একজন মুমিন সারা বছর অপেক্ষা করেন কবে রামাযান আসবে। কারণ এই মাসেই যে আছে লায়লাতুল ক্বদর, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। তাই এই রাতগুলো অতিবাহিত করতে হবে আমল করার মাধ্যমে। চলুন জেনে নিই এই মহিমান্বিত রাতের কিছু আমল—
রামাযানের শেষ দশকের আমলসমূহ:
(১) শেষ দশকে নিজে রাত জেগে ইবাদত করা এবং পরিবার-পরিজনকেও জাগানো: আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ ‘আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (ইবাদতের জন্য রামাযানের) শেষ দশকে ইবাদতে যতটা প্রয়াসী হতেন, তা অন্য কোনো সময়ে হতেন না’।[1] আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ العَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ ‘রামাযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের জন্য কোমরবন্ধ শক্ত করে বেঁধে নিতেন (কঠোর পরিশ্রম করতেন), রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবার-পরিজনকেও জাগাতেন’।[2]
(২) ই‘তিকাফ করা: ই‘তিকাফের আভিধানিক অর্থ— কোনো জিনিসের সাথে লেগে থাকা, নিজেকে সেজন্য আবদ্ধ করা, সেই কাজ ভালো হোক অথবা মন্দ হোক।[3]
শারঈ অর্থ— ‘কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মসজিদে অবধারিতভাবে অবস্থান করাকে ই‘তিকাফ বলে’।[4]
ই‘তিকাফে বসার সময়: ২০ রামাযানের মাগরিবের আগে ই‘তিকাফের জন্য মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। ই‘তিকাফ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ‘আর তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সহবাস করো না’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৭)। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানের শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন, যে পর্যন্ত না তিনি এই পৃথিবী হতে বিদায় গ্রহণ করেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিণীগণ ই‘তিকাফ করতেন’।[5]
তবে কোনো নারী ই‘তিকাফ করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি লাগবে। ই‘তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন, আলিঙ্গন করা অবৈধ। তবে দেখাসাক্ষাৎ করা ও কথাবার্তা বলা এবং লেনদেন জায়েয। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ অবস্থায় আমার দিকে মাথা নুইয়ে দিতেন এবং আমি তাঁর মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিতাম। অথচ সেসময় আমি মাসিক স্রাবগ্রস্ত অবস্থায় থাকতাম। তিনি মানবীয় প্রয়োজন (পেশাব-পায়খানা) পূরণ করার উদ্দেশ্য ছাড়া বাড়িতে আসতেন না।[6]
(৩) বিশেষভাবে লায়লাতুল ক্বদরের রাতগুলো জেগে ইবাদত করা: আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي الوِتْرِ مِنَ العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‘রামাযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে ক্বদর রাতের অনুসন্ধান করো’।[7] আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমানসহ এবং ছওয়াবের আশায় ক্বিয়াম করে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করা হয়’।[8]
লায়লাতুল ক্বদরের ফযীলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ ক্বদর নামে একটি সূরা নাযিল করেছেন: ক্বদর শব্দের অর্থ মর্যাদা, সম্মান, নির্ধারণ, অনুমান এবং আদেশ ও ফয়সালা। আর লায়ল শব্দের অর্থ রাত। এ বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ রাতে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন লাওহে মাহফূয হতে দুনিয়ার আসমানে একসাথে অবতীর্ণ করেন। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ২৩ বছর ধরে অবতীর্ণ হয়। আর এ রাতেই প্রত্যেক মানুষের পূর্ণ এক বছরের বয়স, মৃত্যু, রিযিক্ব ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি যা পরবর্তী বছর পর্যন্ত ঘটবে লিপিবদ্ধ করা হয়। আল্লাহ বলেন, فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ‘এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থির করা হয় (আদ-দুখান, ৪৪/৪)।
আল্লাহ বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ - وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ - لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ - تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ - سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ‘নিশ্চয়ই আমরা এটিকে (কুরআনকে) ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি, আপনি কি জানেন, ক্বদরের রাত কী? ক্বদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ (জিবরীল) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক বিষয়ের ফয়সালা নিয়ে অবতরণ করেন। শান্তিময় সেই রাত্রি ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত’ (আল-ক্বদর, ৯৭/১-৫)।
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ইবরাহীম আলাইহিমাস সালাম-এর ছহীফাসমূহ রামাযানের প্রথম তারিখে, তাওরাত ছয় তারিখে, ইঞ্জীল ১৩ রামাযান, যাবূর ১৮ রামাযান এবং কুরআন ২৪ রামাযানে অবতীর্ণ হয়েছে’।[9] এ বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ রাতে যে দু‘আটি বেশি বেশি পড়তে হয়, তা হলো— اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমাকে ভালবাসো, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও’।[10]
পরিশেষে আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ, তিনি যেন আমাদের রামাযানের শেষ দশকের রাতগুলোতে ইবাদত করার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন।
মাহবূবুর রহমান মাদানী
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[3]. ফিক্বহুল মুয়াসসার, ১৪৫।
[4]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ, ২/১৩৪।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/২০২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭২।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৩৮।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১৭।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০১।
[9]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১৫৭৫।
[10]. তিরমিযী, হা/৩৫১৩, হাদীছ ছহীহ।