কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

কুরআন ও বিজ্ঞানের আলোকে চোখের গুরুত্ব

post title will place here

মহান আল্লাহর অপার হিকমত ও অসীম কুদরতের দিকে লক্ষ করো, তিনি বীর্য থেকে মানবদেহ সৃষ্টি করেছেন। এতে রয়েছে আল্লাহর অশেষ মহিমা ও অসীম কুদরতের আলামত। তিনি তাঁর নিপুণ সৃষ্টি কৌশলে যে অবয়বে মানবদেহ সৃষ্টি করেছেন তাতে কোনো পরিবর্তন ও হ্রাস-বৃদ্ধির সুযোগ নেই। সামান্য পরিবর্তন করতে যাওয়ার অর্থই হলো নানা সমস্যার সৃষ্টি করা। এতে আছে আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরতের নিদর্শন ও চিন্তাশীলদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। 

পক্ষান্তরে জ্ঞানসমৃদ্ধ, পূর্ণ ঈমানে দীপ্ত মানুষ অবশ্যই নিজের শারীরিক গঠন এর বিকাশ এবং এর কার্যনিপুণতা নিয়ে গভীর গবেষণা করে থাকে। তাই আল-কুরআন একনিষ্ঠ বিশ্বাসী, জ্ঞানী এবং চিন্তাশীল লোকদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছে,﴿وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ-وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ﴾ ‘একনিষ্ঠ বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে রয়েছে যেমন অসংখ্য নিদর্শন, তেমনি তোমাদের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে অনেক নিদর্শন, তারপরও কি তোমরা তা দেখবে না? (আয-যারিয়াত, ২০/২১)

চোখের মাঝে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ ও রহস্য :

মানবদেহ পরিচালনা করে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কে তথ্য সরবরাহ করে অনেক সেন্টার। এর মধ্যে চোখ অন্যতম। চোখ দেখে বহুদূর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে মস্তিষ্কের কাছে তথ্য পৌঁছায়। চারপাশের দৃশ্যাবলি চোখের সহায়তায় মস্তিষ্কে দৃশ্যকরণ করে তথ্য পাঠায়। মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চোখের বিশাল ভূমিকা রয়েছে।

চোখ নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে পাঠকবৃন্দকে অনুরোধ করছি, একবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার সঙ্গে আপনাদের চোখ দু’টিকে বুজে রাখতে। কী দেখছি? সবই অন্ধকার! লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সাদা, বেগুনি, গোলাপি, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, তরুলতা, জীবজন্তু, পশু-পক্ষী সবই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সবই এক রূপ ধারণ করেছে এবং সে রূপ ভয়াবহ অন্ধকার। এর মধ্যে ধনী-গরীবের কোনো পার্থক্য নেই। এর মধ্যে সাধু, অসাধু, বীর, কাপুরুষের ভেদাভেদ নেই। সবই এক স্থানে রূপ নিয়েছে।

সবার আস্ফালন, সবার হিম্মত, সবার ধন-দৌলত একাকার হয়ে মিলেছে ওই অন্ধকারে। কঠিন! জটিল ওই অন্ধকার। সবাইকে এক ছাঁচে মিলিয়েছে। হার মানি ওই অন্ধকারের কাছে। মায়ের পেটে ছিলাম সেই অন্ধকারে। আবার চলে যাব সেই মহা অন্ধকার ঘরে। ওহ! সেই মহা অন্ধকারের স্রষ্টা কে? জানাই তাঁকে অসীম শ্রদ্ধা। জানাই তাঁকে লাখো শুকর, যিনি চোখ দিয়ে এই মহা অন্ধকার হতে রক্ষা করেছেন ও আলোর পথ দেখিয়ে প্রেমের রজ্জুতে বেঁধে দিয়েছেন।

আসুন! আমরা চোখের গঠনপ্রণালি নিয়ে আর একটু অগ্রসর হই এবং দেখি আল্লাহর তৈরি চোখের রূপ কেমন। বৈজ্ঞানিকদের মতে, চোখের ঝিল্লিতে মোট নয়টি স্তর আছে। এদের সমষ্টি সূক্ষ্ম কাগজের চাইতেও পাতলা। সকলের অভ্যন্তরস্থ ঝিল্লি স্তরটি ৩ কোটি দণ্ড ও ৩০ লক্ষ ঘনক্ষেত্র দিয়ে প্রস্তুত। এই স্তরগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে। চোখের কাচ পুটকগুলো ঘনত্বের দিক দিয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন, তার ফলে চোখের জ্যোতি একই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত হয়। চোখের মধ্যে যেসব ক্ষুদ্র দর্পণ বা প্রতিফলক রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে লক্ষ লক্ষ শিরা, উপশিরা ও সূক্ষ্ম স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রয়েছে। দেহের প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত দৃষ্টিশক্তি লাভ করা একরূপ অসম্ভব।

‘আধুনিক বিজ্ঞান ও আল্লাহ’ নামক গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে, দর্শন-যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চোখ, যা নিজে ১৩ কোটি আলো বিকিরণকারী যন্ত্রের সমষ্টি এবং এই সকল যন্ত্র হচ্ছে স্নায়ুর কেন্দ্রবিন্দু। আচ্ছাদিত চোখের পাতায়, চোখের দিনরাত রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং এই পাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়া করে। এটি নাড়াতে কোনো ইচ্ছার দরকার হয় না। ধুলাবালি, মাটি, কঙ্কর প্রভৃতি যাবতীয় ক্ষতিকর বহিরাগত জিনিস থেকে এই পাতাই চোখকে রক্ষা করে। অনুরূপভাবে ভ্রুর ছায়া তাকে সূর্যের উত্তাপের প্রখরতা থেকেও রক্ষা করে। চোখের পাতার ক্রমাগত উত্থানপতন চোখকে বহিরাগত ক্ষতিকর জিনিস থেকে রক্ষা করা ছাড়াও চোখের শুষ্কতা প্রতিরোধ করে। চোখের পানি, যাকে অশ্রু বলা হয়ে থাকে, তা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী নিষ্কাশক।[1]

এই চোখের গঠন আল্লাহ তাআলা এমনভাবে করেছেন যে, চোখের ওপরে কপালের সাথের হাড়টিকে একটু উঁচু করেছেন যেন কোনো জিনিস এসে হঠাৎ করে চোখে আঘাত করতে না পারে। কোনো জিনিস এসে চোখে আঘাত করতে গেলেই তা চক্ষু কোটরের হাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এভাবে চোখ আঘাত থেকে রক্ষা পায়। কোনো ক্ষুদ্র বস্তু চোখে পড়তে গেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা চোখের ভ্রুর ব্যবস্থা করেছেন যেন এই চোখ সূর্যের প্রখর আলো থেকে হেফাযতে থাকে। চোখে পানির ব্যবস্থা করেছেন যেন এই পানি চোখকে ধুয়ে প্রতি মুহূর্তে পরিষ্কার করে দেয় এবং মানুষ স্বচ্ছভাবে দেখতে পায়।[2]

আমাদের চোখ প্রতি সেকেন্ডে ১০টি করে ছবি তুলতে পারে। কাজেই একজন মানুষ যদি প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে ঘুমায় আর বাকী সময় জেগে থাকে তাহলে সে ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার ছবি তুলতে সক্ষম। আচ্ছা, দুনিয়ার কোনো ক্যামেরা কি ব্যাটারি বা ইলেকট্রিক চার্জ ছাড়া বছরের পর বছর চোখের মতো ছবি তুলতে পারবে? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলার এই সৃষ্টির মধ্যে আমাদের জন্য অনেক কিছু ভেবে দেখার বিষয় রয়েছে। 

তাছাড়াও একটি চোখ প্রতি মিনিটে গড়ে ১২ বার পিটপিট করে বা চোখের পাতা ফেলে। আট ঘণ্টা ঘুম আর বাকী সময় জেগে থাকা কোনো মানুষ প্রতিদিন গড়ে ১১ হাজার ৫২০ বার চোখ পিটপিট করে বা চোখের পাতা ফেলে। কিছু রোগ-জীবাণু রয়েছে যেগুলো চোখের পাতা ফেলতে বাধার সৃষ্টি করে। চোখের পাতা যদি সঠিকভাবে খুলে আর বন্ধ হয় তবে সেই রোগ-জীবাণুগুলো আমাদেরকে আক্রমণ করতে পারে না। আর মানুষ তখনই চোখের পাতা পিটপিট করার মূল্য বুঝতে পারে যখন সে এই ধরনের কোনো রোগে আক্রান্ত হয়। আমরা সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, যিনি আমাদেরকে প্রতিদিন ১০ হাজারেরও বেশি বার চোখের পাতা পিটপিট করার ক্ষমতা দিয়েছেন, আর এজন্য তিনি কোনো মূল্য গ্রহণ করেন না। 

আমাদের জীবনে চোখে দেখার সামর্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়? আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আমাদের চোখ কী ধরনের নিদর্শন বহন করছে?

চোখই হচ্ছে প্রাণ সৃষ্টির অন্যতম সুস্পষ্ট প্রমাণ। চোখ মানুষেরই হোক বা অন্য কোনো প্রাণীরই হোক, শ্রেষ্ঠতম ডিজাইনে তৈরির অন্যতম উদাহরণ। এই দুনিয়ায় মানুষের তৈরি যত রকম জটিল জিনিস রয়েছে তার চেয়ে চোখের গঠন অনেক বেশি জটিল এবং অভিভূতকারী। চোখকে ব্যতিক্রম ধরনের অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়।

চোখের গঠন প্রক্রিয়ার কাছে বিবর্তনবাদী প্রবক্তাদের ‘আকস্মিক ঘটনার ধারাবাহিকতা’ তত্ত্বের সমস্ত প্রমাণ মিথ্যা সাব্যস্ত হয়েছে। চোখের গঠন অন্যান্য সৃষ্টি হতে একটি ব্যতিক্রম এমনভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। চোখের রয়েছে বহু অংশ নিয়ে গঠিত জটিল প্রক্রিয়া এবং এগুলো প্রত্যেকটি একই সাথে গঠিত। এটিও অসম্ভব যে, একটি অর্ধেক প্রক্রিয়ার চোখ দিয়ে অর্ধেক দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে কোনো মতেই চোখ দেখার কাজ করতে পারে না। বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা এটা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। 

চোখ ও পাখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা শুধু তখনই কাজ করতে সক্ষম যখন তারা সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়। অর্থাৎ একটি অর্ধ-বিকশিত চোখ দেখতে পারে না। তেমনি একটি অর্ধ-গঠিত পাখা নিয়েও পাখি উড়তে পারে না। এই মুহূর্তে আমরা আবার সেই খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হই, কে চোখের সমস্ত উপাদান একত্র করে সৃষ্টি করলেন?

এক্ষেত্রে আমরা এমন একজন মহাজ্ঞানীর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করতে বাধ্য, যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। প্রাণীদের জন্য দেখার ক্ষমতা, চলার ক্ষমতা, শোনার ক্ষমতা ইত্যাদিও দান করেছেন।

অন্য একটি বিষয় হচ্ছে চেতনাহীন কোষ দ্বারা চেতনাবিশিষ্ট এমন প্রাণ তৈরি, যার রয়েছে দেখার ক্ষমতা, শোনার ক্ষমতা ইত্যাদি। এটা স্ফটিকের মতোই পরিষ্কার যে, এটা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলছেন,﴿قُلْ هُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ﴾ ‘আপনি বলে দিন! তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং অন্তঃকরণ। তোমরা খুব সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (আল-মুলক, ৬৭/২৩)। কিছু চোখ আল্লাহকে চেনার জন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টি অবলোকন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এমন চোখ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,﴿الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ - ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ﴾ ‘যিনি স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখতে পাবে না। তুমি আবার তাকিয়ে দেখো, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফেরাও, সে দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে’ (আল-মুলক, ৬৭/৩-৪)

যে চোখ আল্লাহকে চেনে না, সে চোখ হতভাগা। যে চোখ আল্লাহকে মানে না, সে চোখ অভিশপ্ত। যে চোখ অহীর জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, সে চোখ অবাঞ্ছিত। যে চোখে মানুষের জন্য অশ্রু নেই, মানবতার জন্য শিশির নেই, সেটি মরুচোখ। এমন চোখ থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই।

চোখ কত বড় নেয়ামত : এই কঠিন কাজকে আয়ত্ত করার জন্য একটু চিন্তা করে দেখুন, যে চোখ আল্লাহ তাআলা আপনাকে দিয়েছেন এটা কেমন জিনিস! এটা এমন এক যন্ত্র তিনি আপনাকে দান করেছেন, যা জন্ম থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো পয়সা ছাড়া এবং কোনো পরিশ্রম ছাড়া কাজ করে যাচ্ছে। এমনভাবে কাজ করছে যে, যা ইচ্ছা তা এই চোখ দিয়ে দেখতে পারছেন। যে কোনো দৃশ্য দেখে উপভোগ করতে পারছেন। আল্লাহ তাআলা যদি আপনাকে এই যন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করার তাওফীক্ব দান করেন তখন বুঝতে পারবেন যে, ছোট্ট এই জায়গায় আল্লাহ তাআলা কেমন কারখানা বসিয়ে রেখেছেন। 

চক্ষু বিশেষজ্ঞরা কলেজ, ইউনির্ভাসিটি ও হাসপাতালে সারাজীবন ব্যয় করেও এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হলো না যে, এটা কেমন কারখানা। এই কারখানার মধ্যে কতগুলো পর্দা রয়েছে, কতগুলো ঝিল্লি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা এর মধ্যে কতগুলো পর্দা ফিট করে দিয়েছেন। কিন্তু যেহেতু এটা বিনামূল্যে পাওয়া গেছে, এর জন্য কোনো পয়সা খরচ করতে হয়নি, কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি, এজন্য এই নেয়ামতের কোনো কদর নেই।

বিস্ময়কর চোখের মণি : চোখের মধ্যে আল্লাহ তাআলা এক বিস্ময়কর ব্যবস্থা রেখেছেন। আমাকে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, মানুষ যখন আলোর মধ্যে যায় তখন তার চোখের মণি বিস্তৃত হয় আর যখন অন্ধকারে আসে তখন চোখের মণির স্নায়ুসমূহ সংকুচিত হয়। কারণ অন্ধকারের মধ্যে ঠিকভাবে দেখার জন্য তা সংকুচিত হওয়া জরুরী। ওই চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, এই বিস্তৃত হওয়া ও সংকুচিত হওয়ার কাজে মানুষের চোখের শিরা-উপশিরা সাত মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। এ কাজটি নিজে নিজে হয়ে যায়। এই কাজ যদি মানুষের হাতে ন্যস্ত করা হতো আর বলা হতো যে, যখন তুমি অন্ধকারের মধ্যে যাবে, তখন এই বোতামটি চাপবে আর যখন আলোর মধ্যে যাবে তখন এই দ্বিতীয় বোতামটি চাপবে তাহলে তোমার চোখ ঠিকভাবে কাজ করবে, তাহলে দেখা যেত ভুল সময়ে অথবা প্রয়োজনের অধিক বোতাম চেপে বসত। কিন্তু আল্লাহ তাআলা একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা চোখে বসিয়ে দিয়েছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী চোখের মণি বিস্তৃত ও সংকুচিত হয়।

চোখের পাপড়ির রহস্য ও আধুনিক বিজ্ঞান : মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর চোখে কেন পাপড়ি থাকে? এর কাজই-বা কী? এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক দিন ধরেই চলছে গুঞ্জন, কানাঘুষা। কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা, ধুলাবালি ও ক্ষতিকর পদার্থ যাতে চোখে প্রবেশ করতে না পারে, এ জন্য চোখের পাপড়ি অনেকটা ছাঁকনির মতো কাজ করে। অন্যরা বলেন, এটি বিড়ালের গোঁফের মতো এক ধরনের সেন্সর হিসেবে কাজ করে; যা চোখকে বাতাসবাহিত বালুকণা ও বিপদ থেকে সতর্ক করে।

চোখের পাপড়ি ও তাতে বিদ্যমান সূক্ষ্ম পালকগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, চোখের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গের হেফাযতের জন্য এগুলো একান্ত প্রয়োজন। এগুলোকে আল্লাহ তাআলা সক্রিয়তা ও দ্রুত উঠানামার শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যেন এগুলো বাতাসে উড়ন্ত ধুলাবালি ও ময়লা থেকে চোখকে রক্ষা করতে পারে। চোখের উপর কোনো ধুলাবালি পড়ার উপক্রম হলেই পাপড়িগুলো তা প্রতিরোধ করে এবং চোখকে সেগুলোর অনিষ্টতা হতে রক্ষা করে। 

আল্লাহ তাআলা চোখের পলককে এমন এক বিশেষ ক্ষমতা ও ব্যবস্থা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন যে, প্রয়োজনের সময় তা সক্রিয় হয়ে উঠে, প্রয়োজনে বন্ধ হয়ে যায় আবার খুলে যায় এবং চোখকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা থেকে রক্ষা করে। চোখকে নানা বিপর্যয় থেকে রক্ষা কারা ছাড়াও পলক চোখের ও চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। শোভা বৃদ্ধির জন্যই চোখের পাপড়িগুলোকে পরিমাণ অনুযায়ী লম্বা করে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি এর চেয়ে বেশি লম্বা করা হতো, তবে চোখের জন্য তা হতো যন্ত্রণাদায়ক। আবার বেশি খাটো হলেও সমস্যা দেখা দিত।

বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, দৃষ্টিশক্তির ওপর বাধা সৃষ্টি না করেই বাতাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রিতভাবে পাপড়ির মধ্য দিয়ে চোখে সন্তোষজনক মাত্রায় প্রবাহিত হতে পারে। চক্ষুর গোলকে মিউকাস, তেল ও পানির সমন্বয়ে যে প্রলেপ থাকে তা শুকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে এই পাপড়ি। একই সঙ্গে এটি একটি পরোক্ষ ধুলা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করে। পাপড়ি চোখকে শুষ্ক হয়ে ওঠা ও সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে।

চোখের পানি আল্লাহর বড়ই কুদরত ও রহস্য : আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,﴿سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ﴾ ‘এখন আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলি প্রদর্শন করাব পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে, এ কুরআন সত্য। আপনার পালনকর্তা সর্ববিষয়ে সাক্ষ্যদাতা, এটা কি যথেষ্ট নয়? (ফুছছিলাত, ৪১/৫৩)

চোখের পানি সাধারণ কিছু নয়। এটি শ্লেষ্মা, পানি, তেল ও ইলেকট্রোলাইটের একটি জটিল মিশ্রণ। আল্লাহ তাআলা অনেক উপকারী হিসেবে এটি সৃষ্টি করেছেন। এটি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী, যা চোখের ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে, এটি কর্ণিয়াকে মসৃণ করে, পরিষ্কার দৃষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। 

এটি কর্ণিয়াকে যথেষ্ট আর্দ্র রাখে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে, এটি চোখের জন্য ওয়াইপার (Wiper) হিসেবে কাজ করে।

চোখ একদিন কথা বলবে : সিনেমা দেখে চোখে পানি আসে! নাটক দেখে চোখে পানি আসে! বিরহের গান শুনলে চোখে পানি আসে! অবৈধ প্রেমের কারণে চোখে পানি আসে! পছন্দের দল খেলায় হারলে চোখে পানি আসে! তুমি প্রতিদিন আল্লাহর কতই না নেয়ামত পেলে অথচ একবারও তো তাঁর শুকরিয়া আদায় করলে না। প্রতিদিন না চাইতেই সামনে রিযিক্ব পাও, তারপরও মহান আল্লাহর কথা একবার ভাবলে না। কে তোমাকে সুস্থ রাখল? কে তোমার গুনাহগুলো গোপন করে সম্মান বাড়িয়ে দিল? কত নাফরমানি, কত পাপ করছ? নিজের পাপের কারণে চোখে একটুও পানি আসে না! একটু মন খারাপও হয় না?

তুমি আবার নিজেকে মুসলিম দাবি করছ? ভাবছ, মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছি, নামটা মুসলিমের, আমি একজন মুসলিম। মুসলিম কাকে বলে, এটাই তো তুমি জানো না। তুমি যা করছ তা সবই হারাম, গুনাহের কাজ।

খেলার জন্য কাঁদার নাম মুসলিম নয়। সিনেমা দেখে চোখে পানি আসার নাম মুসলিম নয়। নাটক দেখে চোখে পানি আসার নাম মুসলিম নয়। প্রেমিক/প্রেমিকার জন্য চোখে পানি আসার নাম মুসলিম নয়। মুসলিম মানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল a-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা। মুসলিম মানে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করা। মুসলিম মানে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা। মুসলিম মানে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সঁপে দেওয়া। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ﴾ ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো! আল্লাহ ব্যতীত এমন কোনো স্রষ্টা আছে কি, যিনি তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে রিযিক্ব দান করেন? তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। অতএব, তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ? (ফাত্বির, ৩৫/৩)

এখনো সময় আছে তওবা করে ফিরে এসো। মনে রেখো! আল্লাহর পাকড়াও বড়ই কঠিন। এমন সময়, এমন অবস্থায় পাকড়াও করবে তখন হাউমাউ করে কাঁদার শক্তিটুকুও শরীরে থাকবে না। আল্লাহ বলেন,﴿وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِى لَشَدِيدٌ﴾ ‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর’ (ইবরাহীম, ১৪/৭)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন। আমীন!

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

মো. হারুনুর রশিদ 

বিরল, দিনাজপুর।


[1]. তাফসীর ফী যিলালিল আম্মাপারা, পৃ. ৯৬।

[2]. তাফসীরে সাঈদী, আম্মাপারা, পৃ. ২০৭।

Magazine