কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আল্লাহর দিকে দাওয়াত : দলীয় মোড়কে নাকি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে? (পর্ব-৭)

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : বিভক্তির চিত্র

‘যে কোনো সমাজে বিভক্তি মানেই হচ্ছে, সেখানে এমন কিছু যৌথ বিষয় থাকা, যেসব ব্যাপারে বিপরীতমুখী ও মতভেদপূর্ণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতভেদ পাওয়া যায়। দৃষ্টিভঙ্গি ও মতভেদগুলো এতো জটিল পর্যায়ে পৌঁছে যে, একট সন্তোষজনক পয়েন্টে সকলের একমত হওয়া সম্ভব হয় না। বরং একদল যাকে ভালো মনে করে, অপর দল সেটাকেই খারাপ মনে করে। একদল যাকে সৌভাগ্যের মনে করে, অপর দল সেটাকেই দুর্ভাগ্যের মনে করে।

এরপর খুব স্বাভাবিক একটি জ্ঞাত বিষয় হচ্ছে, এই ধরনের বিবাদমান বিষয়গুলো সাধারণত ঠুনকো কোনো বিষয় হয় না যে, সেগুলো সমাজের স্বল্প সংখ্যক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বা সমাজের নির্দিষ্ট কোনো ক্ষুদ্র শ্রেণির জন্য গুরুত্বপূর্ণ; বরং এই ধরনের বিষয় সাধারণত বড় বিষয় হয়ে থাকে, যা সমাজের বেশির ভাগ মানুষের জ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো এমন বিষয় হয়ে থাকে, যেগুলোকে অবজ্ঞা করার বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। বরং সেসব ব্যাপারে অংশগ্রহণ করা এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা অবধারিত হয়ে থাকে।

ব্যাপারটি থেকে দূরে সরে এখন ইসলামী পরিভাষার আলোকে বলতে চাই, বিভক্তি ঘটে থাকে হয় আক্বীদা ও মৌলিক বিষয়াবলিতে মতভেদের উপর ভিত্তি করে, না হয় আমল ও বিধিবিধানে মতভেদের উপর ভিত্তি করে, না হয় মানহাজ ও আচার-আচরণে মতভেদের উপর ভিত্তি করে।

আর ইসলামের প্রকৃতি সম্পর্কে যার ধারণা আছে, তিনি ভালো করেই জানেন যে, উপর্যুক্ত দিকগুলোর কোনোটাতে ইসলাম বিভক্তির সুযোগ রাখেনি। ইসলামের লম্বা ইতিহাসে এসব ইস্যুতে বিভক্তি দেখা যায়নি। তবে কিছ জঘন্য পরিণতি পরিলক্ষিত হয়েছে, যা জাতিকে ছিন্নভিন্ন করে ছেড়েছে এবং লাঞ্ছনার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করেছে। যা শত্রুদেরকে ইচ্ছেমতো মুসলিম উম্মাহর মান-সম্মান নিয়ে খেলা করার এবং তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

এসব ইস্যুতে ইসলাম বিভক্তির সুযোগ রাখেনি। কারণ ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপকভিত্তিক জীবনব্যবস্থার নাম। ফলে ইসলাম জীবনের এমন কোনো দিক ছাড়েনি, যেখানে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা বাতলে দেয়নি এবং এমন কোনো দিক ছাড়েনি, যে ব্যাপারে মুসলিমদেরকে অন্য চিন্তাচেতনা ও মতামতের সংঘাত থেকে অমুখাপেক্ষী রাখেনি’।[1]

অতএব, বলাই যায় যে, আমাদের সুমহান ইসলাম আমাদের জন্য ‘ইহকালীন পরকালীন যাবতীয় কল্যাণ নিয়ে এসেছে। ইসলাম মুসলিমদেরকে অন্য কারো মুখাপেক্ষী করেনি। তাহলে এ ধারণা কীভাবে চলতে পারে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এ জীবনবিধান অসম্পূর্ণ, যার জন্য বহিরাগত রাজনীতি লাগবে, যা একে পূর্ণতা দেবে অথবা বহিরাগত কোনো ক্বিয়াস বা রূপরেখা বা যুক্তি লাগবে?!

যে ব্যক্তি এমন ধারণা পোষণ করবে, সে ঠিক ঐ ব্যক্তির মতো, যে মনে করে যে, মানুষের অন্য আরেকজন রাসূল লাগবে!!

এসবকিছুর পেছনে কারণ হচ্ছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তা ব্যক্তির কাছে গোপন থাকা এবং সঠিক বুঝের অভাব, যে বুঝের তাওফীক্ব মহান আল্লাহ ছাহাবায়ে কেরামকে দিয়েছিলেন। ফলে তারা কেবল ততটুকুই যথেষ্ট মনে করেছিলেন, যতটুকু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছিলেন। তারা কেবল ততটুকু নিয়েই অন্য সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী হয়েছিলেন। আর এই বুঝের মাধ্যমেই তারা মানুষের মন ও দেশ জয় করেছিলেন’।[2]

‘অতএব, দলাদলি থেকে সাবধান ও সতর্ক থাকুন, -আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন-। দলাদলির মন্দ প্রভাব চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং এর অকল্যাণ উদ্ভূত হচ্ছে। দলাদলি আসলে ড্রেনের মতো, যা ঘোলা ও ময়লা পানি জমা করে এবং অযথা সেগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। তবে যার প্রতি আপনার রব রহম করেছেন, সে ব্যতীত। কেবল সে সেই নীতির উপর থাকতে পারে, যার উপর ছিলেন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার ছাহাবীবর্গ’।[3]

তাহলে হিযবিয়্যাহ বা দলাদলি অর্থ কী? কুরআনে কারীম শব্দটি কতগুলো অর্থে ব্যবহার করেছে? এর মনস্তাত্ত্বিক কী প্রভাবই-বা রয়েছে?

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : হিযবিয়্যাহ

কুরআনে হিযব (اَلْحِزْبُ) শব্দটি কয়েকভাবে এসেছে। অভিধানে এর নানান অর্থও রয়েছে। ফায়রূযাবাদী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হিযব এমন জামা‘আত, যাদের মধ্যে রূঢ়তা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, হিযব হচ্ছে- দল। আর ‘আহযাব’ (اَلْأَحْزَابُ) এমন কতগুলো দল, যারা নবীগণ আলাইহিমুস সালাম-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সঙ্ঘবদ্ধ হয়। মহান আল্লাহর বাণী,﴿‌فَإِنَّ ‌حِزْبَ ‌اللَّهِ﴾ –এর অর্থ আল্লাহর সাহায্যকারী। শব্দটি পবিত্র কুরআনে কয়েকটি অর্থে এসেছে:

(১) ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব, দল ও দ্বীনের কারণে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। এ অর্থে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿‌كُلُّ ‌حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ﴾ ‘প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৫৩)

(২) শয়তানের চ্যালাচামুণ্ডা। ইরশাদ হচ্ছে, ﴿أُولَئِكَ ‌حِزْبُ ‌الشَّيْطَانِ﴾ ‘তারাই শয়তানের দল’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/১৯)

(৩) দয়াময় আল্লাহর সৈনিক। এরশাদ হচ্ছে,﴿أُولَئِكَ ‌حِزْبُ اللَّهِ﴾ ‘তারাই আল্লাহর দল’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/২২)

দুনিয়াতে তারাই আসলে বিজয়ী, তারাই সংস্কারক। আল্লাহ বলেন,﴿فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ ‌هُمُ ‌الْغَالِبُونَ﴾ ‘অতএব, অবশ্যই আল্লাহর দলই বিজয়ী’ (আল-মায়েদাহ, ৫/৫৬)। পরকালেও তারাই সফলকাম। ইরশাদ হচ্ছে,﴿أَلَا إِنَّ ‌حِزْبَ ‌اللَّهِ ‌هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾ ‘জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/২২)

শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী বলেন, ‘আভিধানিক অর্থে ‘হিযব’ হচ্ছে এমন কিছু মানুষ, যাদেরকে আক্বীদা ও ঈমানের ক্ষেত্রে বা কুফরী, ফাসেক্বী ও পাপের ক্ষেত্রে বা এলাকা ও দেশের ক্ষেত্রে বা গোত্র ও বংশের ক্ষেত্রে বা পেশা ও ভাষার ক্ষেত্রে অথবা এ ধরনের অন্য কোনো সম্পর্ক ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য বা স্বার্থ সংঘবদ্ধ করেছে’।[4]

কোনো বিবেকবানের কাছে একথা অস্পষ্ট নয় যে, প্রত্যেকটা দলের অভ্যন্তরীণ কিছু মূলনীতি, চিন্তাচেতনা, কর্মসূচি ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, যেগুলোর সমন্বয়ই হচ্ছে সেই দলের সংবিধান, যদিও কোনো কোনো দলের এরকম কোনো সংবিধানের কথা উল্লেখ থাকে না।

এই সংবিধান ‘(দলের) মূল ভিত্তির স্থান দখল করে আছে, যেখান থেকে দলের পরিকল্পনা উপস্থাপিত হয় এবং এর উপর ভিত্তি করে দল প্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব, যে ব্যক্তি এই সংবিধানের প্রতি ঈমান রাখে এবং এটিকে হক্ব বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, অন্য ভাষায়- যে ব্যক্তি এই সংবিধানকে মেনে নেয় এবং এটিকে চলার ও কাজের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, সে ব্যক্তিই হয় সেই দলের নিয়মিত কর্মী এবং সে হয়ে যায় দলের সদস্য। আরো হয়ে যেতে পারে দলের কমিটির কেউ বা দলের কোনো রুকন। পক্ষান্তরে, যার বিশ্বাস এমনটা নয়, সে কিছুই হতে পারে না।

বুঝা গেলো, দলের সংবিধানই হচ্ছে মিত্রতা-শত্রুতা, ঐক্য-বিভক্তি এবং সম্মান-লাঞ্ছনার মূল ভিত্তি’।[5]

এর উপর ভিত্তি করে বলা চলে, ‘দুনিয়াতে দু’টি দল ছাড়া অন্য কোনো দল নেই: আল্লাহর দল এবং শয়তানের দল। সফলকাম দল ও ক্ষতিগ্রস্ত দল। মুসলিম ও কাফের।

ফলে যে ব্যক্তি আল্লাহর একটিমাত্র দলে অনেকগুলো দল ঢুকায়, সে আল্লাহর দলকে ছিন্নভিন্ন করা ও আল্লাহর দলের ঐক্য বিনষ্ট করার কাজে অংশগ্রহণ করে। যে ব্যক্তি অন্য কোনো দলের কারণে আল্লাহর দলের কতকের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলে, সে আসলে আল্লাহর অলি-আওলিয়ার সাথে শত্রুতা পোষণ করে চলে এবং সে মহান আল্লাহর নিম্নবর্ণিত বাণীর আওতায় পড়ে যায়-مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا، ‌فَقَدْ ‌بَارَزَنِي ‌بِالْمُحَارَبَةِ ‘যে ব্যক্তি আমার অলির সাথে শত্রুতা করে, সে মূলত আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়’।[6]

সম্পূর্ণ দ্বীন আল্লাহর জন্য হয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সংকীর্ণ ও ঘৃণ্য দলাদলি বর্জন করা এবং এর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না দেওয়া একজন মুসলিমের অধিকার। কারণ এই দলাদলি আল্লাহর দলকে দুর্বল করে দেয়’।[7]

তবে ‘হিযব’ নাম থেকে পালিয়ে অধিক উপযুক্ত ও চটকদার কোনো নামের দিকে ঝুঁকে পড়া মূলত এমন বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া, যা মূর্খতা দ্বারা আবৃত। কারণ ‘হিযব’ শব্দটি আভিধানিক বা পারিভাষিক কোনো অর্থেই নিন্দনীয় নয়। দলাদলির অন্তরালে যে তিক্ত বাস্তবতা ও ঘটনাপূঞ্জ লুকিয়ে থাকে, সেটাই মূলত নিন্দনীয়। দলাদলি যে ফলাফল, বিভক্তি ও বিভেদ বয়ে আনে, মূলতা সেগুলোই নিন্দনীয়।

যেসব আয়াতে ‘হিযব’ কথাটি উল্লিখিত হয়েছে, সেসব নিয়ে গবেষণা করলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যাবে, যেখানে কোনো অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়।

অতএব, ‘এই নাম পরিবর্তন বৈধ নয়’।[8] কারণ নাম কোনো কিছুর বাস্তবতা বদলায় না। আর বাহ্যিক রূপ অভ্যন্তরীণ বিষয়ের প্রতিফলন। যে ব্যক্তি বিবর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে আপনার উদ্দেশ্যে প্রফুল্লতা প্রদর্শন করে, সে তা কেবল এজন্য করে যে, তার মধ্যে দলের সদস্যদের প্রতি ঘনিষ্ঠতা, ভালোবাসা ও পক্ষাবলম্বন গ্রোথিত রয়েছে। যেহেতু তার চোখ আপনার চোখে পড়েছে, তাই সে এমন হাসি দিতে বাধ্য হয়েছে। আপনি তাকে না দেখলে কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে চলে যেত।

(চলবে)

মূল : আলী ইবনে হাসান আল-হালাবী আল-আছারী

অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী

বি. এ. (অনার্স), উচ্চতর ডিপ্লোমা, এম. এ. এবং এম.ফিল., মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
অধ্যক্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ১৯-২০।

[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, এ‘লামুল মুওয়াক্কে‘ঈন, ৪/৩৭৬।

[3]. বাকর আবূ যায়েদ, হিলইয়াতু ত্বলিবিলি ইলম, পৃ. ৬৫।

[4]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৭।

[5]. আল-আহযাব আস-সিয়াসিয়্যাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ১৩।

[6]. ছহীহ বুখারী, ১১/২৯২; দ্রষ্টব্য: সিলসিলাতুল আহাদীছ আছ-ছহীহাহ, হা/১৬৪০।

[7]. আয়েয আল-ক্বরনী, আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ আল-মু‘আছেরাহ, পৃ. ১২।

[8]. আল-মুনতাক্বা আন-নাফীস মিন তালবীসি ইবলীস, পৃ. ৪৭০।

Magazine