ইমাম আবুল হাসান আশআরীর জীবনী
নাম ও বংশ: তার পুরো নাম আবুল হাসান আলী ইবনে ইসমাঈল ইবনে আবুল বাশার ইসহাক্ব ইবনে সালেম ইবনে ইসমাঈল ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বেলাল ইবনে আবূ বুরদাহ ইবনে আবূ মূসা আশআরী। তিনি বিখ্যাত ছাহাবী আবূ মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বংশধর ছিলেন। এ ছাহাবীর দিকে সম্পৃক্ত করে তাকে ‘আশআরী’ বলা হয়।
জন্ম: তার জন্মসাল নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। কারও মতে ২৬০ হিজরীতে, কারও মতে ২৬৬ হিজরীতে আবার কারও মতে ২৭০ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তবে প্রথম মতটি প্রাধান্যযোগ্য, যা অধিকাংশ জীবনী-লেখকগণ উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষকবৃন্দ: ইমাম আশআরী আহলুল হাদীছদের থেকে হাদীছ বর্ণনায় প্রসিদ্ধ ছিলেন না। তবে তিনি তার তাফসীরে কিছু বর্ণনা তার শিক্ষকদের থেকে বর্ণনা করেছেন। তার প্রসিদ্ধ কয়েকজন শিক্ষক হলেন—
১. আবূ আলী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব আল-জুব্বায়ী। আবুল হাসান আশআরী মু‘তাযিলা মত বর্জন করার পূর্বে মু‘তাযিলা অবস্থায় তিনি তার শিক্ষক ছিলেন।
২. যাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া আস-সাজী। তিনি বাছরার বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও মুফতী ছিলেন। তিনি ৩০৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম যাহাবী বলেন, ‘তার থেকে আবুল হাসান আশআরী আল্লাহর গুণাবলির ক্ষেত্রে সালাফদের আক্বীদা শিখেন এবং একাধিক গ্রন্থে আবুল হাসান আশআরী সেই আক্বীদার ওপর নির্ভর করেন’।[1] আবুল হাসান আশআরীর পিতা মারা যাওয়ার সময় তিনি তাকে আস-সাজীর কাছে যাওয়ার অছিয়ত করে যান।
৩. আবূ ইসহাক্ব আল-মারওয়াযী ইবরাহীম ইবনে আহমাদ আল-মারওয়াযী। আল-মারওয়াযী ছিলেন আবুল আব্বাস ইবনে সুরাইজের বিজ্ঞ ও ঘনিষ্ঠ ছাত্র। তার কাছে শাফেঈ মাযহাবের কর্তৃত্ব ছিল। তিনি ৩৪০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. আবুল আব্বাস ইবনে সুরাইজ আহমাদ ইবনে উমার ইবনে সুরাইজ। তিনি ৩০৩ হিজরীতে মারা যান। আবুল হাসান আশআরী তার কাছে ফিক্বহ শিখেন।
৫. আবূ বকর কাফফাল আশ-শাশী মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে ইসমাঈল। তিনি ৩৬০ হিজরীতে মারা যান।
৬. আবূ খালীফা আল-জুমাহী ফাযল ইবনে হুবাব। তিনি ৩০৫ হিজরীতে মারা যান।
৭. সাহল ইবনে নূহ।
৮. আব্দুর রহমান ইবনে খালাফ।
৯. মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকূব আল-মাকবূরী।
ছাত্রবৃন্দ: আবুল হাসান আশআরীর কাছে অনেকে ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তার পূর্বের আক্বীদা থেকে ফিরে আসার কারণে অনেক ছাত্র তার কাছে ভিড় জমায়। স্পষ্ট যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আক্বীদায় তার ছাত্র হন। তার প্রসিদ্ধ কয়েকজন ছাত্র নিম্নরূপ—
১. ইবনে মুজাহিদ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকূব আত-তায়ী আল-বাগদাদী। তিনি ৩৭০ হিজরীতে মারা যান। তার ছাত্র ছিলেন বাকিল্লানী।
২. আবুল হাসান আল-বাহেলী। তিনি ৩৭৫ হিজরীর দিকে মারা যান। তার ছাত্র ছিলেন আবূ ইসহাক্ব আল-ইসফিরায়ীনী, ইবনে ফুওরাক ও বাকিল্লানী।
৩. আবুল হাসান বুনদার ইবনে হুসাইন আশ-শীরাযী আছ-ছূফী। তিনি ছিলেন আবুল হাসান আশআরীর খাদেম। তিনি ৩৫৩ হিজরীতে মারা যান।
৪. আবুল হাসান আলী ইবনে মাহদী আত-তবারী। তিনি ৩৮০ হিজরীর দিকে মারা যান।
এ চারজন ছিলেন আবুল হাসান আশআরীর খাছ ছাত্র।
৫. আবূ বকর কাফফাল আশ-শাশী মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে ইসমাঈল। তিনি আবুল হাসান আশআরীর শিক্ষকও ছিলেন। তিনি ৩৬০ হিজরীতে মারা যান।
৬. ইবনে খাফীফ আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে খাফীফ আশ-শীরাযী। তিনি ৩৭১ হিজরীতে মারা যান।
৭. আবুল হাসান আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ আত-তবারী। তিনি সিরিয়াতে আবুল হাসান আশআরীর মাযহাব প্রচার করেন।
৮. আবূ সাহল আস-সা‘লুকী মুহাম্মাদ ইবনে সুলায়মান ইবনে মুহাম্মাদ। তিনি ৩৬৯ হিজরীতে মারা যান।
৯. আবূ যায়দ আল-মারওয়াযী মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। তিনি ৩৭১ হিজরীতে মারা যান।
মাযহাব: যে-সব ইমাম প্রসিদ্ধি লাভ করেন, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রত্যেক মাযহাবের অনুসারীগণ তাকে তাদের মাযহাবের দিকে সম্পৃক্ত করেন। এমনকি মাযহাবের ইমামদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে এবং তাদেরকে অন্য মাযহাবের স্তরে উল্লেখ করা হয়েছে। যারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব বা স্বাধীন মুজতাহিদ ছিলেন তাদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইমাম আবুল হাসান আশআরীর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। তার ফিক্বহী মাযহাব নির্ধারণ নিয়ে শাফেঈ, মালেকী ও হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ মতবিরোধ করেছেন। প্রত্যেক মাযহাবের অনুসারীগণ তাকে তাদের মাযহাবের অনুসারী হিসেবে গণ্য করেছেন।
যারা তাকে মালেকী দাবি করেছেন, তাদের অন্যতম হলেন— ক্বাযী ইয়ায,[2] ইবনু ফারহুন,[3] দাঊদী[4] ও আবূ আব্দুল্লাহ কুলায়ী।[5]
আর যারা তাকে হানাফী দাবি করেছেন, তাদের অন্যতম হলেন— মাসঊদী,[6] কুরাশী[7]।
তবে প্রাধান্যযোগ্য মত হলো, তিনি শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। অধিকাংশ আলেম এ মত প্রদান করেছেন।
গ্রন্থাবলি: আবুল হাসান আশআরীর অনেক গ্রন্থ রয়েছে। ইবনে হাযম বলেন, তার গ্রন্থের সংখ্যা ৫৫টি। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তার গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮০টি। তন্মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো—
১. মাকালাতুল ইসলামিয়ীন ওয়া ইখতিলাফুল মুছল্লীন। তিনি এ গ্রন্থে বিভিন্ন দল ও ফেরক্বা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
২. আল-লুমা ফির রদ্দি আলা আহলিয যাইগ ওয়াল বিদা। তিনি এ গ্রন্থে অনেক কালামী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং মু‘তাযিলাদের খণ্ডন করেছেন।
৩. আর-রিসালাতু ইলা আহলিছ ছাগ্র। সীমান্তবাসীরা তাকে হক্বপন্থিদের মাযহাব নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এ গ্রন্থে তার উত্তর দেন। তিনি এখানে দলীল গ্রহণের পদ্ধতি ও এক্ষেত্রে রাসূলগণের মানহাজ নিয়ে লম্বা আলোচনা করেন। এছাড়া তিনি আল্লাহর গুণাবলি, দর্শন, তাক্বদীর, নবুঅত, ঈমান, কাবীরা গুনাহগার, কবরের আযাব, পুলছিরাত, শাফাআত, ছাহাবী ইত্যাদি আক্বীদা বিষয়ে আলোচনা করেন।
৪. আল-ইবানাহ আন উছূলিদ দিয়ানাহ। আমাদের আলোচিত গ্রন্থ।
৫. রিসালাতু ইসতিহসানিল খাওয ফী ইলমিল কালাম। যারা মনে করেন ইলমুল কালাম ও নতুন পরিভাষার জ্ঞান চর্চা করা বিদআত, তাদের খণ্ডনে তিনি এ গ্রন্থ লিখেন।
৬. রিসালাতুন ফিল ঈমান।
৭. আল-উমাদ ফির রুইয়াহ।
৮. জাওয়াবাতু আহলি ফারিস।
৯. মুতাশাবিহুল কুরআন।
১০. আন-নাকযু আলা ইবনির রাওয়ান্দী।
১১. আদাবুল জাদাল।
১২. আল-মুখতাযান ফী তাফসীরিল কুরআন। বলা হয় এটি সত্তর খণ্ডে। ইবনুল আরবী কানুনুত তাবীলে (পৃ. ৪৫৬) উল্লেখ করেছেন এটি ৫০০ খণ্ডে।
তাঁর ব্যাপারে আলেমগণের প্রশংসা:
১. আবুল হাসান বাহেলী বলেন, আমার শায়খ আশআরীর তুলনা সমুদ্রের পানিফোটা।[8]
২. বাকিল্লানী বলেন, আমার সবচেয়ে উত্তম অবস্থা হলো, আমি আবুল হাসান আশআরীর কথা বুঝব।[9]
৩. আহমাদ ইবনে আলী বলেন, আমি আবুল হাসান আশআরীর কিছু বছর খেদমত করি। বাগদাদেও মৃত্যু পর্যন্ত তার সাথে ছিলাম। তার তুলনায় বেশি পরহেযগার আমি আমার চোখে দেখিনি।[10]
৪. সুবকী বলেন, তার সকল ভালো গুণ যদি উল্লেখ করা হয়, তাহলে পাতা শেষ হয়ে যাবে।[11]
৫. খাত্বীব বাগদাদী বলেন, আবুল হাসান আশআরী কালামপন্থি। তিনি মু‘তাযিলা, রাফেযী, জাহমিয়া, খারেজী ও সকল প্রকার বিদআতী-সহ মুলহিদদের খণ্ডনে গ্রন্থ ও কিতাব লেখক।[12]
৬. আবূ বকর ছাইরাফী বলেন, মু‘তাযিলারা তাদের মাথা উঁচু করে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আশআরীকে প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে শেয়ালের গর্তে প্রবেশ করান।[13]
৭. যাহাবী বলেন, আবুল হাসান আশআরী তীক্ষ্ণ মেধা ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তার ভালো গুণাবলি ছিল। অনেক গ্রন্থ ছিল, যা তার প্রশস্ত জ্ঞানের দাবি রাখে।[14] তিনি আরও বলেন, আমি আক্বীদা বিষয়ে আবুল হাসানের চারটি গ্রন্থ দেখেছি। তাতে তিনি আল্লাহর গুণাবলি বিষয়ে সালাফদের মাযহাবের মূলনীতিসমূহ উল্লেখ করেছেন।[15]
মৃত্যু: তার মৃত্যুর ব্যাপারে একাধিক মত পাওয়া যায়। আবূ বকর ওয়াযযান বলেন, তিনি ৩৩০ হিজরীর পর মৃত্যুবরণ করেন। তবে ইবনে আসাকির বলেন, এ মৃত্যু তারিখ ভুল।[16]
আরেক মতানুযায়ী ৩৩১ হিজরীতে মারা যান। ইবনুল জাওযীও এ মত দিয়েছেন। আরেক মতানুযায়ী তিনি ৩২৪ হিজরীতে মারা যান।
আবূ আলী যাহের ইবনে আহমাদ বলেন, আবুল হাসান আশআরীর মৃত্যুর সময় তার মাথা আমার কোলে ছিল। তিনি মৃত্যু সন্ধিক্ষণে কিছু বলছিলেন। আমি তার কাছে আমার কান নিয়ে গেলে শুনতে পাই, তিনি বলছিলেন, আল্লাহ মু‘তাযিলাদের ওপর লা‘নত করুন। তারা ধোঁকা দিয়েছে।[17]
ইমাম আবুল হাসান আশআরীর আক্বীদা
প্রথম স্তর:
আবুল হাসান আশআরী প্রাথমিক স্তরে জীবনের বড় একটি অংশ প্রায় ৪০ বছর মু‘তাযিলা আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। আবূ মুহাম্মাদ হাসান ইবনে মুহাম্মাদ আল-আসকারী বলেন, ‘আশআরী আবূ আলী জুব্বায়ীর ছাত্র ছিলেন। তার কাছে শিখতেন। ৪০ বছর পর্যন্ত তার থেকে বিচ্ছিন্ন হননি’।[18] এরপর আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়াত দেন।
তিনি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করেন নিম্নোক্ত কারণে:
১. স্বপ্ন: এ কাহিনী উল্লেখ করা হয় যে, তিনি রামাযান মাসে শুয়েছিলেন। তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, ‘আলী! আমার থেকে বর্ণিত মাযহাবকে সহযোগিতা করো। এটাই হক্ব’। এরপর তিনি জাগ্রত হলে এক বিস্ময়কর অবস্থার সম্মুখীন হন। তিনি উক্ত স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন। তিনি উক্ত স্বপ্ন দেখেন রামাযানের প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে আবার তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবার তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি যার আদেশ দিয়েছিলাম, সে ব্যাপারে তুমি কী করেছ?’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কীভাবে এমন এক মাযহাব বর্জন করতে পারি, যাকে আমি ৪০ বছর সহযোগিতা করেছি, তা নিয়ে গ্রন্থ লিখেছি এবং তাতে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছি?’ এ কথা শুনে তিনি চরমভাবে রেগে যান এবং বলেন, ‘অনুরূপ তৎকালীন যুগের লোকেরা আমার ব্যাপারে বলতো ওয়াসওয়াসার শিকার এবং পাগল। আমি মানুষের কথার কারণে আল্লাহর হক্ব নষ্ট করিনি’।[19]
২. তার শিক্ষক জুব্বায়ীর সাথে মুনাযারা: জুব্বায়ী ছিলেন ইমাম আবুল হাসান আশআরীর শিক্ষক। তার সাথে আশআরীর অনেকগুলো মুনাযারার কথা উল্লেখ করা হয়। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ একটি মুনাযারা হলো, আবুল হাসান তাকে তিন ভাই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন: এক ভাই ছিল মুমিন মুত্তাক্বী, দ্বিতীয় ভাই ছিল কাফের দুর্ভাগা আর তৃতীয় ভাই ছিল ছোট বাচ্চা। তারা তিন ভাই মারা যায়। তিন ভাইয়ের কী অবস্থা হবে? জুব্বায়ী বলেন, ‘প্রথম মুত্তাক্বী ভাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, দ্বিতীয় কাফের ভাই জাহান্নামে প্রবেশ করবে আর তৃতীয় বাচ্চা নিরাপদে থাকবে’।
আশআরী বলেন, ‘ছোট বাচ্চা ভাই যদি মুত্তাক্বী ভাইয়ের সাথে জান্নাতে থাকতে চায়, তাহলে কি তাকে অনুমতি দেওয়া হবে?’
জুব্বায়ী বলেন, ‘না, দেওয়া হবে না। তাকে বলা হবে, তোমার ভাই জান্নাতে পৌঁছেছে আল্লাহর অনেক আনুগত্য করার মাধ্যমে। আর তোমার সেই আনুগত্য নেই’।
আশআরী বলেন, ‘ছোট ভাই যদি বলে, এতে তো আমার কোনো ত্রুটি ও দোষ নেই। আপনি তো আমাকে জীবিত রাখেননি এবং আপনার আনুগত্য করার সক্ষমতা দেননি’।
জুব্বায়ী বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমি জানতাম যে, আমি যদি তোমাকে জীবিত রাখতাম, তাহলে তুমি নাফরমানী করতে এবং আযাবের হক্বদার হয়ে যেতে। কাজেই আমি তোমার কল্যাণের প্রতি যত্নবান ছিলাম’।
আশআরী বলেন, যদি কাফের ভাই বলে, ‘হে জগৎসমূহের ইলাহ! আপনি যেমন আমার ছোট ভাইয়ের অবস্থা জানতেন, তেমন আমার অবস্থাও জানতেন। তাহলে কেন আমাকে বাদ দিয়ে তার কল্যাণের প্রতি যত্নবান হয়েছেন?’
এ কথা শুনে জুব্বায়ী আশআরীকে বলেন, ‘তুমি পাগল’। ফলে আশআরী বলেন, ‘না, আমি পাগল নই, বরং শায়খের গাধা গিরিপথে আটকে গেছে’।[20] জুব্বায়ী লা-জওয়াব হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি মু‘তাযিলা মাযহাব বর্জন করেন।
৩. পেরেশানি ও দলীলসমূহ সমান মনে হওয়া: তিনি ১৫ দিন গায়েব থাকেন। এরপর জুম‘আ মসজিদে এসে মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মানুষ সকল! আমি এতদিন গায়েব ছিলাম। আমি চিন্তা-গবেষণা করে দেখলাম, সকল দলীল-আদিল্লা আমার কাছে সমান লাগে; কোনোটাই প্রাধান্যযোগ্য মনে হয়নি। আমার কাছে হক্ব বাতিলের ওপর প্রাধান্য পায়নি এবং বাতিল সকল হক্বের উপর প্রাধান্য পায়নি। এরপর আমি আল্লাহর কাছে হেদায়াত ভিক্ষা করি। ফলে আল্লাহ আমাকে হেদায়াত দিয়েছেন, যা আমি আমার কিতাবে লিখেছি। আমি আমার পূর্বের সকল আক্বীদা থেকে এমনভাবে বের হলাম, যেভাবে আমার ওপর থেকে এই পোশাক বের করছি। এরপর তিনি তার চাদর খুলে ফেলে দেন এবং যে কিতাব লিখেন তা মানুষকে দেন’।[21]
এছাড়া আরও বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়।
দ্বিতীয় স্তর:
ইমাম আশআরীর এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, তিনি প্রথমে মু‘তাযিলাদের অনুসারী ছিলেন, এরপর মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করেন। এই প্রথম স্তরের পর তিনি দুই স্তর গ্রহণ করেন, না-কি এক স্তর গ্রহণ করেন- তা নিয়ে আলেমগণের মাঝে মতবিরোধ আছে।
যারা বলেছেন তিনি এক স্তর গ্রহণ করেন, তাদের মাঝে আবার কয়েকটি মত রয়েছে—
(ক) একদল আলেমের মতে, তিনি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পর কুল্লাবিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন এবং এর ওপর পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করেন।
(খ) আবার আরেকদলের মতে, তিনি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পর আহলুস সুন্নাহ ওয়াস সালাফের মত গ্রহণ করেন এবং এর ওপর পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করেন।
(গ) অন্যদলের মতে, তিনি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পর মাঝামাঝি মত গ্রহণ করেন; যাকে ‘আশআরী’ মাযহাব বলা হয়।
আবার যারা বলেছেন তিনি দুই স্তর গ্রহণ করেন, তাদের মাঝে দুটি মত রয়েছে—
(ক) তিনি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পর সালাফদের মত গ্রহণ করেন এবং এরপর তিনি মাঝামাঝি মতবাদ গ্রহণ করেন।[22]
(খ) তিনি মু‘তাযিলা মতবাদ বর্জন করার পর কুল্লাবিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন এবং এরপর তিনি পরিপূর্ণভাবে আহলুস সুন্নাহর মত গ্রহণ করেন।[23]
তবে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া,[24] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম[25] ও ইমাম যাহাবী[26] বলেছেন, তিনি আহলুস সুন্নাহ মাযহাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেও কিছু ক্ষেত্রে কুল্লাবিয়া মতবাদের প্রভাব ছিল। আর এটাই প্রাধান্যযোগ্য মনে হয়। আল্লাহু আ‘লাম।
(চলবেইনশা-আল্লাহ)
আব্দুল্লাহ মাহমুদ
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
[1]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪/৯৮।
[2]. তারতীবুল মাদারিক, ৫/২৪।
[3]. আদ-দীবাজ, ২/৬৪।
[4]. তবাকাতুল মুফাসসিরীন, ১/৩৯৭।
[5]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১১৭।
[6]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১১৭-এর টীকা দ্রষ্টব্য।
[7]. আল-জাওয়াহিরুল মুযিয়া, ২/৫৪৫।
[8]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১২৫।
[9]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১২৬।
[10]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১৪১।
[11]. আত-তবাকাত লিস সুবকী, ৩/৩৫১।
[12]. তারীখু বাগদাদ, ১১/৩৪৬-৩৪৭।
[13]. তারীখু বাগদাদ, ১১/৩৪৭; তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ৯৪।
[14]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৫/৮৭।
[15]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৫/৮৬।
[16]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১৪৬।
[17]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১৪৮।
[18]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ৯১।
[19]. তারতীবুল মাদারিক, ৫/২৮-২৯।
[20]. ওয়াফাইয়াতুল আয়ান, ৪/২৬৭-২৬৮; তবাকাত, ৩/৩৫৬।
[21]. তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী, পৃ. ১১৩, ৪০, ৩৯; তবাকাত, ৩/৩৪৭।
[22]. এ মত যারা দিয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন যাহেদ কাওসারী (তাবয়ীনুকাযিবিলমুফতারী, ৩৯২টীকা), হামুদা গারাবা (আল-আশআরী, পৃ. ৬৭-৬৯), ড. ফাওকিয়া বিনতে হুসাইন (আল-ইবানাহ, পৃ. ৭৯-৮০)।
[23]. এই মত অনেকেই প্রদান করেছেন। যেমন ইবনে কাসীর (ইতহাফুসসাদাহ, ২/৪), মুহিব্বুল্লাহ খাত্বীব (আর-রওযুলবাসিম, পৃ. ১৭৪-এরটীকা দ্রষ্টব্য), আহমাদ ইবনে হাজার আবূ তামী (আল-আকাইদুসসালাফিয়্যাহ, ১/১৪৩), মুহাম্মাদ ছালেহ উছায়মীন (আল-কাওয়াঈদুলমুসলা, পৃ. ৮০-৮১)-সহ আরও অনেকেই।
[24]. মাওকিফু ইবনে তায়মিয়া মিনাল আশাইরাহ, ১/৩৯৬; দারউ তাআরুযিল আক্বল ওয়ান নাক্বল, ২/১৬; আল-ইসতিক্বামাহ, ১/২১২।
[25]. মাওকিফু ইবনে তায়মিয়া মিনাল আশাইরাহ, ১/৩৯৬; ইজতিমাউল জুয়ূশিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ১৮১।
[26]. কিতাবুল আরশ, পৃ. ২১৮; অনুবাদক কর্তৃক অনূদিত বাংলা।