যাখ্যা করতে পারার সক্ষমতা।[10]

আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত তাফসীরটি মূসা ইবনু আবী আয়েশার ছাত্র আবূ আওয়ানা বর্ণনা করেছেন। আর ‘বায়ানাহু’ দ্বারা ব্যাখ্যা করা উদ্দেশ্য মর্মে বর্ণিত বর্ণনাটি মূসা ইবনু আবী আয়েশার ছাত্র ইসরাঈল ও জারীর বর্ণনা করেছে। ওয়াল্লাহু আ‘লামু বিছ ছওয়াব।

আয়াতের আগে পরের সাথে সম্পর্ক : আয়াতের আগে ও পরে ক্বিয়ামতের আলোচনা তার মাঝে মাত্র কয়েকটি আয়াতে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই ধরনের উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। ক্বিয়ামতের আলোচনার মধ্যে কুরআনকেন্দ্রিক এই কয়েকটি আয়াত আনার কী কারণ বা এই আয়াতগুলোর সাথে তার আগের ও পরের ক্বিয়ামতসংক্রান্ত আয়াতের কী সম্পর্ক?

আমাদের মনে রাখতে হবে পবিত্র কুরআনে কোনো কিছুই একসাথে একত্রে এক জায়গায় উল্লিখিত হয়নি। যেমন মূসা আলাইহিস সালাম-এর জীবনী পরিপূর্ণরূপে এক জায়গায় একসাথে উল্লেখ করা হয়নি। ঠিক তেমনি জান্নাতের বিবরণ বা জাহান্নামের বিবরণ সম্পূর্ণরূপে আলাদাভাবে একত্রে কোথাও বর্ণিত হয়নি। বরং যখন যেখানে যেভাবে প্রয়োজন মনে হয়েছে তখন সেখানে ততটুকু তিনি উল্লেখ করেছেন। যেহেতু কুরআন কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয় সেহেতু সকল নবীর বিস্তারিত ইতিহাস উল্লেখ করা হয়নি। বরং কুরআন যেহেতু উপদেশের বই, সেহেতু যে নবীর জীবনীর যে অংশ দিয়ে পবিত্র কুরআনের যেখানে যে ধরনের উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, সেখানে সেই বিশেষ অংশটুকু উল্লেখ করে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এজন্য কুরআনের প্রতিটি আয়াতের সাথে তার আগের ও পরের আয়াতের সম্পর্ক থাকবে বিষয়টি এমন নয়। আর এই বিভিন্নতাই আমাদের পৃথিবীর মৌলিক সৌন্দর্য। যদি মহান আল্লাহ সব নদীগুলো এক জায়গায় দিয়ে দিতেন, সব সমুদ্র এক জায়গায় দিয়ে দিতেন, সব পাহাড় এক জায়গায় দিয়ে দিতেন, এভাবে ভাগ ভাগ করে সাজাতেন, তাহলে পৃথিবীর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যেত। এজন্য বিচ্ছিন্নভাবে যখন যেখানে নদীর দরকার সেখানে নদী রয়েছে আবার নদীর পাশেই পাহাড় রয়েছে আবার মরুভূমির পাশেই সবুজ রয়েছে, বরফাচ্ছাদিত শহরের পাশেই তপ্ত লু হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা বিষয়টি বুঝার জন্য আমাদের বাস্তব জীবন থেকে আরো একটি উদাহরণ দেখতে পারি—

যখন আমাদের কারো পিতা তার সন্তানকে প্রথম প্রথম উপদেশ দেয়, তখন তিনি তাকে সকল উপদেশ একসাথে প্রদান করেন না, বরং প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদান করেন। যেমন যখন তিনি দেখেন তার সন্তান খাচ্ছে তখন তাকে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাওয়ার জন্য আদেশ প্রদান করেন। আবার যখন দেখেন কারো সাথে সময় নষ্ট করছে, তখন সময়ের মূল্যের উপদেশ প্রদান করেন। আবার যখন দেখেন মোবাইলে গেম খেলছে, তখন মোবাইল আসক্তির বিষয়ে উপদেশ প্রদান করেন। ঠিক একইভাবে পবিত্র কুরআনের মূল সৌন্দর্য হচ্ছে প্রয়োজন অনুযায়ী উপদেশের বিন্যাস। একই উপদেশ এমনভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বারবার বলা হয়েছে, যাতে সবসময়ই সেই উপদেশটি নতুন আঙ্গিকে নতুন অর্থ বহন করে। মূলকথা একই হলেও প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন হওয়ার কারণে তার অনুভূতি ও স্বাদও ভিন্ন হয় আর এটাই কুরআনের মু‘জেযা। সুতরাং উক্ত আয়াতগুলো ক্বিয়ামতের আলোচনার মধ্যে বর্ণিত হওয়ায় কুরআনের জন্য দোষ-ত্রুটির কিছু নয়।

তারপরও মুফাসসিরগণ প্রত্যেক আয়াতের সাথে তার আগের ও পরের আয়াতের সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। উক্ত আয়াতগুলোর ক্ষেত্রেও তাদের পক্ষ থেকে প্রদানকৃত কয়েকটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নিম্নে পেশ করা হলো—

(ক) মূলত সূরা আল-ক্বিয়ামাহ অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহ্বা ও ঠোঁট তাড়াহুড়ো করে নাড়াচ্ছিলেন। তাই তখনই তাকে সতর্কতার উদ্দেশ্যে এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ করা হয়। যেমন ইবনু আশুর রহিমাহুল্লাহ বলেন, فَيَكُونُ وُقُوعُ هَذِهِ الْآيَةِ فِي هَذِهِ السُّورَةِ مِثْلَ وُقُوعِ وَما نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ فِي سُورَةِ مَرْيَمَ [৬৪] ، وَوُقُوعُ حافِظُوا عَلَى الصَّلَواتِ وَالصَّلاةِ الْوُسْطى فِي أَثْنَاءِ أَحْكَامِ الزَّوْجَاتِ فِي سُورَةِ الْبَقَرَة [২৩৮] . قَالُوا: نزلت هَذِهِ الْآيَةُ فِي أَثْنَاءِ سُورَةِ الْقِيَامَةِ: هَذَا مَا لَا خِلَافَ فِيهِ بَيْنَ أَهْلِ الْحَدِيثِ وَأَيِمَّةِ التَّفْسِيرِ.

‘এই আয়াতগুলোর সূরা ক্বিয়ামার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ঠিক তেমন, যেমনটি সূরা মারইয়ামের মধ্যে এই আয়াতটিوَما نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ ‘বলে দাও, হে জিবরীল! আমি একমাত্র আপনার প্রতিপালকের নির্দেশেই কুরআন নিয়ে অবতীর্ণ হই’ (মারইয়াম, ১৯/৬৪)। অনুরূপই সূরা আল-বাক্বরায় স্ত্রীগণের হুকুম-আহকাম বর্ণনার মাঝে এই আয়াতের উল্লেখحافِظُوا عَلَى الصَّلَواتِ وَالصَّلاةِ الْوُسْطى ‘তোমরা ছালাতসমূহকে সংরক্ষণ করো! বিশেষ করে মধ্যবর্তী ছালাতকে’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৮)। সকল মুহাদ্দিছ ও তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম এই বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে, এই আয়াতগুলো সূরা আল-ক্বিয়ামাহ অবতীর্ণ হওয়া অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছে’।[11]

ইবনু আশুর রহিমাহুল্লাহ-এর উক্ত মন্তব্যের ব্যাখ্যা : সূরা মারইয়ামে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলে দাও, হে জিবরীল! আমি একমাত্র আপনার প্রতিপালকের নির্দেশেই কুরআন নিয়ে অবতীর্ণ হই’ (মারইয়াম, ১৯/৬৪)। এই আয়াতের আগে পরে সূরা মারইয়ামে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়ের আলোচনা আছে, কিন্তু এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে কয়েকদিন যাবৎ জিবরীল আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসেননি, তার সেই না আসার উত্তর মহান আল্লাহ এই আয়াতে দিয়েছেন। তথা আয়াত অবতীর্ণ হওয়া অবস্থায় আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মনের মধ্যে উদিত প্রশ্নের উত্তর সেই অবস্থাতেই সাথে সাথে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা হয়তো যে বিষয়ক আয়াত অবতীর্ণ হচ্ছিল তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ঠিক এমনটিই ঘটেছে সূরা আল-ক্বিয়ামাহতে। ক্বিয়ামত বিষয়ক আয়াত অবতীর্ণ হওয়া অবস্থাতেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতগুলো মুখস্থ করার জন্য খুব তাড়াহুড়ো করছিলেন তাই সেই অবস্থাতেই তাকে উক্ত বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

(খ) উক্ত আয়াতগুলোর সাথে তার পূর্বের অংশের সরাসরি কোনো মিল না থাকলেও আয়াতের পরের অংশের সাথে আয়াতগুলোর মিল রয়েছে। যেমন উক্ত আয়াতগুলোর শেষে মহান আল্লাহ বলেন, كَلَّا بَلْ تُحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ - وَتَذَرُونَ الْآخِرَةَ ‘কখনই নয়, তোমরা তাড়াহুড়ো পছন্দ করে থাকো এবং আখেরাতকে পরিত্যাগ করে দাও’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/২০)। তথা যেহেতু দুনিয়ার ফলাফল খুব দ্রুত পাওয়া যায়, কিন্তু পরকালের ফলাফল পেতে সময় লাগে; তাই মানুষ দুনিয়াকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কেননা মানুষ দ্রুততা ও তাড়াহুড়ো ভালোবাসে। যা চোখের সামনে দ্রুত পাওয়া সম্ভব সেটার পেছনেই মানুষ ছোটে।

আগের আয়াতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করার পরপরই সেই তাড়াহুড়োর সাথে সম্পৃক্ত দুনিয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিয়েই মহান আল্লাহ পুনরায় ক্বিয়ামতের আলোচনায় প্রবেশ করেছেন। যা এই আয়াতগুলোর সাথে পরের আয়াতগুলোর সম্পর্ক নিশ্চিত করেছে।

(চলবে)

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; এম. এ. (অধ্যয়নরত), উলূমুল হাদীছ বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৫, ৪৯২৭, ৪৯২৮, ৪৯২৯, ৫০৪৪, ৭৫২৪।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪৮।

[3]. নাসাঈ কুবরা, হা/১০০৯, ৭৯২৪, ১১৫৭০, ১১৫৭১, ১১৫৭২।

[4]. তিরমিযী, হা/৩৩২৯।

[5]. আহমাদ, হা/১৯৩৫।

[6]. বাযযার, হা/৪৯৭৬, ৪৯৭৭।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫২৪।

[8]. তিরমিযী, হা/৩৩২৯।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯২৯, ৫০৪৪।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯২৮।

[11]. আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর, ২৯/৩৪৯।

Magazine