[ক]
গল্প- এক চাষা একবার বিয়ের সাজে সেজে রাজার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। পথে যে-ই যাচ্ছে, সে-ই জিজ্ঞেস করছে, ব্যাপার কী? চাষার একই উত্তর, ‘রাজকন্যাকে খুব ভালোবাসি তো, তাই তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি; বিয়ে প্রায় ফাইনাল’। জবাব শুনে অধিকাংশ লোকই হতবাক!!! একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, বুঝলাম আপনি ভালোবাসেন, কিন্তু রাজকন্যা বাসে তো?’ চাষার নির্লিপ্ত জবাব, ‘তা জানি না’।
প্রিয় ভাই! বিয়ে কি হবে? উত্তর ‘না’ হওয়ারই কথা। খুব যারা আশাবাদী তাঁরা হয়তো ভাববেন, বর যেহেতু রাজী তাহলে তো বিয়ের অর্ধেক কাজ শেষই, তাই না? কিন্তু বাস্তবতা নিশ্চিতই ভিন্ন। কারণ ভালোবাসা এমন এক জিনিস, যা একতরফাভাবে পূর্ণতা লাভ করে না। তাই চাষা যতই আশাবাদী হোক, এটাকে ভালোবাসা না বলে পাগলামি বলাই সম্ভবত যুক্তিযুক্ত।
[খ]
লিখার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আল্লাহর ভালোবাসা’। সচেতনভাবেই, এটা দ্বিমাত্রিক— প্রথমত, আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি। আর দ্বিতীয়ত, আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন। অর্থাৎ দু’দিক থেকেই ভালোবাসা।
গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত এমন কোনো মুসলিম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বলবে, আমি আল্লাহকে ভালোবাসি না। কারণ আল্লাহকে ভালো না বাসলে যে, ঈমানই থাকে না। কেননা মুহাব্বতের প্রথম ভাগই ‘আল্লাহর মুহাব্বত’। ঈমানের জন্যই এটা শর্ত।
পাশাপাশি ঈমানের পূর্ণতার জন্য শর্ত ‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’। যতক্ষণ না আল্লাহর জন্য কাউকে বা কোনো কিছুকে ভালোবাসা হবে, আর আল্লাহর জন্যই কারো প্রতি কিংবা কোনো কিছুর প্রতি ঘৃণা করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। এক্ষেত্রে সর্বপ্রধান হচ্ছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মুহাব্বত; তাঁর সুন্নাহর প্রতি ভালোবাসা।
আমরা আল্লাহকে, তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুহাব্বত করি; মুহাব্বতের দাবি করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন।
[গ]
ভালোবাসার নিয়মনীতির অন্যতম হচ্ছে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানো। আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন; তার হাজারো নমুনা দৃশ্যমান। যেমন- তিনিই লালনপালন করেন, নানা নেয়ামত দান করেন, দয়া করেন, ক্ষমা করেন। সবই তো ভালোবাসার প্রকাশ।
বলতে পারেন, এসব তো তিনি কাফেরদেরও করেন। হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে মুমিনদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশও আছে। যারা ঈমানদার, তাঁরা তা বুঝতে পারেন। দরিদ্রতা ও অসুস্থতাকে ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে নেওয়া আমরা হয়তো বুঝি না; কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম বুঝতেন, সালাফে ছালেহীন বুঝতেন, এযুগের পূর্ণ ঈমানদারগণও বুঝেন।
আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা নেন এটাও এক ধরনের ভালোবাসা। কেননা তিনি আমাদের মর্যাদা উচ্চ করতে চান, নেয়ামত বাড়িয়ে দিতে চান। নইলে পাপ করে তওবাকারী কীভাবে আগের চাইতে বেশি মর্যাদাবান হয়? দুনিয়ার কোনো হিসেবে কি মেলে? চাকরিতে ভুল করে ক্ষমা চাইলে কি প্রমোশন হয় কখনো?
প্রিয় ভাই! দেখুন ক্লাসে কোন্ ছাত্রকে শিক্ষক বেশি কাজ দেন, পড়া জেজ্ঞেস করেন? নিশ্চয়ই ভালো ছাত্রকে। কেন? ছাত্রের মঙ্গলের জন্যই। আর খারাপ ছাত্রকে বেশি কাজ না দেওয়া তাকে সুবিধা দেওয়া নয়; বরং তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া। কাফেরদের ক্ষেত্রে আল্লাহ দুনিয়াতে এমনই করে থাকেন।
কিংবা ধরে নিন, আপনার কোম্পানিতে নতুন কোনো ইভেন্ট করবেন। দায়িত্ব কাকে দেবেন? যে আপনার বিশ্বস্ত, যাকে আপনি ভালো জানেন ও যোগ্যতাসম্পন্ন। তাকেই তো? কাজ শেষ হয়ে গেলে পুরস্কারও নিশ্চয় তিনিই পাবেন। আর যদি তিনি চ্যালেঞ্জ না নেন, পুরস্কার সম্ভবত অন্যের ভাগ্যেই জুটবে।
আল্লাহ তাআলার পরীক্ষা মুমিনদের জন্য এমনই। এমন কোনো পরীক্ষা তিনি নেন না, যাতে তাঁর ভালোবাসা লেগে থাকে না। এজন্যই দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার শিকার হয়েছেন নবীগণ, তারপর পর্যায়ক্রমে তাক্বওয়াবানগণ।
প্রিয় ভাই! আল্লাহ তাআলা তাঁর ভালোবাসার আরো একটি প্রমাণ রেখে দিয়েছেন। তা হচ্ছে, তিনি যাকে ভালোবাসেন, সকল মানুষের মাঝে সে ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেন। টাকাপয়সা নেই, উচ্চতর ডিগ্রি নেই, ক্ষমতা কিংবা বড় চাকরি নেই, নেই গাড়ি-বাড়িও, কিন্তু সমাজে তাঁর সম্মান আছে, লোকজন তাঁকে ভালোবাসে— এমন নযীর আমাদের আশেপাশেই বিদ্যমান। একটু খুঁজলেই হয়তো পেয়ে যাব। কারণ? আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভালোবেসেছেন। মানুষ কি আর ভালো না বেসে পারে?
[ঘ]
আমরা দাবি করি, আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি। কিন্তু প্রকাশের দিক থেকে আমরা বড়ই কৃপণ। আমরা শুধু মুখে বলেই এই ভালোবাসা প্রকাশ করি। কাজে-কর্মে তেমন কোনো প্রকাশ দেখি না। হ্যাঁ, অনেক সময় বিশাল মিছিল-মিটিং, ওয়ায-মাহফিলে যোগদান কিংবা মীলাদ-ক্বিয়ামের আয়োজন করেই মনে করি ভালোবাসার প্রকাশ হয়ে গেল। এতেই মুহাব্বতের হক্ব সর্বোত্তম উপায়ে আদায় করছি বলে মনে করি।
প্রিয় ভাই! একবারও ভেবে দেখি না— এসব কি সত্যিই ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য? আল্লাহ তাআলার পছন্দও কি এই? ইসলাম নির্দেশিত পন্থাও কি এগুলো?
উত্তর আপনাদের হাতেই তোলা থাকল।
[ঙ]
অনেকে বলে, ‘ছালাত না পড়লে কি হবে ঈমান শক্ত আছে’ কিংবা ‘সুন্নাহ না মানতে পারলেও আমি আল্লাহকে ভালোবাসি, তাঁর রাসূলকে ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালোবাসি’।
প্রিয় ভাই! ‘মুহাব্বতই সবকিছু (আমলের দরকার নেই)’ এমন বক্তব্য ইসলামের না। এটা ‘ভক্তিতে মুক্তি’ চেতনারই অন্য প্রকাশ। সনাতনধর্মী বা খ্রিষ্টানদের এসব বক্তব্য ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামে এমন নযীর একটিও নেই, যেখানে কোনো ছাহাবী, কিংবা কোনো তাবেঈ নতুবা কোনো তাবে-তাবেঈ অথবা আমাদের পুণ্যবান সালাফগণ শুধু ভালোবাসার কথা বলে গেছেন, আমলের কথা বলেননি বা নিজে আমল ত্যাগ করেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সুন্নাত ছেড়ে দেওয়ার নযীরও আমরা তাঁদের মধ্যে খুব একটা দেখি না, সেখানে শুধু মুহাব্বত দিয়ে কীভাবে নাজাত সম্ভব আমার জ্ঞানে ধরে না!
হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা চাইলে যে কাউকেই ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে সেটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন।
প্রিয় বন্ধু! ‘ভক্তিতেই মুক্তি’ শ্লোগানের ফলে সনাতন আর খ্রিষ্টান ধর্মের কী হাল, তা তো নিজের চোখেই দেখছেন। এখন সেসব শুধু আচার সর্বস্ব ধর্ম হিসেবেই আছে।
এমনই হবে যদি আমল বাদ দিয়ে শুধু মুহাব্বতের ফেরিওয়ালাদের হাতে ইসলামের পতাকা তুলে দেওয়া হয়। সমাজে যত বিদআত আর বিতর্ক এসবের মূল কারিগরও কিন্তু এরাই।
[চ]
প্রিয় ভাই! এবার দেখি ভালোবাসা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কী বলেছেন— ‘বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আলে ইমরান, ৩/৩১)।
উক্ত আয়াত আমরা প্রায় সবাই জানি, অর্থও শুনেছি। কিন্তু গভীরভাবে ভাবিনি হয়তো কোনোদিন। প্রিয় ভাই! আল্লাহর মুহাব্বতের সার্বিক রূপরেখা এই আয়াতে বিদ্যমান।
একদা একদল লোক রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি। তখন এই আয়াত নাযিল হয়। বলা হয়- যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করো। হাসান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘এটা হলো পরীক্ষা, তাদের ঈমানের’। অর্থাৎ দেখা হবে তাঁরা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করে কি-না? ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, ‘এই আয়াত সকলের জন্যই মানদণ্ড, যারা আল্লাহর মুহাব্বতের দাবি করে। যদি কেউ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ত্বরীক্বার উপর না থাকে, তবে সে তার দাবিতে মিথ্যাবাদী’। তাফসীরে তবারীর ভাষ্যমতে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ হচ্ছে আল্লাহর মুহাব্বতের আলামত।
প্রিয় ভাই! এবার সম্ভবত পরিষ্কার যে, কীভাবে আল্লাহর মুহাব্বত প্রকাশ করব। একটাই উপায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ অনুসরণ। ছাহাবায়ে কেরাম করেছেন সেভাবে; নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে যেভাবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে; সকল কাজে-কথায় ও আচরণে। এটাই মানদণ্ড কে আল্লাহকে কতটুকু ভালোবাসে তার। যার সুন্নাহর অনুসরণ বেশি, তিনি আল্লাহকে বেশিই ভালোবাসেন। আর যার কম, তার নিজেকে প্রশ্ন করাই মঙ্গলজনক।
[ছ]
আয়াতে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আল্লাহ তাআলা তাঁর ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম করেছেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ। কেননা আল্লাহ দুনিয়াতে দৃশ্যমান সত্তা নন, তাঁকে অনুসরণও করা যায় না। এজন্য ভালোবাসার প্রকাশ মানুষের জন্য সহজ করে দিয়েছেন, যেন মানুষ আমল করতে পারে।
সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা নিজের ভালোবাসার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। এখানেও তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন এখানে আল্লাহ তাআলা পরিপূর্ণ ভালোবাসার শর্ত করেননি; শর্ত করেছেন আমল।
কারণ অন্তরের উপর মানুষের যতটা নিয়ন্ত্রণ, তার চাইতে বেশি আমলের উপর। সুতরাং কেউ যদি যথার্থভাবে আল্লাহকে ভালোবাসতে সক্ষম নাও হয়, কিন্তু সুন্নাহর অনুসরণে পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পারে, তবে আল্লাহ তাআলাই তাঁকে ভালোবাসবেন, আর তার ত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন। বান্দার দিক থেকে ভালোবাসার অপূর্ণতা আল্লাহ তাআলা তাঁর ভালোবাসা দিয়ে ঢেকে দেবেন। সুবহানাল্লাহ!! কতই মহান আমাদের মালিক!!
[জ]
প্রিয় ভাই! এবার সময় নিজের অবস্থা যাচাইয়ের। আত্মজিজ্ঞাসা করি— আল্লাহর প্রতি আমার ভালোবাসা কেমন ও কতটুকু? তা নিজের পছন্দমতো কাজ দিয়ে, না-কি আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায়? আর আল্লাহ তাআলাই কি আমাকে ভালোবাসেন?
শেষ প্রশ্নটুকু কিন্তু ভুলে যাবেন না। সারা জীবন আপনি আল্লাহকে ভালোবেসে গেলেন— তবে নিজের পন্থায়; কুরবানী করলেন, কষ্ট করলেন, নিজের মনগড়াভাবে। অথচ আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পেলেন না? এমন হলে কী হবে? দুনিয়াও বরবাদ, আখেরাতও বরবাদ।
প্রিয় ভাই! মাআযাল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন হওয়া থেকে হেফাযত করুন। সাথে সাথে আমাদেরও সতর্ক হওয়া উচিত, নিজেদের কাজ আর আমলের হিসাব নেওয়া। এখনো যদি না করি, তবে তো চাষার মতোই আমাদের অবস্থা। লোকজন আমাকে পাগল ভাববে; আর আমি ভাবব কাজ তো হয়েই গেছে, সামান্যটুকু মাত্র বাকী!!!
প্রিয় ভাই! জানি প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে আমরা অনেক দূরে। কিন্তু তা তো অসম্ভব নয়, আর আল্লাহ তাআলাও এতে সাহায্য করবেন নিশ্চিতরূপেই। একটি একটি করেই না হয় সুন্নাহ পালন শুরু করি। একদিন হয়তো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ অনুসরণ করতে পারব।
সেদিন আল্লাহর প্রতি আমাদের ভালোবাসার দাবি সত্য হবে; আর প্রতিদান যা পাব তা না হয় নাই-বা বললাম। থাক না কিছু গোপনই। দয়াময় যা দিবেন, তা তো আর বলে বুঝানো যাবে না। তাঁর মতোই অসীম আর অবিস্মরণীয় আনন্দের উৎসই হবে সে দান। মুমিন হৃদয় তো সে প্রতীক্ষাতেই বাঁচে।
মুস্তফা মনজুর
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।