সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নতি-অগ্রগতি সম্ভব নয়। এ শিক্ষা কার্যক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকের উপরই নির্ভর করে একটি জাতির সুষ্ঠু গঠন, সুন্দর বিকাশ ও উন্নতি-অবনতির পারদ। শিক্ষকের হাতে গড়া ছোট্ট শিশুটিই একদিন পরিণত হয় নামকরা অফিসার, খ্যাতিমান ডাক্তার, যশস্বী প্রকৌশলী, অকুতোভয় সেনানায়ক, চৌকস সমরনায়ক এবং বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়কে। মোটকথা, জ্ঞানগরিমা, সৃষ্টিশীলতা-সেবা, নেতৃত্ব-কর্তৃত্বে যারাই বিশ্বকে কিছু উপহার দেন তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে শিক্ষকের স্নেহস্পর্শে ধন্য। এজন্য শিক্ষককে বলা হয় জাতি গঠনের মহান কারিগর।
শিক্ষা আলোস্বরূপ। আর শিক্ষক হলেন আলোকবর্তিকা। এক প্রদীপ থেকে যেমন লক্ষ্য প্রদীপ জ্বালানো যায়, ঠিক তেমনি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে গোটা জাতিকে আলোকিত করা যায়। তিনি শিক্ষার্থীর দেহ-মনে যে আলো জ্বালিয়ে দেন ক্রমে সে আলোয় উদ্ভাসিত হয় প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি জনপদ। অনস্বীকার্য যে, এই পৃথিবীর বিনির্মাণ ও শ্রীবৃদ্ধি যাদের হাতে হয়েছে তারা সবাই ছিলেন শিক্ষক অথবা গুরু বা পণ্ডিত। তাদের আলোয়ই আলোকিত হয়েছে পুরো পৃথিবী।
পিতামাতার পরই শিক্ষকের স্থান। পিতামাতা সন্তানকে জন্ম দিয়ে শুধু লালনপালন করেন। আর শিক্ষক সেই সন্তানকে উত্তমরূপে নিয়মকানুন, আদবকায়দা, শিষ্টাচার, বিনয়, নম্রতা, নিয়মানুবর্তিতা, দয়া, সহানুভূতি ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এজন্য শিক্ষককে দ্বিতীয় পিতাও বলা হয়। পিতা যেমন সবসময় পুত্রের কল্যাণ কামনা করেন, তার সমূহ ক্ষতির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন থাকেন এবং তাকে কল্যাণের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেন, শিক্ষকও অনুরূপভাবে তার শিক্ষার্থীর কল্যাণ কামনা করেন এবং তাকে কল্যাণের পথ দেখান, তার ক্ষতির আশঙ্কায় সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকেন। তাই বলা হয় একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার। সন্তান তার পিতা থেকে যেমন সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীও তার শিক্ষক থেকে জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হয়। সন্তান যেমন পিতা থেকে প্রাপ্ত সম্পদের পরিচর্যা করে অনেক বড় সম্পদশালী হতে পারে, শিক্ষার্থীও তেমনি শিক্ষক থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে বড় জ্ঞানী হতে পারে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্পর্ক হলো আত্মার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়। শিক্ষার্থী যত বড়ই হোক না কেন চিরকাল সে তার শিক্ষকের প্রতি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বাধ্য। আবার একজন শিক্ষককেও অমরত্ব লাভ করতে হয় তার শিক্ষার্থীর মাঝে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এবং সকল সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। তাদের কেউ কাউকে অবহেলা, অনাদর কিংবা অশ্রদ্ধা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। পারস্পরিক স্নেহ, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার মাধ্যমেই এ সম্পর্ক অমরত্ব লাভ করে থাকে।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। নবী-রাসূলগণ আলাইহিমুস সালাম ছিলেন মানবজাতির মহান শিক্ষক। তাদের উত্তরাধিকার হিসেবে যারা শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত তারাও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বিবেচিত। দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাদের ইলমী সুধা পানে ধন্য হন। তাদের দিকনির্দেশনা মেনে স্বীয় জীবন, সন্তান, স্বজন, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আলোকের পথে, কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন। দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে যে কোনো প্রয়োজনে তাদের কাছেই ছুটে আসে সর্বাগ্রে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মাছের যেমন পতন শুরু হয় মাথা থেকে, ঠিক তেমনি জাতির অধঃপতন শুরু হয় জাতির নেতৃবৃন্দ তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, উল্কার গতিতে তা পুরো জাতিকে ধ্বংসের দিকে তাড়িত করছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে মানহীন শিক্ষকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরূপ শিক্ষকের হাতে অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সহকর্মী কেউই নিরাপদ নয়।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো অনেক শিক্ষকেরই নেই পর্যাপ্ত যোগ্যতা, উচ্চশিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য ও স্বীকৃতি। আবার, এই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েই কোমলমতি শিক্ষাথীরা বইবিমুখ হচ্ছে। পড়ার টেবিলের পরিবর্তে ক্লাব এবং পানশালায় ফুর্তি করছে। বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে রাস্তাঘাট এবং পার্কে আড্ডা দিচ্ছে। হিরোইজম দেখাতে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। কথিত বড়ভাইদের নির্দেশে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। দলীয় ক্যাডারদের খায়েশ পূরণ করতে নারী নিপীড়ন এবং ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে জড়িত হচ্ছে। বই-খাতা-কলমের পরিবর্তে তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে ক্ষুর, চাকুসহ নানা অত্যাধুনিক মরণাস্ত্র। এ জাতীয় সীমাহীন বেয়াদব এবং উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীকে বিদ্যমান বিধিনিষেধ এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা চড়াও হচ্ছে নিজের পিতৃতুল্য শিক্ষকের উপর। ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্য হয়ে কখনো নৈতিক শাসন করতে গিয়ে চুন থেকে পান খসলেই অভিভাবকগণ শিক্ষকমণ্ডলীর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে, নানাভাবে হয়রানি করার প্রয়াস পাচ্ছে। এ সুযোগে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা অযোগ্য ও অসৎ দায়িত্বশীল এবং শিক্ষকবিদ্বেষী ব্যক্তিরাও অভিভাবকের সাথে তাল মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককের বিরুদ্ধে যাচ্ছে-তাই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এর সাথে রাজনৈতিক বড়ভাই এবং বুড়ো গ্যাংস্টারদের হুমকি-ধমকি এবং নিরপেক্ষ মিডিয়ার হলুদ সংবাদ পরিবেশনের বিড়ম্বনা তো আছেই। পত্রিকার পাতা খুললেই এ রকম ভুরি ভুরি সংবাদ দৃষ্টিতে পড়ে। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই এবং আত্মসম্মান বাঁচাতে সৎ, যোগ্য, আদর্শবান এবং নীতিবান শিক্ষকরা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।
আবার, এরকম শত অপকর্মের সাথে জড়িত এবং অন্ধকারের চোরাবালিতে ডুবন্ত শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠন, তার শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পাওয়ানোর দায়িত্বও শিক্ষকদেরই। নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে পরীক্ষার হলে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের নকল করার সুযোগ দিতে হয়। যেনতেনভাবে খাতায় কিছু একটা আঁকানো বা লেখা থাকলেই তাদেরকে সর্বোচ্চ নম্বর দিতে হয়। এসবই করা হয় স্থানীয় মাস্তান, পাতিনেতা, পদস্থ অফিসার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তির নির্দেশে এবং ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ এর নামে। নীতি-নৈতিকতার কারণে যারা এসব কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হতে চান না, তাদেরকেও ছাড় দেওয়া হয় না; বরং প্রকারান্তরে চাকরির ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হয় এসব অপকর্মের সাক্ষী হতে। তাই সবকিছু দেখে, শুনে, জেনে বুঝেও একান্ত পেটের দায়ে অসহায়ের মতো দিন পার করছেন শিক্ষকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হবেন না বা স্বেচ্ছায় আসবেন না। ফলে জাতির পতন এবং সর্বনাশ অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষকরা অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের অনেকেই বেছে নেয় প্রাইভেট টিউশনির মতো অপমানকর কাজকে, কোচিং বাণিজ্যের মতো ঘৃণিত পেশাকে। অনেকেই বেছে নেয় ছোটখাটো ব্যবসাবাণিজ্যকে। আবার অনেকেই বেছে নেয় পাতিনেতা-নেত্রীদের পদলেহনকে। ফলে একজন মহান শিক্ষকের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না তার কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ, শ্রম, সাধনা, গবেষণা। ফলে শুধু শিক্ষার্থীরাই বঞ্চিত হচ্ছে না; বঞ্চিত হচ্ছে তার পরিবার, বঞ্চিত হচ্ছে গোটা দেশ ও জাতি।
শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা, নির্যাতন, লাঞ্ছনা, বঞ্চনার ফল ইতোমধ্যে জাতি পেতে শুরু করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন মনুষ্যত্বের পরিবর্তে পশুত্বের চর্চা বেড়েছে। ফলে সনদধারীর সংখ্যা বাড়লেও আলোকিত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ইভটিজিং, বুলিং, র্যাগিং, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা, শিক্ষার্থী নির্যাতন ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে মাদকে আসক্ত হচ্ছে। মাদকে তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হচ্ছে। অনেকেই মাদক বিক্রি এবং ছিনতাইয়ের সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হচ্ছে। ৭-৮ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা স্নাতক শেষ করতে পারছে না। এইচএসসি পাশের সনদ নিয়েই তাদেরকে বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে।[1] দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং কথিত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নেতারা ছিনতাইকালে হাতেনাতে ধরা পড়ছে।[2] ছাত্রনেতারা মাদক ও অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে বারবার পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে।[3] চুরির দায়ে কারাবাস করছে।[4] শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্র নেতারা বহিষ্কার হচ্ছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যায় থেকে।[5] এছাড়া শিক্ষকদের গা ছাড়া ভাবের কারণে বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতে সেশনজট প্রকট হচ্ছে। ঝড়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর জীবন থেকে মূল্যবান সময়।[6] নৈতিক শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ২০২২ সালে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যা গড় হিসাবে দাঁড়ায় প্রতি মাসে ৩৭ জন।[7] শিক্ষা বাণিজ্যে পরিণত হওয়ার ফলে অভিভাবকরা শিক্ষা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ছুটতে হচ্ছে প্রাইভেট টিউটর কিংবা কোচিং সেন্টারে এবং ঢালতে হচ্ছে প্রচুর অর্থ।[8] সরকারিতে যেখানে শিক্ষার্থীদের গড় মাসিক ব্যয় ৫০০ টাকা, সেখানে বেসরকারিতে গড়ে মাসিক খরচ ২২ হাজার টাকা।[9] আবার বিশাল অংকের টাকা খরচ করে কোনো মতে সনদ জোগাড় করলেও উচ্চ শিক্ষিতদের অর্ধাংশেরও বেশি বেকারই থাকছে। যারা চাকরি, ব্যবসা কিংবা জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তাদের মানসিক বৈকল্যতাও সীমাহীন। তাইতো একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান উপজেলা কার্যালয়ের অফিসে বসে মাদক সেবন করে।[10] একজন রাজনীতিবিদ দানশীল রাজনীতিবিদের আড়ালে ভয়ঙ্কর ডাকাত হয়।[11] মানুষের জীবন-মালের নিরাপত্তা দানকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ওসি প্রদীপের মতো ভয়ঙ্কর খুনির জন্ম হয়।[12] কাজি আনারকলির মতো মানুষেরা দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়।[13] জন্ম হয় ঐশীর মতো খুনি কুলাঙ্গার মেয়ের। দেশের সর্বোচ্চ আইন পরিষদের সদস্য হয়েও মোস্তাফিজরা প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে পত্রিকার হেড লাইন হয়।[14] এ যেন ইউনিভার্সিটি আব সাউথ আফ্রিকার প্রবেশদ্বারে লেখা সেই ঐতিহাসিক উক্তিরই বাস্তব রূপায়ন- ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত দালান-কোঠা ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি’। নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, আমরা সে দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষকের প্রতি অনাদর ও অবহেলার ফলস্বরূপ আমরা একটি বিকলাঙ্গ এবং মানসিক বিকারগ্রস্ত একটি জাতি পেতে যাচ্ছি, যাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক আচার, সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচার কিছুই নেই। এরা পড়তে বসে রাত ১০টার পর, আর ঘুমাতে যায় ভোর ৫টায়। এদের সকাল হয় দুপুর ১২টায়। কানে হেডফোন গোঁজা এ প্রজন্মকে পরিবার, দেশ, জাতি কোনো কিছুই খুব একটা টানে না। এভাবে অন্ধকার গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। একসময় তারা অন্ধকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে। একই সাথে হুমকির মুখে পড়বে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, এমন কিছু ব্যক্তি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় যুক্ত আছেন যারা প্রকৃত অর্থেই এ পেশার জন্য বেমানান এবং অযোগ্য। শিক্ষক হয়েও যারা ধূমপান, জুয়া, মাদক, ধর্ষণ, বলাৎকার, শিক্ষার্থী নির্যাতন, শিক্ষক নির্যাতন, একান্ত ব্যক্তিগত কাজে শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠানের সম্পদকে ব্যবহার, দুর্নীতি, দলবাজি, পক্ষপাতদুষ্টতা, শিক্ষাবাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস, অস্ত্রবাজির মতো ঘৃণিত কাজে জড়িত তারা অবশ্যই শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার।
এরপরও কিছু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আছেন, যারা স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্যকে ভুলে যাননি, ভুলে যাননি দেশ ও জাতির প্রতি নিজের দায়বদ্ধতাকে। তারা স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেননি। নিজেদের নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দেননি। তারা শিক্ষকতাকে পবিত্র আমানত হিসেবে গ্রহণ করছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (আলে ইমরান, ৩/১১০)। এরকম দায়িত্বশীল এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তি যুগে যুগে ছিলেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন, যদিও তাদের সংখ্যা অতি নগণ্যও হয়। যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘুণেধরা সমাজের নিকট অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত হলেও, শিক্ষার্থী নামধারী বখাটেদের নিকট অপ্রিয় হলেও, অপরিণামদর্শী ব্যর্থ অভিভাবকের নিকট চক্ষুশূল হলেও, আইন এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে অপরাধী হলেও এসব শিক্ষকরাই প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী এবং প্রকৃত সফলকাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকবে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে। সৎকাজের আদেশ করবে, আর অসৎকাজের নিষেধ করবে। আর এরাই মূলত সফলকাম’ (আলে ইমরান, ৩/১০৪)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের শিক্ষক সমাজকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মো. হাসিম আলী
সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।
[1]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২ এপ্রিল, ২০২৩।
[2]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।
[3]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২ আগস্ট, ২০২৩।
[4]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।
[5]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২২ আগস্ট, ২০২৩।
[6]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩।
[7]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩।
[8]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩।
[9]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩।
[10]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।
[11]. দৈনিক যুগান্তর, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।
[12]. দৈনিক যুগান্তর, ৩১ জানুয়ারি, ২০২২।
[13]. দৈনিক মানবজমিন, ৩ আগস্ট, ২০২২।
[14]. দৈনিক ইনকিলাব, ২৩ মে, ২০২৩।